কলকাতা তুমিও হেটে দেখো
কলকাতা তুমিও ভেবে দেখো
ঐতিহ্যের শহরের ঐতিহাসিক স্থান
ঐতিহ্য মন্ডিত প্যালেসের ইতিহাস
পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী কলকাতা একসময় পরিচিত ছিল প্রাসাদ-নগরী হিসেবে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনাকালে রাজধানী কলকাতায় ধনী জমিদার ও অভিজাত বাঙালিরা গড়ে তোলেন অসংখ্য ভবন,প্রাসাদ ও বাগান বাড়ি। এমনি একটি প্রাসাদ হলো মার্বেল_প্যালেস। চোরবাগানের মল্লিক পরিবারের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন রামকৃষ্ণ মল্লিক, যিনি ব্যাবসা করে প্রচুর অর্থের অধিকারী হন। ওনার এক বংশধর নীলমণি মল্লিক রাজেন্দ্র_মল্লিককে শিশু বয়সে দত্তক নেন। রাজেন্দ্রর তিন বছর বয়সকালে প্রচুর সম্পত্তি রেখে নীলমণি মারা যান। মাত্র ১৬ বছর বয়সে ১৮৩৫_সালে তিনি এক ফরাসি স্থপতিকে দিয়ে এই ‘মার্বেল প্যালেস’ নির্মাণ শুরু করান। শেষ হতে সময় লাগে ৫বছর (১৮৪০)। নিউক্ল্যাসিকাল স্থাপত্যরীতিতে গড়ে তোলা এই তিনতলা ভবনটির সামনে রয়েছে কোরিন্থিয়ান রীতিতে তৈরি স্তম্ভ এবং কারুকার্য করা বড় বারান্দা। চিনা প্যাভিলিয়নের ধরনে নির্মিত হয়েছে ঢালু ছাদ। নীলমণি মল্লিক উত্তর কলকাতার মুক্তারামবাবু স্ট্রিটে তাঁর বসতবাড়িতে জগন্নাথদেবের মন্দির নির্মাণ করেন। মার্বেল প্যালেসের অন্দর মহলের প্রাঙ্গণে মন্দিরটি এখনো রয়েছে। এই ৪৬ নম্বর মুক্তারামবাবু স্ট্রিটেই রাজেন্দ্র মল্লিক গড়ে তোলেন অসাধারণ সৌন্দর্যমন্ডিত মার্বেল প্যালেস (যে হেতু রাজার পরিবারের সদস্যরা এখনও এ বাড়িতে বাস করেন তাই দর্শনার্থীরা শুধু ভবনটির একটি অংশেই ঢুকতে পারেন। প্রাসাদের অন্দরমহলে এবং প্রসাদের ভিতরে অবস্থিত জগন্নাথদেবের মন্দিরে ঢোকার অধিকার তাদের নেই)। বিপুল সম্পত্তি ও আভিজাত্যর জন্য রানী ভিক্টোরিয়া তাকে রাজা উপাধি দেন।
অন্দরমহলের দৃশ্য ভাস্কর্য ও তার ইতিহাস
ভবনটির ভিতরে রয়েছে মোট ১৮৩৫ প্রকারের ভাস্কর্য ও চিত্রকর্ম। বিশেষ করে গ্রীক ও রোমান পুরাণের দেবদেবী জিউস, মিনার্ভা, মার্কারি, এ্যাপোলো, হেরা, ভেনাস, কিউপিড যেন জীবন্ত হয়ে উঠেছে শ্বেত পাথরের দেহে। এছাড়াও বিশাল বিশাল ক্যানভাসে আঁকা এই চিত্রকর্মগুলো দর্শকদের মুগ্ধ করে অনায়াসে। এই চিত্রকর্মগুলোর মধ্যে ষোড়শ শতকের বিখ্যাত জার্মান শিল্পী রুবেনস এর আঁকা দুটি ছবি রয়েছে। এ দুটি ছবি হলো দ্য ম্যারেজ অব সেন্ট ক্যাথেরিন এবং দ্য মার্টারডম অব সেন্ট সেবাস্টিয়ান। রুবেনস এর এ দুটি মূল চিত্রকর্ম এ সংগ্রহশালার বিখ্যাত সম্পদ। ইংরেজ শিল্পী স্যার জোশুয়া রেনল্ড এরও দুটি