Tripsee Treks  and Tours LLP
Blog and Travel with Us

দার্জিলিং এক পাহাড়ি রূপকথা



Anindita Sil Anindita Sil

কখনো একঝাঁক রঙিন প্রজাপতিকে উড়ে বেড়াতে দেখেছেন নিজের আশেপাশে, ম্যাজিক্যাল মুহূর্ত না এক্কেবারে!! একবার ভাবুন তো যদি নিজের মনের মধ্যে যদি সেই ম্যাজিকটা শুরু হয়, যদি মনে হয় নিজের সারা শরীর মন জুড়ে হাজার হাজার প্রজাপতি উড়ে বেড়াচ্ছে!! বোঝাতে পারছি না বলুন, ভীষণ দুর্বোধ্য হয়ে যাচ্ছে কথাগুলো তাই না... 

আসলে পাহাড়ে যাওয়ার সময় আমার না ঠিক এই রকমই একটা অনুভূতি হয়, বিশেষ করে যদি সেই গন্তব্য আমাদের সকলের প্রিয় "দার্জিলিং" হয় তাহলে তো মনে হয় অসংখ্য প্রজাপতি যেন মনের মধ্যে উড়ে বেড়াচ্ছে।

দার্জিলিং মেলটা (অথবা উত্তরবঙ্গ যাওয়ার যেকোনো ট্রেন) যখন একটু একটু করে কিষানগঞ্জ আলুয়াবাড়ি পেছনে ফেলে এগিয়ে যায় নিউ জলপাইগুড়ির দিকে আমি কেমন যেন একটা ঘোরের মধ্যে চলে যাই, কারণ ততক্ষনে তো আমার ভালোবাসার হাতছানি আলিঙ্গনের প্রত্যাশায় প্রত্যাশী হয়ে উঠেছে। 

নিউ জলপাইগুড়ির কোলাহলময় ভিড়ভাট্টা আর স্থানীয় ব্যবসায়ীদের কড়ির লেনদেন মিটিয়ে বাহন যখন শিলিগুড়ি শহরের রাস্তা পেরিয়ে পাহাড়ী পাকদন্ডী বেয়ে এগিয়ে চলে পাংখাবাড়ি কার্শিয়ং এর দিকে, ইট কাঠ পাথরে আবদ্ধ সভ্যতার জঞ্জাল আর কর্পোরেট জীবনের মাপা মেকি সীমাবদ্ধতাকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে মুখে চোখে বাতাসের সজীব সতেজ ঝাপটা, যখন  আন্তরিক অভ্যর্থনা জানায় তখন গলার দিয়ে অপরিসীম খুশি আনন্দ আর একটা উন্মাদনায় মেশানো এক দলা-পাকানো অদ্ভুত অনুভূতি ছিটকে ছিটকে বেরিয়ে আসতে চায় প্রতিটা মুহূর্তে... কারণ আমি যে দার্জিলিং চলেছি!! 

আমার আশৈশবের ভালোবাসা জীবনের প্রথম পাহাড় দার্জিলিংয়ের স্পর্শ পেতে চলেছি, আবার ছুঁয়ে দেখবো তাকে কুয়াশার চাদর  আর শ্যাওলার আস্তরণ সরিয়ে আবার তাকে উষ্ণ আলিঙ্গন করবো, প্রাণ ভরে নেব আমার ভালোবাসার শহরের ঘ্রাণ, সব বাধা পেরিয়ে বার বার ফিরে আসা যায় যে শহরটার কাছে যে শহরটা আমার বাল্য স্মৃতির একটা গোটা অধ্যায় জুড়ে রয়েছে, আমি আবারও পৌঁছেছি সেই শহরের চৌকাঠে, আমার প্রানের শহর আমাকে আলিঙ্গন করবে বলে মুখিয়ে আছি আমি আসছি পাহাড় রানী তোমার কাছে আরো একবার।।

