তখনও Windows মানে জানলা, Whatsapp মানে কি খবর ? app/application মানে দরখাস্ত। Facebook, Google এসব শব্দ তখন অপরিচিত, এমন কি মোবাইল ফোন ও এসে পৌঁছয় নি ভারতে, web মানে তখনো মাকড়সার জাল।
১৯৯১ সাল, আমার প্রবল আগ্রহে, অভিজ্ঞ ট্রেকার বন্ধু সুকুমার(সোনা), আমাকে, তাদের পরবর্তী ট্রেকে নিয়ে যেতে রাজি হল। কিন্তু বিধান দিল, রোজ সকালে মাঠে গিয়ে দৌড়তে হবে, ফ্রি হ্যান্ড করতে হবে।
আমাদের দল ছিল, তাপস (ফোটোগ্রাফার SLR Camera ছিল) দেবাশীষ (দলনেতা) শংকর, উজ্জ্বল, অসীম, আমি আর সুকুমার।
Decathlon ত দূর অস্ত, এইসব Hi trek, U Back,Alpine,ইত্যাদি যারা স্যাক, স্লীপিং ব্যাগ ভাড়া দেয় তারাও তখন জন্মায়নি। একমাত্র voruka mountaineering trust ছিল, যেখানে এসব ভাড়ায় পাওয়া যেত। তিন মাস আগে থেকে আবেদন করে যাত্রার দুদিন আগে সশরীরে উপস্থিত হয়ে সংগ্রহ করতে হোত। আমি নতুন বলে আমাকে দলে নেয়নি। বন্ধুরাই সংগ্রহ করে এনেছিল। আমাকে পইপই করে বলে দিয়েছিল, অল্প জামা কাপড় নিবি, যত নিবি নিজেকে বইতে হবে,যদিও পালকের স্লীপিং ব্যাগ ছিল, কিন্তু কি ভারী আর কি গন্ধ, আসলে ফেরত দিয়েছে আর ঝাঁপিয়ে পড়ে দখল করতে হয়েছে।
তখন ট্রেনের টিকিট সবে কম্পিউটার ভুক্ত করার চেষ্টা চলছে। বিভিন্ন কাউন্টার এ বিভিন্ন রকম কোটা আছে। হাওড়ায় না পেলে ফেয়ারলি তে যেতে হবে। বেলুড় মঠেও একটা ছিল কিন্তু আমাদের দল সাতজনের হয়ে গেছে, অত টিকিট বড় কাউন্টার ছাড়া পাওয়া যাবে না। অমৃতসর মেলে টিকিট হল, পরদিন সন্ধ্যায় লক্ষ্ণৌ এ ট্রেন বদলে নৈনিতাল এক্সপ্রেস, পরের ভোরে হলদোয়ানি তে নামা। সেবার অক্টোবরের মাঝামাঝি ছিল পুজো, তখনো কাউন্টারে লাইন দিয়ে পুজোর সময় ট্রেনের টিকিট পাওয়া যেত, ভোরবেলা গেলে। বিভিন্ন জনের পরামর্শ নিয়ে স্যাক গুছানো, দুদিন ধরে স্লীপিং ব্যাগ গোটানো র ট্রেনিং, এদিক টা চেপে ধরলে ওদিক টা বেরিয়ে যায়, তার থলে তে আর ঢোকানো যায় না।
ট্রেন সকাল সকাল হলদোয়ানি পৌঁছালো,দু তিন জন দৌড়ে গিয়ে বাসে জায়গা রাখলো, বাকিরা মিলে বাসের মাথায় মালপত্র তুলতে লাগলো সাতটা স্যাক দুটো বড় বস্তা, যার মধ্যে দুটো টেন্ট, স্টোভ, থালা,বাসন, ডেকচি, গ্লাস,খুন্তি, প্রেসার কুকার, কিছু শুকনো খাবার, এসব।
আটটা নাগাদ বাস ছেড়ে দিল,পাহাড়ি পথে ঘুরে ঘুরে বাস চলতে থাকল। সেই আমার প্রথম হিমালয় দর্শন, হাঁ করে গিলছি সব। সন্ধ্যা সাতটা য় বাগেশ্বরে গিয়ে বাস হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। সবাই বসেই এসেছি, কিন্তু এদিক সেদিক।
একটা বড় ঘর নেওয়া হল,অপরিচ্ছন্ন,কিন্তু একরাতের ভাড়া ১২ টাকা! ততোধিক অন্ধকার একটি ওয়াশরুম (!) ও ছিল,ভেতরে কিছুই দেখা যায় না।
কৃচ্ছসাধন বুঝলে কৃচ্ছসাধন!!
