“এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি,
সকল দেশের রানী সে যে আমার জন্মভূমি”
প্রথম পর্বে কল্পা দিয়ে শেষ করছিলাম,এই পর্বে সাংলা আর ছিটকুলের কথা বলব।ছিটকুলের সৌন্দর্য ভাষায় কি করে ব্যাখ্যা করব জানিনা,তাই দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের ভাষা ধার করতে হলো।ছিটকুলের কথায় পরে আসছি,আগে সাংলা থেকে শুরু করি।কল্পা থেকে একই রাস্তায় করছাম ড্যাম অবধি এসে আমরা সাংলার রাস্তা ধরলাম। করছাম ড্যাম থেকে সাংলার দূরত্ব ১৮.২ কিমি,সময় লাগা উচিৎ ৫০মিনিট,কিন্তু সাংলা ছিটকুল রোড বিশ্বের দূর্গম রাস্তাগুলির একটি হবার দরুণ সময় প্রায় দেড়-ঘণ্টা লেগে গেল।
এটিও খুব ছোট একটি পাহাড়ি জনপদ,খুব বড়ো কোন হোটেল নেই।আগের পর্বে বলেছি প্রচন্ড ঠান্ডার দরুণ আমরা কল্পায় তিনদিনের জায়গায় মাত্র একদিন ছিলাম এবং বাকি দুদিনে্য বুকিং ক্যানসেল করেছিলাম।সেই হিসাবে সাংলায় আমাদের কোন বুকিং ছিলনা,কারণ সাংলায় কিছুই দেখবার নেই।সুতরাং এখন যা পরিস্থিতি দাঁড়ালো তাতে সাংলায় আমাদের রাত্রিবাস করতেই হবে।
সাংলাতেও খুব ঠান্ডা কিন্তু কল্পার মতো কনকনে ভাব এখানে নেই,এত ঠান্ডার জন্য এখানে টুরিস্টও কম,তাই আমাদের ড্রাইভারের সহযোগিতায় বেশ ভালো হোটেলেই জায়গা পেলাম,দুঃখ শুধু একটাই,এখানেও তিনতলায় উঠতে হবে এবং এখানেও লিফট নেই।তবে ঘর দেখে তিনতলায় ওঠার ক্লান্তি ভুলে গেলাম।এখানেও ছাদের ঘর এবং হাত বাড়ালেই পাহাড়, তবে কল্পার মতো বরফে ঢাকা নয়।সাংলাতে ও জলের কষ্ট আছে তবে এখানে আমরা গিজার এবং গরমজল পাওয়াতে ওই বিকেল পাঁচটায় প্রায় দুদিন পর আকন্ঠ স্নান করলাম।সেইরাতে আর কোথাও যাবার ছিলনা তাই তাড়াতাড়ি ডিনার করে শুয়ে পড়লাম।
ছিটকুল যাবার রাস্তায় বরফ
“স্বর্গ যদি কোথাও থাকে তা এখানেই”-
ছিটকুল সম্পর্কে সবার আগে এই উক্তিটাই মনে আসে।ছিটকুল হল ভারত-তিব্বত সীমান্তের শেষ জনপদ।এর ৬০/৬৫কিমি পরই তিব্বত শুরু।ছিটকুল খুবই ছোট জনপদ।খুবই কম লোকের বসবাস।সাংলা থেকে ছিটকুলের দূরত্ব মাত্র ১২কিমি,কিন্তু ৩/৪ কিমি পর থেকেই রাস্তা খুবই খারাপ,উপরন্তু যেদিন আমরা ছিটকুল যাবো,সেদিন সকাল থেকেই মেঘলা আকাশ আর কনকনে হাওয়া।আমাদের ড্রাইভার সাহেবের কথা অনুযায়ী আমরা প্রাতরাশের পরই বেরিয়ে পড়লাম।ভাগ্য আমাদের সহায় বলতে হবে।কিছুদূর যাবার পরই মেঘ কেটে গেল এবং ঝলমলে রোদের দেখা মিলল।