(হিমাচলের স্বল্প পরিচিত অথচ তুলনামূলক সহজ সুন্দর একটি ট্রেকিং বা ভ্রমন রুট এর পরিচয় করার প্রচেষ্টা)
(প্রথম পর্ব):
** বানজার ভ্যালি, হিমাচল প্রদেশ **
হিমাচলে ভ্রমন বা ট্রেকিং বলতেই যে অঞ্চল গুলো আমাদের চোখে ভেসে আসে, সে অর্থে বানজার বা তির্থান ভ্যালি বা গ্রেট হিমালয় ন্যাশনাল পার্কের দিকটা এখনো জনপ্রিয়তা পায়নি। অথচ বিপুল প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যময় পরিবেশের ডালি সাজিয়ে রয়েছে এই সমস্ত অঞ্চল। জন কোলাহলের বাইরে....যেখানে নাম না জানা পাখিদের কলতানে ভোরের আলো এসে স্পর্শ করে পাহাড়ের মাথায় থাকা বুগিয়ালের সবুজ ঘাসে, ধীরে ধীরে নেমে এসে ছড়িয়ে পড়ে ঘন সবুজে মোড়া গ্রাম গুলোতে। শুরু হয় কর্ম ব্যাস্ত গ্রামীণ জীবন.... মেয়েরা কেউ চলেছে আপেল বাগানের কাজে... আবার কেউ বা জঙ্গলে কাঠ সংগ্রহের উদ্দেশ্যে। গ্রাম গুলোতে খুঁজে পাওয়া যায় Traditional Himachali culture এর বৈশিষ্ট্য। গ্রামের মাঝে রয়েছে মন্দির, প্রাচীন স্থাপত্যের ছাপ নিয়ে। যাদের ওয়াইল্ড লাইফ এডভেঞ্চার পছন্দ বা যাদের পক্ষী পর্যবেক্ষণ করার নেশা রয়েছে, তাদের ক্ষেত্রে এই অঞ্চল অত্যন্ত আকর্ষক। রয়েছে ট্রাউট মাছ ধরার সুযোগ। আর ট্রেকিং এর অজস্র ঠিকানা।
প্রথম পর্বঃ
ছেলের আবদার- " বাবা আমিও তোমার সাথে পাহাড়ে হাঁটব, টেন্ট এ থাকব। " মৃদু ধমক এর সুরে বললাম - "আমার এখন অফিসের কাজের চাপ, রাখ তোর আবদার।" কিন্তু কথাটা অন্তর ছুঁয়ে গেল।... ও যখন ছোট ছিলো, এক ফোঁটা ছেলে কে ছেড়ে ট্রেকিং এ আসতে খারাপ লাগত... আর ভাবতাম- "যেদিন আমি আর ছেলে দুজনে কোনো বুগিয়ালে টেন্ট লাগিয়ে থাকব.... বুগিয়ালের ঘাসে দুজনে পিঠে হেলান দিয়ে বসে বিশাল হিমালয়ের সৌন্দর্য উপভোগ করব, সেদিন আমার হিমালয় দর্শন সার্থক রূপ পাবে।"
ঈশ্বর জানেন ... ঠিক সেই দিন আমার হিমাচলের অনেক দিনের পুরোনো বন্ধু নরিন্দর ভাই এর দুপুর বেলায় ফোন.... " দাদা ক্যায়সা হালচাল হ্যায় আপকা.... " কথায় কথায় ওর বহুদিনের আহ্বান এর কথা মনে পড়ে গেল। সবিনয়ে ওকে জানালাম ছেলের ইচ্ছার কথা..... আর সেখানেই প্রোগ্রাম তৈরী হয়ে গেল। অফিস থেকে বেরিয়ে... এজেন্সি মারফত দিল্লি হয়ে হিমাচল যাবার এবং আসার টিকিট কাটাও শেষ.....। এবার অন্য চাপ..... " টিকিট তো কাটলাম.... বাড়ীতে আমার ঝগড়া করার পার্টনার আবার কি ভাবে রিএক্ট করে... সেই ভেবে।"ভাগ্য যখন সহায় থাকে তখন সব কিছুরই হিসাব মিলে যায়। এক্ষেত্রেও তাই হল।....
