Tripsee Treks  and Tours LLP
Blog and Travel with Us

মৌসুনি ভ্রমণ



Kishan Paul Kishan Paul

প্রস্তাবটি রাখা হয়েছিল আমাদের সান্দাকফু ট্রেকিং-এর শেষ দিনেই - "অনেক তো পাহাড় হলো, এবার একটু সমুদ্র হোক।"  সেই প্রস্তাবকে বাস্তবায়িত করতে আমাদের সময় লাগল চার মাস, মাত্র চার মাস। সমুদ্র বললেই আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে পুরী, দীঘা, তাজপুর, নিদেনপক্ষে বকখালি। কিন্তু এই সমস্ত সমুদ্রসৈকত প্রায় সারাবছরই পর্যটকদের কোলাহলে গমগম করে। আমরা চাইছিলাম, একটু নিরিবিলিতে কাটাবো দুটো দিন। উপরোক্ত কোনোটিতেই সেটা সম্ভব নয়। তাই একটু খোঁজখবর নিতে একটাই নাম বারংবার পাওয়া গেল - 'মৌসুনি দ্বীপ', পশ্চিমবঙ্গের ভার্জিন আইল্যান্ড। অবশ্য নাম শোনার পর থেকে প্ল্যানিং-এর পরিবর্তে স্বপ্ন দেখতে শুরু করলাম,কারণ প্ল্যানিং-এর জন্য আমাদের অতনু স্যার আছেন।এই মানুষটি আছেন বলেই এত ঘোরাঘুরি সম্ভব হয়। হোটেল, পরিবহন, খাওয়াদাওয়া সম্পর্কিত যাবতীয় প্ল্যানিং স্যার করে রাখেন, তাই আমরাও প্রতিবারই নিশ্চিন্ত মনে ঘুরতে বেরিয়ে যাই।কিন্তু এবার পরিস্থিতি অন্যরকম ছিল, প্রধানত একটাই বিষয় আমাদের সবাইকে ভাবিয়ে তুলেছিল সেটি হল তারিখ। 'তারিখ পে তারিখ, তারিখ পে তারিখের' পর,রীতিমতো মিটিং করে আমাদের এবারের মৌসুনি অভিযানের তারিখ ঠিক হল ২২শে ফেব্রুয়ারি,শনিবার। প্ল্যান হল সেইদিন রাতে মৌসুনিতে থেকে, পরেরদিন আবার কলকাতায় ফেরা।