পরদিন সকাল সাতটা য় বাস যাবে ভারারি,বাস রাস্তার সেখানেই শেষ। ন টায় পৌঁছলাম, লিডার দেবাশিষ আর সোনা, বাজার করতে চলে গেলপ্রায় আধবস্তা চাল, কিছু ডাল, আর এক জেরিকেন কেরোসিন।জাতোলি গ্রামের পুষ্কর সিং কে চিঠি দেওয়া হয়েছিল,গাইড আর দুটো পোর্টার নিয়ে আজ সকালে আমাদের সাথে এখানে দেখা করার কথা। তাদের খবর নেই। এদিকে বাজার করার ফাঁকে ওরা দুজন পোর্টার যোগাড় করে ফেলেছে,,, নন্দন সিং আর পান সিং, টাকা পয়সা নিয়ে কথাবার্তা হয়ে গেছে। ঠিক মনে নেই বোধহয় ৩০-৩৫ টাকা দিনপ্রতি, পড়াও প্রতি এমন রেট ছিল।আমি ত ইউকো ব্যাংকের কর্মচারী, ঘুরতে ঘুরতে একটা ইউকো ব্যাংক খুঁজে পেলাম। আহা কি অবস্থান, জানলা দিয়ে দেখা যাচ্ছে, নীচে বয়ে চলা সরযু নদী, ওপরে শুভ্র পর্বত শৃঙ্গ।ম্যানেজার বাবু ত ক্ষেপে লাল, প্রকৃতি দেখছেনজানেন এই নির্জন আবাসে থেকে আগের ম্যানেজার এই ঘরে গলায় দড়ি দিয়েছিল !!
ওদিকে গোপাল সিং দুজন লোক নিয়ে হাজির
পুষ্কর পাঠিয়েছে। বয়স্ক লোক। খানিক চেঁচামেচি র পর রফা হোলো গোপাল সিং গাইড কাম কুক কাম পোর্টার, আর নন্দন আর পানু,, গোপালের সাথে আনা দুজন লোক নোব না।
মালপত্র জিপে তোলা হল, নন্দন আর পানু হেঁটে এগিয়ে গেল, নদীর ধার দিয়ে অসম্ভব এবড়োখেবড়ো, ধুলি ধুসরিত রাস্তা, আমরা নজন জিপে কোনও রকমে ঠাসাঠাসি করে বসে, পথিমধ্যে নন্দন আর পানু কেও তুলে নেওয়া হল, মাডগার্ডের ওপর দাঁড়িয়ে ওরা যাবে, ২০ কিমি রাস্তা, এসে পৌঁছোলাম সং গ্রাম। জিপ আর যাবে না এখান থেকে লোহারক্ষেত যেতে হবে। সবাই মিলে ভাত ডাল ডিমের কারি, রাস্তার পাশের ঝুপড়ি তে খাওয়া হল।
তারপর দোকানের পাশ দিয়ে ঊর্ধ্বমুখী রাস্তায় হাঁটা শুরু পাঁচ মিনিটে ই দম বেরিয়ে গেল। এতবড় হাঁ করে হাঁফাচ্ছি, এই ত পাঁচ মিনিট হাঁটা হল এখন ও সাতদিন হাঁটতে হবে। মনে মনে নিজেকে বললাম পারতেই হবে, ধীরে ধীরে উঠতে শুরু করলাম।
একঘন্টায় পৌঁছে গেলাম লোহারক্ষেত। আজকের মত হাঁটা শেষ। বেলা তিনটা কিন্তু সূর্য পাহাড়ের আড়ালে চলে গেছে, আলো কমে এসেছে।
আজ সকাল থেকেই প্রস্তুতি, স্যাক গুছিয়ে নাও , স্লীপিং ব্যাগ যেন ওপরের দিকে থাকে, প্রাতরাশ করে রওনা। আটটায় বেরনো হোলো, অনেক হুড়োহুড়ি করে, সামনে উত্তুঙ্গ পাহাড়ি পথ খাড়া উঠে গেছে, এঁকেবেঁকে, পিছনে রোদ্দুর, মাঝে মাঝে গাছের ছায়া, একটু উঠেই মালুম পেলাম
চড়াই কাকে বলে, প্রতিটা পদক্ষেপে উঠতে হচ্ছে.
