Tripsee Treks  and Tours LLP
Blog and Travel with Us

রূপের কুন্ডে ডুব



Dweep Saha Dweep Saha

" বাঙালির পাহাড়ের যে কি নেশা বুঝিনা উঁচু জায়গা ভালো  লাগলে তালগাছে চড়ে বসে ঠান্ডা ভালো লাগলে বরফ জড়িয়ে শুয়ে থাকে, পাহাড়ে কষ্ট করে কেন যে যাওয়া বুঝি না বাবা..."

ট্রেকিং জিনিসটা খুব অদ্ভুত , যখন যাই হাটতে হাটতে যখন পা হাটু ব্যথা হয় এবং তখন মনে হয়ে কেন যে এলাম আর এসব না এই শেষ , কিন্তু ওই পাহাড়ের ঠান্ডা হাওয়ার শিরশিরানি আর ভোরের সূর্যের মনমোহিনী রূপের মোহে যে একবার ফেঁসেছে তার পক্ষে সেই নেশা কাটিয়ে বেরিয়ে আসা খুব শক্ত | তাই একটা ঘোরা শেষ হতে না হতে আর একটা  ঘুরতে যাওয়ার প্ল্যান তৈরী হওয়া শুরু হয় | ২০১৭ জুন মাসের গরমে যখন কলকাতাবাসীর প্রাণ ওষ্ঠাগত তখন একদিন হটাৎ গিন্নি বলে বসলো আর সহ্য হচ্ছে না পাহাড়টা যেতেই হবে এবার |রূপকুন্ড লেক বা স্কেলেটন লেক ট্রেকের নাম অনেকবার শুনেছি মনেও ইচ্ছা ছিল যাওয়ার, কিন্তু হয়ে ওঠেনি | প্রধানত দুটো কারণ ট্রেক টা হাই অল্টিটিউড এবং রূপকুন্ড যাওয়ার জন্য খোলা থাকে বছরে ৩-৪ মাস , মে-জুন এবং সেপ্টেম্বর-অক্টোবর | তাই জুন মাসে পরিকল্পনা করতে বসলেও ঠিক হলো আমরা অক্টোবর এ যাব পুজোর পর , কারণ রূপকুন্ড ট্রেক যাওয়ার আগে কিছু শারীরিক ফিটনেসের জন্য প্রস্তুতি নেয়াটা প্রয়োজন | যাওয়ার জন্য যোগাযোগ করলাম পূর্ব পরিচিত ট্রেককিং অর্গানাইজার হিমালয় ট্রেকারস এর কর্ণধার সপ্তর্ষি রায়ের সাথে | সপ্তর্ষিদার পরামর্শ মতো আমরা শুরু করলাম প্রতি সপ্তাহে নিয়ম করে ২-৩ বার ময়দানে গিয়ে ফ্রীহ্যান্ড ব্যায়াম আর অল্পবিস্তর দৌড়োদৌড়ি শুরু করলাম | ওই যে আগেই বলেছি বাঙালিরা বেসিক্যালি ল্যাদখোর কিন্তু পাহাড়ে যাওয়ার নামে উৎসাহ কোথা যে এসে যায় কেউ জানে না |

দিলওয়ালও কি দিল্লি

ইতিমধ্যে বাকি প্রস্তুতি আর শপিং চলতে চলতে লক্ষ্মীপুজোও চলে গেলো আর আমাদের আখাঙ্খিত সময় এসে গেলো দিল্লি যাওয়ার  | সকালে রাজধানী থেকে নামার পর যে কয়েকঘন্টা সময় হাতে বেঁচে রইলো রাতের হল্দওয়ানির বাস ছাড়ার জন্য সেটার সদ্ব্যাবহার করতে আমরা চলে গেলাম পুরানো দিল্লির জামা মসজিদ অঞ্চলে | রাবড়ি পরাঠা মির্চি পরাঠা দিয়ে শুরু করে কারীমের কাবাব কোনোটাই বাদ দিলাম না| বাসে ওঠার আগে দিল্লি স্পেশাল পেট পুজো শেষ করলাম দিল্লির বিখ্যাত সুজির গোলগাপ্পা দিয়ে |

আনন্দবিহার বাস টার্মিনাল থেকে ভলভো বসে শুরু হলো আমাদের যাত্রা হল্দওয়ানি হয়ে কাঠগোদাম | রাতে পাঞ্জাবি  ধাবায় রাতের নৈশভোজ সেরে এক ঘুমে আমরা পৌছালাম ভোর ৫টা নাগাদ হল্দওয়ানি বাস স্টপে | ওখান থেকে ৫ কিমি দূরে কাঠগোদাম যাওয়ার জন্য অটো দাঁড়িয়ে থাকে হল্দওয়ানি বাসস্ট্যান্ডে | কাঠগোদাম স্টেশনে প্রাতঃকৃত্য সেরে বেরিয়ে স্টেশনের পিছনের প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখে সারা রাতের ক্লান্তি জুড়িয়ে গেলো | স্টেশনের পিছনেই অনুচ্চ কিছু টিলা যেন হিমালয়ের কোলে আসার জন্য হাতছানি দিচ্ছে | স্টেশনের মনোরম পরিবেশে ডুবে সকালের চা বিস্কুট খেয়ে কিছুটা সময় কাটিয়ে , সপ্তর্ষিদার দেয়া গাড়ির ড্রাইভারের নম্বরটাতে কল লাগাতেই ড্রাইভার ভদ্রলোক দেখি গেটের সামনেই দাঁড়িয়ে আছেন |

 

লোহাতে লাগেনি জং

মোটামুটি আধঘন্টার মধ্যে বাকি সব পর্বতপ্রেমীর দল এসে হাজির| আর এক কাপ চা সিগারেটে সবার সাথে আলাপ সেরে বাসে উঠে দীর্ঘ দুশো কুড়ি কিমি  পাহাড়ি যাত্রা শুরু হলো লোহারজুঙের উদ্দেশ্যে। যেখান থেকে আমাদের আগামী ৬ দিনের যাযাবর জীবনের সূচনা| কৌশানি পার হয়ে একটা জায়গায় ছোট একটা পাহাড়ি রেস্তোরায় আমাদের দুপুরের খাবার জায়গা হলো | খাবার স্বাদ কেমন সেটা উল্লেখ্য নয় কিন্তু পাহাড়ের ঢালে বসে ডিম্ ভাজা,ডাল ভাত যেন অমৃত | যাই হোক খাবার খেয়ে হালকা বাবা ভোলানাথের প্রসাদ খেয়ে আমেজে  আবার বাকি পথ চলা শুরু হলো| দূরে আকাশের বুকে বরফে মোরা  ত্রিশূল , নন্দাঘুন্টির  হাতছানি আমাদের উত্তরখন্ডের ভাঙা পথের ক্লান্তি যেন ভুলিয়ে রাখে পুরো দশটি ঘন্টা |

