Tripsee Treks  and Tours LLP
Blog and Travel with Us

সাইকেলে বিশ্ব ভ্রমণ



Sourav Biswas Sourav Biswas

সকাল সাতটায় মুঠোফোনটা হঠাৎ বেজে উঠলো। আজ রবিবার, রবিবার আমি একটু বেশি বেলা পর্যন্ত ঘুমাই। তাই মনটা একটু খিঁচড়ে উঠলো। ঘুম চোখেই ফোনটা হাতে নিয়ে দেখি বাবাই এর ফোন। বাবাই আমার অফিস কলিগ। আমার জুনিয়ার, কিন্তু আমার খুব ভক্ত। যেকোনো জায়গায় বেড়াতে গেলে বা ট্রেকিং এ গেলে ও আমার সঙ্গ নেবেই। মোটামুটি আমার ছায়াসঙ্গী বলা চলে। ফোনটা অন করে বললাম- "কিরে এত সাত সকালে ফোন"? বাবাই প্রচন্ড উত্তেজিত কণ্ঠে বলল -"সৌরভ দা তুমি বাড়ি আছো? একবার আজকে আমার বাড়িতে আসতে পারবে?" আমি বললাম -"কেন? কি ব্যাপার রে?" বাবাই বলল- "সৌরভ দা সেই ভদ্রলোক ফেরত এসেছে।" আমি মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝলাম না। তাই আবার জিজ্ঞাসা করলাম কে ফিরে এসেছে রে বাবাই? ও বলল -"সেই যে সোমনাথ মুখার্জী, আরে যার কথা তোমায় বলেছিলাম, আমাদের পাড়াতেই থাকতেন।"। এতক্ষণে ব্যাপারটা আমার কাছে ক্লিয়ার হল। সোমনাথ মুখার্জী, মানে সেই সোমনাথ মুখার্জী যিনি বহুদিন আগে সাইকেলে বিশ্ব ভ্রমণ করতে বেরিয়ে নিখোঁজ হয়েছিলেন, তিনি ফিরে এসেছেন। বাবাই কে বললাম আমি অবশ্যই যাবো। একজন বিশ্ব ভ্রমণ করে ফিরে এসেছেন তার অভিজ্ঞতার ভান্ডার আমাদের সামনে উজাড় করে দেবেন, এই সুযোগ কি মিস করা যায়?

        বিকাল থাকতে থাকতেই বাবাইদের বাড়ি পৌঁছে গেলাম। আমার আসার কিছুক্ষণ পরেই উনিও পৌঁছে গেলেন। বেশ লম্বা, মেদ-বর্জিত চেহারা, মাথার চুল পনিটেল করে বাঁধা। এসে আমাদের সবার সঙ্গে পরিচয় সেরে নিলেন। বেশ অমায়িক ব্যবহার। আমরা তাকে অনুরোধ করলাম একদম প্রথম থেকে ওনার বিশ্বভ্রমণের কাহিনী আমাদের শোনাতে। আমরা বলতে আমি, আর বাবাইদের বাড়ির কয়েকজন। যাই হোক এবার আমরা ওনার মুখ থেকেই শুনে নেব ওনার অভিজ্ঞতার কাহিনী…..

   আমার সাইকেল ভ্রমণের মূল উদ্দেশ্য ছিল মানুষের সঙ্গে মানুষের যে যোগাযোগ, ভালোবাসা, আদান-প্রদান সেটা বাড়ানো, তার প্রচার করা, এবং সেই সঙ্গে এক এক জায়গার যে এক এক রকম সংস্কৃতি সে সম্পর্কেও জানা বা অন্যদের জানানো। তবে এই সাইকেল ভ্রমণ শুরু করার আগে আমাকে অনেক প্রস্তুতি নিতে হয়েছিল। আর তার প্রস্তুতি হিসেবেই কখনো ব্যান্ডেল বা কখনো পুরি আমি সাইকেলেই ঘুরতে গিয়েছিলাম। এই সমস্ত কর্মকাণ্ডেই আমার সঙ্গী ছিলো লালটু আর বাবলু। বাবলু ছিল আমার প্রানের বন্ধু। ও সব সময় আমার সঙ্গে আমার পাশে থাকতো। ওর ভালো নাম প্রদীপ গোস্বামী। ঠিক ছিল ও এই বিশ্ব ভ্রমণে ও আমার সঙ্গী হবে। কিন্তু খুবই দুর্ভাগ্যের কথা যে সবকিছু শুরু হওয়ার আগেই ও সাঁতার কাটতে গিয়ে গঙ্গায় ডুবে মারা যায়। বিশ্ব ভ্রমণ শুরু করার আগে আমার শেষ প্রস্তুতি ছিল দিল্লি যাত্রা।সেখানে আমার সঙ্গী ছিল আমার পিসতুতো দাদা, কবোনদা। ঠিক ছিল আমি আর ও, এই দুইজন মিলে বিশ্বভ্রমণে বেরোবো। কিন্তু দিল্লি থেকে ফেরার সময়ই ও এই যাত্রা থেকে সরে আসে। হয়তো ও বুঝতে পেরেছিল এটা ওর জন্য বেশ শক্ত ব্যাপার, অনেক সময়ের ব্যাপার। যাই হোক শেষ পর্যন্ত আমার সঙ্গী হলো ঝুনুদা সেটা যাত্রা আর দুই মাস বাকি ছিল। আমার বাবা এইসব বিষয় আমাকে বেশ উৎসাহী ছিলেন। আমরা প্রস্তুতি নিতাম ভূগোলের এটলাস ম্যাপ দেখে।