দুর্নিবার দুর্দমনীয় কোনো প্রত্যাশার পূরণের প্রতীক্ষা যে কি দুর্বিষহ কি অনন্ত তা যে এই প্রতীক্ষায় নিজেকে নিমজ্জন করেছে একমাত্র সেই জানে, কার্শিয়ং সোনাদা ঘুমের রাস্তা জোড়া যানযটের অন্তর্জালে জড়িয়ে গিয়েছি আষ্টেপৃষ্ঠে সে বন্ধনী কাটিয়ে উঠে আমার প্রানের শহরের কাছে পৌঁছাতে বড্ডো বেলা হয়ে যাচ্ছে  অধৈর্য হয়ে পরছি আমি ক্রমশ তার একটা ব্যবহারিক কারণ অবশ্যই পেট সকালের করা ব্রেকফাস্টের ম্যাগী যে ততক্ষনে ভবলীলা সাঙ্গ করেছে তা "পেটের প্যা পো আওয়াজ" ভালো রকমই জানান দিচ্ছে। 

যাক আরো প্রায় ঘন্টা খানেকের অপেক্ষার পরে আমি অবশেষে পৌঁছলাম আমার স্বপ্নের শহরে। কথায় আছে অপেক্ষা যত দীর্ঘ হয় মিলনের অনুভূতি ততই মধুর হয়, দীর্ঘ গত চার বছরের অদেখা আর অস্পর্শিত অপেক্ষা, পথের সব ক্লান্তি ক্লেদ এক লহমায় ঠিক ওই ম্যাজিকের মতনই সব ধুয়ে যায় মলিন হয়ে যায় যখন আমাকে আমার স্বপ্নসুন্দরী আমার দার্জিলিং শহর অভিবাদন জানিয়ে নিজের স্নেহময়ী ছায়ায় টেনে নেয়। ম্যালের তাজা বাতাস যে বাতাসে মিশে আছে আমার ভালোবাসার ঘ্রাণ যে ঘ্রানের স্পর্শে মিশে থাকে এমন এক অপার্থিব শীতল শিরশিরে অনুভূতি যা মনের সব কালিমা আর বুকের অন্তস্থলে জমিয়ে রাখা যাবতীয় কঠিন অভিমানের পাহাড়কে এক লহমায় গলিয়ে জল করে দিতে পারে। প্রেমিকের প্রথম স্পর্শে ঠিক যেইভাবে পবিত্র কিশোরী প্রেম শিহরিত হয় ঠিক সেইভাবেই শিহরণ জেগে ওঠে মনে প্রানে সর্বাঙ্গে, এই তো আমার দার্জিলিং। 

তবে আজ অনেক দেরি করে ফেলেছি তোমার কাছে পৌঁছাতে lদার্জিলিং ঘড়ি প্রায় সাড়ে চারটার কাঁটা ছুঁই ছুঁই, হোটেলে পৌঁছে অল্প করে ফ্রেশ হয়েই ছুটলাম দ্বিপ্রহরিক (!!) খাদ্য সন্ধ্যানে কারণ পেটের পিয়ানোয় ততক্ষনে আপৎকালীন সাইরেনের সুর বেজে উঠেছে। গন্তব্য "কুঙ্গা" কিন্তু স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষেই হোক বা বিকেল সাড়ে পাঁচটার সময় আমাদের মতো গুটিকয় উন্মাদ পাহারপ্রেমী যে তাদের ক্ষুধা নিবারণ হেতু রেস্টুরেন্টে হানা দেবে সে বিষয়ের অজ্ঞানতার দৌলতেই হোক পৌঁছে দেখা গেল কুঙ্গা তার ঝাঁপি বন্ধ করে দিয়েছে অগত্যা আমাদের দ্বিতীয় গন্তব্য "পেনাং", ক্লক টাওয়ার কে পিছনে রেখে স্টেট ব্যাংকের সামনে দিয়ে একটু এগোলেই দার্জিলিং হেড পোস্ট অফিসের ঠিক বিপরীতেই এই রেস্টুরেন্ট। নিয়েছিলাম অথেন্টিক নেপালি পর্ক থালি। বিশ্বাস করুন এমন পর্ক আমি শেষ কবে খেয়েছি মনে করা দুষ্কর, তার ওপর রেস্টুরেন্টের অন্দর সজ্জাও দৃষ্টি আকর্ষণ করবেই। খাদ্য পর্ব মিটিয়ে অর্থাৎ পেটের মধ্যস্থ ব্যান্ড পার্টিকে থামিয়ে এইবার আমার আমার অখণ্ড অবসর কারণ আমি তো কেবল তোমাকে উপলব্ধি করতে এসেছি তোমার কাছে নিজেকে সমর্পণ করতে এসেছি, তাই ম্যালের আশেপাশে ঘুরে গল্প করে আর বৃদ্ধ ইতিহ্য পাইনরিজের সামনে দিয়ে বার কয়েক হাঁটাহাঁটি করে সন্ধ্যেটা কাটিয়ে ফিরে এলাম আমাদের দুইরাতের আশ্রয়ে, আকাশে তখন কৃষ্ণকলি মেঘ চাঁদকে এক এক বার ঘিরে ধরছে আবার পরমূহুর্তেই চাঁদ সেই বাধা ছিন্ন করে তার জোৎসনা ঢেলে দিচ্ছে  নিস্তব্ধ নিঃশব্দ শান্ত প্রকৃতির ওপর, বহুক্ষণ এই লুকোচুরি খেলা চলতে লাগলো কতক্ষন তা আজ আর মনে নেই, মনে করতে চাইলেও তা হয়তো আর সম্ভব নয় কারণ ততক্ষনে গাঢ় ঘুম এসে চোখের পাতায় আল্পনা এঁকে গেছে নিপুণ হাতে।।

