শুক্রবার সন্ধ্যা বেলা অফিস সেরে যখন বাড়ি ঢুকলাম তখন রাত্রি ৯ টা প্রায়। ফ্রেশ হয়ে খাবারের টেবিলে বসতেই আমার স্ত্রী বললো, চলো কাল- পরশু কোথাও বেড়িয়ে আসি। সারাদিনের পরে ৫ ঘণ্টা জার্নি করে বাড়ী ফিরে আর নতুন করে কোন কিছু ভাবতেই ইচ্ছে করছিল না। একটা টেনে ঘুম দরকার। যাইহোক, আমি জিজ্ঞেস করলাম কোথায় যাবে ? আর, দুদিনের ঘোরার হলে থাকার ব্যাপারটাও আসছে সাথে। উত্তর টা বোধহয় তার তৈরির ছিল। বললো, বকখালি চলো। আমি বললাম, যাওয়া যেতেই পারে। কিন্তু কয়েকটা ব্যাপারে সমাধান করতে হবে আগে। এক, বাবা মা কে রাজি করাতে হবে যে আমরা আর 7-8 ঘন্টা পরেই ঘুরতে যাবো, আর তাদেরকেও সাথে যেতে হবে। দুই, ছেলের বয়স দুই। তার সমস্ত কিছু গুছিয়ে নিয়ে রেডি হতে হবে। তিন, ওখানে গিয়ে থাকার ব্যবস্থা করে নিতে হবে আজকেই, কারণ, সাথে আমাদের দুই বছরের ছেলে এবং বয়স্ক বাবা মা।
উওর বোধহয় রেডি ছিল তার মুখে। বললো হেনরী আইল্যান্ড WBSFDC র সুন্দরী কমপ্লেক্স এ দুটো নন এসি রুম ফাঁকা আছে। বুক করবো ? বললাম করে ফেল আগে। তারপর বাবা মাকে রাজি করাবো। এমনিতে দুই দিনের ট্রিপ এ খুব বেশি কিছু নিয়ে যাওয়ার থাকে না, কিন্তু ছেলের খাবার দাবারের ব্যবস্থাটুকু করে নিতে হয়।
যাওয়ার ব্যাপারে সেরকম চিন্তার কিছু ছিলোনা। শ্বশুরমশাই ব্যাঙ্গালোর ট্রিটমেন্ট এ যাবার সময় গাড়ীটি রেখে যাওয়ার সময় বলেই গিয়েছিলেন যেন আমরা তার সদব্যবহার করি। তাই খাবার টেবিলে ডিনার সারতে সারতে সবকিছু প্ল্যান কমপ্লিট। কমপ্লিট রুম বুকিং। কমপ্লিট বাবা মা কে মানানো। কমপ্লিট শ্বশুরমশাই কে জানানো যে আগামী কাল সকালে গাড়ীটির উপর কি পরিমান অত্যাচার হতে চলেছে। ব্যাগপত্র গুছিয়ে নিয়ে ঘড়িতে এলার্ম দিলাম, "সুন্দরী ডাকছে"।
আজ শনিবার। ভোর ভোর উঠে পড়েছি সবাই। কলকাতা পার করে ডায়মন্ডহারবার রোড যত তাড়াতাড়ি ধরতে পারবো, তত ভালো। যানজট এড়ানো যাবে। সেই মতো 6:30 মিনিট নাগাদ রওনা দিলাম। ইএম বাইপাস থেকে মা ব্রিজ ধরে পিজি হাসপাতাল ছাড়িয়ে নেমে চিড়িয়াখানা কে ডানহাতে রেখে এগিয়ে এসে রাস্তা হারিয়ে ফেলেছি। মাঝেরহাট এর ব্রিজ ভেঙে থাকার জন্যে এখানে রাস্তায় অনেকগুলো নো এন্ট্রি। অগত্যা গুগল এর সাহায্য নিতেই হবে। আর তাতেই বিপত্তি বাড়লো আবার। বেশ কয়েকটা চরকি পাক খেয়ে তারপর একজনকে জিজ্ঞাসা করে বেরোনোর পথ পেলাম। অনেকটা সময় নষ্ট করে ফেলেছি এখানেই। যাইহোক, তারপর থেকে কিছুটা নির্ঝঞ্ঝাটে বেহালা - জোকা পেরিয়ে এসে এবার ব্রেকফাস্ট করতেই হবে। যাইহোক 9 টা নাগাদ ব্রেকফাস্ট করার জন্য থামলাম রাস্তার পাশের একটা ছোট্ট দোকানে।
