কাঁধে ব্যাগ নিয়ে বেড়িয়ে পড়ার মজাই আলাদা l আর সেই মজা নিতেই ব্যাগ কাঁধে বেড়িয়ে পড়া l পাহাড়ে ব্যাগ কাঁধে নিয়ে বেশ কিছু জায়গা আমি ঘুরে বেড়িয়েছি, কিন্তু কোনো দিনই সমুদ্রের ধার দিয়ে হাঁটিনি l সমুদ্রের ধার দিয়ে ঘন্টা র পর ঘন্টা হাঁটতে কেমন লাগবে সেই ফিলিং নেওয়ার জন্য হঠাৎ করে বেরিয়ে পড়লাম চাঁদিপুর l
প্রথম দিন
========
হাওড়া থেকে একদিন চড়ে পড়লাম ভুবনেশ্বর জনশতাব্দী এক্সপ্রেসে, যেটা দুপুর ১:২৫ এ হাওড়া র ১৮ নম্বর প্লাটফর্ম থেকে ছাড়ে, আর বিকেল ৪:৪২ এ বালাসোরে নামিয়ে দেয় l ট্রেন জার্নি তে মোট ৩ তে স্টেশনে ট্রেনটা দাঁড়ায় l প্রথমটা খড়্গপুর, ৩:৩০ নাগাদ. খড়্গপুর স্টেশন এর মুখ্য আকর্ষণ আলুর দম l ট্রেনটা দাঁড়াতেই আমি আলুর দম এর খোঁজ শুরু করে দিলাম, আর পেয়েও গেলাম l
সেই আলুর দম আর জল খেয়ে ক্ষুধা দেবতা কে তুষ্ট করে দরজার ধারে দাঁড়িয়ে দেখতে থাকলাম দিগন্ত বিস্তৃত সবুজ মাঠ l ট্রেনটা বালাসোর আসার আগে ক্রস করলো দুটো নদী, একটার নাম পাঁচপাড়া নদী, আরও একটা বুড়িবালাম নদী l নদী দুটো যখন ক্রস করছিলো তখন আমারমাথায় এলো এই দুটো নদী আমাদের কাছে আবার দেখা দেবে যখন আমরা সমুদ্রের ধার দিয়ে যাবো l এই ভাবেই দেখতে দেখতে কখন ৪:৩০ বেজে গেলো বুঝতেই পারিনি l ট্রেন টা ঠিক সময়ে আমাদের পৌঁছে দিলো বালাসোর স্টেশন l
বালাসোর একটা ছোট্ট স্টেশন যার বাইরে বেরোতেই আমরা বেশ কিছু অটো দেখতে পেলাম l প্রথমে আমরা একটা চা এর দোকান দেখে একটু চা খেয়ে নিজেদের চার্জড করে নিলাম l চা এর দোকান এর ঠিক উল্টো দিকেই একটা ফুচকার দোকান দেখতে পেতেই আমার জিভ আমাকে বলতে থাকলো, ‘চল খাই’ l আর কি করবো, একপ্রকার বাধ্য হয়েই গেলাম ফুচকাওয়ালার কাছে l শুধুমাত্র জিভ কে শান্ত করবো বলে, কিন্তু ফুচকাওয়ালার কথা শুনে মনও শান্ত হয়ে গেলো. বলে কি ........... ১০ টাকাতে ৮ টা ফুচকা( যেখানে কলকাতা তে ১০ টাকা তে ৪ তে বা ৫ টা দেয় ) !!! যাই হোক জিভ ও পেট কে শান্ত করে বেরিয়ে পড়লাম অটোতে করে চাঁদিপুর এর উদ্দেশে l ২৫০ টাকা ভাড়া দিয়ে মিনিট ৪০ পর পৌঁছলাম চাঁদিপুর l যখন চাঁদিপুর পৌঁছলাম তখন সূর্যি মামা আমাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়েছে l
চাঁদিপুর পৌঁছে একটু ফ্রেশ হয়ে আমরা বেরিয়ে পড়লাম সমুদ্র দেখতে। আমাদের হোটেল থেকে মিনিট ১০ হাঁটলেই সমুদ্র l কিন্তু সমুদ্রের কাছে গিয়ে একটু হতাশ হলাম l তখন ভাটা চলছিল, তাই সমুদ্র ৪কিমি পিছিয়ে গেছিলো, সুতরাং জল দেখা তো দূরঅস্ত, আওয়াজ পর্যন্ত পাইনি l যাই হোক আমরা একটু উদর দেবতার উদ্দেশে মুড়ি আর তেলেভাজা অর্পণ করে ৮টা নাগাদ ফিরে এলাম হোটেল এর রুম এ l পরের দিন যাত্রা শুরু l কিন্তু গল্পের ইচ্ছে তো আর সেসব শোনে না, রুম এ ঢুকেই শুরু হয়ে গেলো আড্ডা l নিখাদ আড্ডার মাঝে বিরতি স্বরূপ এলো ডিনার টাইম l ডিম্ এর ঝোল, আলু ভাজা আর ভাত দিয়ে ডিনার সেরে আমরা রুম এ ফিরে এলাম l পরের দিন যাত্রা শুরু করবো l ঠিক হলো সকাল ৬ টায়. ব্যাগ পত্র গুছিয়ে শুয়ে পড়লাম l