যাই হোক বিকেল ৪তে নাগাদ পৌছালাম লোহারজুঙে | বাস থেকে ব্যাগ নামাতেই ট্রেক লিডার দেব সিংহ তার দুই গাইড মহিপাল সিংহ এন্ড দিলীপ সিংহকে নিয়ে হাজির গেস্টহাউসে আমাদের স্বাগত করতে গরম চা আর পকোড়া নিয়ে| চা পকোড়া খেয়ে রুমে ফ্রেশ হয়ে  উঠে বাইরে এসে একটা ছোট সমাবেশ সারা হলো যেখানে সবার পরিচয় দিয়ে আগামী ৬ দিনের সূচি ঠিক করা হলো | মহিপাল এবং দিলীপ সিং জি আমাদের সাথে গাইড হয়ে থাকবেন আগামী ৬ দিন|নানান বয়েসের পর্বত প্রেমী এক হলে যে কিরম একটা মধুর আড্ডা বসে সেটা ঠিক বলে বোঝানো সম্ভব নয়| রাতের খাবার পরিবেশিত হতে সন্ধ্যে ৮টা | অনভ্যাস ও অনিচ্ছা সত্ত্বেও দেব সিংহের নির্দেশে আমরা তখনি খেতে বসে গেলাম কারণ আগামী ৬ দিন রাতের খাবার ৮ টার মধ্যে শেষ করে পথ চলা শুরু করতে হবে সকাল সকাল প্রতিদিন |

এখানে একটা ছোট উপদেশ নতুন পাহাড়ি যাযাবরদের জন্য ট্রেক সকাল সকাল শুরু করবেন কারণ সূর্যের আলো ঢোলে যাওয়ার পর ঠান্ডায় আর অন্ধকারে ট্রেক করা নিজেকে শাস্তি দেওয়ার সমান |

লোহারজুং জায়গার দৈব মাহাত্ম এখানে বলে রাখি ছোট্ট করে : মা সতী এখানে লোহাসুরের সঙ্গে যুদ্ধ করে তার সংহার করে  মহাদেবের সঙ্গে মিলনের জন্য রূপকুন্ডের পথে এগিয়ে গেছিলেন |

 

দিদনা কা স্বপ্না 

যাই হোক "রাত কেটে ভোর হয় পাখি জাগে বনে " আর আমাদের পথ চলার শুরু হয় সেই ক্ষনে |

পরের দিন সকালে প্রাতরাশ সেরে আমাদের পথ চলা শুরু হলো প্রথম দিনের রাত্রিযাপনের ঠিকানা এই পথের শেষ গ্রাম দিদনার  উদ্দেশ্যে | যাযাবর জীবনের শুরুর প্রথম এক ঘন্টা খুব অস্বস্তির | এই একজনের জুতোর ফিতে খুলে যাচ্ছে তো ব্যাগের স্ট্রাপটা সেট হচ্ছেনা তো আর একজনের তেষ্টায় গলা শুকিয়ে যাচ্ছে, আর একজনের জুতোতে পা ছড়ে যাচ্ছে | আমাদের সিংহের দল মানে  গাইড এবং বাকি স্টাফ যৎপর্ণাই প্রচেষ্টায় সবার অনুরোধ রেখে চলেছে | এই এর জন্য অল্টারনেট জুতোর ব্যবস্থা করে তো  ওর জন্য ভাড়ায় ওয়াকিং স্টিক  আর একজনের জন্য ভাড়ায় ফেদারের জ্যাকেটের ব্যবস্থা করে| যাই হোক আমরা আধাঘন্টা এগোতে এগোতে লোহারজং এর কংক্রিটের রাস্তা ছেড়ে ঢুকে যাই জঙ্গলের মধ্যে|

অদ্ভূত ব্যাপার হঠাৎ সবার যেন সমস্যা কমে গেলো লোকজন আরামে হেটে চলেছে নরম ঘাসে মোরা রাস্তা দিয়ে চারিদিকে পাখির গান শুনতে শুনতে | রাস্তায় পড়লো একটা ছোট পাহাড়ি ঝর্ণা যেখান থেকে পরের ৩ ঘন্টা চলার মতো খাবার জল বোতলে ভরে খরস্রোতা ঝর্ণা পেরিয়ে এগিয়ে যেতে হবে দিদনার উদ্দেশ্যে | জল ভরা তো হয়ে গেলো কিন্তু মুশকিল হলো ওই ঝর্ণা পার হওয়া নিয়ে | হটাৎ বাই উঠায় পাহাড়ে চড়তে তো চলে  এলাম  কিন্তু নড়বড়ে ছোট পাথরে পা রেখে পার হওয়াটা তো অসম্ভব |  যাই হোক ঝর্ণার মাঝে পা দিয়ে মহিপাল আর দিলীপ সিংহ ( আমাদের গাইড ) দেবদূতের মতো হাত ধরে সবাই কে পার করতে লাগলো একে একে | আমি আবার একটু বেশি পাকামো করে নিজে পার হতে গিয়ে পপাত ধরণীতল না হলেও, হাটু অবধি গেলো জলে ডুবে ও ভিজে | ধুত্তেরি কি জ্বালা আরো তো ৫ দিন বাকি ট্রেকের , জুতো না শুকোলে চাপের ব্যাপার | যাই হোক ভিজে পায়ে জঙ্গলি পাহাড়ি রাস্তা দিয়ে এগোতে এগোতে দুপুর নাগাদ এসে পৌছালাম দিদনাতে , আজকের রাতের ঠিকানা |

দিদনাই শেষ ট্রেকের রাত যেখানে ঘরে বিছানাতে থাকার ব্যবস্থা আছে তার পর থেকে পুরোটাই তাবু আর স্লিপিং ব্যাগ | তাই বাঙালি বুদ্ধি লাগিয়ে ঠিক করে একটা বিছানার ব্যবস্থা করে বাইরে এসে জুতো শুকোতে দিতে দিতে দেখি লাঞ্চ তৈরী| গরম ভাত ডাল আর পাহাড়ি শাগের যে এতো স্বাদ লুকিয়ে থাকতে পারে সেটা এই পাহাড়ে এসে না খেলে বোধহয় বুঝতেও পারতাম না কোনোদিন| লাঞ্চ শেষে রোদ পোহাতে পোহাতে ট্রেকারদের আড্ডা বসলো। সবার নিজের ঝুলির অভিজ্ঞতা বের করে | সঙ্গে ছিলেন অনেক অভিজ্ঞ ট্রেকার যাদের অভিজ্ঞতা শুনতে শুনতে যে কখন সূর্য ঢোলে পড়েছে পশ্চিম পাহাড়ে খেয়াল করিনি| খেয়াল হলো দিলীপ সিংহের চা পাকোড়ার ডাকে | বিকেল ৫ টার সূর্যের রূপ যে কীরকম মায়াবী খেলা দেখতে পারে সেটা ছবি দেখে বিচার করা খুব মুশকিল তাও আবার আমার মতো আনাড়ির হাতে ক্যামেরা আর বাদরের গলায়……যাগ্গে বললাম না আর |

ভয়ের ব্যাপারটা তখন বুঝলাম যখন দিদনা ঘরের পিছনের বড়ো পাহাড়টার মাথার একদম ওপরের দিকে আঙ্গুল তুলে মহিপাল সিংহ বললেন ওই যে ঘাসজমিটা দেখা যাচ্ছে তার ওপরে উঠে আরো ৭কিমি যেতে হবে | শুনেই তো আত্মারাম খাঁচাছাড়া | পুরো রাস্তাটা ৭কি মি সিধা চড়াই, উৎরাইয়ের নামগন্ধ নেই | যাগ্গে কি আর করা যাবে ,পড়েছি যবনের হাতে খানা খেতে হবে সাথে | 