          তখন ১৯৮২ সাল। একটা শুভ দিন দেখে আমরা দুজনে বেরিয়ে পড়লাম। বাড়ি থেকে সোজা কলকাতা রাজ ভবন। সেখান থেকে আমাদের বিদায় সংবর্ধনা দেওয়া হল। পারমিশনের কাগজপত্র, ফটোশুট, ইত্যাদি শেষ করে আমরা রওনা দিলাম দিল্লির উদ্দেশ্যে। রাস্তায় আমরা বিভিন্ন জায়গায় রাত্রি বাস করতাম কখনো স্কুলে, কখনো কোন ক্লাবে, বা কোন পূর্ব পরিচিত ব্যক্তির বাড়ি। প্রতিদিন প্রায় ৭০ থেকে ৮০ কিমি অতিক্রম করতাম আমরা। আমাদের কাছে ছিল পুলিশের থেকে দেওয়া একটা পরিচয় পত্র। যেখানেই যেতাম লোকাল থানায় গিয়ে সেটা দেখালে ওরাই রাত্রে থাকার একটা ব্যবস্থা করে দিত। ভারতবর্ষের বাইরে ও সেটা আমাদের খুব সাহায্য করেছিল। যাই হোক আমরা দিল্লি পৌঁছে গেলাম। তখনকার প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী, ভাগ্যক্রমে তার একটা অ্যাপোয়েন্টমেন্ট ও পেয়ে গেলাম। উনি বেশ আগ্রহ ভরে আমাদের উদ্দেশ্য, যাত্রাপথ ইত্যাদি সমস্ত কথা উৎসাহের সঙ্গে শুনলেন এবং আমাদের কোন সাহায্য লাগবে কিনা জানাতে বললেন। আমরা প্রণব মুখার্জির সঙ্গেও দেখা করেছিলাম তাকেও আমরা আমাদের বিশ্ব ভ্রমণের উদ্দেশ্য বিশদে ব্যাখ্যা করলাম। তদানীন্তন জাহাজ মন্ত্রী ছিলেন শ্রী সীতারাম কেশরী মহাশয়। উনি আমাদের একটা চিঠি করে দিলেন এই মর্মে যে ভারতবর্ষে বা ভারতবর্ষের বাইরে যদি কোন ভারতীয় জাহাজ আমরা পাই তবে তারা আমাদের সাহায্য করতে বাধ্য থাকবে। তবে জাহাজের আমাদের খুব একটা প্রয়োজন হয়নি। দিল্লি পর্ব শেষ করে আমরা রওনা দিলাম বোম্বাই এর উদ্দেশ্যে। পথমধ্যে রাজস্থান ও গুজরাট রাজ্যের তৎকালীন রাজ্যপাল-গণেরাও সংবর্ধনার মাধ্যমে আমাদেরকে আরো উৎসাহিত করলেন। অবশেষে আমরা বোম্বাই এসে পৌছালাম। সেখানে আমরা দেখা করলাম মিস্টার গিল এর সাথে, যিনি এয়ার ইন্ডিয়া বোম্বাই অফিসের একজন পদস্থ কর্মচারী। প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে উনার কাছে আগেই নির্দেশ এসেছিল। আমরা ওনার সহায়তায় সাইকেল গুলো খুলে প্যাকিং করে লাগেজে ভরে দিলাম। কারণ গোটা সাইকেল প্লেনে করে নিয়ে যাওয়া বেশ অসুবিধাজনক। মিস্টার গিলের তত্ত্বাবধানে এবং সহায়তায় আমরা কেনিয়া গামী একটা উড়োজাহাজে চেপে বসলাম যেটা আমাদের নিয়ে যাবে কেনিয়ার উদ্দেশ্যে আর সেখান থেকেই শুরু হবে আমাদের আসল বিশ্ব ভ্রমণ।