পেটাই পরোটা, মুড়ি ঘুঘনি, প্লেন পরোটা, ওমলেট, চা পাওয়া যাচ্ছিল দোকানে। ব্রেকফাস্ট সেরে আবার রওনা দিলাম। কিছুক্ষণ পরে সুন্দরী থেকে ম্যানেজারের ফোন। ফোনেই আমাদের আসার ব্যাপারে কনফার্ম করলাম আর সাথে দুপুরের খাবার অর্ডার দিয়ে দিলাম ।
অপরিচিত পথে লং ড্রাইভ এর অভিজ্ঞতা একেবারেই নেই । চেনা পথে একটানা অনেকটা রাস্তা গাড়ি চালানো হয়েছে যদিও, তাও গুগল ম্যাপে চোখ রেখে চলতে হচ্ছে । যে কারণেই ১৫০ কিলোমিটার রাস্তা হওয়া সত্ত্বেও বেশ কয়েক ঘন্টা লেগে যাবে বলেই মনে হচ্ছে । ব্রেকফাস্ট দেরি করে হয়েছে, সুতরাং পেটের মধ্যে এখনও কিছু রয়েছে । আর যেহেতু শুধু আমরা নিজেরাই রয়েছি, তাই তাড়াহুড়ো করার কোন বাধ্যবাধকতা নেই সেভাবে । দুপুরের খাবার অর্ডার দেওয়া হয়ে গেছে । আমরা চলেছি আমাদের নিজেদের ছন্দে । ডায়মন্ডহারবার কে বাইপাস করে আমরা আরো এগিয়ে চলেছে কাকদ্বীপ, নামখানা । নামখানার পরেই হাতানিয়া দোয়ানিয়া নদীর উপরে সুন্দর ব্রিজ হয়েছে এখন । বছরখানেক আগে পর্যন্ত নামখানা আসার পর জেটিতে লঞ্চে করে এই নদী পার হয়ে তারপর বকখালির দিকে রওনা হতে হতো । কিন্তু এখন সুদৃশ্য এই ব্রিজটি হয়ে যাওয়ার ফলে বকখালি যাওয়া
অনেক সহজ হয়ে গেছে । ব্রিজটি অনেক লম্বা এবং খুব সুন্দর ভাবে তৈরি করা । নামখানা পার করে এসে আমরা ব্রিজের উপর নামলাম । এখান থেকে নিচের নদীতে লঞ্চ চলাচল দেখতে ভারী সুন্দর
লাগে । একটু পর আমরা আবার রওনা দিলাম । ই রিক্সা, যেগুলো আমরা টোটো নামে বেশি চিনি, সেগুলো আজ দেশের প্রত্যন্ত এলাকাতেও ছড়িয়ে গেছে । এবং, এবং প্রচুর পরিমানে । নামখানা থেকে বকখালি যাওয়ার পথে রাস্তায় এরকম প্রচুর দেখা মিলল । আমাদের গন্তব্য হেনরি আইল্যান্ড ফিশারিজ প্রোজেক্টের সুন্দরী কমপ্লেক্সে । স্টেট ফিশারিজ ডেভলপমেন্ট কর্পোরেশন এর এখানে দুটি টুরিস্ট কম্প্লেক্স রয়েছে । ম্যানগ্রোভ আর সুন্দরী । বকখালি পৌঁছানোর কিছুটা আগেই বাঁদিকে সরু রাস্তা ধরে ৩-৪ কিলোমিটার মত হবে, প্রথমে ম্যানগ্রোভ কমপ্লেক্স । ম্যানগ্রোভ ছাড়িয়ে আরো কিলোমিটার খানেক এগিয়ে গেলে সুন্দরী কম্প্লেক্স । দুটোই খুব সুন্দর । কিন্তু অবস্থানগত দিক দিয়ে দেখলে সব থেকে