​ছোটোবেলায় পড়েছিলাম সাত-এ সমুদ্র। আক্ষরিক অর্থেই আমরা সাতজন চলেছি এবার সমুদ্র দর্শনে। অতনু স্যার, বিপ্লব স্যার,কুন্দন স্যার, অভিজিৎ স্যার, অরিন্দম স্যার, মেফতাহুলদা আর আমি। পূর্বপরিকল্পনামত ২২ তারিখ ভোর পাঁচটায় ঘুম থেকে উঠে,রেডি হয়ে সকাল ৭টার মধ্যে পৌঁছে গেলাম যাদবপুর স্টেশনে।ঠিক ছিল, এখান থেকে নামখানা লোকালের ৬ নং বগিতে সকলে উঠবো নিজেদের সুবিধামত কাছাকাছি স্টেশন থেকে। যাদবপুর পৌঁছাতেই দেখা হয়ে গেল কুন্দন স্যারের সাথে।চা খেতে খেতে চোখ গেল অনতিদূরের এক শিমুলগাছে, টকটকে রক্তিমবর্ণের থোকা থোকা শিমুল ফুল ফুটে আছে,কেমন একটা মন ভালো করে দেওয়া অনুভূতি হল। হাতে বেশ কিছুক্ষণ সময় ছিল,তাই আমরা দুজন পরের ট্রেন ধরে গড়িয়া স্টেশনে পৌঁছালাম। সেখানে দেখা হল অতনু স্যার, বিপ্লব স্যার, অরিন্দম স্যারের সাথে। মেফতাহুলদা পার্কসার্কাস থেকে ট্রেনে উঠে পড়েছে ইতিমধ্যে। শিয়ালদহ থেকে সকাল ৭টা ১৪-এর নামখানা লোকাল গড়িয়া স্টেশনে পৌঁছাল পৌনে আটটা নাগাদ। ভেবেছিলাম শনিবার বলে ভীড় কম হবে৷ কিন্তু ট্রেনে উঠেই বুঝতে পারলাম আজ আর বসার সৌভাগ্য হবে না। প্রায় একপ্রকার বাদুড়ঝোলা হয়েই থাকলাম। ইতিমধ্যে অভিজিৎ স্যার সোনারপুর স্টেশন থেকে উঠে পড়েছেন। সাতজনে একজায়গায় হয়েছি, কোন ভীড় আমাদের থামায়? ঝুলন্ত অবস্থাতেই চলতে লাগল আমাদের হাসিঠাট্টা। ভীড় ক্রমশ অগভীর হতে থাকল, আর হাসি-ঠাট্টা-মজা করতে করতে আমরা নামখানা পৌঁছে গেলাম ১০টার মধ্যে। স্টেশনের বাইরে এসে একটা টোটো ভাড়া করে সাতজনে রওনা দিলাম হুজ্জুতের ঘাটের উদ্দেশ্যে। ইতিমধ্যে পেটে ছুঁচো ডনবৈঠক দিতে শুরু করেছে। হাতানিয়া-দোয়ানিয়া ব্রিজ পেরিয়েই একটি মিষ্টির দোকান চোখে পড়ল। সেখানে টোটো থামিয়ে প্রাতঃরাশ সারলাম। সেই অনামী দোকানের পেটাই পরোটা আর কুমড়োর তরকারি হয়ত আমার খাওয়া অন্যতম সেরা খাবারগুলির মধ্যে একটা হয়ে থাকবে। এরপর এল রসমালাইয়ের পালা,সেটাও খেলাম চেটেপুটেই । পেটপুরে খাওয়ার পরে, টোটোয় উঠে আবার আমাদের যাত্রা শুরু হল। সবুজগাছের ছায়াঘেরা রাস্তায় প্রায় ৩০ মিনিট যাওয়ার পর আমরা পৌঁছে গেলাম হুজ্জুতের ঘাটে। কিন্তু সেখানে পৌঁছাতেই আমাদের চক্ষু চড়কগাছ। প্রায় ২০০ জনের লাইন ফেরিঘাট অবধি, কারণ এখানে মাত্র দুটি ভুটভুটি নৌকা খেয়া পারাপার করে। আর একটি নৌকা অবশ্য আছে, কিন্তু সেটায় শুধুমাত্র বাইক পারাপার হয়। একজনের থেকে জানা গেল, মোটামুটি এক-দেড় ঘণ্টা লাগবে ভুটভুটিতে উঠতে। চড়া রোদে আমরা পালা করে লাইন দিতে থাকলাম, আর নিমেষের মধ্যে শেষ হতে থাকল ডাব, কোল্ডড্রিংকসের বোতল। অবশেষে প্রায় একঘণ্টা পর, নৌকায় চড়ার সৌভাগ্য হল।হুজ্জুতের ঘাট থেকে চিনাই নদী পেরিয়ে অন্যদিকের ঘাটে সময় লাগল মিনিট দশেক। নৌকা থেকে নেমে আবার টোটো ধরতে হল আমাদের গন্তব্যস্থলে পৌঁছানোর জন্য।