ট্রেকের প্রথম দিন যখন সন্ধে নামে হটাৎ মনে হয় কিছুই করার নেই | স্মার্ট ফোনটাও কিরাম বোকা ফোন হয়ে গেছে | কিন্তু মজাটা হলো কিছুক্ষন পরেই যখন তারার ঢল নামে আকাশে আর অন্ধকার পাহাড়টা মনোরম আলোয় ভোরে যায়, তখন মনে হয়  চুলোয় যাক ৪জি ইন্টারনেট, বেঁচে থাক আমাদের রাতপরীদের (ঝি ঝি পোকার ) গান | ট্রেকের রাত খুব তাড়াতাড়ি হয়, শহর যখন কৃত্তিম আলোতে ঝকমক করছে তখন চাঁদের আলোয় পাহাড়ের জঙ্গলে রাত ঢলে পরে | ৭:৩০ টা নাগাদ রুটি সবজি খেয়ে গা এলাতেই চোখে রাজ্যের ঘুম জড়িয়ে এলো |

এমনি তে আমি ঘুম থেকে জীবনে মাধ্যমিকের অংক পরীক্ষা ছাড়া কোনোদিনও সকালে উঠিনি, তো মনে একটা ভয় থেকেই যায় ট্রেকের সময়ে সকালে ওঠা নিয়ে | তো যাই হোক সকালবেলা রোদ উঠে যাওয়ার পর ঘুম ভেঙে হটাৎ দেখি আমি একা শুয়ে স্লিপিং ব্যাগে তাবু নেই, মাথার ওপরে  ঝকঝক রোদ উঠে  গেছে আর বাকি সবাই তাবু টাবু তুলে পগার পার , শুধু ১টা খচচর মাথা নেড়ে ঘাস চিবুচ্ছে আর আমাকে দেখে দাঁত বার করে বলছে “সকাল সকাল না উঠলে এই হয়|”

বেদনী কি পেত্নী

ভয়ে কালঘাম ছুটে লাফিয়ে উঠে দেখি কোথায় টাবু কোথায় রোদ, আমি তো শুয়ে আছি কম্বল চাপা দিয়ে খাটে ,ঘড়ি তে বাজে সবে ভোর ৪:৩০ | যাতে স্বপ্ন সত্যি না হয় সেই ভয় আর ঘুম এলো না  |  ওই শীতে কম্বল ছেড়ে প্রাতঃকৃত্য করতে যাওয়ার যে মনের জোর লাগে সেটা এই বাঙালির মনে এমনিও কোনোদিন ছিল না , তাই দিলীপ সিংহ যতক্ষণ না চা নিয়ে এসে গুড মর্নিং কল না দেয় শুয়েই কাটানো শ্রেয় | ভোর ৬:০০ টা নাগাদ লাল চা খেয়ে তৈরী হতে মিনিট বিশেক, ততক্ষনে প্রাতরাশ প্রায় তৈরী | ম্যাগি ওমলেট আর এক কাপ চা খেয়ে হাঁটা শুরু হলো ৭:৩০ | দিদনা থেকে আলী বুগিয়াল হেঁটে যাওয়ার রাস্তা সিধা দিদনা থেকে ওপর অবধি বোঝা যায় | অতএব আমরা যারা কাছিমের মাসতুতো ভাইয়ের গতিতে হাঁটি, তারা হাঁটা শুরু করলাম সবার আগে | অভিজ্ঞ (পড়ুন বয়স্ক) ট্রেকাররা দেখি আরাম করে চায়ের মৌজ নিয়ে আরো কিছু বাদে এগোনোর পরিকল্পনা করছে | যাই হোক মিনিট ১৫ হাঁটার পরেই দেখি হাঁফ ধরতে শুরু করছে |

একটা গাছতলে মিনিট দুয়েক বিশ্রাম করতে না করতে দেখি মহিপাল সিংজি এসে তাড়া লাগালেন "চলো চলো , রাস্তা আজ লম্বা হ্যায়| শাম সে পেহেলে পৌছনা হ্যায়|" সন্ধ্যে বেলা ট্রেক করা যে কি দুরহ তার অভিজ্ঞতা আগের বার হয়েছিল তাই আর কালবিলম্ব না করে এগিয়ে পড়লাম ছোট্ট ছোট্ট পা ফেলে | আধাঘন্টা বাদে দেখি  সেই অভিজ্ঞ  (বয়স্ক) ট্রেকার কজন পাশ দিয়ে অতিক্রম করে এগিয়ে গেল "থেমো না এগিয়ে চলো আস্তে আস্তে " পুরো কমপ্লেক্স খেয়ে যা তা অবস্থা , সব থেকে অভিজ্ঞ ট্রেকার প্রায় ৬০ বছরের কাছে বয়সে ও গাইডের সাথে পাল্লা দিয়ে হাঁটছেন | পুরো রাস্তা ৪৫ ডিগ্রী অ্যাঙ্গেল ধরে আকাশের দিকে উঠে গেছে , বিশ পা হাঁটলেই হাঁফ ধরছে | যাই হোক ঘন্টা তিনেক অক্লান্ত চড়াই  ভাঙার পড়ার এসে পড়লো বুগিয়ালের ঘাসজমি | বুগিয়াল বলতে যেটা বোঝায় ১১০০০ ফুট উচ্চতায় যখন বড় গাছ জঙ্গল শেষ হয়ে ঘাসজমি শুরু হয় | আলী বুগিয়াল পৌঁছানোর একটু আগেই ধৌলাধার রেঞ্জ নীল আকাশের পটভূমিকায় ক্যালেন্ডারের ছবি হয়ে ফুটে উঠে যে স্বর্গসুখ দেয় তাতে বিগত ৩-৪ ঘন্টার সব ক্লান্তি ভুলে যাওয়া যায় এক মুহূর্তে |

লাঞ্চ প্যাকেট ছিল ব্যাগ এ সেদিন , কারণ Miles to Go Before I Sleep ...ঠান্ডা ডিম্ সেদ্ধ আর ঠান্ডা স্যান্ডউইচ যে অমৃতর মতন লাগে সেটা বুঝতে গেলে সমুদ্র থেকে ১২০০০ ফুট উঁচুতে আলী বুগিয়াল এ  মেষ পালকদের পাশে বসে কাশ্মীরি কার্পেটের থেকে  নরম ঘাসে মোরা উপ্তক এ  বসে রোদ পোহাতে পোহাতে খেতে হবে |

