Tripsee Treks  and Tours LLP
Blog and Travel with Us

গঙ্গা তুমি কোথা হইতে আসিয়াছো?



Ashim Kumar Das Ashim Kumar Das

"গঙ্গা তুমি কোথা হইতে আসিয়াছো?

                   মহাদেবের জটা হইতে।"

পুরাকালে সগর নামে ইক্ষাকু বংশের এক রাজা ছিলেন।ওনার ছিল দুই রাণী কেশিনি আর সুমতি।কিন্তু ওদের কোনো সন্তান ছিলো না তাই  রাজার মন সবসময়ই অশান্তির বাতাবরণে আবিষ্ট থাকতো। সন্তান লাভের উদ্দেশ্যে রাণীদের নিয়ে রাজামশাই দেবাদিদেবের তপস্যায় রত হলেন। দীর্ঘ তপস্যার ফলে তুষ্ট মহাদেবের বরে সুমতির গর্ভে একটি বলবান পুত্রসন্তান জন্ম নিল।নাম হলো তার অসমঞ্জ।অন্যদিকে কেশিনির গর্ভে জন্ম নিলো ষাট হাজার পুত্রসন্তান। তারাও ছিলো যথেষ্ট বীর্যবান,কিন্তু অত্যাচারী। তাদের অত্যাচারে প্রজাসকল সবসময়ই আতঙ্কিত  হয়ে থাকতো।

                                  এদিকে সগর রাজার মনে জন্ম নিলো এক বাসনা। তিনি নিজে দেবরাজ ইন্দ্রের সমান ক্ষমতাবান হতে চাইলেন।একেতো তিনি বিখ্যাত ইক্ষাকু বংশের সন্তান তার উপর এতোগুলো বলবান পুত্রসন্তানের পিতা।তার মনে এই বাসনা আসতেই পারে।কিন্তু মনে বাসনা আসলেই তো আর হবে না, এই বাসনা সফল করতে হলে কঠিন এক কার্যকারণ প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে যেতে হবে তাকে আর তার পরিবারকে। আর  এই উদ্দেশ্যেই তাকে আয়োজন করতে হবে একশত অশ্বমেধ যজ্ঞ।সফলকাম হলে আর সব রাজন্যবর্গ,ঋষিকুল,দেবতারা সবাই  খুশী হলে তবেই মিলবে দেবরাজ ইন্দ্রের সমান ক্ষমতা।

এমনিতেই একটা যজ্ঞ সফল করতেই মহাশক্তিশালী নৃপতিদেরই কালঘাম ছুটে যায় তায় একশত অশ্বমেধ যজ্ঞ!একি সোজা কথা!তবুও নিরানব্বইটা যজ্ঞ সফল ভাবে সম্পন্ন করে সগর রাজা শততম যজ্ঞের আয়োজন করতে উঠেপড়ে লাগলেন। সুন্দরভাবে সজ্জিত এক অশ্বকে ছাড়লেন সসাগরা পৃথিবী প্রদক্ষিণ করে আসতে, সঙ্গে পাহারাদার হিসাবে পাঠালেন তার ওই ষাট হাজার পুত্রকে। অশ্ব তো মনের আনন্দে দেশ-বিদেশ,নগর প্রান্তর ঘুরে বেড়াচ্ছে, বাধা দেবে সেই অশ্বকে এমন বুকের পাটা কোনো রাজারই ছিলো না, ইচ্ছাও ছিলো না। প্রমাদ গনলেন ক্ষমতালোভী দেবরাজ,তাঁর ক্ষমতা যে যায় যায়!তবে অতো সহজে ছেড়ে দেওয়ার পাত্র তো নন ইন্দ্রদেব।তিনি হরণ করলেন যজ্ঞের অশ্বকে,লুকিয়ে রাখলেন পাতালপুরীতে কপিলমুনির আশ্রমে।এদিকে অশ্বের খোঁজে দিক-বিদিক এক করে ফেললো সগর রাজার ছেলেরা।খুঁজতে খুঁজতে উপস্থিত হোলো পাতালপুরীতে কপিলমুনির আশ্রমে।দেখলো, মনের আনন্দে চরে বেড়াচ্ছে যজ্ঞের অশ্ব।ক্রোধে অন্ধ হয়ে মুনিকে চোর অপবাদ দিয়ে চরম অসম্মান করে বসলো ওরা।ক্রোধান্বিত মুনিবরের রোষের আগুনে পুড়ে খাক হয়ে গেলো সগর রাজার ষাট হাজার সন্তান।

