১ম পর্ব:
অতনু অনেক দিন ধরেই বলছিলো সান্দাকফু যাওয়ার কথা। কিন্তু নানা কারণে যাওয়া হচ্ছিলো না. এবার তাই ঠিক করলাম পুজোর ছুটিতে যাবোই সান্দাকফু।
অঙ্কিত কে যাওয়ার কথা বলতে ও রাজি হয়ে গেলো। অতনু এর আগে একবার গিয়েছে সান্দাকফু তে. কিন্তু আমার আর অঙ্কিতের এটাই প্রথম ট্রেকিং। যাইহোক, পুজোর চার মাস আগে ট্রেন এর টিকিট কাটা হলো। দার্জিলিং মেল এ RAC তে টিকিট পেলাম। ফেরার টিকিট confirm পেলাম গরিব রথ এ। আমার সহকর্মী পায়েল ৩ বার সান্দাকফু ঘুরে এসেছে। ওর কাছ থেকে গাইড এর নম্বর পেলাম। guide কে বলে রাখা হলো যে যে জায়গায় night stay করতে হবে সেখানকার home stay book করে রাখতে। গাইড সব final করে দিলো।
যথারীতি শুভ দিন উপস্থিত।
১৮ অক্টোবর:
১০:০৫ রাত্রি - শিয়ালদহ থেকে দার্জিলিং মেল ছাড়লো। RAC টিকিট কন্ফার্ম হয়ে গিয়েছে।
১৯ অক্টোবর:
সকল ৮:৪৫- নিউ জলপাইগুড়ি নামলাম। নেমে গাইড কে ফোন করলাম। switched off . আমরা তো মহা আতান্তরে পরে গেলাম। কিছুতেই গাইড কে ফোন পাচ্ছি না। ভগবানের নাম করে এগিয়ে গেলাম। অটোতে তেনজিং নোরগে bus stand . ভাড়া ২০ টাকা করে জনপ্রতি। পৌঁছে দেখি আরেক বিপদ উপস্থিত। সেদিন বিজয়া দশমী উপলক্ষে নেপালি অধিবাসী দের বিশেষ উৎসব। তাই আজ গাড়ির সংখ্যা খুব কম। মানেভঞ্জন অবধি গাড়ি পাওয়া যাচ্ছে না। যে দু একটা গাড়ি পেলাম তারাও তিন গুন্ ভাড়া হাঁকছে। এই সময় আরো দুই বাঙালী কে পেলাম। প্রায় সময় বয়সী।তারাও মানেভঞ্জন হয়ে সান্দাকফু যাবে। বিশ্বজিৎ ও অয়ন। একটু ভরসা পেলাম। শেষে অতনু বুদ্ধি দিলো। যেকোনো গাড়িতে ঘুম বা সুখিয়াপোখরি যাওয়া যাক। একটু খোঁজ করে জানলাম এক ঘন্টা অন্তর ঘুম যাওয়ার বাস আছে। ১১ টা নাগাদ ওই রকম একটা বাসে উঠে পড়লাম আমরা ৫ জন। ভাড়া জনপ্রতি ৯০ টাকা। দুপুর ১.৩০ নাগাদ ঘুম পৌঁছলাম পথের দুই ধারের চা বাগান আর প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে।ঘুম থেকে একটা মারুতি omni পেয়ে গেলাম। মানেভঞ্জন অবধি ভাড়া ৫০০ টাকা (জনপ্রতি ১০০ করে পড়লো) .পথে সুখিয়াপোখরি তে lunch সারলাম। ভাত , শাক, চিকেন। ১৬০ টাকা প্রতি প্লেট।