আলী বুগিয়াল এর টপটা ঘাসমরা কাছিমের পিঠের মতো | ৪ঘন্টার ক্লান্তি কাটাতে খাবার খেয়ে আধঘন্টার মতো ঘাসের গালিচাতে লম্বা হয়ে রোদ পোহাতেই ডাক পড়লো দিলীপ সিংহের "চলো সাব , সামনে অর ভি রাস্তা বাকি হায়... | রাত কে ক্যাম্প বেদনী বুইগ্যাল মে হোগা ইহা পানি নেহি মিলতা | জিগ্যেস করতে বললো আরো ৬-৭ কিমি মতো বাকি রাস্তা | পিঠে বস্তা থুড়ি রুকস্যাক তুলে ঠুকে ঠুকে আবার চলা শুরু হলো | অবশ্য নরম ঘাসে মোরা বুগিয়াল দিয়ে হাটতে মন্দ লাগছিলো না | আর ট্রেকের সব  থেকে বড়ো প্রাপ্তি হলো প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য , আর আকাশ পরিষ্কার থাকলে তো কথাই নেই | আলী বুগিয়াল থেকে  বেদনী বুগিয়ালের রাস্তা অপেক্ষাকৃত সহজ | ২-৩ কিমি পাথুরে পাকদন্ডী ছাড়া বাকিটা পুরোটাই নরম ঘাসের গালিচা | আমি আর গিন্নি আস্তে আস্তে গল্প করতে করতে এগিয়ে যেতে যেতে আবার খেয়াল হলো পেটে ছুঁচোর ডন | একে হ্যাংলা বাঙালি তার ওপর আবার পরিশ্রম , খিদে কি আর তর সয় | রূপকুন্ডের রাস্তায় একটা  মজা হলো  ৫-৬ কিমি প্রতি একটা করে চা -ডিমভাজার গুমটি | ম্যাগি চা খেয়ে পা বাড়াতেই জানা গেলো আমাদের দলের একজন পা মোচকেছে বুগিয়াল থেকে নামতে গিয়ে |  তার পিঠের মালপত্র বাধ্য হয়ে খচ্চরে তুলে দিতে হলো | এখানে একটা কথা উল্লেখ্য, কে পিঠে রুকস্যাক নেবে আর কে  খচ্চরে তুলবে সেটা প্রথমেই ঠিক করতে হয় | কারণ সেই মতো খচ্চরের সংখ্যা ঠিক হয় এবং দাম নির্ধারিত হয়| কিন্তু ওই যে আমরা জানি শেরপারা আমাদের পাহাড়ের দেবদূত এবং তারা খুব অসুবিধা না হলে, না কখনোই করেন না । অতএব মহিপালজি নিজেই এসে তার রুকস্যাক তুলে খচ্ছরে বেঁধে দিলেন | যাইহোক আরো ঘন্টা তিনেক চড়াই উৎরাই ভেঙে এগোনোর পরে উঁচুতে দেখা পেলাম বেদনী কুন্ডের | কথিত আছে বেদনী কুন্ডে তপস্যা করেছেন স্বয়ং ব্যাস দেব এবং মহাভারত শেষ করেছেন এখানে বসেই । বেদনী কুন্ডের মাঝে একটা ছোট মন্দির আছে , স্থানীয়রা খুব জাগ্রত মানেন । বেদনী কুন্ডের সামনে বসে আড্ডায় কখন যে বেলা গড়িয়ে সূর্যাস্তর সময় হয়ে এসেছে তা কারুর খেয়াল নেই । খেয়াল হলো চা -পাকোড়ার ডাকে । চা পাকোড়া আর ১১০০০ ফিট ঠান্ডায় পাহাড়ের মাথায় গেরুয়া সূর্যাস্ত কি যে নৈসর্গিক সুখ দিতে পারে সেটা পরে বোঝার থেকে গিয়ে উপভোগ করাটা  সহজ বোধহয়..।  সন্ধে নামতে অল্প করে ভোলেবাবার প্রসাদ খেয়ে আর এক রাউন্ড চা খেতে খেতে রাতের খিচুড়ি আর ডিম্ ভাজার ডাক পরে গেলো ।

নৈশাহার ৭:৩০ তার মধ্যে শেষ । আজ শোয়ার ব্যবস্থা কিন্তু তাঁবুতে । আমি আর গিন্নির প্রথম বার স্লিপিং ব্যাগে শোবো, তার জন্য ভয় না উত্তেজনা কি তা জানিনা.. মনের ভিতরে হচ্ছে ।   যাই হোক স্লিপিং ব্যাগটা একটু অদ্ভুত বস্তু । একটা লম্বা বস্তার মতো জিনিস , ওপর থেকে নিচ অবধি চেন আছে । চেন খুলে নিজেকে বস্তায় ঢুকিয়ে হাত দুটো ভিতর দিকে রেখে চেন টেনে মুখ অবধি বন্ধ করে দিতে হবে। পুরো ব্যাণ্ডেজ ভুতের মতো অবস্থা আর কি , ঘুমোতে হবে  সোজা চিৎ হয়ে , কারণ সকালে উঠে বা রাতে আব্যসিক কাজকর্মের সময়ে যদি চেন আঙুলের ডগায় না পাওয়া যায় তাহলেই চিত্তির| যাই হোক গিন্নির স্লিপিং ব্যাগের চেন বন্ধ করে বাইরে এলাম কুন্ডের পাশে বসে ধুম্ পান করতে করতে কিছুক্ষন তাঁরার আলোয় সময় কাটাবো ভেবে । আমাদের টেন্ট থেকে ২০০ গজ দূরে হচ্ছে বেদনী কুন্ডের পাশের বেদি । ওখানেই বসে গোটা দুয়েক ফুঁকবো আর নৈসর্গিক দৃশ্যে বুদ্ হয়ে থাকবো |

কুন্ডের থেকে ১০০ ফুট দূরে আছি এরম সময়ে হটাৎ যেন চোখে পড়লো সাদা কাপড় মুড়ে ওই কনকনে ঠান্ডায় কে যেন জলের মাঝে দাঁড়িয়ে আছে ।  বুকের মাঝখান যেন দুম দাম আওয়াজ করে উঠলো চোখ কচলে দেখি সত্যি এখনো দাঁড়িয়ে আছে তেনারা । কোনোরকমে পকেট থাবড়ে টর্চ বের করে তাক করে জ্বালাতে দেখি দুটো লাঠিতে বাধা সাদা পতাকা ফোতফোঁৎ করে উড়ছে । তাঁরার আলোর মায়ায় তারা যেন কায়া পেয়েছে । ধরে প্রাণ ফিরে পেলাম কিন্তু আর বেশি সাহস না দেখিয়ে তাঁবুর পাশে দাঁড়িয়ে ধুমপান করে স্লিপিং ব্যাগে ঢুকে পড়লাম । শরীর এমনিতেও পরিশ্রমে ক্লান্ত তো ঘুম আস্তে দেরি হলো না।