মূল চিত্রকর্ম এখানে রয়েছে। এ দুটি হলো সাপের সঙ্গে যুদ্ধরত শিশু হারকিউলিস আর ভেনাস ও কিউপিড। এছাড়া টিটান,মুরিল্লোসহ অনেক বিখ্যাত চিত্রকরের চিত্রকর্মের কপি এখানে রয়েছে। তিনতলা ভবনের পুরোটাইই অত্যন্ত মূল্যবান ইটালিয়ান মার্বেল পাথরে তৈরি। এখানে মোট ৯০রঙের ইটালিয়ান মার্বেল দেখা যায়। সেই জন্যই এর নামকরণ করা হয়েছে মার্বেল প্যালেস। এছাড়াও কাঠের ডিসাইন করা ছাদ (হাতে ডিসাইন করা বা হ্যান্ড ক্রাফটেড)
ভারতের প্রথম পিয়ানো (যা এখনো বাজানো হয়),রানী ভিক্টোরিয়ার যৌবনরূপী বৃদ্ধারূপী মুর্তি রয়েছে এখানে।
মেঝে থেকে ছাদ পর্যন্ত বিস্তৃত বেলজিয়ামে তৈরি আয়না (বেলজিয়াম আয়না মহল) ঘরগুলোর শোভা যেন আরো বাড়িয়েছে। এছাড়া রয়েছে ভিক্টোরীয় যুগে তৈরি কারুকার্য-খচিত কাঠের ও পাথরের আসবাবপত্র, বিশাল ঝাড়বাতি, বিভিন্ন আকারের দৃষ্টিনন্দন ঘড়ি, অত্যন্ত দামী কার্পেট,নকশা করা বাতিদান,বাদ্যযন্ত্র (পন্ডিত রবি শঙ্করের বাজানো বাদ্য যন্ত্র) সহ বিভিন্ন শিল্প-সামগ্রী। রয়েছে নাচঘর (বাঈ নাচ/বল ড্যান্স রুম আলাদা আলাদা), রিসেপশন হল, সঙ্গীত মহল।
এই মহলের দালানে আছে অজস্র দেশি এবং বিদেশি পাখির সম্ভার। যেমন, ম্যকাও, টিয়া, কাকাতুয়া, পায়রা ইত্যাদি।
প্যালেসের বাইরের দৃশ্য এবং চিড়িয়াখানা
তিনতলা ভবনটির সামনে বাঙালি রীতিতে উন্মুক্ত প্রাঙ্গণ ও বিশাল বাগান এবং বাগানে রয়েছে বিভিন্ন ভাস্কর্য ও ফোয়ারা। বিশেষ করে সিংহের মূর্তিগুলো নজরকাড়ে। এছাড়াও আছে রক গার্ডেন, কৃত্রিম হ্রদ।
ভিতরে রয়েছে বাঙালি রীতিতে তৈরি ঠাকুরদালান। এই মন্ডপে যেমন পূজা হত তেমনি যাত্রাপালা ও কীর্তনের আসরও বসত।
আরেকটি যে কারণে এই প্রাসাদ বিখ্যাত সেটি হোলো এই বাড়ির উদ্যানেই গড়ে উঠেছিল ভারতের প্রথম চিড়িয়াখানা। আলিপুর চিড়িয়াখানারও আগে। রাজা রাজেন্দ্র মল্লিক তাঁর স্ত্রীর আবদারে এই চিড়িয়াখানা তৈরী করেন।
এই বাগানে এখনো একটি ছোট চিড়িয়াখানা রয়েছে।১৮৭৮ সালে আলিপুর চিড়িয়াখানা তৈরী হলে উনি নিজের ব্যক্তিগত সংগ্রহ থেকে প্রচুর পশু ও পাখী দান করেন। তাদের চিড়িয়াখানার ভিতরে মল্লিক হাউজ বলে একটি জায়গায় রাখা হয়েছিল।
তবে এখনো চিড়িয়াখানায় দশর্করা দেখতে পাবেন ময়ূর, বিভিন্ন প্রজাতির বুনো হাঁস, Malabar pied hornbil (মালাবার ধনেশ), Golden pheasant (সোনালী ফেজেন্ট), Four horned antelope (chowsingha) চৌশিঙ্গা মৃগ হরিণ,Spotted deer (চিতল হরিণ),Golden pheasant (সোনালী ফেজেন্ট), Dove (ঘুঘু),Ring neck parakeet, Moustache parakeet (মদনা তোতা), Lady amharst pheasant.
