Read রুইনসারা তাল ( প্রথম পর্ব )
একদম মাথা ঠাণ্ডা রেখে কোনক্রমে বাইক দাঁড় করিয়ে প্রথমেই দেখে নিলাম ওর বাইকটা কেমনআছে, মোবাইল রাস্তায় পড়ে আছে কিনা , আর তারপর ওকে দেখেই বুঝতে পারছিলাম চোট বেশ গুরুতর। ভয় হচ্ছিল হাত পা কিছু ভেঙ্গেছে কিনা। ইতিমধ্যে লোকজন ওকে ধরে তুলেছে, একজন জল দিল, মাথায় , হাতে , পায়ে। একটু জল খেয়ে কল্যাণ ঠিক হল। বহত তেজ অ্যাকসিডেন্ট হুয়া, বাবুজি বহত জোর সামাল লিয়া, চিন্তা কা কোই বাত নাহি, হসপিটাল নজদিগ ই হাঁয়, ট্রিটমেন্ট করা লিজিয়ে , একটি ছেলে বলল। বাইক ভি রিপেয়ার হো জায়েগা । শালা হঠাত করে ডান দিকে ঘুরে গেল , ওকে বাঁচাতে ব্রেক করতেই পড়ে গেলাম। এতক্ষণে কল্যাণ মুখ খুলল । এর পর প্রায় মিনিট খানেক ধরে বাংলা ভাষায় যত গালিগালাজ আছে সেগুলো শুনলাম। তুই কি আমায় বলছিস? এখানে তো অন্য কেউ বাংলা বুঝবে না।আমার কথায় হুঁশ ফিরল। পাকামি করে যদি হাত পায়ের গার্ড গুলো না খুলতিস এমন কাণ্ড ঘটত না।ধরে ধরে সামনের হসপিটাল এ নিয়ে গেলাম। ওমা এটা হসপিটাল কোথায়? এতো নার্সিং হোম । অবশ্যচেহারায় কলকাতায় বা মফস্বলে বেআইনি অ্যাবরশন করার জন্য যেগুলি থাকে সেইরকম। দোতলার উপর আলমুনিয়াম এর চ্যানেল দিয়ে আর প্লাইউড দিয়ে পার্টিশন করা । খুব জোর ৪ ফুট বাই ৬ ফুট কয়েকটা ব্লক। একজন কম্পাউডার টাইপের লোক এসে কল্যান কে নিয়ে গেল। তবে খুব যত্ন করে ক্ষতস্থান পরিষ্কার করে , মলম লাগিয়ে , ব্যাথা কমাবার ইঞ্জেকশান পট পট করে ফুটিয়ে দিল।ওঃ যদি কল্যাণ এর সেই সময়ের চিল চিৎকার লিখে শোনানো যেত!! মিথ্যা বলব না আমার বেশ মজা লাগছিল,ব্যাটা যেমন পাকামো করা... এবার ফল ভোগ। পরে অবশ্য চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলাম , এতখানি রাস্তা যদি না যেতে পারে। মানুষ মেরামতির পর এবার যন্ত্র মেরামতির পালা। ৩০ মিনিটের মধ্যেই বাইক মেরামত হয়ে গেল। স্থানীয় লোকজন সাহায্য না করলে খুব বিপদে পড়ে যেতাম। সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়ে বাইকে স্টার্ট দেওয়ার সময় কানে এলো….39; সামালকে জানা বাবুজি।
আইস্তা যানা । এই যাত্রা পথে বার বার দেখেছি সাধারণ মানুষ কিভাবে ভালবাসার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। আমাদের দুজনেরই এটা একটা বিশাল বড় পাওনা। এই যাঃ যায়গাটার নামই বলা হয় নি । যায়গার নাম হচ্ছে ভাদোহি ।