বিকাল নাগাদ মানেভঞ্জন পৌঁছলাম। নেপালি উৎসবের জন্যে বেশিরভাগ হোম stay বন্ধ আজ। খোঁজাখুঁজির পর একটা home stay পেলাম। একটাই room ৬টা বেড। ১০০ টাকা করে জন প্রতি ধার্য হলো। room এ এসে সবে একটু বিশ্রাম নিচ্ছি, ঘর মালিক এসে নতুন শর্ত দিলো। dinner এখানেই করতে হবে। বাইরে করা চলবে না। রাজি হয়েই গেলাম। কিন্তু তার পরেই খাবারের দাম শুনে চমকে গেলাম। রাত্রে খিচুড়ি দেয়া হবে। প্রতি প্লেট ৫০০ টাকা। শুনেই বেরিয়ে এলাম। অনেক খোজা-খুজির পর অন্য একটি হোম হোম stay পাওয়া গেলো। ২ তো রুম ৩ টি করে bed এর। দামদর করে ৮০০টাকা প্রতি রুম পড়লো। dinner ওখানেই করার কোনো বাধ্যবাদকতা নেই। তবুও রাত্রে আমরা ওখানেই ডিনার করলাম। মেনু- খিচুড়ি / রুটি, ডাল , তরকারি, পাঁপড়। প্রতি প্লেট ১২০/- . চিকেন নিলে প্রতি প্লেট ১৬০/- খাবারের মান বেশ ভালো। রাত্রে স্নান এর জন্যে গরম জল দিলো কোনো অতিরিক্ত টাকা নেয়নি যদিও।
ও হ্যা, এর মাঝে আমরা GUIDE & PORTERS এর অফিসে গিয়ে গাইড বুক করে এলাম। গাইডের জন্যে দিন প্রতি ১০০০ টাকা।
( আপনাদের সুবিধার জন্যে আমাদের হোম stay এর ডিটেলস দিলাম: GURUNG'S HOME STAY . MANEYBHANJYANG . Bishan Gurung . ফোন- ৭৪৭৮৮২২৮৯০, (৯৭৭) ৯৮০৬০৩৮৭৮৫। আগে থেকে ফোনে বলে রাখলে ওনারাই NJP থেকে গাড়ির ব্যবস্থা করে রাখেন।)
দ্বিতীয় পর্ব ::
২০ অক্টোবর :
সকাল ৮টা নাগাদ আমাদের গাইড ,শেরিং এলেন। ৯টা নাগাদ যাত্রা শুরু করলাম। ট্রেকিং এর প্রথম দিন আজ। গ্রন্তব্য - টংলু। দূরত্ব- ১৩KM . সান্দাকফুর পথ সিঙ্গালিলা ন্যাশনাল পার্ক এর মধ্যে দিয়ে যায়। প্রথমেই তাই Singalila Wildlife Division অফিসে group এর একজনের সমস্ত details নথিভুক্ত করতে হয়। আর প্রত্যেক জনের মাথাপিছু ১০০ টাকা করে এবং ক্যামেরা পিছু ১০০ টাকা জমা দিতে হয়। (mobile ক্যামেরার জন্যে কিছু দিতে হয় না, only for ডিজিটাল ক্যামেরা , DSLR ). তা ফর্মালিটি পূরণ করে "ওম মণিপদ্মে হুঁম " মন্ত্রোচ্চারণ করে এগিয়ে চললাম। পায়েল আগেই বলে দিয়েছিলো যে গাইড কে বলে রাখতে মাঝে মাঝে short cut route দিয়ে যেন নিয়ে যায়। গাইডকে তা বলেও রাখলাম। এখানে বলে রাখি আমি ট্রেক এর জন্যে woodlands এর একটা shoe কিনেছিলাম এই ভেবে এটা ট্রেক করতে খুব হেল্প করবে।কিন্তু হায় , আমার ধারণা অচিরেই ভুল প্রমাণিত হলো। short cut রাস্তা গুলো একটু বেশী খাড়াই বা ঢালু হয়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে তো রীতিমতো শ্যাওলা জমে পিচ্ছিল হয়ে ছিলো।