পাথরের নাচুনি

ঘুম ভাঙলো "চায় লেলো.. " আওয়াজে তাঁবুর চেন খুলে বাইরে এসে দেখি সামনের সবুজ পাহাড়ে ঝকঝকে রোঁদের খেলা চলছে । পিচুটি মাখা চোখ যেন জুড়িয়ে গেলো । লাফ দিয়ে বাইরে এসে দেখি স্বাভাবিক ভাবেই সবার শেষে আমি উঠেছি । একটু দূরেই  বাথরুম তাবু খাটানো ছিল । প্রাতঃকৃত্য সেরে রেডি হতে হতেই প্রাতরাশ তৈরী (মাগ্গি সূপ) | খেয়ে হাটা লাগলাম আজকের গন্তব্যস্থল পাথর নাচুনির দিকে। রাস্তা ক্যাম্পসাইটের পিছনের দিক দিয়ে সোজা সুতরাং আমরা যারা গতিতে  কাছিমের বংশজ তারা তাড়াতাড়ি হাঁটা লাগলাম । দূরত্ব মাত্র ৮ কিমি কিন্তু শেষ ২কিমি ছাড়া পুরোটাই চড়াই । সূর্যের ঝলমলে আলো মাখা বেদনী বুগিয়াল আর কুন্ড ছেড়ে আমাদের এগিয়ে যেতে ইচ্ছা তো করছিলো না কিন্তু ফিরবো এই বুগিয়াল হয়েই সুতরাং ত্রিশূল আর নন্দাঘুটিকে কাছ থেকে দেখার সুযোগ না ছাড়ার সিদ্ধান্তই বিবেচিত হলো | পাকদন্ডীর আসে পাশের রূপ কিন্তু বদলে গেছে মাইলখানেক আগে থেকেই | সবুজ ঘন ঘাসজমি শেষ হয়ে হলদে রুক্ষ ঘাসজমি, পাথুরে রাস্তা  আর বড়গাছ একদমই নেই | উচ্চতা প্রায় ১২৫০০ ফুট , এই উচ্চতায় এখানে ছোটো গাছে বোরো ফুল ফোটে | হটাৎ রাস্তায় অক্টোবর মাসের বিরল দৃশ্য : ব্রহ্মকমল | যদিও শুকিয়ে গেছে কিন্তু তাও দেখা সৌভাগ্যের ব্যাপার | ব্রহ্মকমল দেখে মুগ্ধ হয়ে একজন আবার সেখানেই নিজের ক্যামেরা রেখে আধ মাইল এগিয়ে গিয়ে খেয়াল হলো যে আধ মাইল পিছনে দৌড় লাগাতে হবে |

ট্রেকের গাইডদের কিছু মুখস্ত বুলি আছে | যেরকম যদি জিঞ্জাসা করা হয় "ভাই অর কিতনা দূর যানা হ্যায় ?" উত্তর হয় "সামনে জো পাহাড় দিখ রাহা হায়, উস্কে পিছে " কিংবা "বাস থোৱা সি বাকি হ্যায়.. " কিংবা যদি ভুল করে শোনা গেলো যে আর ২কিমি বাকি আছে তবে নিশ্চিত ভাবে পরে যতবার জিগেশ করা হবে একই উত্তর পাওয়া যাবে "বাস অর ২কিমি বাকি "| মাঝে একটা জায়গা পরে ঘোড়া লোটানি | ঘোড়া লোটানি নামের উৎপত্তি হচ্ছে হোমকুন্ড যাত্রার শেষ বিন্দু যেখান থেকে মালবাহী ঘোড়া খচ্চরদের ফেরৎ পাঠানো হয় | তো সেখানে পৌঁছতে আমরা বেশ কয়েকটা ২ কিমি রাস্তা মানে দেব সিংহের ভাষায় "অর ২ কিমি সির্ফ " পার করে এসে পৌছালাম।

পাহাড়ের ধারে পা ঝুলিয়ে বসে চা খেয়ে যে তৃপ্তি পাওয়া যায় সেটা কিন্তু দার্জিলিঙের ফার্স্ট ক্লাস টি ৫ তারা হোটেলে খেয়েও আসে না । চা ওমলেট খেয়ে আধাঘন্টা বিশ্রাম নিয়ে এগিয়ে পড়লাম শেষ ২ কিমি দূর পাথর নাচুনির উদ্দেশ্যে |

পাথর নাচুনি শেষ ক্যাম্পসাইট যেখানে ঘাস দেখা যায় | পাথর নাচুনির নামের পিছনে স্থানীয় উপকথা আছে রাজা হোমকুন্ড যাত্রা পথে বিনোদনের জন্য নর্তকীদের নাচ দেখে বিশ্রাম করছিলেন | এতে দেবী রুষ্ট হয়ে অভিশাপ দেন এবং সব নর্তকী এক গর্তের মধ্যে পাথর চাপা পরে যায় | শোনা যায় অনেক গভীর রাতে নাকি নর্তকীদের পায়ের মলের আওয়াজ আজও শোনা যায় | ক্যাম্পসাইটে পৌঁছানের সাথে দুপুরের খাবারের ডাক , খাবার আজ সয়াবিনের সবজি, গরম ডাল ও ভাত | খেয়ে আঁচিয়ে আমাদের আড্ডা বসলো আজ তাস হাতে ; টোয়েন্টি নাইন | ঘন্টায় ঘন্টায় চা পাকোড়া আর তাস , বাঙালির সময়ে যে কোথা দিয়ে  বয়ে যায় কেউ আর খোঁজ রাখে না | সময়ের খেয়াল হলো নৈশভোজের ডাকে | আজ খেতে বসে দলের ফোটোগ্রাফেরদের পরিকল্পনা হলো ষ্টার ট্রেইল ক্যামেরা বন্ধি হবে | যদিও আমি ক্যামেরার সামনে যতটাই সাবলীল পিছনে ততটাই নোভিশ| যাই হোক সিগারেট জল যোগান দেওয়ার নাম করে তাদের দলে ভিড়ে গেলাম হিরে খচিত আকাশ দেখার লোভে | সেই রাতে রাত ছিল অমাবস্যা.., ভাগ্য ছিল সহায় সেরাত্রে, আকাশে মেঘের নেই লেশমাত্র | মুম্বাইয়ের হীরেবাজারের থেকে কোনঅংশে কম ছিলোনা  সে রাতের আকাশ |

বাঘের ঘরে ঘোঘের বাসা তাকেই বলে বাগুবাসা

ট্রেকের সকাল বোধহয় পৃথিবীর সবথেকে সুন্দর দৃশ্য হয় | আর সেই সকাল ছিল যেন সোনায় মোরা, বরফে ভেজা ঘাসের ওপর সোনা আর হিরে যেন কেউ মুঠো ভোরে ছড়িয়ে দিয়েছে | সকালের খাবার আজ পাস্তা , পথও বেশি দূরের নয়, ৬-৭ কিমি কিন্তু রাস্তা যেন পুরো আকাশের দিকে উঠে গেছে | সামনের পাহাড়টার সারা গায়ে যেন রাস্তাটা সাপের মতো আঁকাবাঁকা হয়ে উঠে গেছে , দেখেই তো আত্মারাম খাঁচাছাড়া | যাই হোক পড়েছি পাহাড়ির হাতে, চলতে হবে উঁচু পথে | আজকের গন্তব্য বাগুবাসা, শোনা যায় দেবীর বাহন (ব্যাঘ্র বা সিংহ ) তার ঘর হচ্ছে বাগুবাসায় | চলা শুরু হলো , ১০ মিনিট এগোই ২ মিনিট বসি | রাস্তা তো নয় যেন আকাশে ওঠার সিঁড়ি  উঠেই যাচ্ছি উঠেই যাচ্ছি | আর কতদূর জিগ্যেস করলে তো বাধা উত্তর জানাই আছে । "সামনে জো পাহাড় দিখ রাহা হ্যায়, উস্কে পিছে " কিংবা "বাস থোৱা সি বাকি হ্যায় "