বেনারস থেকে মাত্র ৫০ কিমি এসেছি। ঘড়িতে বাজে প্রায় ১০ টা। এরপর কিছুক্ষণ যাচ্ছি আর দাঁড়াচ্ছি। হ্যাঁরে , তুই ঠিক আছিস তো? প্রায় ১২ টা নাগাদ কল্যাণ বলল , একটু দাঁড়া , বড্ড ঘুম পাচ্ছে। আসলে পেইন কিলার ইনজেকশন এর এফেক্ট। কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে আবার চলা , ভয় ও একটু একটু করছে , যদি ও ঘুমিয়ে পড়ে । পথের সৌন্দর্য দেখা মাথায় উঠেছে, ভালয় ভালয় লখনোউ পৌছতে পারলে হয়। এতক্ষণে পেরিয়ে এসেছি এলাহাবাদ । ২টো নাগাদ একটা ধাবায় ঢুকে জিগ্যাসা করলাম খানা মিলেগা? মিলেগা কিউ নহি সাব? কেয়া চাহিয়ে ইয়ে তো বতাইয়ে। কল্যাণ ধপাস করে একটা খাটিয়াতে শুয়ে পড়ল, আমি কিছু খাব না , আমার ঘুম পাচ্ছে। মনে মনে প্রমাদ গুনলাম , সর্বনাশ । এবার যদি না ওঠে ঘুম থেকে। ঠিক আছে ঘুমো। আমি রুটি আর রায়তা অর্ডার দিলাম। গরম গরম রুটি , তার কি স্বাদ। এরপর একটা বড় চা খেয়ে অপেক্ষা করতে লাগলাম । মাঝে মাঝে ও শব্দ করছে ঘুমের ঘোরে আঃ আঃ । বুঝতে পারছি কষ্ট হচ্ছে বেচারির । মিনিট ৪০ পরে ভাবলাম আর না এবার জাগাই। কোনক্রমে ঘুম ভাঙ্গিয়ে জোর করে দুটো রুটি আর এক গ্লাস চা খাইয়ে বের হলাম ।
হঠাত করে এলাকার চেহারা বদলে গেল। ঝাঁ চকচকে রাস্তা, দামি দামি গাড়ি চোখে পড়তে লাগল।সাইবার কাফে, মোবাইল এর দোকান, জামা কাপড়ের দোকান, আইসক্রিম পার্লার। সুন্দর সুন্দর বাড়ি।,স্ট্রীট ল্যাম্প.... কোন এক জাদু মন্ত্র বলে সব বদলে গিয়েছে। জিনস, টপ পরে সুন্দরী মহিলা। সুবেশ যুবক। আমি হাঁ করে দেখছিলাম। মনে মনে ভাবছিলাম হবেই না বা কেন। জায়গাটার নাম যে রায়বেরিলি ।আধুনিক ভারতের রাজাদের জায়গিরদার যে। একটু দেখে নেওয়া যাক কি কি আছে এখানে। National Institute of Fashion Technology (NIFT) , Rajiv Gandhi Institute of Petroleum Technology, Indira Gandhi Rashtriya Uran Akademi National Institute of Pharmaceutical Education and Research (NIPER) , Footwear Design and Development Institute(FDDI) , Feroze Gandhi Institute of Engineering and Technology (FGIET) ,Feroze Gandhi Degree College আরও অনেক কিছু । নামগুলো থেকেই যা বোঝার বুঝে নিন । এতদুর এসেছি এই মহান যায়গার মাটি স্পর্শ না করলে কি চলে। সুতরাং tea break . কল্যাণ দারুণ খুশী , ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস এর অন্ধ ভক্ত যে। ওর উত্তেজনা দেখে মনে হল ওর সব ব্যাথা উধাও । ভালোই হল । এখন কিছুটা যেতে হবে, এদিকে ঘড়িতে প্রায় সাড়ে চারটে বাজে। সন্ধ্যা নামছে , আস্তে আস্তে বাড়িঘর সব পরিবর্তন হচ্ছে। রাস্তার লোকজন ও। কেমন যেন নবাবী মেজাজ । মাগরিবের নামাজ পড়া শুরু হয়েছে । গোধূলির মরা আলোর সঙ্গে আজানের সুর মিলে মিশে একটা পরিবেশ তৈরি করছে , যেখানে কোথাও যেন বিষণ্ণতার সুর মিশে যাচ্ছে। লখনোউ এসেই গেলাম প্রায়।