আঁকাবাঁকা মেঠোপথ দিয়ে আমাদের টোটো নদীর থেকে ক্রমশ দূরে সরতে লাগল এবং আমরাও গ্রামবাংলার পল্লীজীবনের সাক্ষী হয়ে একটু একটু করে এগোতে লাগলাম রত্নাকরের দিকে। বসুন্ধরা যেন তার সমস্ত সৌন্দর্য আমাদের রাস্তার দুপাশে ছড়িয়ে দিয়েছে। কোথাও শান্ত-শীতল, ছায়া-সুনিবিড় পুকুরের পাশ দিয়ে গ্রাম্যবধূ গরু নিয়ে চলেছে, কোথাও বা গ্রাম্যচাষী প্রখর রৌদ্রে জমিতে ধান রুইছে। দেখতে পেলাম মাটির দোতলা বাড়ির, ধানের গোলার, সবজি বাগানের এবং সদ্য মাটি থেকে মাথা বের করা কচি ধানগাছের। তন্ময় হয়ে আমরা চারিদিকে দেখতে লাগলাম,আর চলন্ত অবস্থায় যতটুকু পারা যায় ছবির মত সুন্দর গ্রামটিকে ক্যামেরাবন্দী করতে লাগলাম। মিনিট ২০ পর, টোটো থেকে নেমে বালিময় রাস্তা দিয়ে আরও কিছুটা হেঁটে অবশেষে আমরা পৌঁছালাম আমাদের ক্যাম্পে। বেশ অনেকটা জায়গা জুড়ে ছোটো, বড়, মাঝারি সাইজের অনেকগুলো তাঁবু খাটানো আছে, আর একদিকে রয়েছে পরপর ৩টি ঘর, তার পাশেই রান্নাঘর এবং কমন বাথরুম। আমাদের জন্য একটি ঘর এবং একটি তাঁবু ঠিক করা ছিল। ক্যাম্পে প্রবেশ করেই চলে গেলাম তাঁবুর ভিতরে। তোফা ব্যবস্থা করা ভিতরে, চারজনের শোয়ার জায়গা, তার সাথে একটি টেবিল-ফ্যান রয়েছে,আলো আছে, ফোন চার্জ করার জন্যও একটি সুইচবোর্ড আছে। সবেমাত্র বসেছি কি বসিনি, একজন ডাবের জল নিয়ে এসে হাজির।

এটি এখানকার প্রায় সব তাঁবুরই বিশেষত্ব, আপনি এখানে পা দেওয়ামাত্রই আপনাকে ওয়েলকাম ড্রিংকস হিসেবে একটি প্রমাণ সাইজের ডাব দেওয়া হবে। আমাদেরও প্রত্যেককে ডাব দেওয়া হল।প্রচণ্ড তেষ্টা পেয়েছিল,তাই প্রায় একচুমুকে ডাবটিকে নিঃশেষ করে দিলাম। এরপর মনে ইচ্ছা জাগলো সমুদ্রে গিয়ে স্নান করার, কিন্তু আমাদের দেখাশোনার দায়িত্বে যে দাদা ছিলেন, তার কাছ থেকে খবর পাওয়া গেল এখন ভাঁটা চলছে, তাই এখন সমুদ্রে স্নান করা যাবেনা। শুনে একটু মন খারাপ হয়ে গেল। সবারই প্রচণ্ড খিদেও পেয়েছিল, তাই ঠিক করা হল সবাই এক এক করে স্নান সেরে নিয়ে আগে আমরা দুপুরের খাওয়া সেরে নেবো। স্নান সেরে খাওয়ার টেবিলে বসতেই চক্ষু চড়কগাছ। খাওয়াদাওয়ার এলাহি আয়োজন,মেনুতে আছে ভাত, ডাল, আলু ভাজা, স্যালাড, একটা সবজি তরকারি, চিংড়ির মালাইকারী, কাতলা কালিয়া আর পাপড় ভাজা। একে এতটা সফর করে এসেছি, তার উপর এরকম লোভনীয় আর সুস্বাদু খাবার।তাই পেট ভরে খাওয়ার পরই মনটা কেমন ঘুম ঘুম করতে লাগল।, নিলাম একরাউণ্ড ঘুমিয়ে। ৪টে নাগাদ ঘুম থেকে উঠে বাইরে আসতেই চোখে পড়ল বিরাট বিরাট ঝাউগাছের উপর দিনের শেষ আলোকবিন্দু মাখিয়ে বিদায় নিচ্ছেন সূর্যদেব। একটা জুতো গলিয়ে তড়িঘড়ি চলে এলাম সমুদ্রসৈকতে। প্রসঙ্গত বলে রাখা ভালো, আমাদের ক্যাম্পটি একদম সমুদ্রসৈকত লাগোয়াই। সমুদ্রসৈকতে তখন চলছে পড়ন্ত বিকেলের আলোর নানান খেলা। রক্তমুখী সূর্য সমুদ্র তীরবর্তী প্রতিটি বালুকণাকে সোনালী আভায় রাঙিয়ে নিজে বিদায় নিচ্ছে। আশেপাশে অনেক নৌকা নোঙর ফেলে শান্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, আর সমুদ্রের জল সেই নৌকাগুলির পায়ের নিচে গড়াগড়ি দিয়ে তাদের অশান্ত করার বৃথা চেষ্টা করছে। সমুদ্রের ঢেউয়ের কলতান,বালুকাবেলায় সূর্যের স্তিমিত রঙিন আভা, দূরবর্তী ঝাউগাছগুলি থেকে ভেসে আসা ঝিরিঝিরি হাওয়া পারিপার্শ্বিক পরিবেশকে মোহময়ী করে তুলেছিল, যা ভাষায় বর্ণনা করার ক্ষমতা আমার নেই।