কেনিয়া হল ইস্ট আফ্রিকার একটা দেশ এবং এটা আফ্রিকা মহাদেশের প্রবেশদ্বার ও বটে। আমরা নাইরোবি পৌঁছে লোকাল অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ অফিসে যোগাযোগ করলাম। সেখানে তখন অনেক পাঞ্জাবি বসবাস করতেন। যেহেতু আমরা অতদুর থেকে এসেছি এবং তাদের দেশের লোক ও বটে তাই তারা আমাদের নিয়ে বেশ মাতামাতি করলেন আর আমাদের একটা ছোটখাটো সংবর্ধনা দিলেন। সেখানকার তৎকালীন যিনি ভারতীয় রাষ্ট্রদূত ছিলেন(এখন আর নাম মনে নেই) তিনি আমাদের বেশ সাহায্য করলেন তিনি এবং আমাদের যাত্রা শুরুর সি অফ করলেন। আমাদের আফ্রিকা মহাদেশের অভিযান শুরু হলো। রোড ম্যাপ, উগান্ডা- রওয়ান্ডা- বুরুন্ডি। পুরো রাস্তাটাই জঙ্গলের মধ্য দিয়ে। মাঝে মাঝে ছোট ছোট আদিবাসীদের গ্রাম। সেখানে রাত্রি বাস করা যেত, কখনো কখনো তাও পাওয়া যেত না তখন আমাদের ভরষা ছিল আমাদের সঙ্গের তাবু। ঝুনুদার কাছে এ ছিল একরকম স্বর্গ। কারণ ঝুনুদার ওয়াইল্ডলাইফ, জঙ্গল, সেখানকার আদিবাসী, এগুলোর প্রতি বেশ আগ্রহ ছিল আমার থেকেও ঢের বেশি। সে তো এই যাত্রা বেশ উপভোগ করতে লাগলো কিন্তু আমার ক্ষেত্রে বলা যায় একটু ভয় ভয়ই লাগছিল আমার। তবে অল্প কিছুদিনের মধ্যেই আমিও বেশ অভিজ্ঞতা সম্পন্ন আর এই জীবনের সঙ্গে অভিযোজিত ও হয়ে গেলাম। পরের দিকে আমার আর তেমন কোন অসুবিধা হত না | সেখান থেকে সবথেকে বড় যে শিক্ষা পেলাম এবং পরবর্তী জীবনে যা আমার কাজেও লেগেছিল তা হল- 'ভয় পেলে চলবে না'. যেকোনো জানোয়ারের সঙ্গে ভয় পেয়ে গেলেই সে যদি বুঝতে পারে যে আপনি ভয় পেয়ে গেছেন তাহলেই আপনাকে আক্রমণ করবে। যেকোন বন্যজন্তুর সামনে পড়লে দৌড়িয়ে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা আদৌ করতে নেই। যেমন যাচ্ছি সেই ভাবেই চলে যেতে হবে বা তার সামনাসামনি দাঁড়িয়ে পড়তে হবে, ওকে ইগনোর করতে হবে। তাকে বুঝতে দেওয়া চলবে না যে তুমি ভয় পেয়ে গেছ। কারণ সেও কিন্তু তোমাকে দেখে ভয় পাচ্ছে। যেকোনো বন্য জন্তু নতুন কিছু দেখলে, সে ভাবে ওই জিনিসটা হয়তো তাকে আক্রমণ করতে আসছে। যখন সে বুঝতে পারবে যে আপনার থেকে তার কোন ক্ষতির সম্ভাবনা নেই সে কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আপনাকে আক্রমণ করবে না (খাদ্য-খাদক সম্পর্ক বাদ দিয়ে)।