কিন্তু রাস্তা মোটেই ভালো নয়।মাত্র ১২ কিমি রাস্তা যেতেই আমাদের প্রায় দুঘন্টা লেগে গেল।৫/৬ কিলোমিটার যাবার পর রাস্তার পাশে অপূর্ব দৃশ্যপট শুরু হল।রাস্তার দুপাশে শুধু বরফ,মনে হচ্ছিল ঠিক যেন কোন হলিউড সিনেমার শ্যুটিং দেখছি।আরও কিছুদুর যেতে একটা চেকপোস্ট পড়ল।আমাদের সচিত্র পরিচয় পত্র এবং গাড়ির কাগজপত্র দেখানোর পর আমরা যাবার অনুমতি পেলাম এবং আমাদের বলে দেওয়া হল দিনের আলো থাকতে থাকতে যেন ফিরে আসি।তারপর যতই এগোতে লাগলাম প্রাকৃতিক দৃশ্যপট সুন্দর থেকে আরও সুন্দরতর হতে থাকল।
অবশেষে আমরা এসে পৌঁছালাম ছিটকুল,
ভারতবর্ষের শেষ সীমানা ।
চারদিকে শুধু বরফ আর বরফ।সত্যি বলতে কি এত বরফ বিদেশে ছাড়া আমি ভারতবর্ষে আর কোথাও দেখিনি।যেখানে গিয়ে ভারত সীমান্ত শেষ সেখানে আমাদের গাড়ীটা গিয়ে দাঁড়ালো।আমাদের গাড়িটা বাদ দিয়ে মাত্র ২টি গাড়ি ওখানে দাঁড়িয়ে ছিল।অর্থাৎ পর্যটক একেবারেই নেই।পরে শুনেছিলাম আর দুদিন পর ছিটকুল বন্ধ হয়ে যাবে,স্থানীয় মানুষেরা সব দোকানপত্র বন্ধ করে ঠান্ডার কারণে নীচের জনপদে নেমে যাবেন।
ছিটকুলে বেশ কিছু হোটেল এবং তাঁবু আছে,কিন্তু এত ঠান্ডার কারণে সবই বন্ধ।লোকজন খুবই কম।মাত্র একটাই দোকান খোলা ছিল।ছিটকুলে ৫০০বছর পুরনো একটা কাঠের ছোট মন্দির আছে,ঠান্ডার কারণে সেটি বন্ধ থাকার জন্য আমরা দেখতে পাইনি।কিন্তু অসাধারণ প্রাকৃতিক দৃশ্য আমাদের সব না দেখার দুঃখ ভুলিয়ে দিয়েছিল।সামনেই খোলা প্রান্তর,তার শেষ মাথায় বরফে ঢাকা পাহাড় এবং সেখানে নির্মেঘ আকাশ পাহাড়ে এসে মিশেছে।
এবং এই পাহাড় দেখে আমার বিভূতিভূষণের চাঁদের পাহাড়ের কথা মনে হয়েছিল।যতবার দেখি মন আর ভরে না।এদিকে যত বিকেল হচ্ছে তাপমান ততই কমছে।কনকনে হাওয়ার তেজ বাড়ছে,যে একটা মাত্র দোকান খোলা ছিল সেটাও ঝাঁপ ফেলার তোড়জোর করতে লাগল।
চারদিকে শুধু বরফ আর বরফ।
যে একটিমাত্র দোকান খোলা ছিল ঠান্ডা হাওয়ার থেকে বাঁচতে সেই দোকানের ছাউনিতে গিয়ে বসলাম।দোকানী কে তাঁবু এবং হোটেল কেন বন্ধ জিজ্ঞাসা করাতে শুনলাম এখানে যে পরিমাণ বরফ পড়ে তাতে জনপদের সাথে সব যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়,সেই কারণেই অতিরিক্ত ঠান্ডায় ছিটকুলে থাকার অনুমতি মেলেনা।গরমের সময় নদী সংলগ্ন তাঁবুগুলি তে রাত্রিবাসের বুকিং মেলে।