আর দেখা গেলো আমার woodlands এর জুতোটাই সবথেকে বেশী সমস্যা করছে। এছাড়া আমাদের কারোর কাছেই trekking stick ছিল না। এই stick হাঁটার সময় খুব সাহায্য করে। গাইড জানালো চিত্রে পৌঁছলে উনি সরু বাঁশের লাঠি জোগাড় করে দেবেন। যাইহোক, কিছু দূর যাওয়ার পর অয়ন রাস্তার পাশের একটি ছোট বাঁশ গাছ কেটে ওটাকে ৩ টুকরো করে বেশ ভালো লাঠি বানিয়ে দিলো। এই লাঠিটাই আমরা শেষ দিন অবধি ব্যবহার করেছিলাম। যাইহোক, ঘন্টা ২ পরে আমরা চিত্রে (মানেভঞ্জন থেকে দূরত্ব- ৩km ) পৌঁছলাম। ওখানে কফি, এবং wai wai (এক ধরণের জনপ্রিয় noodles যা শুকনো খাওয়া যায় , এমনকি ঠান্ডা জল দিয়েও খাওয়া যায় ) খেয়ে নিলাম। চিত্র্যের একটু আগে একটি সুন্দর মনাস্ট্রি আছে। আপনারা চাইলে দেখতে পারেন।
চিত্রের অবধি পথ একটু খাড়াই। তাই উঠতে একটু কষ্ট হয়। এরপর রাস্তা অপেক্ষাকৃত কম খাড়াই মেঘমা অবধি।মেঘমা খুব সুন্দর একটি গ্রাম ভারত নেপাল সীমান্তে। চিত্রে থেকে দূরত্ব ৬km মেঘমা তে আমরা লাঞ্চ সেরে নিলাম।
মেঘমা থেকে দুটি রাস্তা ভাগ হয়ে যায়। বাঁ দিকের রাস্তা যাচ্ছে টুমলিং। ডান দিকের টি টংলু। আমরা ডান দিকের রাস্তা ধরলাম। এবার রাস্তা বেশ খাড়াই। অঙ্কিত আর আমি গাইডের সাথে সাথে তাড়াতাড়ি এগোলাম।বাকিরা ধীরে সুস্থে আসছে। ২km পর টংলু পৌঁছলাম। টংলু তে GTA বাংলো ও DM এর বাংলো আছে। টংলু তে পৌঁছে দেখি থাকার জায়গা আর নেই। খুব হতাশ হয়ে গেলাম। মিনিট ২০ পরে অতনু অয়ন বিশ্বজিৎ এলো। গাইড জানালো এর পর আমাদের টুমলিং যেতে হবে খুব তাড়াতাড়ি। কারণ টুমলিং এও জায়গা না পেলে আরো এগিয়ে গিয়ে জৌবারি গিয়ে থাকতে হবে। এদিকে একের পর এক ল্যান্ড রোভার চলে যাচ্ছে। তারা সবাই টুমলিং এ stay করবে। সুতরাং আমাদের খুব তাড়াতাড়ি হেটে টুমলিং পৌঁছতে হবে। এদিকে অয়ন আর অতনু খুব ক্লান্ত। শেষে ঠিক হলো অঙ্কিত আমি আর আমাদের গাইড শেরিং এগিয়ে গিয়ে টুমলিং এ হোম stay খুঁজবো। না পেলে আরো এগিয়ে জৌবারি চলে যাবো। সেই মতো আমরা ৩ জন টংলু থেকে বা দিকের একটা short cut ধরলাম। almost ছুটতে ছুটতে প্রায় ৪৫ মিনিটে ২ km পথ অতিক্রম করে টুমলিং পৌঁছলাম।সৌভাগ্যক্রমে একটা হোম stay পেয়ে গেলাম। ৬ বেডের একটা রুম। জন প্রতি ২০০ টাকা।বাকিরা প্রায় ১ ঘন্টা পর এলো। টুমলিং এ ইলেক্ট্রিসিটির খুব অসুবিধা। রাত্রে ওখানেই candle light dinner করলাম ভাত ডাল সবজি ডিম্ ভাজা সহযোগে। খরচ ওই ১২০ টাকা প্রতি প্লেট।
২১ অক্টোবর:
আজকের ডেস্টিনেশন কালিপোখরি (টুমলিং থেকে দূরত্ব- ১৩km ) .