দিল্লি থেকে সন্ধ্যার মানালী গামী ভলভো বাসে চেপে "অট" এসে যখন নামলাম তখনও ভোরের আলো সেভাবে ফুটে বেরোয় নি। নির্জন অটের রাস্তার পাশে একটা মাত্র চায়ের দোকান সবে খুলেছে।বেশ শিরশির করা ঠান্ডা... আপাতত এক ঘন্টা এখানে বসে চা খেয়ে কাটাতে হবে।রাস্তার উলটো দিকে এমন সময় দূর্লভ জিনিসের সুলভ দর্শন হলো.... "সুলভ ইউজ এন্ড পে" রয়েছে দেখে আর কোনো ভয় না পেয়ে বাপ ব্যাটা দুজনে মনের আনন্দে ভোরের আলোয় চায়ে চুমুক দিতে লাগলাম।.... পরবর্তী গন্তব্য বানজার হয়ে জিভি গ্রাম।
দ্বিতীয় পর্বঃ
ভুন্টার থেকে বানজার গামী লোকাল বাসের জানলার ধারে পাশাপাশি দুটো সিট.... অটের টানেল টা নেহাত কম লম্বা না.... প্রায় ৩কিমি লম্বা টানেল পেরিয়ে চণ্ডীগড় গামী রাস্তা ছেড়ে বাম দিকে বাঁক নিয়ে বিপাশা নদী পেরিয়ে চলে এলো সাঁইজ নদীর পাশে.... এতো বার হিমাচলে আসি, অথচ এই দিকে আসা হয়না... ভেবে বেশ নতুন লাগছে সব কিছু। আর কিছুটা পথ এগিয়ে সাঁইজ নালা পেরিয়ে চলে এলাম তীর্থান নালার পাশে.... পথ গিয়েছে বানজার অভিমুখে।
পাহাড়ে দেখেছি ছোটোদের উৎসাহের কাছে বার বার হার মানতে হয় সিনিয়র দের। যা দেখে,.. যেটা অনুভব করে... সবটুকুই আসে অন্তরের গভীরে থাকা আবেগ থেকে। আর এই ছোটো ছোট প্রশ্ন গুলোই তাদের অভিজ্ঞতার ঝুলি কে সমৃদ্ধ করে তোলে। .....ক্লান্তি বিরাজ করছে সারা শরীর জুড়ে.... ঘুমে দুচোখের পাতা বুজে আসে, আর ব্যাহত হয় কৈশরের কৌতুহলের তাড়নায়... "উফফ.. কি মুস্কিল... ছেলেটার দেখছি আজ প্রশ্নের যেন শেষ নেই। এটা কি নদী.... ওটা কি ফুল... ঠিক ভুল জানি না.... তন্দ্রা জড়ানো চোখে উত্তর দিয়ে চলেছি..... হঠাৎ দেখি আমায় ঠেলে তুলে দেখাচ্ছে.... কি সুন্দর ফুল ফুটে রয়েছে গাছ গুলো তে... আর তুমি ঘুমোচ্ছো..... আরে সত্যি তো এতো আপেল গাছে ফুল ধরেছে.....সাদা আর গোলাপি রঙের মিশ্রনে ফুলগুলো যেন অলঙ্কার রূপে সমগ্র উপত্যকাকে সাজিয়ে তুলেছে। রাস্তার দুপাশের সেই আপেল বাগানের সৌন্দর্য দেখতে দেখতে প্রায় ২৫ কিমি দূরে বানজার এবং তার পর গাড়ী ভাড়া করে জালরি পাশ অভিমুখে আরো ৮ কিমি রাস্তা অতিক্রম করে জিভি গ্রামে। নির্জন প্রকৃতির মাঝে ছোট বড় কিছু ঘর বাড়ী নিয়ে ৬০০০ ফুট উচ্চতায় এই জনপদ।একটু উপর দিকে তাকালে জঙ্গলের গভীরতা আন্দাজ করা যায়। তবে ৭-৮ বছর আগে জিভি র কথা যেমন শুনেছিলাম....সেই হিসাবে এখন বেশ কিছু হোটেল চোখে পড়লো। "ডোলি গেস্ট হাউজ" এই অঞ্চলে বেশ পুরোনো গেস্ট হাউজ... বন্ধু নরিন্দর আমাদের আসার খবর পেয়ে আগে থেকে ওখানে সব ব্যবস্থা করে রেখেছিলো।দোতোলায় কাঠের ঘরে থাকার অভিজ্ঞতা আমার বেশ কিছুবার থাকলেও ছেলে এমন বাড়ীতে আগে কখনো থাকেনি... ওর লাফালাফি আর জোরে জোরে পা ঠুকে ওপরে ওঠার শব্দে পাশের ঘর গুলোর বিদেশী অথিতিদের ঘুম নির্ঘাত ভেঙেছিলো.... তাই তো অমন বিরক্তিকর চোখে দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে...... কিন্তু ছোট ছেলের উচ্ছাস দেখে আর রেগে থাকতে পারিনি। আলাপ করে এসে আমায় বললো... পাশের ঘরের সাহেব নাকি ম্যাঞ্চেস্টার থেকে ইন্ডিয়ায় এলে এখানে এসে ২০-২৫ দিন কাটিয়ে যায়। ওই কোনার ঘরের আমেরিকান ভদ্রমহিলা প্রায় ১০ দিন ধরে নেচার স্টাডি করছে....।প্রাকৃতিক পরিবেশে ওপেন এয়ার রেস্টুরেন্ট এ বসে ব্রেকফাস্ট সেরে ক্যামেরা নিয়ে এদিক ওদিক ঘোরাঘুরি..... এই সময় শিলাবৃষ্টি থেকে রক্ষা করতে বাগানে আপেল গাছগুলোকে প্লাস্টিক বা ত্রিপল দিয়ে ছেয়ে রাখার কাজ চলছে......। দুপাশের জঙ্গলময় পরিবেশে মাঝখানে আঁকাবাঁকা পথ চলেছে.... এখানে জঙ্গলে ওক গাছের আধিক্য.... পায়ে পায়ে ঘোরাঘুরিতে সময় কেটে যায়। সব মিশিয়ে জিভির পরিবেশ কোথাও মনের কোনে দাগ রেখে যায়। বিকালে নরিন্দর এসে পৌছে গেল। ও কোনো বিদেশী কে নিয়ে কোনো বুগিয়ালে টেন্ট খাটিয়ে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করাতে নিয়ে গিয়েছিল। জানালো আমাদের ট্রেকের জন্য সব বন্দোবস্ত পাকা করে রেখেছে। কাল সকালে ব্রেকফাস্ট করে গাড়ী নিয়ে সোজা গ্রাম হয়ে জালরি পাশ চলে গিয়ে শুরু করবো আমাদের পায়েপায়ে হিমালয় দর্শন।
তৃতীয় পর্বঃ
ট্রেক শুরুর আগের দিন আমি চেষ্টা করি রাত আটটার ভিতরে ডিনার করে নটায় বিছানা.... সেই নিয়মে শুয়ে পড়লাম বটে..... কিন্তু ঘুম ভালো ভাবে আসেনা.... বহু বার ট্রেকে এসেছি.... কিন্তু এমন ধারা হয়েছে বলে মনে পড়েনা। মনকে বলি.... টেনশন হচ্ছে? না... তা কেন হবে.... এ তো সহজ রাস্তা....। মজাদার ট্রেক।
পরে চিন্তা করে বুঝলাম চাপটা ছেলের জন্য হয়তো.... ১৪মাস আগে হাত ভেঙে যেভাবে সার্জারি হয়েছিলো... তার ওপর, সে তো আবার নিজের সমস্যা গুলো তার মা কে বলে.... আমি ওর সমস্যা গুলো ঠিক ভাবে আন্দাজ করতে পারব কিনা.... এই সব আর কি.....