কিছুক্ষণ একজায়গায় চুপ করে দাঁড়িয়ে গোটা পরিবেশের রসাস্বাদন করলাম, এরপর হাঁটা লাগালাম সমুদ্রসৈকত বরাবর। চারপাশের মুহূর্তগুলিকে যতটুকু সম্ভব ক্যামেরাবন্দী করে, আবার যখন ফেরার রাস্তা ধরলাম, সূর্য রক্তিম থেকে রক্তিমতর হতে হতে একসময় টুপ করে দিগন্তরেখার মাঝখান থেকেই উধাও হয়ে গেল। এরপর আমরা ক্যাম্পে ফিরে এসে দেখি, উঠোনের ঠিক মাঝ বরাবর জায়গায় চিকেন বারবিকিউয়ের আয়োজন করা হয়েছে। এক্ষেত্রে বলে নেওয়া দরকার প্যাকেজে কিন্তু বারবিকিউয়ের খরচ অন্তর্ভুক্ত থাকে না,আপনাকে ওখানে গিয়ে এ ব্যাপারে আলাদাভাবে কথা বলতে হবে৷ আমাদের আগে থেকেই বলা ছিল, তাই সেইমত চিকেন বারবিকিউয়ের ব্যবস্থা করা হয়েছিল কর্তৃপক্ষের তরফ থেকে। লকলকে আগুনের শিখার উপর তারজালি দিয়ে চিকেন বারবিকিউ হতে থাকল, আর আমরা সেই কৃত্রিম উনুনের চারপাশে গোল হয়ে বসে আগুনের উত্তাপ নিতে নিতে গল্পে মশগুল হয়ে উঠলাম। প্রায় একঘণ্টা পর বারবিকিউ সম্পন্ন হলে আমরা আয়েশ করে কেউ টেবিলে বসে, কেউ কেউ আবার হ্যামকে শুয়ে সমুদ্রের ঢেউয়ের আওয়াজ শুনতে শুনতে ঝলসানো চিকেনকে উদরস্থ করতে লাগলাম। খাওয়া শেষে আবার একদফা সমুদ্রের ধার বরাবর হাঁটতে বের হলাম সকলে মিলে। কিন্তু বিকেলের সমুদ্রের সাথে এই সমুদ্রের আকাশ পাতাল তফাৎ। যেদিকে চোখ যায়, নিকষ কালো অন্ধকার, তারই মধ্যে ঢেউয়ের কলতান বদলে গেছে এখন গর্জনে।উথাল-পাতাল ঢেউগুলি  জোয়ারের আগমনী বার্তা দিচ্ছে। মৌসুনী দ্বীপের তটরেখা প্রায় সমতল এবং অনেকখানি বিস্তৃত। তাই আমরা এবার হাঁটতে শুরু করলাম সমুদ্রের ধার ঘেঁসে। অনেকদূরে মাঝেমধ্যে মাছধরা নৌকাগুলির আলো চোখে পড়তে লাগল, আবার পরেক্ষণেই যেন সেগুলি অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। আলো-আঁধারির এই খেলার মাঝে খেয়াল হল, সমুদ্রের জল এসে পায়ের পাতা ভিজিয়ে যাচ্ছে। এরই মাঝে মোবাইলের টর্চ জ্বেলে কুড়িয়ে নিতে থাকলাম ঝিনুক, দেখা মিলল বিভিন্ন আকারের কাঁকড়ারও। যখন ফিরে আসছি,দেখলাম জ্যান্ত ইলিশ মাছ, সবেমাত্র সমুদ্র থেকে তোলা, আর আঁশগুলি হালকা নীলবর্ণের। প্রায় একঘণ্টা হাঁটাহাঁটি করে ক্যাম্পে ফিরে এলাম। সারাদিনের ধকলে ক্লান্তবোধ করছিলাম। তাই চটপট রুটি আর মাংস সহযোগে রাতের খাওয়া শেষ করে তাঁবুর মধ্যে চলে গেলাম। সমুদ্রের তর্জন-গর্জন শুনতে শুনতে কখন যে চোখের পাতা ভারী হয়ে এসেছে, খেয়াল নেই।