​পরদিন ঘুম ভাঙল  সকাল আটটার দিকে, পর্দা সরিয়ে জানলা খুলতেই দার্জিলিংয়ের আকাশ এক ঝলমলে রোদ্দুরের ঝাপটা দিয়ে সুপ্রভাত জানালো আমাকে। মনে হয় কিছুক্ষন আগেই একপশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে শহরের বুকে। গতকালের চাঁদ আর মেঘের লুকোচুরি খেলায় কে জিতেছিল কে জানে তবে আমার মনে হওয়াকে ঠিক প্রমাণিত করে শুনলাম ভোরের দিকে নাকি ঝেঁপে বৃষ্টি হয়েছে, তবে সে বৃষ্টি চাঁদের হেরে যাওয়ার দুঃখে নাকি মেঘের জিতে যাওয়ার গৌরবে বলতে পারবো না। 

দার্জিলিংয়ে আজ আমার দ্বিতীয় দিন। পূর্ব পরিকল্পনা মতোই আজ আমাদের প্রাতরাশের গন্তব্য হলো "টম এন্ড জেরী" রেস্টুরেন্ট, ম্যাল থেকে এগিয়ে গিয়ে আস্তাবল আর হোটেল ড্রিমল্যান্ড পেরিয়ে আরো খানিকটা গেলে এই রেস্তোরাঁয় আপনি পৌঁছে যাবেন।  ছোট্ট রেস্তোরাটির আসল মূলধন হলো অন্দরসজ্জা এবং একটা বুকসেল্ফ আমার মতো আরো অনেক বইপোকাদের আগ্রহ কাড়বে এ আমি নিশ্চিত, রেস্তোরাঁয় উপস্থিত পরিবেশনকারী তথা রাধুনির আমায়িক ব্যবহার, খাবারের স্বাদ, পরিমান এবং গুন নিয়েও আমার অন্তত কোনো অভিযোগ ছিল না ব্যক্তিগত ভাবে। কেভেন্টার্স এর  রুফটপ থেকে ওই মনমুগ্ধকর দৃশ্য উপভোগ করতে না পারার দুঃখ ছাড়া আর কোনো ভাবেই ক্যাভেন্টার্সকে মিস করতে দেয় নি এই রেস্টুরেন্ট। ঠিক উল্টোদিকেই আছে "সোনামস কিচেন", এখানকার খাবারেরও সুনাম সম্পর্কেও সকলেরই হয়তো জানা। 