দ্বিতীয় দিন
=========
ভোর ৫:৩০ এ ঘুম ভাঙলো এলাম এর আওয়াজে lকাল ভেবেছিলাম একটু স্নান করে বেরোবো, কিন্তু ঠান্ডা জল সেই ভাবনাতে জল ঢেলে দিলো lফ্রেশ হয়ে ৬ টা নাগাদ রেডি হয়ে একটু এদিক ওদিক ঘুরতে থাকলাম lঅ্যারাউন্ড ৬:৩০ আমরা রওনা দিলাম সমুদ্রের ধার ধরে l তবে ঠান্ডা টা যতটা হবে ভেবেছিলাম তার থেকে বেশ বেশি l হয়তো একটু underestimate করে ফেলেছিলাম. সমুদ্র একটু দূর এ. জল টা দূরে দেখা যাচ্ছে, আরও হালকা একটা আওয়াজ আসছে l হাঁটার সময় ঠান্ডা হাওয়াটা মুখে এসে লাগছিলো, সঙ্গে সমুদ্রের আওয়াজ একটা অদ্ভুত মাদকতা সৃষ্টি করছিলো l ঘন্টা খানেক হেঁটে আমরা পৌঁছে গেলাম বুড়িবালাম নদীর ধারে l
এই সেই জায়গা যেখানে যতীন্দ্র নাথ মুখোপাধ্যায় ( বাঘা যতীন) ইংরেজদের সাথে লড়াই করেছিল l জায়গাটা অদ্ভুত. আমার পিছনে যতদূর দেখা যায় হলুদ বালির বিচ, সামনে বুড়িবালাম নদী এসে মিশেছে সমুদ্রে, আরও নদীর অন্য পাড়টা দেখা যাচ্ছে l আবার এগিয়ে গেছে সামনের দিকে l আমি খেয়াল করলাম খালি চারটে রং দেখতে পাচ্ছি, গাঢ় নীল আকাশ, হলদেটে বিচ, নীল সমুদ্র আর নদীর মোহনা,আর সবুজ ঝাউ এর বন l আমি একটু তাড়াতাড়ি পৌঁছে গেছিলাম, তখন আমার বাকি বন্ধুরা আসেনি l আমি ওই দিগন্তর দিকে চেয়ে বসে থাকলাম কিছুক্ষন. কয়েকজন ছেলে নদীর ধারে মাছ ধরছিল, ওদের জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম আমরা যদি নদীর পার ধরে সমুদ্রের বিপরীত এ হাটতে থাকি তাহলে বলরাম ঘাঁটি পাবো l ওখান থেকে নৌকো পাওয়া যায় যেটা আমাদের বুড়িবালাম নদী ক্রস করিয়ে দেবে l সুতরাং হাটতে থাকলাম বলরাম ঘাঁটি র উদ্দেশ্যে l
৮:৩০ নাগাদ আমরা এসে পৌঁছলাম বলরাম ঘাঁটি l এখানে এসে দেখলাম এটা একটা ছোট্ট মাছের আড়ৎ l সঙ্গে কিছু খাওয়ার দোকানও পেয়ে গেলাম, আর খাওয়ার দোকান দেখেই পেট বাবাজি লাফালাফি শুরু করে দিলো l ওকে শান্ত করতে আমরা ঢুকে পড়লাম একটা মিষ্টি র দোকানে l লুচি আর আলুর তরকারি দিয়ে ব্রেকফাস্ট টা মন্দ হলো না l একটা রসগোল্লা দিয়ে সমাপ্তি টেনে আমরা গেলাম নদীর ধা্রে l নৌকা পেলাম বটে, কিন্তু সে এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা l এখানে কোনো ঘাট নেই. সুতরাং আমাদের জুতো মোজা খুলে সিঁড়ি দিয়ে নৌকায় উঠতে