তথ্য সংগ্রহের মাঝেই হাতে গরম কফির কাপ পৌঁছে দিলেন দোকানী এবং বললেন এবার উনি দোকান বন্ধ করবেন।কফি শেষ করে আমরা উঠলাম।তখনও দিনের আলো যথেষ্ট,কিন্তু দোকানী বললেন ওখানে অন্ধকার হঠাৎ করেই নামবে আর তাপমাত্রাও কমে যাবে,অগত্যা আমরা পার্কিং-এর দিকে গেলাম।গিয়ে দেখি অন্য গাড়ি দুটো ইতিমধ্যে নীচে নেমে গেছে।অগত্যা আমরাও নামতে শুরু করলাম।
কিন্তু আমাদের অবাক হওয়া তখনও অনেক বাকি,ছিটকুল আসার সময় খেয়াল করিনি কিন্তু ফেরার সময় আমাদের মনমরা ভাব লক্ষ্য করে আমাদের গাড়ির ড্রাইভার উপত্যকাটা ছাড়িয়ে মোটামুটি এক কি.মি পরে রাস্তার ধারে গাড়িটা দাঁড় করালেন।
তারপর দেখলাম সেই অপূর্ব দৃশ্য,আমাদের ঠিক ডান দিকেই নীচে একটি খরস্রোতা নদী,যার দুপাশে বরফ মাঝখানটা সরু খালের মতো জল আর তার ধার থেকে যে পাহাড়,সেটা পুরোটাই বরফে ঢাকা।পাহাড়ের ওইপাশ টা অন্ধকার নামছে,আমরা যেখানে দাঁড়িয়ে সেখানে তখনও যথেষ্ট দিনের আলো।তাতেই বরফে ঢাকা উপত্যকার অপরূপ রূপ দেখলাম।দেখে যেন মনের আশ আর মিটছে না,এবারে আমাদের ড্রাইভার তাড়া দিলেন,ঝুপ করে অন্ধকার নেমে এলে গাড়ি চালানো সমস্যা হবে।তবুও ওনাকে ধীরে গাড়ি চালাতে বলে প্রকৃতির রূপ দর্শন করতে করতে ছিটকুলকে বিদায় জানিয়ে সাংলার পথে ফিরতে লাগলাম।ছিটকুলের বরফে ঢাকা যে দৃশ্য দেখেছি তা আজীবন আমার মানসপটে খোদাই হয়ে থাকবে।
জরুরী তথ্য:-ছিটকুল যেতে গেলে সাংলায় রাত্রিবাস করাই ভালো।আর ছিটকুলের হোটেল বা তাঁবুতে থাকতে গেলে আগে বুকিং করে যাওয়া ভালো।ডিসেম্বর থেকে এপ্রিল অতিরিক্ত ঠান্ডা আর তুষারপাতের জন্য ছিটকুলের রাস্তা বন্ধ থাকে।উপযুক্ত গরম জামাকাপড় এবং ওষুধপত্র সঙ্গে রাখা বাধ্যতামূলক।বরফ দর্শন করতে চাইলে শীতকালেই যাওয়া শ্রেয়,অন্যসময় ঠান্ডা থাকলেও বরফ দেখা যাবেনা।
Name- Rupa Bhattacharya
City- Kolkata
Hobbies-Reading,writing,Travelling
Previous Tours- Himachal Pradesh (all), Assam, Kaziranga, shilong, Meghalaya, cherrapunji, chandipur, Darjiling,Gangtak,Dharamshala,Dalhousie, Macleodganj, Chandigarg, Amritsar,Hardwar, Kedarnath, Badrinath, Agra, Mathura, Vrindavan, Barsani, Mumbai, Mahabaleshwar, lonavala, panchgani, khandala, chennai, puducherry, Hydrabad, and so many places in India and abroad also like US, Malaysia, Singapore, Australia