দলনেতা হয়ে টিম নিয়ে আসার দায়িত্ব... আর শুধু ছেলে কে নিয়ে একা পাহাড়ে ট্রেকের দায়িত্ব দুটোর তফাত হয়তো সেদিন অনুভব করেছিলাম।
সকাল নটায় গাড়ী এসে গেল.... মালপত্র গাড়ীতে লোড করে দূর্গা দূর্গা বলে জালরি পাসের পথ ধরলাম। জিভি থেকে ওক, পাইনের জঙ্গলের ভিতর দিয়ে আঁকাবাঁকা চড়াই পথে সোজা.... সোজা গ্রামে(৯৩০০ ফুট)(৭কিমি) এসে থামলাম। দেখলাম কিছু বিদেশীর দল হেঁটে চলেছে জালরির পথে.... গাড়ীতে না গিয়ে এই ১২ কিমি পথ ট্রেক করে যেতে পারলে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আরো বেশী উপভোগ করা যায়.... কিন্তু সময়ের অভাবে গাড়ীর সাহায্য নেওয়া....। নির্জন পরিবেশে ছোট্ট গ্রাম সোজা যেন রূপের রানী। রডোডেন্ড্রন গাছের ঝোপের ভিতর দিয়ে হিমালয় দর্শন..... আহা এখানে দুটো দিন যদি কাটাতে পারতাম.....এই আক্ষেপ মনে নিয়ে চললাম আরো পাঁচ কিমি দূরে জালরি পাসের দিকে।
একটা কথা বলে রাখি..... ভেবেছিলাম এপ্রিলের গোড়ায় হিমাচলের পথে রডোডেন্ড্রনের শোভা দেখে চক্ষু সার্থক করব.... কিন্তু আশাহত হলাম.... শুনলাম এই বছর না কি ওদিকে ফেব্রুয়ারি মাসের গোড়া থেকেই ফুল ফুটে, এখন প্রায় শেষের পথে।.... যাক.... অবশিষ্ট ফুল গুলো দিয়েই ছেলে কে পরিচয় করালাম পাহাড়ি গুরাসের সাথে।
চলে এলাম ৩১২০ মি উচ্চতায় জালরি পাসের উপর। শনশন করে ঠান্ডা হাওয়া জানান দিলো.... " পাস" এর সকল বৈশিষ্ট্য নিয়েই সে রয়েছে। পাসের উপর মহাকালী মন্দির.... যাতায়াতের সময় সব গাড়ী সেখানে দাঁড়িয়ে মায়ের দর্শন করে যায়। দুএকটা ধাবা দোকান নিয়ে এই অঞ্চল। শুনলাম জালরি পাসের রিজের দক্ষিন দিক অর্থাৎ সিমলা পাহাড়ের দিক কে বলে আউটার সেরাজ(Seraj) আর উত্তর দিক অর্থাৎ বানজার এর ঢাল কে ইনার সেরাজ বলে।.... সেরাজ( Seraj) মান্ডি জেলার একটা ছোট্ট গ্রাম। বহুদিন আগে হয়ত মান্ডির রাজারা তাদের রাজত্ব সীমা নির্ধারণ করার জন্য এমন ভাবে প্রকাশ করত।
জালরি পাসের উপর গাড়ী কে বিদায় জানিয়ে ওই রিজের পশ্চিম দিকের ওক- পাইনের জঙ্গলের পথ ধরে এগিয়ে চললাম। আধ ঘন্টা এগিয়ে এসে দেখা পেলাম তিন দিকে জঙ্গলে ঘেরা এক খন্ড সবুজ ঘাসের ঢেউ খেলানো বুগিয়াল। দূরে দেখা যায় তুষার ধবল হিমালয়ের বিস্তার।.... এখানেই আজ টেন্ট করে থাকা।
নরিন্দর, বাবলু, আর আশু ভাই দ্রুততার সাথে দুটো তাঁবু আর কিচেন রেডি করে ফেললো। ঠিক হলো ম্যাগি খেয়ে আমরা এখান থেকে আশু ভাইয়ের সাথে ৪কিমি দূরে "রঘুপুর ফোর্ট"( ৩৫৫০মি) দেখতে যাব। প্রথম দিন কিছুটা চড়াই উতরাই করে উচ্চতার সাথে খাপ খাইয়ে নেবার পক্ষে যথেষ্ট।
টেন্টিং গ্রাউন্ড থেকে পশ্চিম দিকে বেশ কিছুটা উপরে পরিস্কার দেখা যায় রঘুপুর গড়ের টপ অংশটা। এখনো বেশ কিছু ঢালে শীতের জমা বরফের অবশিষ্ট অংশের ছাপ দেখে জুনিয়ারের খুশি আর ধরেনা......