উঃ ! ঘামছি !! ক্লান্ত হচ্ছি !!! এই ত বেরোলাম, কিন্তু এগারো কিমি টানা চড়াই রাস্তা, কোথাও খাড়া উঠে গেছে !
ওঃ এবার শান্তি, আর চড়াই নেই, বলতেই পারছি না। উঠছি, উঠছি, পিঠে বোঝা, এসব নিয়ে সমতলেই হাঁটিনি কোনো দিন, এ ত খাড়াই পাহাড়ি পথ। মুখ হাঁ করে হাঁফাচ্ছি, তেষ্টায় ছাতি ফেটে যাচ্ছে, সকালের ঠান্ডা য় সোয়েটার পরে বেরিয়েছিলাম, সব খুলে ফেলতে হোলো, খালি একটা সূতির গেঞ্জি। তাও ঘামে জবজবে। কিন্তু ওঠার ত শেষ নেই, পৃথিবীর সব কিছু ভুলে গেছি কখন এই চড়াই শেষ হবে, আর কোনো চিন্তা নেই
গাছের ছায়া পেলে একটু দাঁড়িয়ে পড়ছি, ওপরে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করছি, আর কতটা উঠতে হবে, ওই ত ওই গাছটার মাথা, তারপর ত আর পাহাড় দেখা যাচ্ছে না। হয়ে যাবে, চল !! অনিচ্ছুক শরীর কে টেনে তুলি, আর একটু, এই ভাবে হাঁটতে থাকি,বন্ধুরা আগে পিছে আছে, সতর্ক করে দিয়েছে, একেবারে পেছনে থাকবি না, তুই প্রথম এসেছিস। মাঝামাঝি থাকার চেষ্টা করবি।
কেউ আগে চলে গেছে, কেউ পিছে, নন্দন আর পানু অত ভারী বস্তা কাঁধে নিয়ে টুকটুক করে হেঁটে, কিভাবে যে অত আগে চলে গেল, আবার মন কে সাহস দিই, চলো মুসাফির, ঘন্টা দুয়েক হাঁটার পর পেট ত খিদেয় মোচড়াচ্ছে,তখন বলেছিল, একটু বেশি করে খেয়ে নে। অনেক চড়াই। কিসব বলে, ভরা পেটে হাঁটা যায় নাকি? কম করেই খেয়েছিলাম, তরতর করে উঠে যাব বলে, কিন্তু এখন বুঝতে পারছি, পেট খিদেয় চোঁ চোঁ করছে, একটু করে জল, লজেন্স চুষে খাব বলে নিয়ে,কড়মড় করে চিবিয়ে ফেলছি।
উঠতে থাকো !! উঠতে থাকো !! ক্রমশ শরীর অবসন্ন হয়ে আসছে, চার ঘন্টা হয়ে গেল, উঠছি, আর পা চলছে না, কোনো সৌন্দর্য এর দিকে আর দৃষ্টি নেই। চোখ বুটের ডগায়, ঘাড় নিচু, ধনুকের মত বেঁকে, পিঠের বোঝা যাতে কাঁধে বেশি চাপ না দেয়উঠে চলো, চড়াই ভাঙ্গো, এ পথের কি শেষ নেইএই রাস্তা গোল গোল করে ঘুরে উঠেই যাচ্ছে, উঠেই যাচ্ছে, পাহাড়ের মাথা অব্দি বৃক্ষ শ্রেণী, যতবার ভাবছি, ওই ত ওই অব্দি দেখা যাচ্ছে, ওর ওপরে আর নেই, কিন্তু উঠে দেখছি, আর একটু ওপর সেখানে পৌঁছে আর একটু ওপরে, তখন ও জানতাম না, পরে জেনেছি, হিমালয়ের কতকগুলো বিখ্যাত চড়াই ঃ ঢাকুরির চড়াই, রি র চড়াই, রুদ্রনাথের চড়াই, সোনা দেখালো ওই দ্যাখ পাহাড়ের ওই খান টা V এর মততখন কিছুই দেখতে ইচ্ছা করছে নাকিচ্ছু শুনতে ইচ্ছা করছে না, খিদেও আর পাচ্ছে নাতেষ্টার অনুভূতি ও আর নেই।