                               এদিকে বছর আসে বছর যায়,না আসে অশ্বমেধের অশ্ব, না আসে তার ষাট হাজার সন্তান। সগর রাজা ক্রমে অসহিষ্ণু হয়ে উঠলেন,তবে কি ইন্দ্রের মতো ক্ষমতা লাভ করতে পারবেননা?ক্ষমতার লড়াইয়ে হেরে যাবেন তিনি? ক্ষমতার দম্ভ,লড়াই সব দেশে, সব কালে একইরকম ছিল, এখনও আছে আর ভবিষ্যতেও থাকবে। মাঝখানে চিড়ে চ্যাপ্টা হয়ে মরবে  সাধারণ মানুষ। যাইহোক সগর রাজা পাঠালেন তার পৌত্র অংশুমানকে তত্ত্বতালাশ করতে।বারংবার নির্দেশ দিলেন মাথা গরম না করতে।যেনতেন প্রকারেণ যজ্ঞের অশ্ব তার চাই ই চাই।ক্ষমতা তাকে পেতেই হবে।চললেন অংশুমান অশ্বের খোঁজে, অশ্বের চলার পথ অনুসরণ করে। চলতে চলতে এসে উপস্থিত হলেন পাতালপুরে কপিলমুনির আশ্রমে, দেখলেন পরমানন্দে যজ্ঞের অশ্ব ঘুরে বেড়াচ্ছে। পিতামহের আজ্ঞা শিরোধার্য করে শান্তভাবে ঋষিবরের কাছে পিতৃব্যদের অভব্যতার জন্যে বারংবার ক্ষমা প্রার্থনা করতে লাগলেন। অংশুমানের ব্যবহারে প্রীত হয়ে কপিলমুনি অশ্ব প্রত্যার্পন করলেন আর সগর রাজার ছেলেদের মুক্তির উপায়ও বলে দিলেন। যদি তাদের বংশের কোনো সন্তান দেবলোক থেকে গঙ্গাকে মর্তে এনে ওই ভষ্মের উপর দিয়ে প্রবাহিত করাতে পারে তবেই ওই ষাট হাজার সন্তান মুক্তি পাবে। এই বিধান শুনে আর যজ্ঞের অশ্ব নিয়ে অংশুমান ফিরে এলেন রাজধানীতে। মহাধুমধামে সম্পন্ন হোলো যজ্ঞের কাজ।ক্রমে রাজসিংহাসনে বসলেন সেই অংশুমান।

সন্ধ্যারাগের আলোয় পতিতপাবনী

এরপর সময় এগিয়ে চলে নিজের মতো করে। একের পর এক রাজা আসেন আর চলে যান, কিন্তু রাজা সগরের সন্তানেরা আর মুক্ত হতে পারে না। কোনো রাজার ক্ষমতায় কুলায় না এই অসাধ্যসাধন করতে।

        পেরিয়ে গেল আরও বেশ কিছুটা সময়। রাজা দিলীপ তখন সিংহাসনে উপবিষ্ট, পুত্র ভগীরথের সময় হয়েছে রাজসিংহাসনে বসার। কিন্তু ভগীরথ করে বসলেন কঠিন এক প্রতিজ্ঞা,যতদিন না তিনি মুক্ত করে আনতে পারবেন তাঁর পিতৃপুরুষদের, ততদিন সিংহাসনে বসা তো দূরের কথা, রাজ্যেও ফিরবেন না।