হবে l সিঁড়ি মানে নৌকো র গায়ে ঝোলানো একটা স্কুটার এর চাকা l যেটা শরীর ওজনে এপাশ ওপাশ করছে l কোনোক্রমে নৌকোতে ওঠার পর দেখলাম আমাদের সঙ্গী হতে চলেছে ২ টো স্প্লেন্ডার bike l নৌকো যাত্রাটা মন্দ নয় l আমরা নৌকো করে চলেছি ,অন্য পাড়ে উড়ে চলেছে বেশ কিছু গাংচিল l যাই হোক ১০টাকা মাথাপিছু দিয়ে আমরা নদী ক্রস করে নামলাম যোশীপুর ঘাটে l এবার পা ধুয়ে জুতো পরে আবার আমরা এগোতে থাকলাম সমুদ্রের দিকে l একটু গ্রাম এর মধ্যে দিয়ে হাঁটা l রাস্তা তে দেখতে পেলাম ফিঙে আর মাছরাঙা নিজেদের মতো খাবার খুঁজে চলেছে l রাস্তার ধারে একটা ছোট্ট পুকুরে পারে দেখলাম প্রচুর ধ্যানমগ্ন বক l একটা ছোট্ট জেলেদের গ্রাম পার করে আমরা নেমে পড়লাম সমুদ্রের পারে lবুড়িবালাম এর ওপড়ে সমুদ্র অনেকটা দূরে ছিল l কিন্তু বুড়িবালাম ক্রস করে যখন আবার এপারের সমুদ্রের পাশে এলাম, দেখলাম সমুদ্র একদম আমাদের ঘাড়ে নিঃস্বাস ফেলছে l
কিছুক্ষন হাঁটার পর দেখলাম সূর্যি মামা হলদেটে চোখ বার করে আমাদের কাছ থেকে জল শোষণ করছে l সুতরাং আমরা সূর্যি মামা কে ভেংচি কেটে ঢুকে পড়লাম ঝাউ এর জঙ্গলে l ট্রেক করতে এলে আমার ভগবান বিশ্বাসটা বেড়ে যায় l কি অদ্ভুত ভাবে প্রত্যেকটা ঝাউ গাছ লাগানো l সারি দিয়ে ভগবান খুব যত্ন করে ঝাউ গাছ গুলো লাগিয়েছেন lদুটো গাছ এর মাঝ এর ছাড়টাও একদম পারফেক্ট l সারি দিয়ে লাগানো ঝাউ বনের মধ্যে দিয়ে হাটতে হাটতে কখন আমরা কিমি ৮ পেরিয়ে এসেছি বুঝতে পারিনি l একটা সময় পর দেখলাম ঝাউ এর বনটা হঠাৎ করে খুব ঘন হয়ে গেলো l আর হাঁটার জায়গা না পেয়ে বাধহয় হয়ে আমরা বেরিয়ে এলাম সমুদ্রের পাড়ে l সুজ্জি মামা তো হেব্বি খুশি l নিজের তেজ আরও একটু বাড়িয়ে নিয়ে আমাদের দেখছে আরও শোষণ করছে l
কি আরও করা যাবে, আমরা জল দেবতা কে স্মরণ করতে করতে এগিয়ে চললাম l একটু দূরে গিয়ে দেখলাম আবার একটা নদী এবার আমরা একটু আস্বস্ত হলাম l যাক আবার নদী পেরোনো, সুতরাং কিছুক্ষন রেস্ট l
কিছু লোক মাছ ধরছিল মোহনাতে, ওদের জিজ্ঞেস করে জানলাম আমাদের নদীর ধার ধরে একটু ভেতরে গেলে একটা মাছের আড়ৎ পাবো l সেখানে ভাতের হোটেলও আছে l জায়গাটার নাম বাহাবালপুর lসুতরাং নদীর ধার ধরে চললাম বাহাবালপুর এর উদ্দেশ্যে, আর বজ্জাত সূর্যি মামা আমাদের শোষণ করতে থাকলো l প্রায় ১১ টায় পৌঁছলাম বাহাবালপুর l একটা ভাত এর হোটেল সামনেই ছিল l ঢুকে পড়লাম তাতে l মাছ ভাত ৯০ টাকা l বাঁশপাতা মাছ, ভাত, সাথে ফুলকপির সবজি, আচার l ভরপেট খেয়ে আমরা ১২টা নাগাদ ঘাটে পৌঁছে দেখলাম নৌকো ১:৩০ এ l সুতরাং আমাদের কাছে প্রচুর সময় l দেবাংশু বললো ‘দাদা পান খাবে?’ আমি পান খাই না, তাও আবার সাদা পান ! বললাম ‘চলো try করে দেখি’. পান এর দোকানে বললো ১০ টাকায় ৬ টা l আমরা বার তিনেক জিজ্ঞেস করে কন্ফার্ম হলাম যে সত্যি লোকটা ১০ টাকায় ৬ টা পান দেবে l পান খেতে খেতে আমি একটু আড়ৎটা ঘুরতে গেলাম l আমরা দুপুরে গেছিলাম বলে আড়ৎ ফাঁকা lহরেক রকমের মাছ এদিক ওদিক পড়ে আছে আর আছে পচা মেছো গন্ধ l আমার নাক আমাকে বললো ‘বেশি এখানে ঘুরলে পেটকে বলে দেব সব যেন বার করে দেয়’ l নাক এ চাপা দিয়ে বেরিয়ে এলাম আড়ৎ থেকে l বেরিয়ে দেখি বাকিরা একটা চালার নিচে বসে আছে l ওদের সাথে বসে আড্ডা দিতে দিতে ১:১৫ বাজিয়ে দিলাম l এবার নৌকোতে ওঠার পালা l
যেহেতু আমরা এক্সপেরিয়েন্সড তাই এবার আর অসুবিধে হলো না নৌকোতে উঠতে l সোজা জুতো মোজা খুলে উঠে পড়লাম নৌকোতে l বারদিয়া নদী পেরিয়ে আমরা নৌকো নিয়ে ঢুকে পড়লাম ডুবডুবি নদীতে l এই নদীর পাড়ে ঘাটে এসে নৌকো থামলো l ঘাটের নাম কোশাফল ঘাট lএই ঘাটে নেমে আমরা চললাম কোশাফল গ্রামে l এই গ্রামের একটা সাইক্লোন শেল্টারে আমরা আজ রাত কাটাবো l গ্রামের মধ্যে দিয়ে প্রায় ২.৫ কিমি যাওয়ার পর পেলাম কোশাফল গ্রাম l সাইক্লোন শেল্টারে একটা ডিপ টিউবওয়েল দেখে আরও নিজেকে সামলাতে পারলাম না l বালতি নিয়ে নেমে পড়লাম স্নান করতে l ভালো করে স্নান করে বুঝতে পারলাম পেটটাও বিদ্রোহ করছে l সুতরাং আমরা প্ল্যান করলাম ভালো করে মুড়ি মেখে খাওয়া হবে l কোশাফল গ্রামটা বেশ বড় গ্রাম l বড় বাজার আছে একটা l সেখান থেকে চপ, মুড়ি, চানাচুর, ছোলা, পেঁয়াজ শশা কিনে আনা হলো l বাজার করতে গিয়ে দেখলাম ফুচকা বিক্রি হচ্ছে l আবার নিজেকে সামলাতে না পেরে দাঁড়িয়ে পড়লাম ফুচকা খেতে l এবার আবার আমার অবাক হওয়ার পালা l
এ ব্যাটা বলে ১০ টাকায় ১০ টা, আবার ২ টো শুকনো ফুচকা ফ্রি l আমি আল্লাদে আটখানা হয়ে ভদ্রলোককে একটু ব্যবসা করার সুযোগ দিলাম l তার পর একটু ১০ টাকা র চূড়মুড় কিনলাম মুড়ি তে মাখবো বলে l ঘরে এসে ভালো করে মুড়ি মেখে খাওয়াদাওয়া হলো l এরপর আমরা একটা বাড়িতে খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা করলাম l বললো আমাদের ডালমা তরকারি সহযোগে ভাত খাওয়াবে l আমরা খাওয়ার ব্যবস্থা করে চলে এলাম আড্ডা মারতে আমাদের ঘরে l এই দিন আমাদের ভাগ্যটা একটু বেশি ভালো ছিল l ওই ঠান্ডাতে আমাদের ভাগ্যে জুটলো একটা শতরঞ্চি নিচে পাতার জন্য l সাইক্লোন শেল্টার এর ম্যানেজার এসেছিলো আমাদেরকে শতরঞ্চি দিতে আর টাকা নিতে. সাইক্লোন সেন্টার এর ভাড়া নিলো ঘর পিছু ২০০ টাকা l সে আমাদের বললো গ্রামের মধ্যে দিয়ে হেঁটে গেলে আমাদের নদী ক্রস করতে হবে না l একটা ব্রিজ হয়েছে l সেটা পেরিয়ে