রিজের দুপাশে নেমে গেছে ঘন জঙ্গল.... ঠিক তার মাঝখান ধরে হালকা উঁচুনিচু পথে এগিয়ে চলা.... বেশ কিছুটা পথ এগিয়ে এসে শুরু হলো চড়াই পথ.... দেখা হলো লোকাল কিছু ছেলে মেয়েদের সাথে.... ওরাও ছুটির দিনে মজা করার জন্য সপরিবারে ঘুরতে এসেছে.... মনে মনে ভাবি..... হায় রে পোড়া কপাল তোদের.... ৪০০-৫০০ টাকার টিকিট কেটে ঢুকে পড়ার মতো Amusement Park নেই.... তাই এতো কষ্ট করে বুকে হাপর টেনে পাহাড়ী পথে....। চড়াই শেষে উঠে এলাম হালকা ঢালের এক সুন্দর বুগিয়ালের উপরে। বহুদূর পর্যন্ত দৃশ্যমান হিমালয়ের রূপ দেখতে দেখতে অবশেষে চলে এলাম রঘুপুর ফোর্টের ভগ্ন প্রায় প্রাচীরের কাছে..... প্রাচীন আমলের পাথর সাজানো অর্ধ ভগ্ন দেওয়াল ছাড়া আর সেভাবে কিছু নেই..... মান্ডির রাজারা তাদের সীমানা সুরক্ষিত রাখার জন্য এই যায়গাটা বেছে নিয়েছিলো। .... একদিকে সুউচ্চ তুষার ধবল হিমালয় থেকে অপর দিকে আবছা নীল রঙের পাহাড় গুলো ধাপে ধাপে নেমে যেতে যেতে কোথায় যেন ধোঁয়ায় হারিয়ে গেছে..... হিমালয়ের এমন বাহারি রূপ প্রত্যক্ষ করাই এখানে আসার সার্থকতা।
ক্যাম্প সাইটে ফিরে আসতে বিকাল গড়িয়ে গেলো। নরিন্দর নিচের জঙ্গল থেকে কিছু শুকনো কাঠ জোগাড় করে রেখেছে... ঠিক হলো আজ ওপেন এয়ার মুনলাইট ডিনার হবে। মেঘমুক্ত আকাশে আগুন জ্বেলে পাহাড়ি গানের সুরে সুরে ভেসে চলা.....
টয়লেট সেরে টেন্টের চেন টেনে স্লিপিং ব্যাগে ঢোকার সময় ছোট বাবুর প্রশ্ন.... " আচ্ছা বাবা.... নীচের জঙ্গলে ভাল্লুক আছে? এখানে চলে আসতে পারে?"..... হ্যাঁ.... সে তো আসতেই পারে.....। ব্যাস..... দেখি আমার পাশে থাকা রুকস্যাক টা প্রায় এক ঝটকায় টেনে নিয়ে টেন্টের ফেস আর নিজের পিঠের ভিতরে একটা ব্যারিকেড করে নিয়ে আমার গায়ের কাছে এসে শুয়ে বলে.... ঠান্ডায় গায়ে গা লেগে থাকলে ঘুমটা ভালো হবে।.......... মনে মনে ভাবি.......
*একেই বলে - আপনি বাঁচলে বাপের নাম।*
চতুর্থ পর্ব:
কোনো এক অচেনা পাখির কর্কশ ডাকে ঘুম ভেঙে গেল.... উইন্ডচিটার গায়ে দিয়ে সোজা টেন্টের বাইরে। ভোরের হিমালয়ের ধ্যানগম্ভীর রূপের ছোঁয়ায় মনে এক অদ্ভুত শীতলতা আসে।..... না নরিন্দররা এখনো ওঠেনি। সূর্যদেব আগমনের বার্তা ধ্বনিত হচ্ছে আকাশে... সুদূরের তুষার শৃঙ্গ গুলো যেন তার প্রতিক্ষায়.... টেন্টিং গ্রাউন্ডের শেষ প্রান্তে জঙ্গলের কাছে পাহাড়ি মোনাল পাখি দেখে গুটিগুটি পায়ে ক্যামেরা আনতে আনতে ততক্ষণে মোনাল পগার পার..... আজকের গন্তব্য সেরোলসার লেক..... দূরত্ব খুব বেশী নয়... টেন্টিং গ্রাউন্ড থেকে বড় জোর ৬ কিমি। চিজ স্যান্ডুইচ আর ওমলেট দিয়ে নাস্তা সেরে টেন্ট গুছিয়ে বেরতে প্রায় নটা বেজে গেল.... নিচের ভ্যালি থেকে মেঘের দল পাহাড়ের গা ধরে উপরে উঠে আসছে.... জালরি পাসের মহাকালী মন্দিরের পিছন দিক দিয়ে পায়ে চলা পথ চলেছে লেকের দিকে। রিজ ধরে একের পর এক
ঢেউ এর মতো সবুজ ধাসে ঢাকা ঢিপি পাহাড়ের চড়াই উতরাই পথে যেতে যেতে সান্দাকফু থেকে ফালুট যাবার কথা মনে পড়ছিল।
মেঘেদের আনাগোনা বেড়েই চলেছে..... মাথার উপর রৌদ্র ততক্ষণে উধাও.... ঢিপি পাহাড়ের মাথায় একটা লাল রঙের মন্দির লক্ষ করে উঠে চলেছি.... দক্ষিন আকাশে মেঘের গর্জন শুনে পিছন ফিরে আকাশের হালচাল দেখে শঙ্খকে ( ছেলে) বললাম.... তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে চল... আমার তাড়াহুড়ো দেখে ও ঘাবড়ে গিয়ে বলে.... বৃষ্টি এলে তো.... "এমনিতেই ভিজতে হবে, প্লাস্টিক চাপা দিয়ে নেব তখন.... তবে ছোটাছুটি করে কি লাভ? "..... রাখ তোর বকবক... যা বলছি তাই কর....