প্রাতরাশ পর্ব শেষ করতে করতেই কুয়াশারানী আবারও ঘিরে ধরলো বিশ্ব চরাচর, তম এন্ড জেরী থেকে বেরিয়ে ম্যালের রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে একটা ফাঁকা বেঞ্চ দেখে বসে পড়লাম, এই মুহূর্তটা শুধু আমার দার্জিলিংকে উপভোগ করার পালা, আমার ভিজে স্যাঁতসেঁতে শ্যাওলা ধরা দার্জিলিংয়ের রন্ধ্রে রন্ধ্রে হাতড়ে বেড়ানোর পালা, ম্যালের একপাশের বেঞ্চে বসে পাখির কলতান শুনতে শুনতে হারিয়ে যাওয়ার পালা নিজের মধ্যে শুধু নিজেকে নিয়েই, এরই মধ্যে কখন যেন এক ঝলক তাজা রোদ এসে আমাদের স্বাগত জানালো, ভাবলাম রোদ যখন উঠেছে আরও একটু এগোতে ক্ষতি কি!! এককাপ কফি হাতে নিয়ে পাহাড়ী অলিগলি পথের বাঁক পেরিয়ে মহাকাল মন্দির ছাড়িয়ে  হেঁটে হেঁটে পৌঁছে গেলাম অবজারভেটরি হিলের রাস্তায়, পথে একদল প্রাণচঞ্চল সবুজ শিশুদের সঙ্গে দেখা হলো মনে হয় স্কুলে যাচ্ছে... একঝাঁক রঙিন প্রজাপতি শৈশবের সরলতায় পরিপূর্ণ। কিন্তু শৈলরানী তুমি তো সবসময়েই খেয়ালী আপন খেয়ালে সাজাও তুমি নিজেকে তাই হঠাৎই মেঘের ওড়নায় জড়িয়ে নিলে তুমি নিজেকে, ঢেকে গেল একহাত দূরের রাস্তাও ঝিরঝির করে ভিজে স্বপ্নরা নেমে এলো আমার সারা শরীর ছুঁয়ে, সম্পূর্ণ ভাসিয়ে দেওয়ার আগেই ছুটে গিয়ে আশ্রয় নিলাম অবসার্ভেটরির ছাউনির নীচে, মুগ্ধ হতে লাগলাম মোহময়ী পাহাড়ী বৃষ্টির ধারালো রূপের ছটায়, ঝিমঝিমে জলতরঙ্গ তার যোগ্য সঙ্গত করে সেই মুগ্ধতাকে এক ঐশ্বরিক অনুভূতির উচ্চতায় নিয়ে পৌঁছে দিয়েছিল যেন সেই মুহূর্তে, বিশ্ব চরাচর যেন স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলো সেই মুহূর্তের কাছে, হারিয়ে গিয়েছিলাম আমি তোমার মধ্যে, এই ভাবে হারাবো বলেই তো তোমার কাছে ছুটে আসা শৈলরানী তোমার জীবনসুধা আকণ্ঠ পান করবো বলেই জাগতিক সব পিছুটান থেকে কদিনের জন্য ছুটি ছিনিয়ে নিয়ে ছুটে এসেছি তোমার কাছে।  

এভাবে কতক্ষন কেটেছে জানা নেই সম্বিৎ ফিরল রাজর্ষিদার ডাকে "চল হোটেলে ফিরতে হবে তো, আবার বৃষ্টি আসতে পারে কিন্তু" খেয়াল হলো বৃষ্টি একটু ধরেছে পাইন গাছের ফাঁক দিয়ে মিষ্টি চোরা রোদ এসে পরেছে আমার পায়ের পাতার কাছে, মেঘের যেন আবার ওই লুকোচুরি খেলার আবদার শুরু হয়েছে তবে আজ আর জোৎসনার সঙ্গে নয় একেবারে সূর্যদেবের সঙ্গেই, বুঝলাম গত কালের লুকোচুরি খেলায় মেঘই জিতেছে তাই আজ আরও সাহস পেয়ে রোদকে বানিয়েছে খেলার প্রতিদ্বন্দ্বী। 