কল্যাণ এবার রেস্ট পাবে। অনেক ধকল গিয়েছে । পিছনে ফিরে দেখলাম... কল্যাণ নেই। এই তো পিছনে পিছনে আসছিল, গেল কোথায়? দাঁড়ালাম। ১০ মিনিট দাঁড়িয়ে ২টো সিগারেট খেয়ে ফেললাম, কিন্তু কল্যাণের দেখা নেই। ফোন করছি , রিং হয়েই যাচ্ছে , তুলছে না। কোথায় গেল? মিনিট পাঁচেক পরেই ফোন বেজে উঠল। তুই কোথায় ?; আমি তো রাস্তাতেই , তুই কোথায়?” আসছি আসছি । একজন লোকের সঙ্গে গল্প করছি, জানিস লোকটি সস্তায় হোটেল দেবে বলছে “ নিকুচি করেছে তোর সস্তার হোটেল তুই আয় , লোকটাকে কাটিয়ে দে। | আচ্ছা আসছি ,কয়েক মিনিটের মধ্যে বুলেট এর ভট ভট শব্দ শোনা গেল। ব্যাটা আকর্ণ বিস্তৃত হাসি হেসে বলল লোকটা কে পটিয়েই ফেলেছিলাম দিলি তো বাগড়া । আচ্ছা চল।উত্তরপ্রদেশ পর্যটন বিভাগের হোটেল এ যাব ঠিক করলাম। কিন্তু যায়গাটা কোথায়? ফটাস করে মোবাইলটা বার করে কল্যাণ বলল, ১ মিনিটের মধ্যে বার করে দিচ্ছি লোকেশন । ৫ মিনিট হয়েগেল সে ঘাড় গুঁজে মোবাইল দেখছে। কিরে তোর ১ মিনিট এখন হওল না? কাঁচুমাচু মুখ করে বলল নেটওয়ার্ক প্রবলেম । ওরে যন্ত্রের চেয়ে মানুষ ভালো, বিজ্ঞের মতো গম্ভীর ভাবে বললাম। চল , খুঁজে নিচ্ছি।একটু এগিয়ে একজনকে জিজ্ঞ্যাসা করতেই একজন বলল।
সিধা চলা যাইয়ে , এক গোল চক্কর আয়েগা , উশে রাইট মোড় লেহ্না, উসকে বাদ সিধা যাইয়ে দো মিনিট , ফির এক গোল চক্কর আয়েগা উশশে লেফট লে লেনা। সব শুনে আমার মাথাতেই চক্কর লেগে যাওয়ার জোগাড়। যাই হোক ,খুঁজে পেতে যখন গেলাম , গিয়ে শুনলাম ঘর নেই। মন্দের ভালো ওনারা একটা হোটেল এর ঠিকানা দিয়ে দিলেন । সেই হোটেলে পৌঁছে আর এক বিপত্তি। মিসিং কল্যান । আবার ফোন , এবার উত্তর পেলাম , ---’বার আর বিরিয়ানির খোজ নিচ্ছি!!’ দুজনে রিসেপসন এ যখন নাম লিখছি , হঠাৎ পাশের দেওয়ালে প্রমাণ সাইজের আয়নায় চোখ , গেল। দুই মূর্তিমানের সারা শরীর ধুলোতে ঢাকা, কালো আর্ম গার্ড টা ছাই রঙের হয়ে গেছে। কখন মুখে, কপালে হাত দিয়েছিলাম , সেখানে পোড়া মবিল লেগে। কল্যানের হলুদ টি-সার্টটা একধারে কালিঝুলি মাখা, হাতে ইয়াব্বড় ব্যান্ডেজ , আর একদিকটা শতছিন্ন । ওই জন্যই বোধহয় সরকারি হোটেল এ জায়গা মেলেনি। কোনক্রমে ঘরে ঢুকে স্নান টান করে ফেলার পর একটু সতেজ।
পোর্টেবল স্টোভ টাতে দু কাপ কফি বানিয়ে দুজনে বসলাম ম্যাপ নিয়ে। কল্যাণ এখন বেশ ফিট। ৫