চললেন ভগীরথ পর্বতশিখরে,বসলেন এক কঠিন তপস্যায়,প্রজাপতি ব্রহ্মার উদ্দেশ্যে,গঙ্গাকে মর্তে আনয়ন করবার মানসে।কেননা গঙ্গা যে ব্রহ্মলোকের বাসিন্দা। দিন যায়,মাস যায়,বছরও পেরিয়ে যায়। ক্রমে ক্রমে বছরের হিসাবও গুলিয়ে যায়, কিন্তু ব্রহ্মার সন্তুষ্টি আর আসেনা। অবশেষে সুদীর্ঘ কঠিন তপস্যায় তুষ্ট হলেন প্রজাপতি ব্রহ্মা। নির্দেশ দিলেন গঙ্গাকে মর্তে প্রবাহিত হতে। গঙ্গার তো মাথায় হাত,সবে যৌবনের দ্বারে উপনিত হয়েছেন,সুন্দর সুন্দর দেবতাদের দেখে মন সবে উৎফুল্ল হতে শুরু করেছে,একটু ছলাকলা করবেন, লাফালাফি, ঝাঁপাঝাঁপি করবেন,তা না যেতে হবে সেই সাত সমুদ্র তের নদী পার হয়ে! সহ্য কি হয়!কিন্তু যেতে হবেই, প্রজাপতির আদেশ পালন না করার হিম্মত তো নেই। রাগে উন্মত্ত হয়ে উঠলেন গঙ্গা,প্রলয়ঙ্করী রূপে দেখা দিলেন। রোষে গর্জন করতে করতে ছুটে বেড়াতে লাগলেন ব্রহ্মলোক থেকে বিষ্ণুলোক। ভয়ে দিশেহারা হয়ে গেল দেবতাকুল। মাতা ধরিত্রীও বিপদ গনলেন, ফেটে চৌচির হয়ে যাবেন বুঝি মা গঙ্গার অভিঘাতে।তবুও ধরাধামে অবতীর্ণ করাতেই হবে গঙ্গাকে,যেমন করেই হোক।কিন্তু কিভাবে! চিন্তায় মগ্ন সবাই। উপায় তো একটাই, অগতির গতি দেবাদিদেব মহাদেব। অপকর্ম করে বেড়াবে দেবতাকূল,ফলভোগ করবে কে?কেন, মহাদেব আছে না! সবাই বিভিন্ন প্রসাধনীতে সজ্জিত হয়ে ঘুরে বেড়াবে আর শিবশম্ভু ঘুরবেন ছাইভষ্ম মেখে,বাঘছাল পরে বিষধর সাপ গায়ে নিয়ে। অমৃত পান করলো সব দেবকূল, বাদ পড়লো কে? কে আবার দেবাদিদেব! তার জন্যে রইলো যে তীব্র হলাহল, নইলে পৃথিবীকে রক্ষা করবে কে!প্রলয়ঙ্করী গঙ্গাকে সামাল দেবে কে? ধারণ করবে কে?গঙ্গার অভিঘাত থেকে মাতা ধরিত্রীকে রক্ষা করবে কে? কেন জটাজুটধারী মহাযোগী মহেশ্বর আছে না?তবে চলো যাই কৈলাশে।এই কথা বলে দেবতারা সবাই মিলে চললো শিবের আলয়ে।তাই ওদিকে আবারও তপস্যায় বসতে হোলো ভগীরথকে।সন্তুষ্ট করতে হোলো আশুতোষকে।রাজী হলেন তিনি গঙ্গার প্রবাহকে মস্তকে ধারণ করতে। উঠে দাঁড়ালেন তিনি কৈলাশ পর্বতের শিখরে,খুলে দিলেন তাঁর জটাজাল, ঢেকে গেলো ধরণী সেই জটাজালে।