পাখির কলতান শুনতে শুনতে ফিরে এলাম হোটেলে, স্নান সেরে ফ্রেশ হয়ে নিলাম। আমাদের কিছু সঙ্গী বেরিয়েছিল গাড়ি নিয়ে উদ্যেশ্য কিছুটা ঘুরে আসবে কিন্তু মাঝপথে বৃষ্টির জন্য আটকে পরায় বেশ দেরি হয়ে গেল ওদের ফিরে আসতে, সকলে ফিরতে মধ্যাহ্ন ভোজনের উদ্দেশ্য "নানকিন" রেস্টুরেন্টে রওনা হলাম, যে রাস্তা দিয়ে আমরা পেনাং পৌঁছেছিলাম সেই সেই রাস্তা দিয়েই আরো একটু এগিয়ে গেলেই নানকিনে পৌঁছে যাওয়া যাবে। এখানকার ভালো উপস্থাপনা সুস্বাদু খাবার আর কর্মীদের আন্তরিক ব্যবহার মন জয় করবে অবশ্যই। মোমো, থাই নুডলস, মিক্স রাইস আর চিলি পর্ক দিয়ে বেশ জমে যাওয়া একটা ভোজ সারতে সারতে ঘড়ির কাঁটা প্রায় সন্ধ্যে ছয়টা ছুঁয়ে ফেললো, এমতাবস্থায় আর হোটেল ফেরার কোনো মানে হয় না, সন্ধ্যে বেলার ম্যালের সৌন্দর্য উপভোগ করতে হবে তো। খানিকক্ষণ ম্যালে কাটিয়ে দেয়ার পর হোটেল ফিরে নিজেরা গল্প করে সময় কাটিয়ে দিয়ে হঠাৎ মনে হলো রাতের খাওয়া বলে একটা ব্যাপার হয় এবং পাহাড়ি নিয়ম অনুযায়ী যা আটটা সাড়ে আটটার মধ্যেই করতে হয় (যদিও ততক্ষনে সাড়ে আট পেরিয়ে গেছে সময়), যেই ভাবা অমনি রওনা হলাম গ্ল্যেনারীসের উদ্দেশ্যে কিন্তু ভাগ্য অসহায় রাত নয়টার পরে কি আর সেখানে প্রবেশাধিকার মেলে!! অবশ্য খিদেও নেই তোমন একটা তাই সিদ্ধান্ত হলো স্ট্রিট ফুড খাওয়া হবে সেই মতো "সুব্বা মোমো" থেকে অল্প মোমো খেয়ে সেদিনের মতন ফিরে এলাম হোটেল একরাশ মনখারাপ কে সঙ্গী করে, কারণ রাত পোহালেই ফিরে আসার শমন জারি করা আছে।।

আজ ভোরের দিকে একবার যখন আমার ঘুম ভাঙল তখন জানলা খুলে দেখি তোমার আড়মোড়া তখনও ভাঙেনি কুয়াশার চাদর মুরে তখনও তুমি ওপাশ ফিরে আছো, এইবার তাহলে সোনালী কাঞ্চনজঙ্ঘা আমার অধরাই থেকে যাবে, কারণ আজ আর কিছুক্ষণেরই অতিথি যে আমি আজই আমার তোমাকে ছেড়ে ফিরে যাওয়ার পালা, এবারের মতো আজই আমার শেষ দিন দার্জিলিং এ। বিরহী প্রিয়া যেমন করে তার শয্যা আকড়ে পরে থাকে ঠিক তেমন করেই আজ আমিও ইচ্ছে করেই একটু বেলা পর্যন্তই শুয়ে থাকলাম কারণ আজ যে আমারও বিরহেরই দিন।

বেলার দিকে মেঘ একটু সরতে সোজা চলে গেলাম "গ্ল্যেনারিস"এ গত রাতের আক্ষেপ সুদে আসলে মিটিয়ে নেব বলে। মজিতো,সিজলার, চিলি পর্ক আর মিক্স নুডুলসে ভরে গেল টেবিল এইবার আর কি স্বাদে ডুবে যাওয়ার পালা, তবে শুধু স্বাদ নয় এখানকার অন্দরসজ্জা, পরিবেশ আর সোজা কথায় গোটা মাহলটায় যে আভিজাত্য এবং সেটাকে ধরে রাখার প্রচেষ্টা আমাকে মুগ্ধ করে বারবার, তবে একথা মানতেই হবে রেস্ত খসবে এখানে ভালো মতোই, তবে পরিমান যা দেয় তাতে দুজনের ভালোমতোই হয়ে যাবে। সোলো ট্রাভেলারদের জন্য অতিরক্ত খাবারের পরিমান নিয়ে কিছু ক্ষেত্রে সমস্যা হতে পারে আমি আসলে শেষ বার এই সমস্যায় পরেছিলাম। 