এইদিন একটা মজা হয়েছে আমার সাথে, যদিও তখন মজা লাগেনি । কদিন ধরেই দেখছিলাম গাইডরা আমাদের রাস্তায় সব সময় থাকছে না, ওরা ।পাহাড়ের ধার ধরে বা পাকদন্ডীর শর্টকাট দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। তো আমি তো জিম করে এসেছি, আমিও যাই ওদের সাথে, আগেও যাবো কম হাটবো । যেমনি ভাবা তেমনি কাজ; দিলীপ সিংহ যেই পাহাড়ের ওপর থেকে আওয়াজ দিলেন "চলো চলো " আমিও পাহাড়ের গায়ের ৬০ডিগ্রী দলের পাকদন্ডী ধরে ওঠা শুরু করলাম । গুনে গুনে ১০ পা সিধে ওঠার পর কিরম একটা সিধে দাঁড়াতে পারছিলাম না, বেঁকে যাচ্ছিলাম জমির দিকে। বাধ্য হয়ে ৪ হাত পায়ে উঠতে শুরু করলাম । ১০ ফুট এগোতে পারিনি প্রায় শুয়ে পড়েছি ঐভাবে , একে সুখী বাঙালি শরীর তারপর পিঠে ৮-৯ কিলোর রুকসাক। বাধ্য হয়ে দিলীপ সিং এসে দেবদূত হয়ে এসে পিঠের বোঝা কমিয়ে সেই যাত্রায় রক্ষা করলেন প্রতিবারের মতো। যাগ্গে যা বুঝলাম যে শহুরে জিমারু হয়ে পাহাড়ে শেরপাদের সাথে পাল্লা দেয়ার চেষ্টা করা আর দৌড়ে রুশ চলে যাওয়ার প্রচেষ্টার কোন পার্থক্য নেই কারণ দু জায়গায় চরম ব্যর্থতা নিশ্চিত | মাঝে রেস্ট চটি পেলাম হচ্ছে কালুভিনায়াক মন্দিরের সামনে । একটা ছোট্ট পাথর স্ল্যাব দিয়ে বানানো মন্দিরে , একটা কালো পাথর খুঁড়ে বানানো মূর্তি । সামনে শঙ্খ রাখা । এসে ভিনায়াকজি কে প্রণাম করে শঙ্খধনি দিয়ে ম্যাগি চা দিয়ে উদর পূর্তি করতে বসলাম আবার| খেয়ে আঁচিয়ে এগিয়ে চললাম বাগুবাসার দিকে । প্রাকৃতিক দৃশ্য পুরো বদলে গেছে , কালো পাথুরে জমি ।

কালুভিনায়াক মন্দিরের পর বাকি রাস্তা উৎরাই , সুতরাং বাগুবাসা ক্যাম্পসাইট পৌঁছানোটা অপেক্ষাকৃত সহজ ছিল | এই প্রথম কোনো ক্যাম্পসাইটে ক্যাম্পিং করবো যেখানে জমি পাথুরে | সাধারণত ক্যাম্পসাইটে ঘাসজমিতে হয় , এইবার যে অসুবিধা হয় পাথুরে জমিতে সেটা হচ্ছে ঘুমানোর সময় | একে তো স্লিপিং ব্যাগ , নড়াচড়া এমনিও বন্ধ , তারওপর নিচে পাথুরে গদি| তবে সব থেকে বড় বিভীষিকা আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে এই রাতে সেটা হলো ভোর ৩টের সময় ট্রেক শুরু হবে বহু আখাঙ্খিত রূপের কুন্ডের উদ্দেশ্যে |

উল্লেখ্য ঘটনা সেই সন্ধ্যে তে হচ্ছে আকাশের সূর্য-মেঘের রঙের হোলি | এতো রঙের খেলা সেই সন্ধেবেলা যা বোধহয় কোনোদিন ভুলবো না | টেম্পারেচার প্রায় নেমে এসেছে রাতে -২/৩ ডিগ্রী তে সন্ধে বেলাতেই ৪ লেয়ার ওপরে ৩ লেয়ার নিচে পরেও যেন ঠক ঠক করে কাঁপছি | এদিকে গাইডের কড়া নির্দেশ সন্ধেবেলা টেন্ট এ যাওয়া যাবে না,পরিবেশ এর  সাথে অক্লেমাইস  করতে হবে নইলে প্রায় ১৬০০০ ফুট উচ্চতায় এ.ম.স  হতে পারে | সেই রাতের খাবারও তাড়াতাড়ি হলো। সকাল সকাল শুয়ে পড়তে হবে |   আল্টিটিউড এর কারণে আজ রাতে ঠিক হলো সবার অক্সিজেন লেভেল চেক কড়া হবে রাতে খাবার পর | মিনিমাম লিমিট বোধহয় ৮০ থাকতে হয় , কিন্তু আমাদের মধ্যে একজনের এসেছিলো ৬৭ এবং শুরু হলো দুশ্চিন্তা তাকে নিয়ে এগোনো যাবে কিনা , নাকি সে ব্যাসিক্যাম্প এ থাকবে আমরা সকালের ট্রেক কমপ্লিট করবো | সেও জেদি, এসেছে যখন পুরো কমপ্লিট করেই ফিরবে | ঠিক হলো সকালে আর একবার চেক করে বেরোনো হবে |

 