সুন্দরী হল সুন্দরী কমপ্লেক্স । বেশ কিছুটা এগিয়ে থাকবে । আমরা পৌঁছে গেলাম সুন্দরী কমপ্লেক্স এ । সেখানে গিয়ে সমস্ত ফরমালিটিজ কমপ্লিট করে নিজেদের রুমে উঠলাম । খিদে পেয়েছে তাই খুব তাড়াতাড়ি চান করে নিয়ে আমরা খেতে গেলাম । অনেক রকম মাছের আইটেম পাওয়া যায় এখানে । যেহেতু স্টেট ফিশারিজ ডেভলপমেন্ট কর্পোরেশন এর অধীনস্থ এই টুরিস্ট কম্প্লেক্স তাই এখানকার বেশিরভাগ মাছ এখানের ফিশেরিজ প্রজেক্ট থেকে আসে বলেই মনে হলো । বাইরে খুব সুন্দর ফুরফুরে হাওয়া দিচ্ছিল । তাই রুমে না গিয়ে বেশ কিছুক্ষণ বাইরে বসে থাকলাম । অনেকক্ষণ ড্রাইভ করে আসতে হয়েছে বলে একটা ক্লান্তিও রয়েছে। একটু বিশ্রাম নিয়ে তারপর বেরোবো ঠিক করলাম । কিছুক্ষণ পর বেরোলাম হেনরি আইল্যান্ডের দিকে । সুন্দরী কম্প্লেক্স থেকে যাওয়ার জন্য সুন্দর একটি রাস্তা বানানো আছে ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট এর মধ্য দিয়ে । খানিকটা রাস্তা যাওয়ার পর একটা গাছের টানেল রয়েছে, যেটার মধ্য দিয়ে হেনরি আইল্যান্ডের বিচে পৌঁছাতে হয় ।
হেনরি আইল্যান্ডের ব্যাপারটা হলো সমুদ্রের মধ্যে একটা বালিয়াড়ির মত জায়গা, যেটা জোয়ারের সময় চারদিকে জল ভর্তি হয়ে গিয়ে একটি ছোট দ্বীপের মত হয়ে যায় । সমুদ্র শান্ত এখানে । তবুও সমুদ্রে নামা বারণ । কারণ এই দ্বীপের মধ্যে চলে গেলে তার চারপাশ জলে ভর্তি হয়ে গেলে সেখান থেকে ফিরে আসা মুশকিল হয়ে যাবে । তাই এখানে সতর্কবাণী দেওয়া রয়েছে । নির্জন নিরিবিলি সৈকতের পাশে একটি ওয়াচ টাওয়ার রয়েছে । যদিও সেটি কোন কারণে বন্ধ ছিল । অনেকটা সময় বিচে ঘুরে বেড়ালাম । আশপাশে দু'চারটে লাল কাঁকড়া দেখা মিলল । দূরে কয়েকটা পাখি উড়ে বেড়াচ্ছিল ।
ফিরে আসার সময় বুঝতে পারলাম যে রাস্তাটি বেশ গা ছমছমে । সন্ধ্যে হয়ে আসছে । বিচের মধ্যে আর কেউ ছিল না । তাই একটু তাড়াতাড়ি ফেরার সিদ্ধান্ত নিলাম । ম্যানগ্রোভ জঙ্গলের মধ্যে একটা যেতে অদ্ভুত ফিলিংস হচ্ছিল । ফিরে এলাম সুন্দরীতে । সন্ধ্যেটা খুব সুন্দর । কিন্তু মশার উপদ্রব রয়েছে, তাই নিচে বেশিক্ষণ বসে থাকতে পারলাম না । এদিকে খাবার খাওয়ার নির্দিষ্ট সময় রয়েছে । বিকেল বেলা চা আর ফিশ পকোড়া অর্ডার করেছিলাম । সেগুলো খেতে খেতে গল্প করতে করতে কিছুটা সময় অতিক্রান্ত হল । শহুরে কোলাহল থেকে দূরে প্রায় জনহীন জায়গায় অদ্ভুত শান্তি বিরাজ করে এখানে । মাছের জায়গায় এসেছি । তাই লাঞ্চ, ডিনার, বিকেলের টিফিন সবকিছুতেই মাছের ছড়াছড়ি । ভেটকি, পমফ্রেট, পার্শ্বে, কাতলা, চিংড়ি । অদ্ভুত সুস্বাদু লাগছিল । ডিনার সেরে নিলাম । ইচ্ছে ছিল নিচের বাঁধানো বেদিতে বসে কিছুক্ষণ সবাই মিলে আড্ডা দেওয়া । কিন্তু মশার তান্ডবে তা হলো না । তাই শুয়ে পড়াই মনস্থির করলাম । পরদিন ভোরবেলা উঠে একটু বিচে যাওয়ার ইচ্ছে আছে । বেশি রাত করে শুতে গেলে ভোরের সৌন্দর্যটা মিস করে যেতে পারি । গুড নাইট ।
ঘড়িতে এলার্ম দেওয়া ছিল । দেরী না করে উঠে পড়লাম ঘুম থেকে । চিকুকে ওঠাবো কিনা ভাবছিলাম । এদিকে নিবেদিতারও যাওয়ার খুব একটা ইচ্ছে নেই । তাই দুজনকে রেখে আমি একাই যেতে মনস্থির করলাম । সুন্দরী থেকে বেরিয়ে যে রাস্তাটা বিচের দিকে গেছে তার কথা তো আগের দিনই বলেছি, কিন্তু আজ এই কাকভোরে আমিই প্রথম, যে এই রাস্তা দিয়ে যেতে চলেছে বলে মনে হল । ম্যানগ্রোভ অরণ্যের মধ্যে একা যেতে ভয় করছিল । কিন্তু দেরি হলেও সানরাইজের সময় বিচের চিকচিকে বালুকণার মধ্যে সূর্যের রশ্মি পড়ে যে অদ্ভুত মায়াবী পরিবেশে জন্ম দেয় তা দেখা হতো না । তাই একটু মনে সাহস সঞ্চয় করে এগিয়ে গেলাম । কিছুক্ষন পরেই দেখলাম আরো একজনকে এগিয়ে আসতে । অসাধারণ লাগছিল পরিবেশটা । সমুদ্রের জলে সূর্যের আলো পড়ে সেটা হেনরি আইল্যান্ডের গাল ছুঁয়ে সামনে এসে যখন পড়ছে, ভাললাগায় ভরে উঠলো মন । হাতে ক্যামেরা থাকলেই যে সবসময় ছবি তুলতে ইচ্ছে করবে তা নয় কিন্তু । অনেক সময় চারপাশের সুন্দর দৃশ্য চোখে বন্দী করতেই বেশি ভালো লাগে । বেশ কিছুক্ষণ ঘুরে বেড়ালাম, এবার ফিরতে হবে । বেলা বাড়ার সাথে সাথে আরো কয়েকজন লোককে আসতে দেখলাম । ফিরে এলাম সুন্দরী তে ।
গতকালকে আসার সময় যেভাবে রাস্তাগুলিয়ে নাস্তানাবুদ হতে হয়েছে, তাই আজ মনের মধ্যে উৎকণ্ঠা রয়েছে । কারণ ফিরতে হবে আজকেই । আর তার আগে বকখালি যাওয়া বাকি আছে । সাথে যেহেতু চিকু রয়েছে তাই তার খাবার বানানোর একটা ব্যাপার থেকেই যায় । সকালবেলা সুন্দরী গেস্ট হাউস ম্যানেজারের সাথে কথা বলে চিকুর খাবারটার ব্যবস্থাপনা করার চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু সেভাবে তাদের কাছ থেকে co-operation পেলাম না সেভাবে । অথবা ভেবেছিলাম যদি এখান থেকে লাঞ্চটা সেরে বেরোনো যায়, সে ক্ষেত্রে যদি একটু তাড়াতাড়ি লাঞ্চের বন্দোবস্ত করা যায় । যাই হোক