মিনিট ও গেল না,বলল... ওই চল চল , খেতে যাব। হোটেলের পাশেই একটা বার আছে। । এর মিনিট পাঁচেকের মধ্যে নিজেকে আবিষ্কার করলাম বিয়ার আর টুন্দা কাবাবএর সঙ্গে। আহা! এখন লিখতে গিয়েও জিভে জল এসে যাচ্ছে। কাবাব চোখের নিমেষেই শেষ। মুর্গ মসল্লম বলি এবার? উত্তরের অপেক্ষা না করেই কল্যাণ অর্ডার দিয়ে দিল। আসার কিছুক্ষনের মধ্যে সেটাও শেষ । এতক্ষণে বোঝা গেল কি পরিমাণ ক্ষুধার্ত ছিলাম আমরা । চন্দ্র সুর্য ওঠার মত নিয়মেই এর পর এলো আয়ুধ স্পেশাল মাটন বিরিয়ানি। আহহ! ঘড়িতে দেখলাম ১০টা বেজে গেছে। ওয়ারকি পরোঠা টা কাল হবে বুঝলি? আমি বললাম।বিছানায় জমিয়ে বসে , কল্যাণ কে বললাম মীর তকী মীর এর নাম শুনেছিস? মীর তকী মীর- উর্দু ভাষার প্রথম শক্তিমান কবি -- না । শুনিনি , আগ্রহ ও নেই। --- উনি আগ্রায় জন্ম গ্রহন করেছিলেন কিন্তু ১৭৮২ সালে এখানে চলে আসেন। আচ্ছা ছাড় পরে না হয় বলব। , বিরিয়ানি যে খাস কলকাতায় সেটার পিছনে নবাব ওয়াজিদ আলি শাহের অবদান আছে সেটা জানিস? --- না। ---- উফ! খাবি আর জানবি না, ----- আচ্ছা পরে শুনব , ঘুম পাচ্ছে।গোমতী ছেড়ে গঙ্গায় আসায় কতখানি চোখের জল ফেলে ছিলেন নবাব? একদল লোক ছুটে যাচ্ছে, প্রচণ্ড হই চই চার দিকে , দোকান পত্র যে কটি আছে সব বন্ধ হয়ে যাছে।একঝাঁক সৈন্য ঘোড়া ছুটিয়ে চলে গেল। গুলির আওয়াজ ভেসে আসছে। প্রচণ্ড আওয়াজ । আজ বুঝি সব বাঁধন ভেঙ্গে গেছে। রাস্তা ধুলো তে ভর্তি । কি হলো কিছুই বুঝতে পারছি না।বাইরে মুখ বাড়িয়ে একজনকে জিজ্ঞ্যাসা করলাম কেয়া হুয়া? আপ জানতে নাহি বেগমজি আ গয়ি,হুমলগ আজ কিলা ওয়াপ্স লে লেংগে। বদলা চাহিয়ে। আপ অন্দর জাইয়ে। হটাৎ কানফাটানো শব্দ। আরে আমি তো হোটেল এ বিছানায়। স্বপ্ন দেখছিলাম।
বেগম হযরত মহল নবাব ওয়াজিদ আলী শাহ এর প্রথম স্ত্রী ছিলেন। লখনৌর রেসিডেন্ট জেনারেল স্লীম্যান কুশাসন ও অনাচার-এর অভিযোগ আনলেন তৎকালীন নবাব আবুল মনসুর মীর্জা মহম্মদ ওয়াজিদ আলি শাহ-এর বিরুদ্ধে। রিপোর্ট জমা দিলেন। Doctrine of Lapse –এর দ্বারা রাজ্যশাসনে ব্যর্থতার কারন দেখিয়ে ওয়াজিদকে সিংহাসনচ্যুত করা হল। ১৮৫৪. বিতাড়িত হলেন । . ওয়াজিদ আলি শাহ বার্ষিক বারো. লক্ষ টাকা পেনসন নিয়ে অযোধ্যার রাজপাট ছেড়ে এলেন. কলিকাতায়। লর্ড ডালহৌসি অযোধ্যা অধিকার করলেন । অযোধ্যার নবাবের প্রাসাদ লুণ্ঠন করা হল।অযোধ্যার প্রসাদ হতে নবাবের কন্যাদের বের করে দেওয়া হোল । ৩০ মে, ১৮৫৭ বেগম হযরত মহল এর নেতৃত্বে লখনৌর রেসিদডেন্সে আক্রমন হোল। তখন সিপাহী বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়েছে সারা ভারতে । রেসিডেন্সে তখন প্রায় ১৭০০ সৈন্য আটকা পড়ে গেলেন। গোলার আঘাতে ভেঙ্গে পড়লো প্রবেশ দ্বার । রেসিডেন্সিতে তখন ইংরাজ ও দেশি মিলিয়ে প্রায় ১৭০০ জন সৈন্য ও তাদের পরিবার-বর্গ উপস্থিত ছিল কমিশনার হেনরি লরেন্সের অধীনে। এই আক্রমণ অবশ্য সফল হয়নি।