হাটা শুরু করলাম ৮টা নাগাদ। সুন্দর রাস্তা। খুব বেশি চড়াই নেই। টুমলিং ৪ km দূরে জৌবারি পৌঁছে কফি খেলাম। টংলু গ্রাম ভারতের মধ্যে।টুমলিং , জৌবারি নেপালে। জৌবারি যাওয়ার পথে একটা চেকপোস্ট পরে যেখানে পার্মিট চেক করা হয়। আসলে টুমলিং এর পরেই সিঙ্গালিলা ন্যাশনাল পার্ক শুরু হয়।
এবারে আমরা ডান দিকের পথ নিলাম। প্রায় ২.৫ km নেমে গৌরিবাস পৌঁছে মোমো খেলাম। শেষ ১ km রাস্তার ঢাল খুব বেশি থাকে। তাই গৌরিবাস এসে সবাই একটু বিশ্রাম নেন। জৌবারি থেকে ৩টে রাস্তা ভাগ হয়ে যায় যা এই গৌরিবাসে এসে মেশে। এখানে একটা SSB Camp আছে। এর পরের রাস্তা আবার খাড়াই। প্রায় ৩.৫ km হেঁটে কাইয়াকাটা পৌঁছে একটু বিশ্রাম। এখানে একটা ফরেস্ট রেস্ট হাউস আছে। (kaiyakatta নাম টা একটু অদ্ভুত। kaiya এখানকার মাড়োয়ারি দের বলা হয়। কথিত আছে এক সময় এক kaiya (মাড়োয়ারী ) লোক এখানে দোকান চালাতেন। উনি এখানকার মানুষ দের নানা ভাবে বঞ্চিত করতেন , উত্ত্যক্ত করতেন। একদিন এক অধিবাসী রেগে গিয়ে ওনার মাথা কেটে দেন। সেই থেকে এই জায়গার নাম kaiya - katta . )
এরপর আরো ৩km হেঁটে সন্ধ্যা নাগাদ আমরা কালিপোখরি পৌঁছলাম। এই গ্রাম এর মুখে একটি ছোট কালো জলের জলাশয় থেকে জায়গাটির নাম কালিপোখরি। জলাশয়টি এখন কার মানুষ দের কাছে খুবই পবিত্র। কালিপোখরি তে একটা হোম stay পেয়ে গেলাম। সেই আগের মতো ৬ বেডের একটা রুম। জন প্রতি ২৫০ টাকা। chowmin(৭০ টাকা) আর ডিম্ ভাজা (২৫ টাকা) দিয়ে ডিনার সারলাম। এখানে নতুন ধরণের ডিম্ ভাজা খেলাম। দুধ দিয়ে ডিম্ ভাজা। খেতে বেশ সুস্বাদু। রাত্রে ঘন কুয়াশা আর ত্রয়োদশীর চাঁদের মিলে যে অপরূপ সৌন্দর্যের সৃষ্টি করেছিল, যা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। শুধু তাকে উপভোগ করা যায়।
২২ অক্টোবর:
আজ সান্দাকফু পৌঁছবো। আর মাত্র ৭ km দূর। রাস্তা অল্প হলেও চড়াই অত্যন্ত বেশি। তাই আজ ঠিক করলাম রাস্তায় একটু বেশি বিশ্রাম নিতে নিতে এগোবো। প্রায় ৩km হাঁটার পর বিকেভঞ্জন পৌঁছে drinks break নেয়া হলো। এখানে ফাইনাল check পোস্ট আছে। এর পরের ৪km রাস্তা খুবই খাড়াই। টানা ৫ মিনিট ও হাটতে পারছি না। প্রচন্ড কষ্ট হচ্ছে আজ। তবে সব কষ্টেরই শেষ আছে। আমরাও দুপুরের আগেই সান্দাকফু পৌঁছে গেলাম।