উনারা এক্ষেত্রে অপারগ বলে জানালেন । তাই আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম যে এখান থেকে সকাল সকাল গিয়ে বকখালিতে ব্রেকফাস্ট সেরে, বিচে ঘুরে আশপাশে জায়গাগুলো দেখে আবার সুন্দরী ফিরে এসে স্নান সেরে এখান থেকে রওনা হব । রাস্তায় ফেরার পথে লাঞ্চ করব । যেমনি ভাবা, তেমনি কাজ । আমরা চললাম বকখালির পথে ।
বকখালি জায়গাটা বেশ জমজমাট । একটু এগিয়ে আসতেই কয়েকটা উইন্ডমিল চোখে পড়ল । এখান থেকে বায়ু বিদ্যুৎ উৎপাদন হয় । কিন্তু দেখলাম উইন্ডমিল এর ব্লেড গুলো স্থির অবস্থায় । বেশ কিছুটা এগিয়ে এসে ঢুকতেই আশেপাশে দোকানগুলোতে গরম গরম লুচির গন্ধে পেটের খিদেটা নাড়া দিয়ে উঠলো । একটু এগিয়ে এসে এক জায়গায় গাড়ি থামিয়ে ব্রেকফাস্ট করলাম । একটা অদ্ভুত ব্যাপার লক্ষ্য করলাম যে, মানুষের মধ্যে একটা সহজাত প্রবৃত্তি আছে যেখানে সবাই ভিড় করে, বাকিরাও সেদিকেই যায় । বকখালি বাজারে থাকা লোকদের মধ্যে প্রায় সকলেই টুরিস্ট । তাই এখানে সেভাবে কারো জানার কথা নয় যে কোন দোকানে সুন্দর খাবার পাওয়া যায় আর কোন দোকানে সেভাবে ভালো খাবার পাওয়া যায় না । কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে দেখলাম যে দু তিনটে দোকানে প্রচুর ভিড়, আর বাকি দোকানগুলোতে ফাঁকা । যদিও কমবেশি সব দোকানেই একই ধরনের খাবার পাওয়া যায় । আমরা কোন ভিড়ের দোকানে না গিয়ে একটি ফাঁকা দোকানে ঢুকে সেখানে গিয়ে খাবার অর্ডার করতে একটু পরে দেখি দোকান ভর্তি হয়ে গেল । প্রথমে কেউ ছিলো না । আমরা পাঁচজন এসে বসার সাথে সাথে লোকজন আসতে শুরু করে । হয়তো আমরা এটাই বিশ্বাস করি যেখানে লোকজন রয়েছে সেখানে নিশ্চয়ই ভালো হবে, বাকি গুলো অতটা ভালো হবেনা । কিন্তু আমার তা মনে হল না । ব্রেকফাস্ট সেরে পাশের দোকানে চা । স্পেশাল চা বানিয়ে দিলেন । চা খেয়ে আমরা বিচের দিকে যেতে মনস্থির করলাম ।
বকখালি সমুদ্র সৈকতের একটা নিজস্ব ছন্দ আছে । রূপ আছে, একটা গন্ধ আছে । অনেকটা ফাঁকা সমতল একটা বিচ । সমুদ্রটা আরো অনেকটা দূরে । বিচ এবং সমুদ্রের জলের মাঝে একটা নিচু খাল মত জায়গা । ঠিক যেমনটা হেনরি আইল্যান্ড এ ছিল । কিন্তু এটা ততটা ও গভীর নয় । হাটুজল । সেটা পার করে সকলেই জলের দিকে যায় । ছাতার নিচে বসার জন্য চেয়ার ভাড়া পাওয়া যায় । সারি দিয়ে ডাব বিক্রি করে চলেছে । রয়েছে আরো নানান খাবার দাবার । একটা শান্তির