দমের হাল খারাপ... বাপ - বেটার বেদম হয়েও দৌড় দেখে প্রকৃতির ও বোধহয় করুণা হয়েছিলো.... নরিন্দররা আগেই ওই লাল মন্দিরের কাছে উঠে আমাদের অপেক্ষায় বসে ছিলো.... "দাদা... পানি পিনা হ্যায়?"... না ভাই চলো, আগে এই ঊঁচু ঢিপি টা থেকে নীচে নামি... তারপর.... । কি মন্দির.... কোন ঠাকুর এখানে বসে আছে, দেখার সময় নেই... দ্রুত নীচের দিকে নামার সময় শুরু হলো ঝোড়ো হাওয়া, আর তার সাথে সাথে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি..... উইন্ডচিটারে কি আর বৃষ্টি আটকানো যায়.... আধ ভেজা হয়ে নীচের দিকে নেমে এসে চোখে পড়লো পাথর সাজানো মেষপালকদের পরিতক্ত আস্তানা... অগত্যা সেখানেই আশ্রয়.... মুষলধারা শুরুর সাথে সাথে পাল্লা দিয়ে বিদ্যুৎচমক আর বাজ পড়ার শব্দ.... পাথরের চালের ফাঁক দিয়ে সহস্রধারার মতো জল পড়ছে.... তার ভিতরে নিজেকে না ভিজিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা।..... ঘরের কোনে পড়ে থাকা কিছু শুকনো কাঠ জড়ো করে জ্বালিয়ে ভেজা জামা জুতো শুকিয়ে নেবার চেষ্টা..... এতক্ষনে শঙ্খ বুঝেছে যে, কেন ওকে ছুটিয়ে ঢিপি থেকে নামিয়ে এনেছি।(( প্রসঙ্গত বলে রাখি,.... বজ্রগর্ভ মেঘের দেখা পেলে, বুগিয়ালে, বিশেষ করে কচ্ছপের পিঠের মত ঢিপির উপর না থাকাই শ্রেয়, চেষ্টা.... যতটা সম্ভব নীচের দিকে নেমে নিজেকে সুরক্ষিত রাখা.... নতুবা... বিদ্যুৎ তার নিশানা বানিয়ে নিতে পারে।))।
এবার বৃষ্টি সাথে শুরু হলো সাবুদানার মত শিলা পড়া... আগুনের পাশে দাঁড়িয়ে শিল পড়ার দৃশ্য.... যেন সপ্নের ঘোর এনে দিলো চোখে। চলার পথ, পাশের সবুজ ঢালে সাদা চাদরের আস্তরণ.... প্রায় ঘন্টা দেড়েক পরে কমে এলো সেই তান্ডব... আর দেরী করা যাবেনা..... আকাশের মুখ ভার.... আবার যে কোনো সময় শুরু হতে পারে। তাই দ্রুত পায়ে চললাম সেরোলসার লেকের পথে।
লেকের কিছু আগে চোখে পড়লো কিছু বিচিত্র ধরনের ঘরের.... প্রকান্ড পাথরের নীচে দেওয়াল সাজিয়ে দরজা লাগিয়ে তৈরি হয়েছে থাকার জায়গা। মনে হয় ভরা মরশুমে স্থানীয় পর্যটকদের ভীড় হলে এখানে হয়ত রাত্রি যাপন করে থাকে। কিছু পাথর সাজানো ধাবা ও রয়েছে, খাবারের সাথে কম্বল মুড়ি দিয়ে রাত কাটানোর খাসা বন্দোবস্ত। ..... ঝিরিঝিরি বৃষ্টি মাথায় নিয়ে চলে এলাম ক্যাম্প সাইটে.... নরিন্দররা আগেই পৌছে গেছে.... এখানে ওরা আমায় সারপ্রাইজ দেবে বলে আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছিলো।.... এদিক ওদিক তাকিয়ে ওদের খোঁজার চেষ্টা..... হঠাৎ ধাবার ভিতর থেকে এক স্থানীয় ছেলে আসে আমায় জড়িয়ে ধরলো।... " দাদা, আমায় চিনতে পারছো? .... মুখটা বিলক্ষন মনে পড়ছে..... কিন্তু কোথায় পরিচয় ঠিক মনে পড়ছিল না.... কিছুটা আন্দাজেই বললাম..... তুমি আমার সাথে কাঙলা পাসে যাবার সময় ছিলে.....। আমি চিনতে পেরেছি দেখে... তার কি যে আনন্দ...!!! চোখের কোনায় জল.... আমায় আর ছেলেকে জড়িয়ে ধরে রেখেছে..... ভাবতেও পারেনি ঈশ্বর আমাদের হিমালয়ের এমন নির্জন যায়গায় মিলিয়ে দেবে।
২০১৩ সালে কাঙলা যাবার সময় ও খরস্রোতা নদী পেরতে গিয়ে বড়সড় দুর্ঘটনা থেকে বেঁচে গিয়েছিল। সেখান থেকে ফিরে... এই লেকের পাশে ওর বাবার তৈরি ধাবায় মানুষের সেবা করে। সামান্য পয়সার বিনিময়ে এমন যায়গায় মানুষের থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করে। তার মধ্যে নরিন্দর গরম ম্যাগীস্যুপ রেডি করে নিয়ে এলো।
গরম গরম খেয়ে যেন শরীরে কিছুটা বল পেলাম। বৃষ্টি পড়ছেনা দেখে ক্যামেরা নিয়ে ঢালু পথে নেমে সোজা চলে এলাম সেরোলসার লেকের ধারে..... চার পাশে ওক গাছের জঙ্গলের ঘেরা সবুজ জলের লেক.... লেক না বলে বড় পুকুর বললেও ভুল হবেনা। চারপাশ দিয়ে রেলিং ঘেরা বাঁধানো পথের ধারে রয়েছে "বুড়ীনাগিন" মাতার মন্দির।......