আমরা আবার সমুদ্রের ধারে চলে যেতে পারবো l যাই হোক আমরা একটু আড্ডা মেরে ৯টা নাগাদ গেলাম খেতে l খেতে গিয়ে দেখলাম ভাত এর সাথে যে ডালমা টা দিয়েছে তাই দিয়েই পুরো ভাত খাওয়া যায়, সঙ্গে ফুলকপির তরকারি, আলু মাখা, আর শেষ পাতে চাটনি l খেয়ে মন ভরে গেলো lদেবাংশু বললো চলো দাদা ছাদ এ যাই l আজ অমাবস্যা l ছাদ এ গিয়ে দেখলাম তারাদের মেলা বসেছে l সেই মেলা দেখতে দেখতে একটু আড্ডা দিয়ে আমরা চলে এলাম নিচে l আজ ক্লান্তিটাও ছিল l তাই ঘুম আসতেও দেরি হলো না l
তৃতীয় দিন
========
পরের দিন সক্কালে উঠে আমরা রেডি হতে থাকলাম l ৭টা নাগাদ বেরিয়ে পড়লাম কালকেরভদ্রলোক এর বলা রাস্তা ধরে l সমুদ্রকে ডান দিকে রেখে আমরা এগিয়ে চললাম গ্রাম এর রাস্তা ধরে l ভদ্রলোক বলেছিলো দ্বারিকা মার্কেটে আমরা ব্রেকফাস্ট করতে পারবো l তারপর সমুদ্রের ধার ধরে আমাদের সোজা পূর্ব দিকে যেতে হবে l কিন্তু আজ ভগবান আমাদের জন্য অন্য প্ল্যান করে রেখেছিলেন l দ্বারিকা মার্কেট এর ঠিক আগে আমাদের দেখা হলো আর একজন এর সাথে l যিনি আমাদের বললেন দ্বারিকা মার্কেটে আমরা কোনো খাওয়ার দোকান পাবো না l
আমাদের যেতে হবে পৌষফালি l সেটা যেতেই আমাদের সময় লাগলো প্রায় ১ ঘন্টা l আমরা যেতে যেতে বুঝতে পারছিলাম আমরা ধীরে ধীরে সমুদ্র থেকে দূরে চলে যাচ্ছি., ১০ টা নাগাদ পৌঁছে আমরা ব্রেকফাস্ট করলাম মুড়ি আর আলুর তরকারি দিয়ে l প্রত্যেকের প্রচুর খিদে পেয়ে গেছিলো l সুতরাং পেট পুরে খেয়ে আমরা আবার যাত্রা শুরু করলাম l
এবার আমাদের উদ্দেশ্য যেনতেনো প্রকারে সমুদ্রের ধারে ফিরে আসা l আমরা ম্যাপে দেখলাম আমরা সমুদ্র থেকে প্রায় ১০ কিমি ভেতরে আছি l গ্রাম এর রাস্তা ধরে হাটতে হাটতে ক্লান্ত হয়ে প্রায় ১০ কিমি ক্রস করে যখন সমুদ্রের ধারে এসে পৌঁছলাম তখন প্রায় ১টা l আর পা চলছিল না l সমুদ্রের ধারে একটা ছোট্ট চালা করে রাখা ছিল l সেটাতে বসে পড়লাম সবাই. প্রায় ৩০ মিনিট বসার পর আমরা আবার চলা শুরু করলাম l এবার আমাদের ডেস্টিনেশন দাগাড়া l গুগল ম্যাপ বলছে সেটা আরো ১২ কিমি দূরে l সুতরাং কোনো কিছু না ভেবে হাঁটা শুরু করলাম l ঝাউ এর বন এর মধ্যে দিয়ে হাটতে হাটতে চললাম l মাঝে মাঝে সুঁইচোরা( asian green bee eater ) পাখির দেখা পেলাম l আরও পেলাম অসংখ্য ফিঙে(Black drongo ) আর ঘুঘু (dove) l কিছুক্ষন পরে আবার ঝাউবন ঘন হতে শুরু করলো l আমরা নেমে এলাম বিচের উপর l হাটতে হাটতে দেখলাম একটা জায়গাতে পাঁচ ছটা মাটির কলসি পরে আছে l আর পাশে কিছু পোড়া কাঠ l ব্যাপারটাকে পাত্তানা দিয়ে এগিয়ে চললাম সামনের দিকে l আবার দেখতে পেলাম পাঁচ ছটা মাটির কলসি পরে আছে l আর পাশে