জোড়া আছে গলি

​রাতে তো আর ঘুম আসে না একলা জেগে রই, মাগো আমার শোলক বলা কাজলা দিদি কই... | একে তো স্লিপিং ব্যাগ তাও পাথুরে জমি, ঘুম আসা তো প্রায় অসম্ভব তারপর রাত থুড়ি ভোর ৩টে ওঠার চাপ | আসে পাশের টেন্ট থেকেও গলার আওয়াজ শুনে বুঝলাম অবস্থা একি প্রায় সকলের | একটু চোখ লেগে আসতে আসতেই দিলীপজির আওয়াজ "গুড মর্নিং, চায় লেলো |" কোনোরকমে বিছানা থুড়ি স্লিপিং ব্যাগ থেকে নেমে গরম চা খেয়ে জুতো বেঁধে তাবু থেকে বেরোতেই যেন হাড়ের ভিতরের মজ্জাটাও জমে গেলো মুহূর্তে | মহিপালজির ব্যারোমিটার রেকর্ড করছে -৬ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড | ১টা গেঞ্জি ২ থার্মাল ১টা ফ্লিস ১টা ডাউন ফেদারের জ্যাকেট যেন নেই | ঠান্ডা  কাটাতে আমরা লাফালাফি ঝাপাঝাপি করে একটু গরম হয়ে সাড়ে ৩টে নাগাদ হাঁটা শুরু করলাম| রাস্তা বেশি নয় মাত্র ছয় , কিন্তু পাথুরে রাস্তা আর পাথরের আয়তন যেন ছয়গুন | অন্ধকারে টর্চের আলোই ভরসা | কিন্তু ওই ঠান্ডায় গ্লাভস থাকা আর না থাকা যেন সমান | আঙ্গুল টনটনিয়ে উঠেছে আর আমি অন্যের টর্চের ভরসায় এগোচ্ছি | এই রাস্তায় আমরা সবাই একসাথেই এগোচ্ছি তো অসুবিধা সেরম কিছু হচ্ছিলো না , খালি নাক দিয়ে ঠান্ডায় যেন নীলগঞ্জ বয়ে যাচ্ছিলো | ট্রেকের কষ্টটা ভুলিয়ে দে প্রাকৃতিক দৃশ্য , কিন্তু নাইট ট্রেকের সব থেকে সুবিধা হলো ৫ ফীটের বেশি দেখা কিছু যাচ্ছে না | শুধু বুঝতে পারছিলাম চড়াই তা একটু বেশি আজ যেন| একে উচ্চতা ১৫০০০ এর ওপরে তায় চরম ঠান্ডা | দম যেন  আজকে আর দিচ্ছে না |৫ মিন পর পর ২মিনের বিশ্রাম|  ঘন্টা দেড়েক চলার পর প্রথম আলোর আভাসে যেন চোখ জুড়িয়ে গেলো | চারিদিকে মাথা থিউল দাঁড়িয়ে থাকা সাদা পাহাড়ের মাঝখান থেকে পাথুরে রাস্তা দিয়ে আমরা উঠে আসছি রূপের কুন্ডের দিকে | ওপরে দেখা যাচ্ছে মহাকালের মন্দিরের মাথায় উড়ানো নিশান | ৬টা নাগাদ পৌঁছলাম কঙ্কালের ঢিপির পাশের রূপকুন্ডের পারে |  মিথ্যে বলবোনা রূপকুন্ডের তুলনায় বেদনী বুগিয়াল বেশি সুন্দর , রূপকুন্ডে প্রায় জল নেই বললেই হয়| মহাকালের দরবারে মাথা ঠেকিয়ে কংকালকে জড়িয়ে নিজস্বী তুলে আমাদের উঠতে হবে আমাদের এই যাত্রার সর্বোচ্চ শিখর জুনারগলি |

জুনারগলি এগোনোর আগে রূপকুন্ডের ইতিহাস নিয়ে কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আছে পাঠকদের জন্য |

কথিত আছে দেবী সতী লোহাসুরকে বধ করে মহাদেবের সাথে এই রূপকুন্ডের ধরে মিলিত হয়েছিলেন | পরিশ্রান্ত দেবীর রূপচর্চা করার জন্য দেবীর নির্দেশে মহাদেব ত্রিশূলের আঘাতে এই কুন্ডের সৃষ্টি করেছিলেন যাতে দেবী নিজের মুখ দর্শন করতে পারেন | লোককথা বলে এই কুন্ডের তীরে আজ দেবাদিদেব ও সতী এখানে আজ মিলিত হন |  স্থানীয়রা বলেনা সেই কারণে সূর্যাস্থের পর রূপকুন্ডের ধারে আজ কেউ থাকতে পারে না | একবার এক মার্কিন অভিযাত্রীরা প্রচেষ্টা করেছিল বলে জানা গেছিলো রাতে থাকার ব্যাটারী চালিত ফ্লাডলাইট নিয়ে , কিন্তু সূর্যাস্তের পরে এতো অস্বাবিক তুষারঝড় হয় যে প্রাণ বাঁচাতে সবাইকেই তাবুতে ফিরে আস্তে হয় ।

কিন্তু রূপকুন্ডের সবথেকে বিস্ময়কর ঘটনা হলো কুন্ডের চারিপাশে পরে থাকা নরকঙ্কালের রাশি । ১৬০০০ ফুট উচ্চতায় এতো মনুষ্য কংকাল পাওয়া বৈজ্ঞানিকদের খুব অবাক করেছিল, এবং তার উৎপত্তি নিয়ে প্রচুর গবেষণা হওয়ার পর ২টো তত্ত্ব সামনে আসে :

১> ওইখানে কোনো যুদ্ধ হয়েছিল কারণ ওখানে কিছু পুরানো অস্ত্র দেখা গিয়েছিলো। কিন্তু এই তত্ত্ব নস্যাৎ হয়ে যায় তার কারণ নরকঙ্কাল ও  অশ্বকঙ্কাল  থেকে যে আঘাতের চিহ্ন পাওয়া গেছে সেগুলোর মাথার পিছন দিকে ভারী কিছু দিয়ে চোটের দাগ।

২> কোনো তীর্থযাত্রী বা সৈনিকরা ওই রাস্তা দিয়ে যাত্রা করছিলেন এবং তুষার ঝরে মাথায় আঘাত পেয়ে সবাই মারা গেছিলেন | এই তথ্য কঙ্কালের মাথার চোট দেখে বেশি স্বীকৃতি পায়।

যাইহোক আধাঘন্টা বিশ্রামের পর সিংজি যুগলের নির্দেশে এগোতে শুরু করলাম ওপরের দিকে | রূপকুন্ড থেকে জুনারগুলির রাস্তা সব থেকে বেশি চড়াই এই শেষ ৪ দিনের তুলনায় । প্রায় ৫০০ ফুট উঠতে হবে কিন্তু প্রতি ৩ পদক্ষেপে যেন দম শেষ হয়ে যাচ্ছে।  সিংহজি যুগল প্রতি বাঁকে আমাদের সাহস জুগিয়ে চলেছেন এই রুটটা যাতে সবাই শেষ করতে পারি । ৫০০ ফুট শেষ করতে লাগলো প্রায় ৪৫ মিনিট উচ্চতা আর চড়াইয়ের জন্য । দম প্রায় শেষ যখন সামনে ভেসে উঠলো জুনারগুলির গেট । একদিকে ত্রিশূল অপরদিকে নন্দাঘুন্টি বিশালাকায় পাশে দাঁড়িয়ে আছে । সাদা ত্রিশূলের ওপরে সোনায় মোরা চুড়ো দেখে আমরা কিছু মুহূর্তের জন্য হতবাক । তারপর একে অপরকে জড়িয়ে সামিট কমপ্লিট করার জন্য অভিনন্দন জানিয়ে , মুগ্ধ চোখে প্রকৃতির বিস্ময়ের রূপে ডুবে গেলাম। কিছু অজানা পাখি দেখা দিলো , সামনের রাস্তা নেমে যায় শিলাসমুদ্রের দিকে , ওখান দিয়ে তীর্থযাত্রী আর কিছু দুঃসাহসী অভিযাত্রী যায় হেমকুন্ড বা রন্টি পিকের দিকে । আমাদের দলের সাহস ও ক্ষমতা আপাতত জুনারগুলি ; তাই এগোনো এবারের মতো  শেষ, এবার ফেরার পালা, রাস্তা অনেকটাই এক শেষের দিকটা শুধু একটা শর্টকাট।