সিপাহীরা রেসিডেন্সি আটকে রাখল নভেম্বর মাস পর্যন্ত এর মধ্যে অবশ্য জুলাই মাসে মারা গেলেন হেনরি লরেন্স। অবশেষে স্যার কলিং বেল ক্যাম্পবেল নভেম্বর মাসে আবার দখল নিলেন। কিন্তু কি হলো বেগম হজরত মহল এর ?বেগম হজরত মহল তার পুত্র সমেত নেপালে নির্বাসিত হলেন। কিন্তু সেখানেও কি শান্তি আছে ?নেপালের প্রধানমন্ত্রী বাহাদুর তাকে প্রথমে আশ্রয় দিতে অস্বীকার করেন পরে অবশ্য আশ্রয়দান করেন ক্লান্ত বিধ্বস্ত বেগম সাহেবা 1879 সালে মারা যান কাঠমুন্ডুর জামা মসজিদে এক অনামা ফলকবিহীন কবরে সমাধিস্থ হলেন ভারতবর্ষে স্বাধীনতা যুদ্ধের এমন একজন মহিলা যাকে আর কেউ মনে রাখলো না। নানা সাহেব, তাতিয়া টোপির নাম আমরা সবাই জানি, কিন্তু কতজন জানেন অসমসাহসী এই মহিলার কথা যিনি ওনাদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করেছিলেন। অতি সাধারন পরিবারের মেয়ে নবাবের হারেমের এক বেগম বিক্রি করে দিয়েছিলেন তার বাবা-মা জীবনে কি অদ্ভত রং বদল, শেষে ভীন দেশে অবহেলাতে মৃত্যু হোল।
এইসব ভাবতে ভাবতে মন ভারী হয়ে যাচ্ছিল। না এবার বেরোবার সময় হল আবার পথে বেরিয়ে পড়ার। এবার গন্তব্য হরিদ্বার।সকালের নরম আলোতে নবাবী শহরের ভাঙছে ঘুম। ইতিউতি পর্যটকরা ঘুরছে ।আমাদের শহর ছাড়তে হচ্ছে । যেতে ইচ্ছে করছে না কিন্তু সময়ের হাতে বন্দী যে আমরা ।কিন্তু আমাদের তো যেতেই হবে । দু দিক দিয়ে দুটো রাস্তা বেরিয়ে গেছে এক দিক সীতাপুর হয়ে অন্য দিক হরদই হয়ে। হরদই,সাইবাদ, শাজাহানপুর। শাজাহানপুর থেকে আবার দুটো রাস্তা, একটা পিলভিট হয়ে হলদোয়ানী যাচ্ছে নৈনিতাল যাওয়ার জন্য আর একটা বেরিলী, রামপুর, মোরদাবাদ , বিজনোর,নাজিবাবাদ হয়ে হরিদ্বার। বেরিলী থেকেও একটা রাস্তা আছে যেটা দিয়ে নৈনিতাল চলে যাওয়া যায়।শাজাহানপুর পর্যন্ত রাস্তা খুব একটা খারাপ না আবার ভালো ও নয় ।
গতি মন্থরতায় ভুগছিলাম রাস্তার লোকজন অলস ভাবে পার হচ্ছে ট্রাক্টর, গরুর গাড়ি মাঝে মাঝেই শ্লথ করে দিচ্ছে গতি।চলে এলাম শাজাহানপুর। কিরে চল পিন্ডারি চলে যাই আমি বললাম দেখলাম কথার কোন উত্তর এলো না।অগত্যা আবার এগিয়ে চলা। মাঝে এক জায়গায় আলুর পরোটা আর চাটনি দিয়ে বিলম্বিত ব্রেকফাস্ট করলাম ।একটা জঙ্গল ঘেরা জায়গা একটু উঁচু নিচু বেশ লাগছিল। একটা নাগাদ একটা ধাবায় খেতে ঢুকলাম।ভাত, সবজ, রায়তা, টক, দই এই দিয়েই মোটামুটি মধ্যাহ্ন ভোজন সারলাম। এদিকে সেদিকে ছোট-বড় লরি, টেম্পো দাঁড় করানো আছে। কেউবা জল নিয়ে স্নান করছে, কেউবা খাটিয়াতে বসে একমনে খাবার খেয়ে চলেছে। রুটি করেই চলেছে একটি লোক...। সিগারেট মদ পাওয়া যাচ্ছে। গাড়ির ড্রাইভার আর সাথীদের কেউ কেউ সেগুলো নিয়েও বসেছে। মাঝে মাঝে জড়ানো গলায় আওয়াজ আসছে রুটি দেনা, পানি দেনা ,সারা ভারতে রাস্তার ধারে ধাবার চরিত্র মোটামুটি একই রকম।