খাওয়াদাওয়া মিটিয়ে বেরিয়ে পরলাম শেষবার হোটেলের উদ্দেশ্যে এইবার রওনা হবার সময় হয়েছে। ফিরে যখন আসতেই হবে এবং সেটা পূর্বনির্ধারিত তখন আর দেরী করে মায়ায় জড়িয়ে তো লাভ নেই আমার সাধের পাইনরিজ, আমার স্বপ্নের ম্যাল, মহাকাল মন্দির, তোমার কুয়াশা জড়ানো মনোহারি রূপ, ভূটিয়া বস্তি, আর রহস্যে মোরা তোমার পাহাড়ি বাঁক তোমার খাদ সেই খাদের ধারের রেলিং যে রেলিংয়ে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে মেঘের ভেলায় চড়ে ভেসে যাওয়া যায় স্বপ্নর দেশে সেই সব কিছুকে বিদায় জানিয়ে ফিরে যেতে হবে সমতলে।

হঠাৎ এক দমকা বাতাস কিছুটা কুয়াশা বয়ে নিয়ে এসে ভিজিয়ে দিয়ে গেল আমাকে, শেষ মুহূর্তে তুমি কি আমাকে বিদায় সম্ভাষণ জানালে!! আবেদন রাখলে কি আবার দেখা করার!! তুমি কি বুঝতে পারছো দার্জিলিং আজ আমাকে ফিরে যেতে হচ্ছে, তোমারও কি মন ভিজছে আমারই মতো!!  তবে কথা দেওয়া থাকলো তোমাকে দার্জিলিং আমি আবার ফিরে আসবো তোমার কাছে তুমি একবার ডাকলেই খুব তাড়াতাড়ি, কতোকিছু বাকি থেকে গেলো বলতো আমার এই ঝটিকা সফরে, তোমাকে তো শুধু ছুঁয়ে দেখাই হলো খালি তোমার প্রাকৃতিক শোভার গভীরে নিজেকে সেভাবে সমর্পণ করা আর হলো কই, সবে তো তোমার নেশার ঘোর লাগছিলো তোমার নেশায় মাতাল হওয়া তো বাকি থেকেই গেল, এসেছিলাম নিজেকে আবার একবার খুঁজে পাওয়ার জন্য কিন্তু আমি তো তোমার কাছে এসে নিজেকে তোমার আঁকা বাঁকা পথের আনাচে কানাচে হারিয়ে ফেললাম আবার, নিজেকে ছড়িয়ে দিয়ে গেলাম দার্জিলিং তোমার কাছে তুমি তোমার সুযোগ মতো আমাকে গুছিয়ে তুলে রেখো কেমন, এরপর যখন আসবো একবার দেখা করিও সেই গুছিয়ে রাখা  আমার সঙ্গে যদি সম্ভব হয়, আর তুমি ততদিন ভালো থেকো দার্জিলিং মাঝে মাঝে ধরা দিয়ো স্বপ্ন হয়ে।।

ফেরার পথে হাতে যথেষ্ট সময়ে থাকায় পথে বাতাসিয়া লুপে কিছুক্ষন সময়ে কাটিয়ে রওনা দি নিউ জলপাইগুড়ির উদ্দেশ্যে শেষ যাত্রার সময়টুকু ভাবলে এখন হাসি পায় কিন্তু সেই মুহূর্তে কি অসম্ভব টেনশনের সম্মুখীন হতে হয়েছিল সেটাই সকলের সঙ্গে ভাগ করে নিতে চাই তাই এই বর্ননা। 

তখন আমরা রোহিনী পেরিয়ে গেছি নেমে এসেছি সমতলে হাতে বেশ সময় আছে যদিও সন্ধ্যে নেমে এসেছে। ভারাক্রান্ত মন হলেও হালকা ভাবেই চলেছি গন্তব্যের দিকে হঠাৎ ই গাড়িতে যান্ত্রিক গোলযোগ দেখা দিল, ড্রাইভার সাহেব ওর পরিচিত একটা গ্যারেজে গাড়ি নিয়ে গেল সমস্যা সমাধানের উদ্দেশ্যে কিন্তু সমাধানের বদলে  ড্রাইভার গ্যারেজে নিয়ে গিয়ে গাড়ি থামিয়ে যেই গাড়ির স্টার্ট বন্ধ করেছে অমনি গোটা গাড়ি গেছে লক হয়ে এবং সে গাড়ি আর দ্বিতীয়বার স্টার্ট নিচ্ছে না শত চেষ্টা অনুরোধেও, এতো সম্পূর্ণ মাথায় আকাশ ভেঙে পরা অবস্থা, কি উপায় হবে এইবার ঘড়ির কাঁটা তখন ছয়টা পেরিয়ে গেছে। ফেরার ট্রেন আটটা দশে কাঞ্চনকন্যা, আমাদের সেখান থেকে দূরত্ব তখনও ওই ঘন্টা খানেকের মতো, প্রতিটা মুহূর্ত তখন সোনার চেয়েও মূল্যবান একটা অন্য গাড়ি ঠিক হলো আমাদের এই রাস্তাটুকু উদ্ধার করে দেওয়ার জন্য এদিকে ঘড়ি ছুটছে নিজের নিয়মে তখন সন্ধ্যে সাড়ে ছটা। এরপরে সেই গাড়ি এলো আরও পনেরো কুড়ি মিনিট পরে শুরু হলো আমাদের ঐতিহাসিক এবং রোমাঞ্চকর এক যাত্রার।।