কিছু পোড়া কাঠ l এবার ব্যাপারটা বুঝতে পারলাম l আমরা শ্মশানে ঢুকে পড়েছি l যাই হোক, শ্মশান এর উপর দিয়ে এগোতে থাকলাম l দেখতে পেলাম কিছু তালবাতাসি পাখি(ASIAN PALM SWIFT) উড়ে বেড়াচ্ছে, আর কয়েকটা মাছরাঙা(Kingfisher) শ্মশানের পোড়া কাঠে বসে আছে l শোষণ এর পাশ দিয়ে একটা ছোট্ট খাল মতো কাটা l তার পর বিচ আর তার পর সমুদ্র l বোধহয় ছোট মাছ ওই খালটাতে ঢোকে l তাদের জন্যই মাছরাঙা দের বসে থাকা l
আমরা শ্মশানটা পেরিয়ে এসে নেমে এলাম বিচে l এবার বিচ ধরে হাটতে থাকা l বিচ ধরে হাটতে হাটতে দেখলাম বামদিকে বস্তাতে করে বালি ভরা চলছে l গাড়ি তে করে সেই বালি চলে যাবে অন্য কোথাও জমি ভরাট করতে. পায়ের তলায় বালি কখনো নরম, কখনো শক্ত l মাঝে মাঝে দেখতে পেলাম নৌকো গুলো বিচের মাঝে দাঁড়িয়ে আছে l কোনোটাতে কাজ চলছে, কোনোটাতে আলকাতরা মাখানো হচ্ছে, আবার কোনোটাতে মাঝিরা জাল গোটানোর কাজ করছে l
হাটতে হাটতে আমরা চলে এলাম এমন একটা জোনে যেখানে অনেক দূর পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে লাল কাঁকড়াদের l কিন্তু কাছে গেলেই তারা ঢুকে পড়ছে নিজেদের আস্তানায় l এইভাবে হাটতে হাটতে আমরা দেখতে পেলাম একটা জায়গায় কিছু বসার জায়গা তৈরী করা আছে সবুজ রং এর l আমি ভেবেছিলাম যাক এবার অন্তত খাবার জুটবে l সেই ১০ টার সময় ব্রেকফাস্ট করে বেড়িয়েছি l
তারপর আরও কিছু পেটে পড়েনি l একটু বসার জায়গার দিকে এগিয়ে যেতেই দেখলাম লেখা আছে ‘Welcome to Dagara’ মনটা খুশি তে ভরে গেলো l
খোঁজ নিয়ে জানা গেলো এখানে হোটেলও আছে l আমরা একটা হোটেল এর ব্যবস্থা করলাম l আর সবচেয়ে খুশির খবর এই যে আমরা সঙ্গে সঙ্গে পেলাম ভাত,মুগ ডাল, আলুর তরকারি, আর রুই মাছ l এটা পেয়ে আমার পেটের সাথে দ্বন্দ্বের অবসান হলো l খেয়ে উঠে ঘড়ি দেখলাম ৪:৩০ l ভাবলাম এবার একটু ডোকরা বিচটা দেখে আসি l ডোকরা বিচটা একটা ছোট্ট টুরিস্ট স্পট l
অনেকেই এখানে আসে পিকনিক করতে lবিচে দেখলাম হরেক রকমের খান ২০ লোকজন ঘোরাফেরা করছে l আমি এদিক ওদিক করতে করতে ঘন্টা খানেক কাটিয়ে দিলাম l বিচের পাশে খান ৩ নৌকা দাঁড় করিয়ে রাখা ছিল lসূর্যি মামা ধীরে ধীরে লাল হয়ে নৌকা গুলোর পিছনে সমুদ্রের জলে ডুব দিলেন আরও ধীরে ধীরে আলোর শেষ বিন্দু টুকুও চলে গেলো l আমি ফিরে এলাম আমাদের হোটেলে l
হোটেলে এসে আবার বসে পড়লাম আড্ডাতে l অনিরুদ্ধ আর দেবাংশুর foodwalk , অভিষেকের bike রাইডিং এর গল্প শুনতে শুনতে কখন ৯টা বেজে গেলো কে জানে l ৯টায় আমরা খাওয়াদাওয়া করতে গেলাম l খেয়ে দেয়ে আবার একটু আড্ডা দিয়ে ১১:৩০ নাগাদ শুতে গেলাম l
চতুর্থ দিন
========