আমরা খেয়ে কিছুটা বিশ্রাম নিয়ে আবার বেরিয়ে পড়লাম দিল্লির উদ্দেশ্যে। কিছুদূর এগোবার হঠাৎ দেখলাম একটা হোন্ডা সিটি আসছে এতক্ষণ রাস্তায় বড় লরি আর কখনো maruti alto, টাটা ইন্ডিকা ছাড়া আর কিছুই চোখে পড়েনি একটা বাঁক টপকাতে সামনে দেখলাম রাস্তাটা কোন যাদু মন্ত্র বলে সুন্দর হয়ে গেল। মধ্যিখান দিয়ে সাদা রং দিয়ে আপডাউন রাস্তা করা, লোকজনের পোশাক-পরিচ্ছদ পাল্টে গেল, একটি মেয়েকে দেখলাম aviator চালিয়ে চলে গেল। বুঝতে পারলাম এসে পড়েছি। মাথার মধ্যে গুনগুন করতে শুরু করলো বেরিলী বাজার মে... ঝুমকা গিরা রে, এক কলি বারবার মাথার মধ্যে। প্রায় 250 কিলোমিটার চলে এসেছি যেতে হবে আরও প্রায় 250 কিলোমিটার রাস্তা। ঝাঁ চকচকে রাস্তা পেয়ে আমাদের সে কি আনন্দ। চল ধান্নু চল।
বাইককে ঘোড়া বানিয়ে বললাম। এদিকে আলো ক্রমশ কমে আসছে পেরিয়ে এলাম রামপুর মোরাদাবাদ। মোরাদাবাদে একটু দাঁড়ালাম। একটা অখাদ্য এগরোল খেলাম। অন্ধকার নেমে গেছে ঘড়িতে প্রায় সাতটা বাজে এখনো যেতে হবে প্রায় 80-90 কিলোমিটার । নাজিবাবাদ আসার আগে একটা রোড সাইড ধাবায় দাড়ালাম। শরীর এবার ধকল জানান দিচ্ছে, মুখে চোখে জল দিয়ে একটু ধাতস্থ হবার চেষ্টা করলাম। কল্যাণের ও অবস্থা তথৈবচ ওর মনের জোর অত্যন্ত বেশি অ্যাক্সিডেন্টের আঘাত এখনও ছাড়েনি। এখন আর যেতে আর ইচ্ছে করছে না মনে হচ্ছে চুলোয় যাক হরিদ্বার এখানেই খাটিয়া পেতে রাত কাটিয়ে দিই। চুপ করে শুয়ে রইলাম।একটু তন্দ্রা মতো এসেছিল। কল্যাণ ইতিমধ্যেই একটা চায়ের অর্ডার দিয়েছিল, একটা বাচ্চা ছেলে এসে ডাকল বাবু চা , ধড়মড়িয়ে উঠে পড়লাম। চা খেয়ে ভেবে দেখলাম এখানেই যাইহোক খেয়ে নিতে হবে মাঝরাতে হরিদ্বারে কিছুই পাবনা এখনো প্রায় 50 কিলোমিটার সাধারণ অবস্থায় এক ঘন্টা লাগার কথা কিন্তু রাত্রিবেলা
জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে রাস্তা, আরো অনেক বেশি লাগবে। দুটো আলুর পরোটা পেটে চালান করে দিয়ে যখন আবার শুরু করলাম তখন ঘড়িতে ৯টা বাজে বেশ কিছুটা যাওয়ার পর সিরিয়াপুর জঙ্গল এসে গেল। ঘন কালো অন্ধকারে জঙ্গলকে ভয়াল লাগছে মাঝে মাঝে লক্ষ্য লক্ষ্য জোনাকি একসঙ্গে জ্বলছে আর নিজে নিজে একসঙ্গে জ্বলছে আর নিভছে। পিছনে ট্রাকের হেডলাইট এ এ ঝকঝক করছে কালো পিচের রাস্তায় সাদা ডিভাইডার লাইন। ঘাট রোড, অতি সাবধানে