গাড়ির পিছনে বসে আমরা তখন অদ্ভুত উত্তেজনায় ফুটছি আমাদের সারথি তখন আমাদের কাছে কোনো এভ্যেঞ্জারের থেকে কম কিছু নয়। ঘড়িতে তখন প্রায় সাড়ে সাতটা আমরা তখনও সেবক মোড়ে, যানজট আমাদের পরকীয়ায় ফাঁসিয়ে ফেলে আমাদের কাছ ছাড়া করতে চাইছে না মোটেও!!  হঠাৎ কি  মনে হলো এইআরসিটিসি র সাইটে গিয়ে চেক করলাম ট্রেনের রানিং স্ট্যাটাস, সর্বনাশ!! সে ট্রেন আজ এক্কেবারে সঠিক সময়ে চলছেন বলেই এপ থেকে জানানো হলো আমরা এদিকে তখন নেতাজি স্ট্যাচুর নীচে নিউ জলপাইগুড়ি চলো অভিযানে ব্যর্থ হবো কিনা সেই চিন্তায় মগ্ন।

এদিকে ট্রেন সেবক স্টেশন পার করে গেছে, ইন্ডিকেট করছে শিলিগুড়ি স্টেশনে ঢুকছে বলে আর আমরা শিলিগুড়ি স্টেশনের কাছে তখনও সেই পরকীয়া প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছি, হাতের মোবাইলে তখন কেবল দুটি পেজ খোলা এক 'এইআরসিটিসি র রানিং স্ট্যাটাস' আর দুই 'গুগুল ম্যাপ' সেখানে ডিস্টেন্স বিটুইন মাই লোকেশন ফ্রম নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশন। কি মনে হলো একবার ভাবলাম শিলিগুড়ি নেমে গিয়ে এখন থেকেই ট্রেনে উঠে পরি তারপর যা হবে দেখা যাবে ট্রেনটা তো পাবো, ড্রাইভার কে বলতে সে অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে বললো সে আমাদের ঠিক আটটার মধ্যে পৌঁছে দেবেই এদিকে ঘড়ি তখন পৌনে আট। জাগ্গে বাবা এখন তুমিই আমাদের ধাঁন্ন্য, বাসন্তীরূপী আমরা আমাদের ইজ্জতের নিয়তি থুড়ি ট্রেন ধরতে পারার নিয়তি তোমার হাতেই ছেড়ে দিয়েছি, এমন সময়ে ফোনের আইআরসিটিসি এপ থেকে প্ল্যাটফর্ম নম্বর ও দিয়ে দিল ট্রেন আসছে পাঁচ নম্বরে মানে গোটা ফ্লাইওভার কভার করতে হবে কিন্তু ড্রাইভার দাদা বললো যে এই এপের ভরসায় যেন আমরা পাঁচে নেমে না যাই বোর্ড একবার যেন অবশ্যই দেখি এই বাণী দৈববানী অপেক্ষা কিছু কম ছিল না সেই প্রসঙ্গে আসছি একটু পরে, এখন আমরা আরো তিন/ চার কিমি দূরত্বে আর ঘড়ি প্রায় আটের কাঁটা ছোঁবে আর যানজট তো আমাদের জীবন মরণ আমাদের সর্বক্ষনের সঙ্গী।