অয়ন ও বিশ্বজিৎ একটু আগেই এসে home stay book করে রেখেছে। ১০০ টাকা জন প্রতি দিয়ে রুম পেয়ে গিয়েছে। ফ্রেশ হয়ে নিয়ে খিচুড়ি পাঁপড় ভাজা আর স্কোয়াশ এর আচার সহযোগে লাঞ্চ করা হলো। বিকালে সামনের ভিউ পয়েন্ট এ গেলাম। সকালে সবাই এখন থেকেই কাঞ্চনজঙ্ঘা এবং সূর্যোদয় দেখে। অতনু বললো ২km আগে আল নামে একটা গ্রাম আছে, যেখান থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘার আরো ভালো ভিউ পাওয়া যাবে। এবং ভিড় ও কম হবে। বিকালে ওই গ্রামে ঘুরে এলাম।কিন্তু মেঘের জন্যে কাঞ্চনজঙ্ঘার দেখা পেলাম না। রাত্রে চাঁদের আলোয় তারা ঝলমল করা আকাশ দেখতে দেখতে ঘুমিয়ে পড়লাম।
২৩ অক্টোবর:
ভোর ৩টে উঠলাম।ফ্রেশ হয়ে সোয়া ৪তে নাগাদ বেরিয়ে পড়লাম আল গ্রামের উদ্দেশে। চারদিক পুরো অন্ধকার , শুধু তারা গুলো মিট মিট করে জ্বলছে। তার মধ্যে দিয়ে হাঁটছি আমরা। ভরসা শুধু মোবাইলের টর্চের আলো। যেমন অন্ধকার তেমন ঠান্ডা। তাপমাত্রা প্রায় শুন্য ডিগ্রী। টর্চের আলো রাস্তা পড়ে থাকা বরফে প্রতিফলিত হয়ে চোখ ধাঁদিয়ে দিচ্ছে। আমরা দ্রুত পায়ে এগিয়ে চললাম। সূর্যোদয়ের আগে পৌঁছতেই হবে আল। ৫টার একটু পরে পৌঁছে গেলাম আল। এবার অপেক্ষা শুধু ওই মুহূর্তের।
পূর্ব ও উত্তর আকাশে কেউ যেন দুটো ক্যানভাস রেখে দিয়েছে। যেখানে আর কিছু খনের মধ্যে শুরু হতে চলেছে প্রকৃতি নামক শিল্পীর রঙের খেলা।
৫.১০: পুব আকাশে শিল্পীর তুলির প্রথম আঁচড় পড়লো। যেন এক ফোঁটা রং ক্যানভাসে পড়লো।
৫.১৫: উত্তরের আঁধার ফুঁড়ে তার সুবিশাল বপু নিয়ে বেরিয়ে এলেন কাঞ্চনজঙ্ঘা। পরিষ্কার ঝকঝকে আকাশ। কাঞ্চনজঙ্ঘাকে দেখে মনে হচ্ছে যেন স্বয়ং ভগবান বুদ্ধ পৃথিবীর কোলে শায়িত। তাই কাঞ্চনজঙ্ঘাকে বলা হয় THE SLEEPLING BUDDHA .
এর পর চোখ আর ক্যামেরা একবার পূর্ব, একবার উত্তর আকাশে বিচরণ করবে।
৫:৪১: সূর্যের লাল আভার প্রথম কিরণ পড়লো কাঞ্চনজঙ্ঘার শিখরে। যেন নববধূর সিঁথিতে প্রথম সিঁদুরের দ্যুতি।
৫.৪৭: পৃথিবীর তৃতীয় উচ্চতম শৃঙ্গ তার বেশ কিছুটা অংশে রাঙা আবির মেখে নিয়েছে। এখন তাকে মনে হচ্ছে যেন গলিত সোনা।
৫.৫০: উত্তর-পশ্চিম আকাশের মঞ্চে উপস্থিত স্বয়ং মাউন্ট এভারেস্ট। এর পর হাজির three sisters .মনে হলো ইডেন গার্ডেন্সে এতোক্ষণ বিরাট কোহলির খেলা চলছিল, এবার নেমে পড়লেন সচিন সৌরভ ও লক্ষণ।এর পরের অংশ বর্ণনা করবো না।
বলা ভালো বর্ণনা করার মতো শব্দ এই মুহূর্তে নেই। আজ প্রায় এক মাস পরেও চোখের সামনে ভেসে ওঠে প্রতি মুহূর্তে বদলে যাওয়া কাঞ্চনজঙ্ঘার রূপ।মোটামুটি ৭ টা অবধি থাকার পর ফেরার পথ ধরলাম। ইচ্ছে না থাকলেও ফিরতে হবে। এদিকে কাঞ্চনজঙ্ঘাও ধীরে ধীরে মেঘের ঘোমটা দিয়ে নিজের রূপ ঢাকতে ব্যস্ত। ৮টা নাগাদ ফিরলাম। ব্যাগ গুছিয়ে , wai-wai খেয়ে ফেরার পথ ধরলাম ৯টায়। গ্রন্তব্য ১৬km দূরে শ্রীখোলা। অনেকে বলেন পাহাড়ে ওঠার থেকে নামা অনেক সোজা। মিথটা সেদিন ভেঙে গেলো।