চালাতে হচ্ছে। একদল ট্রাককে ওভারটেক করার খানিকটা রাস্তা আমরা দুজনে যাচ্ছি। কিছু পরেই হঠাৎ করে আমার বাইকে লাইটে দেখলাম একটা সম্বর । কল্যান কে ইশারায় দাঁড়াতে বললাম দুজনে আলো নিভিয়ে দিলাম। গাছের ফাঁকে রাজকীয় ভঙ্গিতে সে দাঁড়িয়ে। ক্যামেরায় যে ধরব তাকে তাকে সে উপায় নেই, রুকস্যাকে ক্যামেরা ভরে ফেলেছি। এক দিক দিয়ে হয় তা ভালোই হয়েছে, মন ক্যামেরায় তোলা ছবি কোনদিন ফেড হবে না। এরপর যখন হরিদ্বার পৌঁছলাম তখন ঘড়িতে বারোটা বাজে । রেল স্টেশন এর দিকে গঙ্গার ধারে নয় তার উল্টো দিকে আমরা এসে পৌঁছেছিলাম ।কোন আওয়াজ নেই চারপাশ। লালচে বাতিস্তম্ভের গোড়ায় জমাট বাঁধা অন্ধকারে কিছু কুকুর ঘুরে বেড়াচ্ছে কিছু এখানে ওখানে রাস্তার ধারে কুণ্ডলী পাকিয়ে শুয়ে আছে। এত রাত্রেও একটা খাবারের দোকান খোলা। এক জায়গায় বাইক দাঁড় করিয়ে ভাবছি যে রাতে কোথায় থাকব, আর কি আশ্চর্য! যেন মাটি ফুঁড়ে হাজির হলো একটা 10-12 বছরের ছেলে। হোটেল চাহিয়ে? আচ্ছা হোটেল হ্যায়। হাতে যেন চাঁদ পেলাম। কঁহা হ্যায় তেরা হোটেল? আমার বাঙালি টুটাফুটা হিন্দিতে বললাম ।কল্যাণকে বললাম যা তো একটু দেখে আয়। অনেক রাত হয়েছে মাথা গোঁজার মত ভদ্রস্থ জায়গা হলেই হবে। বাচ্চাটাকে বাইকে চাপিয়ে নিয়ে গেল কল্যাণ। এদিকে 10 মিনিট হয়ে গেলো কোন পাত্তা এই। ফোন করলাম, ফোন বেজেই যাচ্ছে ধরছেনা অবশেষে আরো মিনিট পাঁচেক পর কল্যাণের বাইকের শব্দ পাওয়া গেল।চল ব্যবস্থা হয়েছে। এসে পৌঁছলাম রযাল ইন এ। রয়াল কম , ইন বেশি।বাঙালি ভদ্রলোক। ব্যবহার অতিশয় ভয়ংকর। জায়গা দেখে আমার চক্ষু ছানাবড়া। প্রায় 10 /11 ফুট একটা ভীষন ঢালু জায়গা দিয়ে বাইক নামাতে হবে নীচের বেশমেন্ট এ। প্রায় সিক্সটি ডিগ্রি স্লোপ দিয়ে বাইক নামাতে হবে। উফফ! সারা শরীর ভর্তি ক্লান্তি তখন। কোনোক্রমে অতি সাবধানে বাইক টা নামিয়ে রাখলাম। ঘরে ঢুকেই দেখলাম দুটি পরিচ্ছন্ন বিছানা আর কি চাই। এতক্ষন দুজনেরই মনে হল অনেকক্ষণ পেটে পড়েনি কিছু। বাচ্চা ছেলেটা 2 বোতল জল দিয়ে গেল । কল্যান প্রথমে কুড়ি টাকা বার করে আবার কি ভেবে 50 টাকা ছেলেটিকে দিলো। বাচ্চাটা আমাদের অনেক উপকার করেছে। রুকস্যাক থেকে বিস্কুটের প্যাকেট, ফ্রুট কেক আর একটা বাদামের প্যাকেট পেলাম। আমরা বুভুক্ষুর মত খেলাম। একটু হুইস্কি ছিল সেটাও শেষ হয়ে গেল। ক্রমে গা হাত পা ধুয়ে বিছানায় যেতেই আর কিছু মনে নেই।
Name- Nilay Chatterjee
Profession- Service
City- Howrah
Hobbies- Trekking, Biking and photography
Previous Tours- Kolkata to panchachulli Biking and trekking (2019)