কথিত আছে বহুদিন আগে নীচের গ্রাম থেকে কোনো ব্যক্তি এখানে এসে লেকের জলে ডুবে যায়। তখন লেকের জলের গভীরে থাকা বুড়ীনাগিন মাতা তাকে আশ্রয় দেয়। এদিকে তিন বছর অতিক্রান্ত। গ্রামের লোকজন ধরে নেয় যে সে মারা গেছে। তিন বছর পরে সে বুড়ীনাগিন মাতার আশ্রয় ছেড়ে যখন গ্রামে ফেরে, তখন গ্রামের মানুষ বিশ্বাস করতে পারেনা.... তারা সব শুনে যখন সেখানে এসে পৌছায় তখন সেই ব্যক্তি মারা যায়। তার পর গ্রামের মানুষ ওই স্থান কে পুণ্য স্থান মনেকরে সেখানে বুড়ী নাগিন মাতার মন্দির স্থাপন করে।
স্বচ্ছ ও পরিস্কার লেকের জলে দু-তিনটে পরিযায়ী হাঁস ভেসে বেড়ানো দেখে মন ভরে ওঠে.... মনে ভাবি ঈশ্বর রূপে বুড়ী নাগিন মাতা এখানে বিরাজ করে কিনা বুঝি না.... কিন্তু এখানে বিরাজ করে চিরশান্তি, এখানে বিরাজ করে বিশ্বাস, এখানে বিরাজ করে ভালোবাসা। এর ভিতর দিয়েই হয় মানুষের ঈশ্বর প্রাপ্তি।
আকাশের মুখ ভার.... গুরগুর শব্দ শুনে.... টেন্টে ফেরার পথ ধরলাম। কম বেশী সারা রাত টেন্টের চালে বৃষ্টি পড়ার শব্দ..... মাঝেমাঝেই ঘুম ভেঙে ভাবি... এমন চলতে থাকলে কিভাবে সকালে হাঁটা শুরু করবো.... এপ্রিলের গোড়ায় এমন নাছোড় বৃষ্টি আশা করিনি..... তন্দ্রাজড়ানো চোখে খেয়াল হয়... জল পড়ার শব্দ টা যেন কেমন বদলে গেছে..... টেন্টের চালে টোকা মেরে দেখি..... যেটা ভেবেছিলাম, ঠিক তাই। হ্যাঁ... তুষার পাত শুরু হয়েছে..... শঙ্খ ও দেখি উঠে পড়েছে.... ভোরের আলোয় টেন্টের বাইরে চোখ রেখে দেখি.... শুধু পেঁজা তুলোর মতো ঝরে পড়ছে.... দিনের আলো ফোটার পরও কমার বিশেষ লক্ষন নেই.... প্রায় ইঞ্চি সাতেকের পুরু আস্তরণ.... নাহ...আজ আর বেরনোর কোনো সম্ভাবনা নেই... শুধু খাওয়াদাওয়া আর বরফের শোভা দেখে কাটানো এক অলস দিন।
একটু বেলার দিকে আবহাওয়া পরিস্কার হবার ইঙ্গিত পেলাম।.... ক্যামেরা নিয়ে ফসফস করে বরফ মাড়িয়ে চারপাশে ঘুরতে ঘুরতে লেকের পাশে এসে চেনা লেকের দেখা পেলাম অচেনার বেশে।.... টুপটুপ করে গাছের থেকে বরফ খসে পড়ার শব্দ..... মন্দিরের চাতালে প্রায় ফুটখানেক বরফের উপর কোনো জঙ্গলি প্রানীর পায়ের ছাপ দেখে মনে ভয় হয়.... একা এভাবে ঘোরা টা বোধহয় ঠিক নয় ভেবে.... ফিরে এলাম। আরো এক দফা ঝরার পর বিকালের আকাশ পরিস্কার হতে লাগলো.... সবাই মিলে উঠে এলাম রিজের উপর.... সূর্যাস্তের শেষ রাগে রঞ্জিত হয়ে ফিরে এলাম আস্তানায়...। পরের সকাল হোক আমাদের মনেরমত.... এই আশা নিয়ে স্লিপিং ব্যাগে।
পঞ্চম পর্ব
পরের দিন পেলাম ঝকঝকে এক সকালের দেখা। চারপাশে বিছিয়ে থাকা বরফের উপর সূর্যের আলো পড়ে আলোর তীব্রতা যেন বহুগুন দেড়ে গিয়েছে। চোখ উঠেছে সানগ্লাস..... রুকস্যাক পিঠে চড়িয়ে সেরোলসার লেক কে বিদায় জানিয়ে এগিয়ে চললাম...... বেশ কিছুটা চড়াই পথে উঠে যেতে হবে ওই রিজের উচ্চতম অংশ "নচিটপ' এ তার পর কিছুটা নেমে এসে শুরু হবে লামরি রিজ ধরে এগিয়ে যাওয়া।
রিজের উপর থেকে বরফের ঢাল গুলো নীচের দিকে নেমে এসে ওক ফরেস্টের ভিতর মিলিয়ে গেছে..... দূর থেকে দেখে সামনের পথ যথেষ্ট কঠিন বলে মনে হলেও এগিয়ে যেতে বিশেষ অসুবিধার কিছু হচ্ছে না। তার ভিতরে উতরাই ঢালে বাপ- ব্যাটা দুজনেই বার দুয়েক করে আছাড় খাওয়া হয়ে গেছে।...... মজা পেয়ে গেছে শঙ্খ... সুযোগ পেলেই হড়কানোর চেষ্টা.... ধমক দিলেও পাত্তা দেওয়ার কোনো লক্ষণ না দেখে চুপ করে গেলাম.... ঢালে ফুটে থাকা প্রিমুলা ফুল গুলোর দিকে তাকিয়ে মনে হয় যেন সাদা তোয়ালে দিয়ে মুড়ি দিয়ে রাখা সদ্যজাত শিশু.....