বিশ্রামে যায় দিনমণি,বিশ্রামে যায় দিনমজুর

তীব্র গতিতে ঝাঁপ দিলেন প্রলয়ঙ্করী গঙ্গা ধরণীর বুকে,মাথা পেতে দিলেন মহাদেব। আটকে গেলো গঙ্গা ওই বিস্তৃত জটাজালে। ধীরে ধীরে বিন্দু বিন্দু আকারে জটা বেয়ে নামতে লাগলো গঙ্গা। উদ্বেলিত হয়ে উঠলো ভগীরথের হৃদয়।শাঁখ বাজিয়ে, পথ দেখিয়ে আগে আগে চলেন ভগীরথ, পিছে পিছে আসেন গঙ্গা।ঠিক যেন হ্যামলিনের সেই বাঁশিওয়ালা যুবক। খুশীতে ভরে গেল ধরণীর মাটি। সিক্ত হোলো, উর্বরা হোলো ধরণী। শ্যামলিমায় সেজে উঠলো চারিধার। হিমালয়ের সুউচ্চ  দেবভূমি থেকে যাত্রা শুরু করে অবশেষে গঙ্গা এসে উপনীত হল সাগরের কূলে,পাতালপুরীতে কপিলমুনির আশ্রমে। প্রবাহিত হলেন সগর রাজার ছেলেদের ভষ্মের উপর দিয়ে। ব্রহ্মশাপ থেকে মুক্ত হলেন তারা।মুনিবরকে প্রণাম করে রওয়ানা দিলেন দেশের উদ্দেশ্যে। আশ্রয় পেল গঙ্গা সাগরের বুকে।

                                 ভালোই তো ছিল গঙ্গা ব্রহ্মলোকে, দিব্যি ছুটছিলো, খেলছিলো,দাপিয়ে বেড়াচ্ছিলো ব্রহ্মলোক থেকে বিষ্ণুলোক।কি দরকার ছিল তাকে টেনে নামানোর?এই মর্তলোকে? ভগীরথের নাহয় দায় ছিলো পিতৃপুরুষদের পাপস্খলনের,ধরিত্রীর দায় ছিলো উর্বরা হওয়ার,শস্যশ্যামলা হওয়ার।কিন্তু আমার কোনো দায় ছিলো কি! ছিলো, ছিলো,দায় ছিলো প্রাণের,মানের। এখন তো আছি গঙ্গার একপাড়ে পূন্যভূমি,জগজ্জননী শঙ্করীর স্পর্শে ধন্য বংশবাটির হংসেশ্বরী মন্দিরে।এবার যাবো গঙ্গার অপর পাড়ে আর এক মহাজননীর চরণধুলিতে ধন্য কোনা গ্রামে। রাণী রাসমনির জন্মভূমি কোনা গ্রাম। একসময় এসেই পড়লাম দলবল নিয়ে রাণী রাসমনির ভিটেবাড়ির আঙ্গিনায়। একেবারে এককোনায় পড়ে থাকা গ্রামের প্রান্তে, জেলেদের পাড়ায়। ছোট্ট ভিটেবাড়িকে ঘিরে গড়ে উঠেছে মন্দির,দক্ষিনেশ্বর মন্দিরের অনুকরণে।পাশেই গড়ে উঠছে মঠ,সেখানে পুজিত হচ্ছেন রামকৃষ্ণ পরমহংস।আর এই মন্দির প্রাঙ্গনের সামনে অবারিতধারায় বয়ে চলেছে পূন্যসলিলা ভাগীরথী।মহিলা মহল চলে গেল মন্দিরের ভিতরে আর আমি রয়ে গেলাম গঙ্গার কিনারে। গঙ্গার সারা শরীরে আজ পুলক জেগেছে, আনন্দে ডগমগ করছে সে। ফুলে ফুলে উঠছে, কলকল করে কত কথাই না কয়ে চলেছে আপন মনে। বারে বারে উঠে আসতে চাইছে মায়ের চরণ ধুয়ে দিতে।বিভোর হয়ে আছি মা ভাগিরথীর ছলাৎছলাতে, কলকল ধ্বনির মাঝে।