চলচ্চিত্রের সঙ্গে জড়িত ইতিহাস
উত্তমকুমার এই বাড়িতেই দিনের পর দিন শ্যুট করেছিলেন। উত্তম-সুমিত্রা দেবী, ছবি বিশ্বাস, ছায়া দেবী অভিনীত ‘সাহেব বিবি গোলাম’ ছবির শ্যুট এই বাড়িতেই হয়। স্বর্ণযুগের বাংলা ছবি যেগুলো রাজা জমিদারদের নিয়ে সেগুলোর অনেক শ্যুটিং এই বাড়িতে হয়েছে।
মিঠু মুখার্জ্জী, রঞ্জিত মল্লিক অভিনীত ‘স্বয়ংসিদ্ধা’ ছবির শ্যুট এই বাড়ির চিড়িয়াখানায় হয়। মান্না দে-র একটা গান ছিল ‘কিচিমিচি কিচিমিচি’ রঞ্জিত মল্লিকের লিপে পাখি হরিন ময়ূর দের সঙ্গে গানটা ছিল। সঙ্গে ছিলেন ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় রত্না ঘোষালরা।
এছাড়াও মিঠু মুখার্জ্জী যখন বিয়ের পর ঘোড়ার গাড়ী করে এসে যে বিশাল দরজা দিয়ে ঢুকবেন সেটাও এই বাড়িতেও শ্যুট আরও অনেক দৃশ্য।
ঠিকানা
৪৬ মুক্তারাম বাবু স্ট্রীট, জোড়াসাঁকো, কলকাতা -৭০০০০৭
"মহাত্মা গান্ধী রোড মেট্রো স্টেশন এবং গিরিশ পার্ক মেট্রো স্টেশনের মাঝে 'রাম মন্দিরের' ঠিক উল্টো দিকের রাস্তা ধরে ১ মিনিটের হাটা পথ"।
প্রয়োজনীয় কিছু তথ্য
মার্বেল প্যালেস (মল্লিক বাড়ি) কিন্তু এখনো ব্যক্তিগত সম্পত্তি, এটি পশ্চিবঙ্গ সরকারের সম্পত্তি নয়। রাজা রাজেন্দ্র মল্লিক বাহাদুরের উত্তরাধিকারীরা এখনো এই প্রাসাদে বাস করছেন। এর রক্ষনা বেক্ষন ও করছেন রাজা রাজেন্দ্র মল্লিক বাহাদুরের উত্তরাধিকারীরা।
নিয়ম অনুযায়ী দর্শনার্থীদের ২৪ ঘণ্টা আগে পশ্চিম বঙ্গের ট্যুরিজম ইনফরমেশন ব্যুরোর বি.বি.দি বাগের অফিস থেকে অনুমতি নিতে হয় (কোনো প্রবেশ মূল্য লাগে না)।
তবে সেখান থেকে অনুমতি না আনলেও অসুবিধা নেই, গেটের সিকিউরিটি গার্ড কে এবং ভেতরের গাইড কে সামান্য কিছু পয়সা দিলেই প্রবেশে আর কোনো বাধা থাকে না।
তবে যাওয়ার সময় সঙ্গে করে আধার কার্ড বা ভোটার আইডেন্টিটি কার্ড নিয়ে যেতে ভুলবেন না। আপনার পরিচয় পত্র না দেখে গার্ড ভেতরে প্রবেশ করতে দেবে না।
সোমবার এবং বৃহস্পতিবার ছাড়া এই প্যালেস সকাল ১০ টা থেকে বিকাল ৪ টে পর্যন্ত খোলা থাকে। তবে জাতীয় ছুটির দিন গুলো তে এই প্যালেস বন্ধ থাকে।
প্যালেসের ভেতরে ছবি তোলা বারন। প্যালেসের বাইরে অর্থাৎ বাগানে বেড়িয়ে অল্প বিস্তর ছবি তোলা যায় (তবে সিকিউরিটি দেখলে ছবি তুলতে মানা করে)।
বিঃদ্রঃ
যেহেতু ছবি তোলার অনুমতি নেই, তাই কিছু আমার তোলা ছবি দিলাম এবং বেশির ভাগটাই Google থেকে download করে দিলাম।
Name- PULAKESH DEBNATH
Profession- PRIVATE SERVICE
City- KOLKATA
Hobbies- TRAVELLING & PHOTOGRAPHY
Previous Tours- DHANBAD, DARJEELING