ফিরতি পথের নামচা

ঘুরতে যাওয়ার সময় যে উত্তেজনাটা বোধ করি সেটা কমে যায় ফেরার সময়, আর ৪ দিন ট্রেকের পর ক্লান্ত পদযুগল তো যাত্পর্ণাই বিদ্রোহ করে ওঠে | যাবার সময় অন্ধকারে বুঝতে পারিনি কিন্তু রূপকুন্ড থেকে নাবার রাস্তা দেখে তো আত্মারাম খাঁচাছাড়া হওয়ার জোগাড় | নুড়ি পাথরে ভরা রাস্তা ৭০ ডিগ্রী অ্যাঙ্গেল সিধা নিচের দিকে , পা বা লাঠি কোনোটাতেই ভরসা আসছে না | ১০ ফুট নেমে দেখলাম আর সাহস কুলাচ্ছে না , বসেই পড়লাম । চার হাত পায়ে বাচ্ছাদের মতো এগোতে লাগলাম প্রায় ৩০০ ফিটের মতন | তারপর উৎরাই একটু কম হওয়ার পর আবার নরমাল নামা শুরু হলো | প্রথম গন্তব্য বাগুয়াবাসা | ওখানেই প্রাতরাশ সেরে নামতে হবে বেদনী বুগিয়ালের দিকে | রাস্তা একই কিন্তু যেহুতু নিচের দিকে অতএব সময় কিছু কম লাগবে | নামার সময় পিঠে ব্যাগ থাকলে একটু অসুবিধা হয় কারণ, ঝুকে নামা একটু কষ্টকর | এখানেও সিংজি যুগল দেবদূত হয়ে আমাদের পরিত্রান করলেন, খাবার কমে যাওয়ার ফলে খচ্চরের বোঝা অনেক কমে গেছিলো তাই আমাদের ব্যাগগুচ্ছ দিয়ে আমাদের পিঠ হালকা করে এগিয়ে পড়লাম পাথর নাচুনি হয়ে  বেদনীর দিকে |  যাত্রা খুব বেশি ঘটনা বহুল নয় , শুধু মেঘের ঢলে রাস্তা ঢেকে গেছিলো | পাথর নাচুনি পৌঁছে চটিতে ম্যাগি খেয়ে আমাদের বেদনী পৌঁছতে প্রায় বিকেল |

শেষ নামাটা বহুদিন মনে থাকবে, ঘোড়া লোটানি থেকে বাকি পথে প্রায় পুরোটাই বেদনী কুন্ড দেখা যায়। পড়ন্ত বিকেলের আলোয় বেদনী যে কি মায়াময় হয়ে ওঠে না দেখলে বোঝানো সম্ভব না । আজ রাতের ঘুম খুব আরামে হয়েছিল , একে ক্লান্ত তারপর পাথুরে জমি ছেড়ে ঘাস জমিতে শুতে পাওয়া , মনে হচ্ছিলো যেন দামি হোটেলের নরম গদি ।

পাতালের গঙ্গার রং নীল

বেদনী থেকে পরের দিনে যাত্রা শুরু হলো ওয়ান-এর দিকে । রাস্তা প্রায় পুরোটাই উৎরাই তারপর আমরা উৎসাহে পাকদন্ডী বেয়ে নাম শুরু করলাম, অগত্যা যা হওয়ার দলের ২-৩ জন পপাত ধরণীতল, যদিও শুকনো পাতার জন্য আহত কেউ হয়নি । লাঞ্চ ছিল প্যাকেটে, বনভোজনের জায়গা ঠিক করা হলো নীলগঙ্গার তীরে ।  এই ওয়ান থেকেও অনেকে রূপকুন্ড ট্রেক করে আবার নামা হয় লোহারজুং হয়ে। মাঝে ইন্ডিয়া হাইকসের পার্মানেন্ট ক্যাম্পসাইট পড়লো , জায়গাটার নাম গহেরি পাতাল| এখানে একজন বয়স্ক লোকের সাথে আলাপ হলো যিনি একাই এসেছেন এই পথে রূপকুন্ড সামিট করবেন । শুনেও গর্ব হয় , এবং তাদের এটা জানা খুব দরকার যারা বাঙালি জাতিকে ভীতু ঘরকুনো প্রজাতি বলেই চেনেন | এক বিশাল সংখ্যক মাউন্টেনিয়ার পৃথিবী জুড়ে কিন্তু বাঙালি| | যাইহোক আলাপ সেরে আমরা এগিয়ে পড়লাম লাঞ্চ ব্রেক পয়েন্টার দিকে নীল গঙ্গার তীরে । নিচের দিকে নামতেই গরম  বাড়তে শুরু জ্যাকেট সোয়াটের খুলে বাগে বেঁধে নামা শুরু । নীলগঙ্গা থেকে বাকি রাস্তা আর মাত্র ৩-৪ কিমি বাকি , কিন্তু শরীরের অবস্থা এতই ক্লান্ত যে পা যেন আর চলছে না । নামার সময় আর একটা কষ্ট খুব ,পা এর বুড়ো আঙ্গুল এতো ঘষে যায় যে শেষের দিকে হাটা দুস্কর হয়ে ওঠে ।   লাঞ্চের পর আধা ঘন্টা নীলগঙ্গার বরফ গলা জলে পা ডুবিয়ে বসার পর যেন আঙ্গুল গুলো অবশ হয়ে যাওয়ার ফলে একটু যেন আরাম লাগলো ।

শেষ হাটা শুরু হলো ওয়ানএর দিকে, সময় অপেক্ষাকৃত বেশি লাগলো কারণ এই পাহাড়ি জঙ্গল ছেড়ে আর নেমে আস্তে ইচ্ছা করছিলো না । ওয়ান পৌঁছতে প্রায় বিকেল ৪:৩০, গাড়ি রেডি ছিল আমাদের লোহারজুঙে নিয়ে যাওয়ার জন্য । পেটে ছুঁচো ডন মারছিলো , পৌঁছেই আগে খাবার ঘরে সবাই ভিড় জমালাম । খাওয়া শেষেই গরম জল তৈরী ৬ দিনের ময়লা তোলার জন্য । আগে থেকেই ঠিক ছিল আজকের মেনু চিকেন ও কারণ সুধা ক্যাম্পফায়ারের সাথে । একজন পর্বত প্রেমীর কাছে সামিট কমপ্লিট করাটা যে কতটা সেটা বলে বোঝানো সম্ভব নয় । সুতরাং সেই রাত ছিল উৎসবের রাত।গান , ক্যাম্পফায়ার ও খাওয়াদাওয়া শুতে প্রায় রাত ১২টা । পরের দিন সকালে আবার বাস যাত্রা শুরু কাঠগোদাম হয়ে দিল্লি হয়ে কলকাতার উদ্দেশ্যে ।

পুনশ্চ: এই ট্রেকেও দেখলাম ট্যুরিস্টরা যথেচ্ছ নোংরা করছে পাহাড়| দয়া করে নিজের খাবার প্লাস্টিকগুলো ব্যাগে তুলে গাইডদের কাছে রাখা ডাস্টবিন ব্যাগে জমা করুন বা নিজের রুকসাকের কোণে রেখে দিন, বিশ্বাস করুন ব্যাগের ওজন কিছু মাত্র বাড়বে না |

Meet the Blogger

Dweep Saha


Name - Dweep Saha
Age - 32
Profession- IT Professional
City - Kolkata
Hobbies - Rock Climbing, Boxing, Travelling
Travel Experience - Sandakphu trek, Roopkund trek, Kheerganga trek, Phoktey dara trek, Biking and traveling to places like Sikkim, Himachal Pradesh, Andaman etc.



You may also like