এই কদিন হাঁটার সময় একবারও সূর্যোদয় দেখা হয়নি l তাই আজ সকালএ বেরিয়ে পড়লাম সূর্যোদয় দেখবো বলে l সকাল ৬টা নাগাদ হোটেল এর রুম থেকে বেরোলাম l আজ ঠান্ডাটা বেশ কম l বিচে গিয়ে দেখলাম ওখানে শুধু খান ৮ কুকুর ঘুরে বেড়াচ্ছে. বিচের কাছে গিয়ে দেখলাম কিছু বাচ্ছা ছেলে জাল নিয়ে ঝিনুক কোরাতে ব্যাস্ত l আরও পুব এর আকাশ ধীরে ধীরে লাল হওয়া শুরু হয়েছে l কিছুক্ষন পর সূর্যি মামা জলের উপর থেকে দেখা দিলো l পুরো বিচে যতদূর দেখা যায় পুরোটা কমলা রং এ মাখামাখি l আমি ও কমলা রং এ স্নান করে হোটেল এর দিকে রওনা দিলাম l আজ আমাদের যাত্রা পথে পড়বে সুবর্ণরেখা নদী l
কাল গ্রামের মধ্যে দিয়ে হেঁটে বড় কষ্ট হয়েছিল l তাই আজ ঠিক করা হলো যদি গ্রামের মধ্যে দিয়ে হাঁটতে হয় তাহলে কোনো অটো বা ভ্যান করে নেওয়া হবে l আমরা যে হোটেল এ ছিলাম সেখানে জিজ্ঞেস করে জানা গেলো আমাদের বিচ ধরে কিছুদূর হাঁটার পর পড়বে সুবর্ণরেখা নদী কিন্তু ঘাটটা মোহনা থেকে বেশ কিছুটা ভিতরে l আর মোহনা ধরে সুবর্ণরেখা নদীর ঘাটে আসা যায় না l আমাদের বিচ ধরে কিছুদূর হাঁটলে বিচের বামদিকে একটা Bingo Boat দেখতে পাবো l
সেখান থেকে বামদিকে কিছুদূর হাঁটলে একটা গ্রাম পাবো, সেই গ্রাম এর মধ্যে দিয়ে আমাদের ঘাটে যেতে হবে l ঘাটের নাম ভূসনেস্বর এর ঘাট. এখন থেকে নৌকা পাওয়া যায় যা আমাদের কীর্তনিয়া ঘাটে পৌঁছে দেবে l এই পর্যন্ত ইনফরমেশন নিয়ে আমরা হাঁটা শুরু করলাম l
সকাল এর মিথ্যে রোদ গায়ে মেখে আমরা চলেছি. আজ আমরা অনেক ছোট নৌকো দেখতে পেলাম যেটা পাড়ের দিকে আসছে, কিছু নৌকো পৌঁছে গেছে পাড়ে l মাঝিরা ব্যাস্ত মাছ জাল থেকে আলাদা করতে l আর দেখলাম একটা ট্রাকটর বিচে ঘুরে বেড়াচ্ছে l প্রথমে বুঝতে পারিনি ট্রাকটরটা কেন ঐখানে ঘুরছে পরে দেখলাম ওটা নৌকাগুলোকে ঠেলে বালির উপর দিকে তুলে দিচ্ছে l পাশেই দেখলাম মাছ এর নিলাম হচ্ছে l একটা নৌকায় উঁকি মেরে দেখলাম সেখানে হরেক রকম নাম না জানা মাছ l তবে প্রচুর আমুদি মাছ চোখে পড়লো l এইসব দেখতে দেখতে আমরা চলেছি, হটাৎ দেখলাম আমাদের বামদিকে একটা কমলা রং এর অদ্ভুত দর্শন কিছু একটা পরে আছে l একটা ছেলে সাইকেল নিয়ে গ্রাম এর দিকে যাচ্ছিলো l
ওকে জিজ্ঞেস করলাম Bingo Boat কোথায় পড়বে, ও কিছুই বলতে পারলো না l আমরা এগিয়ে চললাম ওই অদ্ভুত কমলা বস্তু টার দিকে l কাছে যেতে দেখতে পেলাম ওতে লেখা আছে Bingo Boat l মনটা খুশি তে ভরে গেলো l
Bingo Boat আসলে একটা পরিত্যক্ত সাবমেরিন টাইপ বোট l দেখতে ও অদ্ভুত, আরও ভিতরে পরে আছে অসংখ মদ এর বোতল l যায় হোক আমরা একটু ফটো তুলে এগিয়ে চললাম ভূসনেস্বর এর ঘাটের দিকে l