বরফের চাদর জড়িয়ে আমাদের দিকে মিটমিট করে দেখছে। অবশেষে উঠে এলাম নচিটপ (৩৫০০ মি) এর মাথায়। রিজের উত্তর পশ্চিম ঢালের নিচে লক্ষ করলে বহু নীচে বানজারের দিকের গ্রাম.... আর উত্তর পূর্ব ঢালের দিকে গ্রেট হিমালয় ন্যাশনাল পার্কের বিস্তার। আমরা রয়েছি... ন্যাশনাল পার্কের পশ্চিম ঢালের এক দম মাথার উপর।
এবার ঢালু পথে নীচের দিকে বেশ কিছুটা নেমে যেতে হবে.... ঢালের তীব্রতা কিন্তু বেশ বেশী... বরফ পড়ে অশান্তি আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। আশুভাই দেখি বার দুয়েক হড়কে যেতে গিয়ে টাল সামলে নীচের দিকে নেমে চলেছে.... রডোডেন্ড্রনের ঝোপের ভিতর দিয়ে ডাল পালা ধরে বা কখনো ডালপালার খোঁচা থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে নীচে নামা..... খুব সাবধানে নেমে এলাম রিজের নীচু অংশে.... গভীর জঙ্গলের মাঝে ওভারহ্যাঙ এর তলায় বসে খানিক বিশ্রাম। যায়গা টা বড় স্যাঁতসেঁতে। তাপ নেবার জন্য কিছু শুকনো কাঠ জোগাড় হয়ে গেলো.... রুটি আর হালুয়া দিয়ে প্যাক লাঞ্চের পর এক গ্লাস করে গরমাগরম চা।
আবার চড়াই পথে লামরি রিজ ধরে এগিয়ে যাওয়া।..... শঙ্খ.. উত্তেজিত হয়ে ইশারায় ডেকে কিছু কিছু বলতে চাইছে.... কাছে গিয়ে বুঝলাম বাবলু ওকে বরফের উপর কোনো জঙ্গলি প্রাণীর পায়ের ছাপ দেখিয়ে কিছু বলেছে, ..... সেই ছোট্ট বেলা থেকে জঙ্গলে বেড়াতে গিয়ে বন্য প্রাণীর দেখা না পেলেই কেঁদে কেঁদে বাড়ী ফিরতো.... ওর বোধহয় মনে হয় জঙ্গলে বেড়াতে গেলেই বাঘ- ভাল্লুক ওর সামনে দিয়ে ফ্যাশন প্যারেড করে যাবে....
আকাশ আবার মেঘে ঢাকতে শুরু হলো.... দ্রুত পায়ে এগিয়ে চললাম....অবশেষে আরো ঘন্টা দেড়েক হেঁটে চলে এলাম লামরি ক্যাম্প সাইটে.... বরফের আচ্ছাদন এর কারনে সবুজ বুগিয়াল অঞ্চল যেন পরিবর্তিত হয়েছে তুষারক্ষেত্রে। বৃষ্টি মাথায় নিয়ে বরফের উপর টেন্ট খাটানো হলো.... বৃষ্টি অবশ্য ক্ষণস্থায়ী.... উপহার পেলাম এক নক্ষত্র খচিত রাত।
ষষ্ঠ এবং শেষ পর্বঃ
সাঁজোয়ার থেকে গাড়ীতে জিভি ফেরার সময় আমার পাশে গোমড়া মুখে শঙ্খ বসে..... বিষয় টা আন্দাজ করে ওর কাছে জানতে চাইলাম যে.... "মনেকর তুই মিউজিয়াম দেখতে গেলি.... তুই একদিনে মিউজিয়ামের ২০টা ঘর দেখে ফিরে আসতে চাইবি?..... নাকি.... ৫ দিন ধরে কিছু কিছু করে পুরোটা দেখবি?"........
উত্তর এলো...""আমি এক দিনেই দেখবো.... যার ইতিহাস ভালোলাগে সে ৫ দিন ধরে দেখবে....।"
ঠিক.... যার ভালো লাগে....
হিমালয়ের প্রতিটা স্থানে, প্রতি ধাপে রয়েছে তার নিজস্ব বৈশিষ্ট্য, না দেখা কত রূপ, কত বিস্ময়.....