যে ঘাটে দাপিয়ে বেড়াতেন ছোট্টো রাণী

           "আঁধার নামিল ধীরে,

                            মৃদু মন্দ সমীরে,

            ভাগিরথীর এই তীরে।"

                          সমস্ত প্রকৃতিকে অদ্ভুত এক রঙে রাঙিয়ে দিয়ে সূর্যদেব চললেন বিশ্রাম নিতে।সারাদিনের হাড়ভাঙা খাটুনির পর জেলেদের দল ফিরে আসছে তাদের ডেরায়। বেঁধে রাখছে তাদের জীবন ধারণের একমাত্র হাতিয়ার ছোট্ট  ডিঙ্গিনৌকাটিকে।ওদিকে মন্দিরে জ্বলে উঠেছে আলো,বাজছে শঙ্খ, বাজছে ঘন্টা, কাসর,উড়ছে উলুধ্বনি,উচ্চারিত হচ্ছে মন্ত্র, চলছে সন্ধ্যারতি। কালো আকাশের প্রেক্ষাপটে আলোকমন্ডিত মন্দির - অসাধারণ এক দৃশ্যকাব্য।মোহিত হয়ে গেছি,চোখের সামনে যেন দেখতে পাচ্ছি পুরনো সেই দিনের ছবি,টাইম মেশিনে চেপে আমি যেন ফিরে গিয়েছি সেই সেকালে।

সেযুগের কুমারহট্ট,আজকের উত্তর চব্বিশ পরগনার হালিশহর ছিলো শিক্ষা-দীক্ষা, শিল্প-সংস্কৃতি,প্রতিভার বিচ্ছুরণে আলোকিত এক বনেদী অঞ্চল।তো সেই কুমারহট্টের প্রত্যন্ত এক অঞ্চলে লুকিয়ে ছিলো হতদরিদ্র গ্রাম,কোনা।মাহিষ্য সম্প্রদায়ভুক্ত হতদরিদ্র জেলে, কৃষিশ্রমিক,গৃহনির্মাণ শ্রমিক অধ্যুষিত গ্রাম কোনা।১৭৯৩ খ্রীস্টাব্দের ২৬শে অক্টোবর এমনই এক হতদরিদ্র কৃষিশ্রমিক হরেকৃষ্ণ দাস আর রামপ্রিয়া দাসীর ভাঙা ঘরে খেলে গেল চাঁদের আলো। শিশু কন্ঠের ক্রন্দনধ্বনি পূন্যতোয়া ভাগীরথীর কলকল ধ্বনিকে ছাপিয়ে গিয়ে পৌঁছে গেলো সকল ঘরে।জন্ম নিলো পৃথিবীর বুকে আরও এক মহীরুহ,ভাগিরথীর এপারে।ওপারে তখন ডালপালা মেলে বিকশিত হবার অপেক্ষায় আর এক মহীরুহ রাণী শঙ্করী। কতো না উর্বরা,কতো না পবিত্র এই গঙ্গার মাটি! কোন সুদূর থেকে উঠিয়ে নিয়ে এসে বপন করা হলো যে চারাগাছকে,আজ সে ডালপালা, সবুজ পাতা,ফুল,ফল নিয়ে সেজে উঠে মহীরুহ হওয়ার অপেক্ষায় দিন গুনছে। আর তখনই এপারে অঙ্কুরিত হলো আরও এক শিশুবৃক্ষ,মহীরুহ হওয়ার সমস্ত সম্ভাবনা নিয়ে। ছুটে এলো সব্বাই, দেখলো চাঁদপানা মুখ নিয়ে ভাঙা ঘর আলো করে শুয়ে আছে ভবিষ্যতের মহাজননী। সবার মুখ থেকে অস্ফুটে বেরিয়ে এলো একটাই কথা, রাজরাণী হও মা।মা রামপ্রিয়ার চোখ সরে না মেয়ের মুখের উপর থেকে। পলক পড়ে না চোখের। মেয়ের নাম দিলেন সত্যদ্রষ্টা জননী, ….’রাণী’। যদিও আরও একটা নাম জুটেছিল তার, রাসমনি।পরে তা জুড়ে গিয়ে রাণী রাসমনি হয়ে বিখ্যাত হয়ে উঠেছিলো সারা পৃথিবীর বুকে। সে পরের কথা পরেই হবে,এখন সে রাণী নাম নিয়ে বড় হয়ে উঠছে। বিকশিত হচ্ছে রূপ, রস,তেজ নিয়ে।সারা ঘর বাড়ি দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। ছুটছে, লাফাচ্ছে, সাঁতার কাটছে ভরা গঙ্গার বুকে, কলকল হাসিতে ভরে তুলছে দিকবিদিক। বয়স কতো আর তখন, মাত্র এগারো। কিন্তু এই এগারোর রূপে আর তেজে মাতোয়ারা তখনই সেই কোনা গ্রাম।