ঘাট এর কাছে আমরা খাওয়াদাওয়া করার জন্য খোঁজাখুঁজি করছিলাম l লোকজনকে জিজ্ঞেস করলে বললো এখানে খালি মিষ্টি পাওয়া যাবে l ওপারে জলখাওয়ার পাওয়া যাবে l
আমরা ২টা রসগোল্লা খেয়ে হাঁটা দিলাম ঘাটের দিকে l এবারের নৌকাটা বেশ বড় l এবং জুতো না খুলেই উঠে পরা যায় l তবে সুবর্ণরেখা নদীটা বেশ চওড়া l আমাদের নদীটা পেরোতে প্রায় ২০ মিনিট সময় লাগলো lনদী পেরিয়ে আমরা পৌঁছে গেলাম কীর্তনিয়া ঘাটে l এখানেই কিছুটা দূরে আছে ভূসনেস্বর এর মন্দির l এটা একটা শিব মন্দির l আমরা মন্দির এর পাশেই দেখলাম অনেক খাবার দোকান l আমরা লুচি আর আলুর তরকারি দিয়ে আমাদের খুদা নিবারণ করলাম l তারপর একটু মন্দির দর্শন করে লোকজনকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম, আর বিচ এর ধার দিয়ে যাওয়া যাবে না তালসারি পর্যন্ত l কারণ মাঝে পড়বে বিচিত্রপুর ডেল্টা l যেটা হেঁটে পার করা যায় না l সুতরাং আমাদের গ্রাম এর মধ্যে দিয়েই যেতে হবে l আরও উপায় না দেখে আমরা একটা অটো ঠিক করলাম যেটা আমাদের তালসারি অব্দি পৌঁছে দেবে l আরো কিছুক্ষন এদিক ওদিক করে আমরা উঠে পড়লাম অটোতে l
অটোটা কিছুক্ষন সুবর্ণরেখা নদীর পাশে দিয়ে গিয়ে ঢুকে পড়লো গ্রামের রাস্তাতে l তারপর বিচিত্রপুর নেচার ক্যাম্প এর রাস্তার পাশ দিয়ে ঢুকে পড়লো তাজপুর l প্রায় ১ ঘন্টার অটো জার্নি l ৩ দিন এর হাঁটার পর গাড়ি চড়ে আমার প্রচন্ড ঘুম পাচ্ছিলো, কিন্তু তাজপুর পৌঁছনোর পর আবার সমুদ্র দেখে চাঙ্গা হয়ে গেলাম l এবার আমাদের আরও কিছুক্ষন হেঁটে দিঘা পৌঁছতে হবে l তাজপুর বিচের ধার দিয়ে আমরা হেঁটে চললাম l বিচ চিরে কিছু ছোট ছোট খাড়ি রয়েছে যেগুলো জোয়ারএর জল কে ভাটার সময় সমুদ্রে নিয়ে যায় l আমরা খালি পায়ে হেঁটে চললাম l আর রাস্তা তে অসংখ্য ঝিনুক আর লাল কাঁকড়ার ঘোরাঘুরি দেখতে থাকলাম l এই রিজিওন টা তে প্রচুর লাল কাঁকড়া আছে কিন্তু যেভাবে বাইক যাতায়াত করে তাতে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম এদের দেখতে পারবে কিনা কে জানে l যাই হোক, চলতে চলতে একটু দূরে আমরা দেখতে পেলাম বেশ কিছু দোকানপাঠ l আন্দাজ করলাম ওটাই উদয়পুর বিচ lউদয়পুর বিচে কিছুক্ষন সময় কাটিয়ে আমরা আবার হাঁটা শুরু করলাম l রাস্তায় দেখলাম সূর্যিমামা ঢোলে পড়েছে অস্তাচলে l আর পুরো বিচ আবার কমলা রং ধারণ করেছে. এই কমলা রং গায়ে মেখেই আমরা পৌঁছে গেলাম নিউ দিঘা l
Name: Arindam Pramanik
Age: 34
Work: Corporate Service
Residence: Howrah
Hobbies: Photography, Travelling, Trekking, aquarium
Previous Tours- Roopkund, Baghini glacier, Bali pass, Tapovan, Vasuki taal, Sandakphu, Goechala