সবাই জানে যে আফ্রিকার রাজা হল সিংহ। বহুবার আমরা সিংহের দলের প্রায় কাছে গিয়ে পড়েছিলাম। কিন্তু উপস্থিত বুদ্ধি বলে বেরিয়ে আসতে পেরেছিলাম। আর বড় প্রাণীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো হাতি আর গন্ডার। এ প্রসঙ্গে একটা লোমহর্ষক ঘটনার কথা মনে পড়ছে। আমরা তো চলেছি ওয়ান্ডার জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে। সেদিন আমার সাইকেলে একটা অদ্ভুত, অস্বাভাবিক শব্দ হচ্ছিল। অনেকক্ষণ ধরেই সেটা আমার অস্বস্তির কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছিল। তাই ভাবলাম সাইকেলটা রেখে একটু দেখে নিই যদি কোন মেরামতের দরকার হয়। যেমন ভাবা…. সাইকেলটা দাঁড় করালাম। একটু জিরিয়ে নিয়ে সাইকেল ঠিক করে রওনা দেব। সামনে একটা মরা কাঠের গুড়ি দেখতে পেলাম। সেইখানে গিয়ে আমার অভ্যাস মত হাত দিয়ে ধুলো ঝেড়ে বসতে যাব, কিন্তু স্প্রিং এর মত পিছিয়ে আসলাম ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ের নির্দেশে। একটু দূর থেকে ভালো করে দেখে বুঝতে পারলাম সেটা হলো একটা বেশ বড় আর মোটা অজগর সাপ। বিরাট সাইজের কিছু একটা খেয়ে গোল পাকিয়ে মাথাটা কুণ্ডলী মধ্যে গুজে নিস্তেজ হয়ে পড়ে আছে দেখে বোঝার কোন উপায় নেই আমিতো সাইকেল নিয়ে চোঁচা দৌড় সেখান থেকে।অন্যান্য দিনের থেকে সাইকেলটা মনে হয় একটু বেশি জোরেই চালাচ্ছিলাম তারপর।

আমাদের আফ্রিকা ভ্রমণ থেকে যেমন আমরা আনন্দ পেয়েছি তেমনি ওই অভিযান থেকে আমরা আমাদের জীবনের অনেক শিক্ষাও গ্রহণ করেছি। জীবনের কোন কিছুই তুচ্ছ নয়, কাউকেই ছোট-বড় বা তুচ্ছ জ্ঞান করতে নেই। সবার থেকেই কিছু না কিছু শিক্ষা গ্রহণ করা যায়। এ প্রসঙ্গে বিশেষ করে উল্লেখ করতে হবে জঙ্গলের গহন অরণ্যে ছোট ছোট গ্রামে বাস করা সেই সব আদিবাসীদের কথা। যেমন সহজ সরল তাদের জীবনযাত্রা তেমনি অনাবিল আনন্দে ও পরিপূর্ণ। তাদের চাওয়া-পাওয়ার পরিসীমাও খুবই কম। তাদের সঙ্গে খাবার ভাগ করে খেয়েছি, তাদের অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেছি। আমাদের তারা তাদেরই একজন ভেবে আপন করে নিয়েছে। তখন কার গায়ের রং সাদা কার গায়ের রং কালো সে বিচার বিলীন হয়ে গেছে।

         মনে পড়ে কালাহারি মরুভূমি বেরোনোর কথা। কালাহারি মরুভূমিতে সাইকেল চালানো অসম্ভব। আমরা দুইজনে সাইকেল বালিতে ঠেলে ঠেলে নিয়ে যেতাম। সঙ্গে যা জল-খাবার ছিল তা একসময় নিঃশেষ হয়ে গেল। সঙ্গে না আছে জল না আছে খাবার। সেখানে থেমে যাওয়া মানে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে নেওয়া। আমরা সাতদিন প্রায় কিছু না খেয়েই সেই মরুভূমি আমরা অতিক্রম করতে পেরেছিলাম। কি করে ভুলবো সেই কথা যে, মরুভূমি পেরোনোর পরে যে গ্রামটিতে আমরা গিয়েছিলাম সেখানকার লোকেরা আমাদের জল-খাবার, সেবা শুশ্রুষা না দিলে আজ হয়তো এই গল্প শোনার মত পরিস্থিতি আমার থাকতো না।

ক্রমশ…...

সোমনাথ মুখার্জী এবং ওনার বোন রুবি মুখার্জী

Meet the Blogger

Sourav Biswas


Name- সৌরভ বিশ্বাস
Profession- চাকুরীজীবী
Mobile Number- ৭৪৩১২৭৪২৪২
City- শ্যামনগর
Hobbies-আদারে-বাদাড়ে ঘুরে বেড়ানো
Previous Tours- সিমলা, দিল্লি, চেন্নাই, নৈনিতাল, টংলু, সুন্দরবন, ঘাটশিলা, দার্জিলিং, অফিস ইত্যাদি



You may also like