সন্ধ্যার আধো-অন্ধকারে রাণী রাসমণীর ভিটে

                 এদিকে কলকাতার জানবাজারের বিখ্যাত জমিদার ও ব্যবসায়ী মাড় বংশের প্রীতরাম দাসের ছোটো ছেলে কুড়ি বর্ষীয় রাজচন্দ্র দাস বজরা সহযোগে তীর্থ করতে বেড়িয়েছেন।মনে তার বড়ই অশান্তি। এই বয়সে দু দুবার বিয়ের পিঁড়িতে বসেও সংসার করা আর হোলো না। দুই স্ত্রীই অকালে তাকে ছেড়ে ইহলোকের মায়া ত্যাগ করে পরলোকে চলে গেছে। তাই অশান্ত মন নিয়ে তীর্থ দর্শণে চলেছেন তিনি। হঠাৎই চোখ গেলো তার গঙ্গার ঘাটে, সমবয়সীদের সাথে খেলতে থাকা, জল তোলপাড় করতে থাকা মেয়েটার দিকে।কে এই মেয়ে!কোথায় পেল এইরূপ ওই একরত্তি মেয়েটা!খোঁজ নিয়ে দেখা গেল,হতদরিদ্র এক মাহিষ্য ঘরেরই মেয়ে,তাদেরই পালটি ঘর।তীর্থে যাওয়া আর হোলো না রাজচন্দ্রের।ঘরে ফিরে গেলো সে। জানালো সে কন্যের কথা। বাড়ির বড়রাও গিয়ে খোঁজ নিয়ে এলো মেয়ের।মেয়ের বাড়ির লোক তো হাতে স্বর্গ পেলো যেন!শুভ দিনে শুভক্ষণে রাজচন্দ্রের ঘরণী হয়ে মাড়বাড়িতে প্রবেশ করলো কোনা গ্রামের নয়নমনি রাণী। এতো দিনে রাণী নাম তার সার্থক হোলো।

কোনা গ্রামে অঙ্কুরিত চারাগাছ প্রোথিত হোলো,বিকশিত হোলো,মহীরুহ হয়ে উঠলো পতিতপাবনী গঙ্গারই এক ধারে কলকাতার জানবাজারে।এরপরের ঘটনা তো বহুল প্রচারিত,বহুল বিজ্ঞাপিত। বিবরণ মনে হয় নিষ্প্রয়োজন। আমি শুধু ভাবছি গঙ্গার দুই পাড়ের দুই মহীয়সী জননীর কথা। কি মিল দুজনেরই কাজে আর মানসিকতায়,দুজনেই ছুঁয়ে আছেন আর এক মহাজননী পূন্যসলিলা গঙ্গাকে।তবে অমিলটাও খুব একটা কম নয়। একজন সদাসর্বদা, সবকাজে পাশে পেয়েছেন তাঁর স্বামীর সরব উপস্থিতি,অন্যজন স্বামীর সাহায্য তো দূরের কথা,স্ত্রীর মর্য্যাদাই পাননি। আর সব থেকে বড় কথা, রাণী রাসমনি পেয়েছিলেন রামকৃষ্ণ পরমহংসকে,যার জন্য পরিচিতি পেয়েছেন সারা বিশ্বজুড়ে। কিন্তু রাণী শঙ্করীর ছিলো না কোনো রামকৃষ্ণ পরমহংস। তাই সব কিছু থাকা সত্ত্বেও রয়ে গেলেন নিরবে,নিভৃতে।

  "বাবা ও বাবা, ধুর কথা শোনে না!"