বাতাবরণ এখানে রয়েছে । প্রথমে ভেবেছিলাম সমুদ্র দেখে চলে যাব, কিন্তু নিবেদিতার জোরাজুরিতে আমরা ঠিক করি যে সমুদ্রের কাছে যাব । বাবা যেতে রাজি হয়নি । তাই একটি ছাতার নিচে চেয়ার ভাড়া নিয়ে সমস্ত জিনিসের জিমেদারিত্ব দিয়ে আমরা তিনজন এবং চিকু জলের দিকে এগিয়ে গেলাম । মাথার উপরে সূর্য । তাই ভাবছিলাম যে ঠিক করছি না ভুল । কিন্তু হঠাৎ একটি দৃশ্যে চোখ পড়ে সমস্ত ভ্রান্তি কেটে গেল । লাল কাঁকড়া । সারা বিচ জুড়ে রয়েছে । হাজার হাজার । এর মধ্যে একটু ভয় পেলেই এদিক
থেকে ওদিক ছুটে বেড়াচ্ছে । অদ্ভুত দৃশ্য । মনে হচ্ছে ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক চ্যানেলে মাসাই মারা সেরেঙ্গেটি ফরেস্টের মধ্যে ওয়াইল্ডের বিস্টের মাইগ্রেশন দেখছি যেন । এবং এদিকে না এলে যে কি মিস করতাম তা বলার কথা নয় । অনেকক্ষণ ধরে দেখলাম । উপভোগ করলাম । সমুদ্রের মধ্যে চিকুকে নামাতে ইচ্ছে করছিল । তাই ওকে সমুদ্রের কাছে নিয়ে এলাম । প্রথমে ভয় পাচ্ছিল । তারপর তার খুব আনন্দ । হাত দিয়ে ঢেউকে ডাকতে লাগলো । বেশ কিছুটা সময় পার করে আমরা সেখান থেকে ফিরে এলাম জামাকাপড় জুতো যেখানে রাখা ছিল । ফিরে এসে ডাবের জল চুমুক দিতে দারুন লাগছিল । আমরা এবার ফিরে যাওয়ার ব্যাপারে মনস্থির করলাম । কিন্তু যেমনটা হয়ে থাকে, যেখানেই বিচ সেখানেই বিচে ঢোকার মুখে সারি দিয়ে দোকান । আর বাঙালির দোকান দেখলে থমকে যাওয়া । যাইহোক মনের শান্তির জন্য কিছু কেনাকাটা করা হলো । তারপর আমরা বিদায় জানালাম বকখালি কে ।বকখালি বিচ থেকে ফিরে এসে আবার চেক আউট করে সেখান থেকে বেরোলাম । এবার ফেরার পালা । আমাদের বেরোতে বেরোতে ১২:৩০ বেজে গেছে । রাস্তায় লাঞ্চ সারতে হবে । তারপর আবার সেই একই ভুলভুলাইয়া পার করে ফিরতে হবে বাড়িতে । যাইহোক আগের দিনের চেয়ে আছে রাস্তা অনেকটা ফাঁকা মনে হল । কিন্তু খাবার সেরকম কোন জায়গা পাওয়া যাচ্ছে না । লাঞ্চ করতে হবে । সময়টা পার হয়ে যাচ্ছে । খিদেও পাচ্ছে । আমরা হাতানিয়া দোয়ানিয়া নদীর ব্রিজ পার করে আবার নামখানা পার করে গেলাম । কিন্তু এই ভিড় বাজারের মাঝে কোথাও খাবার হোটেল দেখে দাঁড়ানোর উপায় নেই । নামখানা পার করে চলে এসেছি । একবার ভাবলাম যে কাকদ্বীপে গিয়ে কোন হোটেলে নিশ্চয়ই পাবো, কিন্তু সেভাবে কোনো হোটেল চোখে পড়ছে না । কিন্তু এবার খেতেই হত । কাকদ্বীপ বাজারে যা ভিড় দেখলাম, তাতে