বেশ কিছুক্ষন পরে সমস্বরে চিৎকার করে উঠলাম হ্যাঁ লাল আলোয় লেখা নিউ জলপাইগুড়ি দেখা গেছে  মনের অবস্থা তখন এমন যে পারলে ওখানেই  গাড়ি থেকে নেমে গিয়ে ছুটে পাঁচ নম্বরে চলে যাই। যাইহোক আটটা পাঁচ/সাত নাগাদ আমরা গোটা স্টেশন আলো করে পদার্পন করলাম বেচারা ড্রাইভারকে শেষে যে একটু ঘটা করে ধন্যবাদ জানিয়ে তার একটা ছবি তুলে রাখবো সে সময়টুকুও পেলাম না (এখন মনে হচ্ছে একটা ছবি থাকলে আপনাদের সঙ্গে শেয়ার করতে পারতাম), অবশ্য সেই মুহূর্তে সেই পরিস্থিতি বা স্নায়বিক জোর কোনোটাই আর অবশিষ্ট ছিল না কারুর মধ্যেই।

ব্যাগ পত্র নিয়ে চোখ দিলাম বোর্ডে কোথায় আমাদের মোস্ট ওয়ান্টেড ট্রেন আসছে সেই প্লাটফর্ম নম্বর দেখতে হবে বলে অবশ্য আমরা যদিও যথেষ্ট শিওর মন্দির ওহি বনায়েঙ্গে মানে ট্রেন পাঁচেই আসবে তাই বোর্ডে প্ল্যাটফর্ম নম্বর আপডেট হয়নি দেখে লটবহর নিয়ে উঠেই পড়েছি ফ্লাইওভারে এবং প্রায় মাঝামাঝি পৌঁছেও গেছি, যেতে যেতেই শুনতে পেলাম এনাউন্সমেন্ট ট্রেন ঢুকছে এবং আমাদের আশায় জল ঢেলে তিনি আসছেন দুই নম্বরে!! ভাগ্গিস ড্রাইভার ভাইয়ের কথা শুনে পাঁচ নম্বরে নেমে পরি নি একেবারে, এবার ভাবুন তো ওনার ওই সাবধানবাণী কি দৈববানী অপেক্ষা কম কিছু, তাড়াতাড়ি করে দুই নম্বর প্ল্যাটফর্মে নেমে এলাম আর সঙ্গে সঙ্গে ট্রেন ও ঝম ঝম শব্দ করে ঢুকে পড়লো, আর আমার সেই যাই হয়ে যাক তবু ট্রেন মিস হবে না এই ইতিহ্যকে বহাল রেখেই আমাদের এই ঐতিহাসিক ট্রেন পাকড়াও পর্বেও এখানেই ইতি পরলো, এবং অবশেষে ফিরে চললাম আমার কল্লোলিনির কাছে।।

 

এবার আমার স্বপ্নের শহরকে বিদায় জানিয়ে গন্তব্য আমার প্রাণের শহরে তিলোত্তমা কলকাতা।।

****************

 

শেষের কিছু কথা:

১. পাহাড়ে পাহাড়ের নিয়ম মেনে চলবো প্লিজ।

২. আসুন সকল পাহাড়ি মানুষদের সন্মান করি ওদের জীবন সংগ্রাম সত্যিই সম্মানের দাবি রাখে।

৩. পাহাড়কে তার নিজের মতোই ধরা দিতে দি, গেছি মানে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখতেই হবে বা বিশেষ কোনো ব্যাপার করতেই হবে এমনটা ভেবে নিলে হয়তো কোন কোন ক্ষেত্রে হতাশ হতে হবে।

৪. সবচেয়ে শেষে বলছি তবে সবচেয়ে প্রয়োজনীয় কথা যেটা সেটা হচ্ছে দার্জিলিং আমার আমাদের সকলের, আমাদের ঐতিহ্য আমাদের গর্ব, তাকে পরিচ্ছন্ন পরিষ্কার করে রাখা আমাদেরই কর্তব্য সে যাতে আরও সুন্দর আরও মোহময়ী হয়ে ওঠে যাতে সেই চেষ্টা করবো আমরা সবসময়।।

শেষ.......

Meet the Blogger

Anindita Sil


Name- Anindita Sil
Profession- Service
City- Kolkata
Hobbies- Traveling, Reading,
Previous Tours- Shimla,Manali, Kasol, Dalhousee, Amritsar, Orissa, Sikkim, Visakhapatnam, Darjeeling, Digha, Mandarmani, Talsari, Puruliya, Jaychandi, Baranti



You may also like