পরদিন ঘুম ভাঙলো বেশ সকালেই, মোবাইলে দেখলাম সাড়ে পাঁচটা বাজছে। ইচ্ছা ছিল, সূর্যোদয় দেখবো। তাই চটপট করে রেডি হয়ে চলে এলাম সমুদ্রের পাড়ে, আকাশ আলোয় আলোকিত হলেও, তখনও সূর্যকে আমরা দেখতে পাইনি । এরমধ্যেই জল অনেকটা দূরে সরে গেছে।আমাদের মধ্যে অভিজিৎ স্যার সবথেকে ফিট। ওনার তত্ত্বাবধানে পাড় বরাবর দৌড়ানো শুরু করলাম, উদ্দেশ্য কালকের গুরুপাক হজম করা। কিন্তু বালির উপর, স্লিপার জুতো পরে এরকম একটা বেঢপ ভুঁড়ি নিয়ে কাঁহাতক আর দৌড়ানো যায়? তাই হাল ছেড়ে দিলাম। দৌড়ানো ছেড়ে তাই শুরু করলাম হাঁটা। একটুখানি যাওয়ার পর, জুতোজোড়াকে হাতে নিয়ে ভেজা বালির উপর দিয়ে হাঁটতে শুরু করলাম। অদ্ভুত সুন্দর সেই অনুভূতি, বেশকিছুটা এগিয়ে গিয়ে পিছনে তাকাতেই দেখতে পাই নিজেরই পদচিহ্ন । ক্রমে সূর্যদেব ঝাউবনের ফাঁকফোকর দিয়ে মূর্তিমান হলেন পূব আকাশে, কিন্তু ততক্ষণে সূর্যের রক্তিমবর্ণ উধাও হয়েছে। আমরা অনেকক্ষণ হাঁটাহাঁটি করলাম, আমাদের মত আরও অনেকেই দেখলাম হাঁটছে, গল্প করছে, ফুরফুরে হাওয়া উপভোগ করছে। অবশ্য এই সাতসকালেও খাওয়া কোনো কমতি ছিল না আমাদের। টাটকা খেজুরের রস, ডাবের জল, চা, বিস্কুট, কেক সবই মুখের ভিতর চালান হতে লাগল। এরপর কিছুক্ষণ বালির উপর নাম খোদাই করার বৃথা চেষ্টা করে আমরা হাঁটা লাগালাম ক্যাম্পের দিকে। ক্যাম্পে ফিরে দেখি, প্রাতঃরাশ তৈরি। গরম-গরম ফুলকো লুচি আর ধোঁয়াওঠা আলুর তরকারী, সাথে একটা করে সিদ্ধ ডিম। প্রত্যেকে কটা করে যে লুচি খেলাম তার হিসাব রাখা অপ্রয়োজনীয়, বলাই বাহুল্য। জলখাবারের পালা সাঙ্গ করে দলবেঁধে বেরোলাম গ্রাম্যপরিবেশের সাথে যোগসূত্র স্থাপন করতে। আঁকাবাকা মাটির রাস্তা দিয়ে গ্রামে প্রবেশ করলাম, প্রাচীন গ্রামবাংলার আদি ও অকৃত্রিম সৌন্দর্য উন্মুক্ত হয়ে আমাদের সামনে