আজকের পথ ভায়া গুরদুম। ঘন জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে হেঁটে ফিরছি আমরা। কোথাও কোথাও জঙ্গল এতো ঘন যে সূর্যদেব সেখানে নিজের পায়ের ছাপ রাখতে পারেননি। জঙ্গল ট্রেক যারা পছন্দ করেন (যেমন আমি) তাদের জন্যে ফেরার এই রুট টা আদর্শ। ভাগ্য ভালো থাকলে himalayan bear , red panda দেখতে পাবেন।
পথে সিরি নদীর একটি অসম্ভব সুন্দর জলপ্রপাত দেখলাম। একটু বিশ্রাম নেয়া হলো। ছোটোখাটো ফটোশ্যুট হয়ে গেলো। সিঁরি নদীর সাথে বন্ধুত্ব করে ওর সাথে সাথেই আমরা এগোতে লাগলাম। জঙ্গলের ঘনত্ব কমে এলো। টিম্বুরে হয়ে সন্ধ্যা ৬ টা নাগাদ শ্রীখোলা পৌঁছলাম। শেরিং জানালো আমরা আরো ১.৫ km এগিয়ে সেপি তে night stay করবো আজ। সেপি তে ৩/৪ টি home stay আছে। ১০০০ টাকায় আমরা একটা ৪ বেডের রুম পেয়েও গেলাম।
ফেরার গাড়ি পেতে আবার সমস্যায় পড়তে হলো। সব গাড়ি দার্জিলিং চলে গিয়েছে। তাই NJP অবধি গাড়ি নেই। এমন কি সুখিয়াপোখরি যাওয়ার গাড়িও পেতে সমস্যা হচ্ছে। ঠিক হলো সকালে গাড়ি না পেলে হেঁটে রিম্বিক নেমে যাবো। সেখান থেকে হয় তো গাড়ি পাওয়া যাবে। রাত্রের দিকে কলকাতার অন্য একটা দল, যারা আমাদের আগে পরেই সান্দাকফু গিয়েছিলো, জানালো ওরা একটা গাড়ি পেয়েছে। NJP যেতে ৬০০০ টাকা নেবে। ওনারা ৪ জন, আমরা ৫ জন। গাড়ি বুক করে নেয়া হলো।
২৪ অক্টোবর:
সকল ৯টায় আমরা ৯জন এবং দুই দলের দুই গাইড গাড়িতে ফেরার পথ ধরলাম। মানেভঞ্জন , সুখিয়াপোখরি হয়ে ৪টে নাগাদ NJP এলাম।
২৫ অক্টোবর ভোর ৪টে NJP থেকে গুয়াহাটি কলকাতা গরিব রথ এক্সপ্রেস ধরলাম। ওই দিন দুপুর ৩টে কলকাতা।
যাত্রা সমাপ্ত।...
কিছু জরুরি INFO :
১) দূরত্ব ও উচ্চতা --
ঘুম (৭৪০৪ ফুট ) থেকে সুখিয়াপোখরি - ৮ KM
সুখিয়াপোখরি থেকে মানেভঞ্জন (৭০৫৪ফুট)- ৭KM
মানেভঞ্জন থেকে মেঘমা (৯৫১৪ ফুট)-৯KM
মেঘমা থেকে টংলু(১০১০৩ ফুট)- ২KM
টংলু থেকে টুমলিং (৯৬০০ফুট)- ২KM
টুমলিং থেকে GAIRIBUS (৮৬০০ফুট)- ৭ KM .
GAIRIBUS থেকে কালিপোখরি (১০৪০০ফুট)- ৬KM
কালিপোখরি থেকে সান্দাকফু(১১৯২৯ ফুট)- ৭KM .
সান্দাকফু থেকে গুরদুম(৭১৫০ফুট)- ১০KM .
গুরদুম থেকে শ্রীখোলা - ৬KM .
শ্রীখোলা থেকে সেপি(৬২৩০ফুট) - ১.৫KM .
সেপি থেকে রিম্বিক - ৬ KM .