  "মামা ও মামা, আরে কিছু শুনতে পাচ্ছো না?"

ছিঁড়ে গেল তন্দ্রাজাল,মুছে গেল সমস্ত দৃশ্য চোখের উপর থেকে, সরে গেল আলো, নেমে এলো নিকষ কালো আঁধার চোখের উপর। দেখি মেয়ে আর ভাগ্নী দাঁড়িয়ে সামনে।

"কি এতো ভাবছো,এই অন্ধকারে দাঁড়িয়ে! যেতে হবে না?"

ও,হ্যাঁ হ্যাঁ, চল চল,দেরী হয়ে গেছে, তাই না! তা ওরা সব গেল কোথায়?

সবাই আছে, ঠিক আছে, ওই দ্যাখো মন্দিরের দরজায়। এতক্ষণ মেয়ে ঝাঁঝ দেখিয়ে গেল।

এবার পালা ভাগ্নীর,তা তুমি কি করছিলে এই অন্ধকারে দাঁড়িয়ে, সেটা তো বললেনা!

ও কিছু না, তোরা বুঝবিনা।

কেন বুঝবো না কেন?-আবার ঝাঁঝালো হলো মেয়ের স্বর।কি ভাবছিলে বলো।

না ভাবছিলাম, এই ভাগিরথীর কথা, ওই পারের রাণী শঙ্করী আর এই পারের রাণী রাসমনির কথা।ভাবছিলাম এই মাটির কথা। কতো অমূল্য সম্পদে ধনী আমাদের এই গ্রাম-বাঙলার উর্বর মাটি। কে বা খবর রাখে!

ঠিক আছে, বাড়ি ফিরে সব শুনবো, এখন চটপট কয়েকটা ছবি তুলে নাও। ওই দ্যাখো সবাই এসে গেছে। দুজনেই হুঁশিয়ারী দিয়ে রাখলো - বাড়ি ফিরে পালিয়ে যেও না আবার! তোমার তো ঘরে মন টেকে না!আগে সব গল্প শুনিয়ে তারপরে যেখানে খুশী যেও।কিচ্ছুটি বলবো না।

আগেও কিছু ছবি তুলেছিলাম,ওদের তাড়নায় আবারও কিছু ছবি তুলে বাহনে উঠে বসলাম। এবার গন্তব্য, সাধক কবি রামপ্রসাদের ভিটে।সেকথা নাহয় পরেই হবে।আমাদের রথ চলেছে রামপ্রসাদের বাসভূমির উদ্দেশ্যে আর আমি চলে গেছি ফের ভাবনার দেশে। এই সেই পথ, যেপথ দিয়ে হেঁটে ফিরতেন এই বাঙলারই কতো না সুসন্তান। কবি ঈশ্বর গুপ্ত,কেশব চন্দ্র সেন,স্বামী নিগমানন্দ,শ্রীচৈতন্য,রাণী রাসমনি,সাধককবি রামপ্রসাদ-কতো, কতো না মণিষীর পদধূলিতে ধন্য হয়েছে এই পথ! তার উপর এই পথের ধার ধরে, পথিককে পথ চিনিয়ে যুগ-যুগান্তর ধরে বয়ে চলেছে পূন্যতোয়া ভাগীরথী।এ পথের 

প্রতিটি ধূলিকণা পূন্যময় না হয়ে আর যায় কোথায়! 