সারা শরীর, মন জুড়ে একটাই চিন্তা, কখন এ চড়াই শেষ হবে, "আরে সেই কথাই ত বলছি, ওই দ্যাখ V, ওটাই হোলো ঢাকুরি পাস," ওঃ জীবনে যে এত আনন্দ ও আছে, দ্বিগুণ উৎসাহে উঠতে শুরু করি, এবং আর ও আধঘন্টা পরে উফ ঢাকুরি পাসের মাথায়,পেছনে ত ঝকঝকে সূর্য, কিন্তু ওপারে মেঘের ঘনঘটা, যার ফলে কুমায়ুনের সব পর্বত শৃঙ্গ ই অদৃশ্য,ওই যে নীচে একটু সবুজ মাঠ দেখা যাচ্ছেওটাই ঢাকুরি,প্রায় কলম্বাসের আমেরিকা আবিষ্কারের মত আনন্দ হোলো, গড় গড় করে নেমে এলাম, সবুজ ঘাসের বিছানায়, স্যাক ফেলে দিয়ে চিৎপটাং হয়ে শুয়ে পড়লাম। হালকা রোদ্দুর মিষ্টি ঠান্ডা হাওয়া, নিস্তব্ধতা ভেদ করে মাঝে মাঝে দাঁড়কাকের কর্কশ ডাক, মেঘ রোদ্দুরের খেলা।এই সেই বিখ্যাত ঢাকুরি ব্যাংলো। প্রায় ৯০০০ ফুট উচ্চতায়, নীচে থেকে উঠে আসা গভীর জংগল, গাছপালা, এখানে এসে হাঁপিয়ে গেছে, তাই বিশ্রাম নেওয়ার জন্য সবুজ ঘাসের গালিচা পাতা। এখানে বসে সামনে তাকালেই কূমায়ুনের প্রায় সমস্ত শৃঙ্গ সার দিয়ে সাজানো, ভানোটি, গঙ্গাকোট, মৃগথুনি হয়ে মাইকতলি, পানওয়ালি দুয়ার, বালজৌরি নন্দাখাত, নন্দাকোট,আহা কি অপরুপ দৃশ্য, ফেরার সময় উপভোগ করেছিলাম একরাত থেকে। পাশের গুমটিতে ভাত ডালের অর্ডার দেওয়া হয়েছে।
ঠিক দশ মিনিট, তারপর শান্তি চলে গেল ভিজে গেঞ্জি গায়ে লেপ্টে, ঠানডা হাওয়ায় হাড় পর্যন্ত কেঁপে যাচ্ছে, গুমটির ঘরে আগুনের পাশে গিয়ে বসতে হোলো।
ভাত ডাল খেয়ে শরীর এলিয়ে গেল, সবুজ ঘাসের বিছানায়
রোদে পিঠ দিয়ে শুতেই ক্লান্তি ঘুম হয়ে চোখে নেমে এলো। আহা এখানেই থেকে যাই।, উঠে পড় স্যাক নে, আজ ই খাতি গ্রামে পৌঁছতে হবে। আবার হাঁটা? আজ এখানে থেকে গেলে হোত না?,আরে ফেরার সময় থাকবএখন উঠে পড়, চল চল, অত্যন্ত অনিচ্ছার সাথে উঠে দাঁড়াতে হল, ভারী ব্যাগ তুলতে হোলো কাঁধে, আবার হাঁটা, আর শরীর চলছে না, তবে এবার ধীরে উৎরাই, নামছি, অত কষ্ট নেই, হাঁফ ধরছে না, কিন্তু বিদ্রোহ করছে পা আর চলছে না, তারপর সতর্কবাণী, হনুমান আছে রাস্তায়, একা থাকবি না। অতএব পা চালিয়ে চলো।বিকেল সাড়ে চারটা নাগাদ খাতি গ্রাম। একটা ঘরে রাত্রিবাস।
***** ***** *****
Name : Amiya Ranjan Chatterjee
Age: 64
Profession : Retired Bank Employee (UCO Bank)
Residence: Uttarpara ( West Bengal)
Hobbies: Travelling, Photography et.al
Previous tours : 25+ treks in past 30 years