গাড়ি থামিয়ে সেখান থেকে নেমে গিয়ে খেয়ে আসা পর্যন্ত সময়টা গাড়ি রাস্তায় রাখা ঠিক হবে না । এতে যানজট সৃষ্টি হতে পারে । তাই কাকদ্বীপ পার করে একটু এগিয়ে আসার পর হঠাৎ চোখে পড়ে একটি হোটেল খোলা আছে । সাধারন হোটেল । দেখে ঠিকঠাক মনে হল । বসার মতো ব্যবস্থা এবং তার সাথে সামনে গাড়ি রাখা জায়গা থাকায় আমরা এখানে খাবার খাবো বলে নামলাম । ছিমছাম । খাওয়া-দাওয়া করছে অনেকে। আমরা বসতেই আলু ভাজা, ডাল, তরকারি, চিংড়ি মাছের তরকারি দিয়ে ভাত দিলেন। আমি প্রথমে একটু অবাক হয়ে গেলাম যে আমরা চিংড়ি মাছ অর্ডার করিনি, তা সত্ত্বেও চিংড়ি মাছ দিয়ে যেতে । যদিও তখন বললে তারা হয়তো চেঞ্জ করে নিতেন, কিন্তু আমরা কিছু বললাম না । আমরা বেশ তৃপ্তি করে খেলাম এবং খাওয়ার পরে যখন পেমেন্ট করতে গেলাম, এত সস্তায় এত সুস্বাদু খাবার সমসাময়িক সময়ে খেয়েছি বলে করে মনে পড়ছেনা । এক প্লেট চিংড়ি মাছের তরকারি দিয়ে ভাত মাত্র ৮০ টাকা । বেশ কয়েকটা করে চিংড়ি ছিল তাতে । বড় সাইজের । তবে কাকদ্বীপ হোস্টেল মোড়ের এই বাবা লোকনাথ হোটেল সপ্তাহে মাত্র দুদিন খোলা থাকে । রবিবার আর বুধবার । কারণ জিজ্ঞেস করলে মালিক বললেন যে এখানে সবদিন কাস্টমার পাওয়া যায় না । এই দুটো দিন এখানে লোকজন আসেন । সেজন্য আমরা শুধুমাত্র এই দুদিনে এখানে হোটেলে খোলা রাখি । পেট ভরে খাবার দাবার খেয়ে এখান থেকে রওনা দিলাম । ভাত খাওয়ার পর আমার ড্রাইভ করতে একটু কষ্ট হয় । তাই নিবেদিতাকে বললাম সতর্ক থাকতে । যাইহোক রাস্তায় সেরকম ট্রাফিক ছিল না । ড্রাইভ করতে খুব একটা অসুবিধা হচ্ছে না আজ । গল্প করতে করতে সময়টা বেশ কাটছে । সাড়ে চারটার দিকে একটু টায়ারড লাগছিল । তাই বেহালা ঢোকার কিছুটা আগেই রাস্তার পাশে গাড়ি থামিয়ে একটু চা খেয়ে নিলাম । আমি দু কাপ খেলাম । এরপর গুগল ম্যাপে ভরসা । যদিও ফেরার সময় খুব একটা অসুবিধা হলো না । এ যাত্রা গুগল ম্যাপ বাঁচিয়ে দিল । মা ফ্লাইওভার ধরে আস্তে আস্তে বাড়ির পথে ।
Name: Chandan Garai
Profession- Govt. Service
City- Ranibandh, Bankura / Kolkata
Hobbies- Photography, Travelling, Writting
Previous Tours- Kerala & Kanyakumari, Sandakphu, Sikkim, Spiti Valley, Sundarban, Dooars, Darjeeling, Kalimpong, Gopalpur – Chilika, Jungalmahal of Bankura, Purulia & Paschim Medinipur District etc.