ধরা দিল। দুপাশে বড় বড় পুকুর, পুকুরে মরাল-মরালীর বিচরণ, তাদের প্যাঁকপ্যাঁক ধ্বনি, দিগন্তবিস্তৃত চাষের জমি, আলের পাশে কচুপাতার উপর তখনও থেকে যাওয়া শিশিরবিন্দু বারংবার আমাদের মনে করিয়ে দিল, শহরাঞ্চলে বাস করে আমরা প্রকৃতি থেকে কত দূরে চলে যাচ্ছি ক্রমশ। এরপর ফিরতি পথে আবার সমুদ্রসৈকতের রাস্তা ধরলাম। সেখান পৌঁছে কিছুক্ষণ দেদার ফটো তোলা হল। কখনো সমুদ্রের দিকে মুখ করে, কখনো দুহাত তুলে, কখনো বালির মধ্যে লাফিয়ে। কিন্তু রৌদ্রের তেজ বাড়তে থাকায় কিছুক্ষণের মধ্যেই আমাদের বাধ্য হয়ে ক্যাম্পে ফিরে আসতে হল। ক্যাম্পে ফিরে স্নান-খাওয়া সেরে যখন আমরা মৌসুনি ছেড়ে বিদায় নিচ্ছি, ঘড়িতে দুপুর দেড়টা বাজছে। এবার মনখারাপের পালা। এই দুদিনেই এই ছোট্ট দ্বীপটি নিজের অপার্থিব সৌন্দর্য আমাদের সামনে উজাড় করে দিয়েছিল, আমরাও তার যথাযথ রসাস্বাদন করেছি। কিন্তু কালের ও কাজের অমোঘ নিয়মে আমরাও আমাদের বাসস্থান আর কর্মস্থলে ফিরতে বাধ্য। অগত্যা চোখের জলেও না হলে মন ভারী করে টোটোয় চেপে বসলাম।ফিরতি পথে হুজ্জুতের ঘাটে না গিয়ে আমরা এলাম বাঘডাঙা ঘাটে। নদী পার হয়ে দেখা মিললো বেশ খানিকটা অঞ্চল জুড়ে ছড়িয়ে থাকা ম্যানগ্রোভ অরণ্যের। শেষবারের মত দেখে নিলাম প্রিয় মৌসুনিকে, মনে মনে বললাম, 'মানুষ চলে যায়,বোধহয় আবার ফিরে আসার জন্যই। এ দেখাই শেষ দেখা নয়, শীঘ্রই দেখা হবে।'

Meet the Blogger

Kishan Paul


নাম - কিশান পাল
পেশা - কলেজের অধ্যাপক
নিবাস - কলকাতার টালিগঞ্জ
ঘুরেছি এখনও অবধি - পুরুলিয়ার অযোধ্যা পাহাড়, বাঁকুড়া-বিষ্ণুপুর, সুন্দরবন, শান্তিনিকেতন, ঘাটশিলা, সান্দাকফু,ধোত্রে, টংলু, উত্তরপ্রদেশের বেনারস, ওড়িশার দারিংবাড়ি।
শখ - অবশ্যই ঘুরে বেড়ানো,ছবি তোলা, বই পড়া, গান শোনা



You may also like