          অতি সত্যি কথা ---

"এ মাটি সোনার মাটি,

     এই মাটিতে সোনাই শুধু ফলে।

                          এ কথা ইতিহাসেই বলে।"

যজ্ঞভূমি

    ----- মানুষের ইতিহাস কখনও মিথ্যা কথা বলে না।----

 

যাক শেষ হোলো 'আমি' নামে এক পাগলের প্রলাপ। তিরস্কার বা পুরস্কার যাই জুটুক তার পুরোপুরি সত্ত্বাধিকারী আমার মেয়ে আর তার দিদি। কেননা তাদেরই তাড়নায় আমার এই প্রলাপ বকা।আমি নিমিত্তের ভাগীদার মাত্র।এবার আসল কথায় আসা যাক। যদি কেউ যেতে চান তবে কিভাবে যাবেন - কোনো চিন্তা না করে শিয়ালদহ মেন লাইনের ট্রেনে উঠে সোজা এসে নামুন কাঁচরাপাড়ায়।এক নম্বর প্ল্যাটফর্মের মেনগেট দিয়ে বেরিয়েই ডানদিকে তাকালেই দেখবেন লাইন দিয়ে অটো দাঁড়িয়ে আছে। যে কোনো একটাতে উঠে চলে আসুন সোজা বাগের মোড়।একটু দাঁড়ান, মোড় পেরোবার আগে জেনে নিন কিছু কথা। মোড়ের ডান দিকের রাস্তা চলে গেছে সোজা কল্যানী ষ্টেশনে।আর ডানদিকে একটু গিয়েই বাঁয়ে ঘুরে গেলেই উঠে পড়বেন কবি ঈশ্বর গুপ্ত নামাঙ্কিত সেতুর উপর,যা কিনা যুক্ত করেছে হুগলী আর উত্তর চব্বিশ পরগনাকে,গঙ্গার উপর দিয়ে।আর যে পথ আপনাকে পৌঁছে দেবে মহাজননী রাণী শঙ্করীর চরণতলে। আবার ওই মোড়ের বাঁদিকের পথ চলে গেছে শ্রীচৈতন্যের স্মৃতিধন্য চৈতন্যডোবা,স্বামী নিগমানন্দ আশ্রম পেরিয়ে সাধককবি রামপ্রসাদের স্নানের ঘাটে। এই পথই শেষ পর্যন্ত পৌঁছে দেবে আপনাকে ব্যারাকপুরে বি টি রোডের উপরে। এবারে মোড় পেরিয়ে ওপারে চলুন। মিনিট চার পাঁচ হাঁটলেই ডানহাতে একটা পথ পাবেন। এই পথের শেষেই আছে শেষের সে ঠাঁই। তবে এখনই ডানদিকে না ঘুরে সোজা চলুন আরও মিনিট পাঁচেক। আহাঃ,চলুনইনা,বলছি তো ঠকবেন না। মিনিট পাঁচেক হেঁটে ডানদিকে তাকান।দেখবেন ঝোপঝাড়ের মধ্যে এক পোড়ো মন্দিরের মাঝে অর্ধকালী মূর্তি।হলপ করে বলতে পারি এরূপ মূর্তি আগে কখনও দেখেননি। আমি তো দেখিনি। এবার ফিরে আসুন সেই পথের বাঁকে,হাঁটুন মিনিট দশেক আবার। দেখুন পথ ঠিক আপনাকে ঠেলে তুলে দিয়েছে পথের প্রান্তে আপনার গন্তব্যে।

পাপীতাপী মানুষ আমি, ধর্মাধর্মের বালাইও নেই আমার। যদি ভুল কিছু কয়ে থাকি, ক্ষমা চেয়ে নিলেম আগেভাগে।

পূন্য সঞ্চয় হোক আপনার ঝুলিতে, অধর্ম যতসব জমা হোক আমার সঞ্চয়ে।

ঘরে ফেরা

Meet the Blogger

Ashim Kumar Das


নাম - অসীম কুমার দাস
বয়স - ৫৭ বছর
পেশা - চাকরি
নিবাস - নিমতা    
শখ     - বই পড়া,ভ্রমণ আর আকাশকুসুম খুঁজে  ফেরা    
ভ্রমণস্থান - যত্রতত্র 



You may also like