২)ট্রেক এর সেরা সময়- এপ্রিল-মে। এই সময় তাপমাত্রা ৫ থেকে ১২ ডিগ্রির মধ্যে থাকে। রডোডেনড্রন, ORCHID এর ফুল চোখ জুড়িয়ে দেয়।
নভেম্বর - ডিসেম্বর দ্বিতীয় মরসুম। তাপমাত্রা ০ থেকে ৮এর মধ্যে থাকে।
অনেকে ঠান্ডা উপভোগ করার জন্যে ডিসেম্বর-ফেব্রুয়ারী মাসেও যান।
জুনের মাঝামাঝি থেকে সেপ্টেম্বর এই ৩মাস সিঙ্গালিলা ন্যাশনাল পার্ক বন্ধ থাকে।
৩) WIND - CHEATER , COTS WOOL , গ্লাভস , টুপি সাথে রাখবেন। মাঝে মাঝে বৃষ্টি হয়। তাই WATER PROOF রাখা ভালো। জিন্স এর থেকে ট্রেক প্যান্ট সুবিধাজনক। SHOE একটু ভালো নেবেন। এটা সত্যি খুব জরুরি। ট্রেককিং STICK নিতে পারেন। না নিলেও গাইড কে বললে ওনারা বাঁশের লাঠি জোগাড় করে দেন।
৪) VOTER ID CARD অবশ্যই রাখবেন।
৫) মোবাইলের নেটওয়ার্ক খুব কম পাওয়া যায়। কিছু জায়গায় BSNL , কিছু জায়গায় এয়ারটেল ও কোথাও কোথাও ভোডাফোন এর নেটওয়ার্ক পাবেন।
৬) ইলেক্ট্রিসিটির প্রব্লেম খুব হয়। তাই পাওয়ার ব্যাঙ্ক, SOLAR CHARGER সাথে রাখবেন। DSLR এর অতিরিক্ত ব্যাটারী সাথে রাখতে পারেন।
৭) LUGGAGE যত কম রাখবেন আপনার হাঁটতে ততো সুবিধা হবে।
৮) প্রয়োজন মতো ওষুধ রাখবেন। যাদের vomiting tendency আছে তারা doctor কে বলে ওষুধ নেবেন। আমাদের দলের অনেকের ফেরার পথে এই ওষুধ কাজে লেগেছিলো।
৯) গাইড এর ভাড়া দিন প্রতি ১০০০/-. আর সান্দাকফু পৌঁছে গাইড কে চিকেন খাবার টাকা দিতে হয়।
১০) হোম stay -
Himchuli lodge kalipokhri 9434357443 , 009779742626492
HOTEL GREEN HILL, RIMBIK BAZAR, 9593828400, 9733069143
HOTEL NAMO BUDDHA, SANDAKAFU - 9733329134, 9635161679
SWAYAMBHU HOMESTAY , TIMBURE: 9647775590, 9732312513
HOTEL SHOVRAJ, SRIKHOLA, SEPI: 9933488243, 9832375526, 9932216197
একটি নিবেদন -
গত সোমবার আনন্দবাজার পত্রিকা এবং আরো কয়েকদিন news paper এ একটা খবর দেখলাম। বিশিষ্ট পর্বতারোহী শ্রী দেবরাজ দত্তের নেতৃত্বে ১৬ জনের একটি দল মানেভঞ্জন থেকে সান্দাকফু যাওয়ার পথে একটি সাফাই অভিযান চালান যাতে ৩০০০ কেজির বেশি প্লাস্টিক ও এলকোহলের বোতল পাওয়া যায়। অভিযাত্রী দের কাছে আমার একটি নিবেদন plz এটা করবেন না। পাহাড়টাকে একটু পরিষ্কার থাকতে দিন। সুন্দর জঙ্গল এর পথে হাঁটার সময় একটা চিপস এর প্যাকেট খুব দৃষ্টিকটু লেগেছে আমার। বিদেশী দের জন্যে যদি নাও ভাবেন, আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম দেড় জন্যে একটু ভাবুন। আসুন না , সবাই মিলে ওদের একটু পরিষ্কার পৃথিবী উপহার দি।
ধন্যবাদ।
Name- BIPLAB SANTRA
Age-28
Profession- SERVICE (W.B. GOVT.)
City- KOLKATA
Hobbies- TREKKING, PHOTOGRAPHY
Previous Tours- SIKKIM, UTTARAKHAND