তাই কোনো নির্দিষ্ট লক্ষের দিকে তাকিয়ে এগিয়ে গিয়ে সফল হলে যেমন যুদ্ধ জয়ের আনন্দ পাওয়া যায়, ঠিক তেমন ই লক্ষে অবিচল থাকতে গিয়ে প্রতি ধাপের বৈচিত্র গুলো নজরে নাও আসতে পারে....
তাই হিমালয়কে আমরা কি ভাবে দেখবো... সেটা আমাদের একান্ত ভাবে নিজস্ব ভাবনা।
হালকা চালের ট্রেকে ভোরে ঘুম থেকে উঠে যুদ্ধকালীন তৎপরতায় তৈরী হয়ে হাঁটা লাগানোটা বেশ কষ্টকর হয়েযায়। সব কিছুইতেই যেন হচ্ছে হবে গোচের মনভাব.... কথা ছিলো ভোরের আলো ফোটার সাথেসাথেই লামালামরি টপের দিকে হাঁটা শুরু করব.... না হলে টপ থেকে ঘুরে নিচে সাঁজোয়ার নেমে যাওয়া মুস্কিল।......
কিন্তু যেটা হবার সেটাই হলো... স্লিপিং ব্যাগের মায়া কাটাতে দেরী হয়ে গেলো... তার পর আমার সঙ্গের শ্রীমান কে নরমে গরমে রেডি করে লামালামরির টপের দিকে হাঁটা শুরু করতেই ঘন্টাখানেক লেট.... বরফের ঢাল ধরে কিছুটা এগোনোর সাথে সাথে সূর্যিমামা একগাল হেসে সোনা চাঁদির দোকান খুলে বসলো।....
....... আর যায় কোথায়..... আমার হ্যাঙলামি শুরু হয়ে গেলো.... এদিক দেখি... ওদিক দেখি আর ক্যামেরা খুলে লেন্স বন্দি করি..... নরিন্দর তাড়া লাগায়... " দাদা জলদি করো.... দের হো যায়গা "..... মুখে হ্যঁ বললেও মনেমনে বলি...." রাখতো তোর বকবকানি "... এমন রুপোলী সকালের মিঠা রোদে ছবি না তুলে আমি গটগট করে মিলিটারি প্যারেড করে যেতে পারবো না বাপু। তাতে টপে আমি পোঁছাই আর না পৌঁছাই..... কিছু এসে যাবেনা।
কিছুটা উঠে এসেই চোখের সামনে উন্মোচিত হলো হিমালয়ের সুবিশাল রেঞ্জ.... বাঁ দিকে হনুমানটিব্বা, টেন্টু জোতের থেকে শুরু করে মাঝে ইন্দ্রাসন, দেওটিব্বা, দেবাচেন,পাপসুরা, ধরমসুরা হয়ে ডান দিকে পার্বতী পর্বত, পিন-পার্বতী অঞ্চল। আগে ওই দিক গুলোয় ঘোরার সুবাদে ওই যায়গাগুলো অন্য এঙ্গেল থেকে দেখে ছবি তুলে জুম করে গবেষণা করতে করতে সময় চলে যায়..... নরিন্দর আমার পুরোনো পরিচিত, তাই ও আমার মতিগতি আন্দাজ করে নিয়েছিলো..... আমায় আর তাড়া লাগানো ছেড়ে আমার সাথে হিমালয় গবেষনায় জড়িয়ে পড়লো। এই ভাবে আরো কিছু দূর এগিয়ে..... যথারীতি বোঝাগেলো আরো এক ঘন্টা দূরে টপে যদি যাই... তবে আর আজ নীচে সাঁজোয়ার পৌছাতে রাত্রি হয়ে যাবে। সেক্ষেত্রে রাতে জঙ্গলের পথ এদিক ওদিক হলে বিপদ বাড়বে.... তাই ক্যাম্প সাইটে ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নিলাম। শ্রীমান অবশ্য কিছুটা রেগেই গিয়েছিলো.... দোষের কিছু নেই... ছোটো বড় সবার ই উচ্চতা সবসময় বেশী টানে.... আসলে আমরা যেখানে অবস্থান করি সেই পরিবেশটাই আমাদের কাছে বাস্তব আর কল্পনার বা আকাঙ্ক্ষার জগৎ হলো উচ্চতম স্থান। দেখেছি.... যে মানুষটি পাঁচ তলার উপরে ফ্লাট এ থাকেন.... তার ১৫ তলায় থাকতে ইচ্ছা করে।
লামরি ক্যাম্প গুটিয়ে ফটোশুটিং পর্ব শেষ করে বরফের ঢাল ধরে সাঁজোয়ারে ফেরার পথ ধরলাম। .... উপর থেকে নীচের দিকে তাকিয়ে যতই মনে হোক.... এ আর এমন কি পথ.... জঙ্গলের পথ আর শেষ যেন হতে চায়না.... প্রায় ঘন্টা পাঁচেকের প্রচেষ্টায় গ্রাম ছাড়িয়ে চলে এলাম মূল রাস্তার ওপর.... আর সেখান থেকে গাড়ী পথে ১২ কিমি দূরে জিভি গ্রাম.......
(( ট্রেকটি আরো উপভোগ্য করতে যদি সময় হাতে থাকে তবে, দুদিন আরো বেশী সময় খরচ করলে নচিটপের পর গুগল থাচ ও ক্রিস্টাল কেভ ঘুরে লামালামরি ( Lama Lambhari/ চালু কথায় লামালামরি) ঘুরে আসা যায়))
Name- Saurabh Chaudhuri
Age- 53 Years
Profession- Service
City- Serampore, Hooghly
Hobbies- Travelling in Himalaya
Previous Tours- Annapurna Base Camp(south), Nepal. Oct-2018