Tripsee Treks  and Tours LLP
Blog and Travel with Us

গোয়েচালা গপ্পো



Rudrajit Banerjee Rudrajit Banerjee

বিষয়বস্তু ট্রেক। হ্যাঁ, বিষয়'বস্তু' ই বলছি  কারণ আমার কাছে ট্রেক তখন বস্তু ছিল। খায় নাকি গায়ে ঘষে বুঝতামনা। পাহাড় নিয়ে আমার অভিজ্ঞতাও রীতিমতো শিহরণযোগ্য ছিল। মানে পাহাড় ছবিতে দেখেছি, বরফ ফ্রিজে দেখেছি।

​তা কিছু বন্ধু ট্রেকের প্লান করলো রূপকুন্ড যাবে। আমাকেও জোরাজুরি করা হলো। বলা হলো, "কোনো ব্যাপার না, তুই শুধু হাঁটবি।" আমি উত্তর দিয়েছিলাম,"যতটা পারবো যাবো। না পারলে থেমে যাবো। ফেরার সময় তোদের সাথে ফিরে যাবো।"

​তা শেষমুহূর্তে রূপকুণ্ডে ক্যাম্প করা নিয়ে কিছু জটিলতা তৈরি হয় আদালতের রায়ে। রাতারাতি জানতে পারি আমরা নাকের বদলে নরুন ভেবে গোয়েচালা যাচ্ছি। আমার কাছে আলাদা কিছু ছিলোনা। রূপকুন্ড ও একটা জায়গার নাম, গোয়েচালাও একটা জায়গার নাম আমার কাছে। শুধু একজন ট্রেক-অভিজ্ঞ অফিসবন্ধু দাদা আমাকে বলেছিল, "পাগল নাকি, প্রথম ট্রেক গোয়েচালা"। যেটা কিনা বেশ চাপ খাইয়েছিলো আমায়। এদিকে ভাইফোঁটা পরে যাওয়ায় দল ছোট হতে হতে ৭ জনের দাঁড়ালো। তার মধ্যে ৩ জনের ফালুট ট্রেক করার অভিজ্ঞতা আছে (ত্রিদিপ, সুজিত, অনুপম)। বাকি ৪ জন প্রথমবার (অমিত, পল্লব, সন্তোষ এবং আমি)

এবার আসল গল্পে আসি।

যাত্রা শুরু:

২রা নভেম্বর, ২০১৮

ট্রেনে উঠে পল্লব আর সন্তোষের সাথে পরিচয় পর্ব সেরে আড্ডা, খাওয়া, ঘুম।

৩রা নভেম্বর,

সারাইঘাট এক্সপ্রেস রাত ২:৩০ এ নিউ জলপাইগুড়ি নামালো। ভোর ৪টের মধ্যে ইউকসামের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। হাইওয়ের কাজ সামলে প্রচুর ধুলো সামলে দুপুর ২:৩০  নাগাদ পৌছালাম। দুপুরের খাবার খেয়ে একটু ঘুরতে বেরোলাম। গন্তব্য ডুবকি মোনাস্ট্রি। ওটা আসলে আমার ট্রেক করার ট্রেনিং ছিল। যাই হোক হাওয়াই চটির সাহায্যে খুব সহজে না হলেও সফলভাবে ঘুরে এলাম।

৪ঠা নভেম্বর,

​সকাল থেকেই উত্তেজিত। তার উপর জীবনে প্রথমবার বরফ আচ্ছাদিত শৃঙ্গ দেখেছি। লোকজনকে জিজ্ঞেস করে জানলাম ওটা পান্ডিম। নাহলে হয়তো কাঞ্চনজঙ্ঘা ভাবতাম।

হাঁটা শুরু হলো, কোথায় পাহাড়? এতো জঙ্গল!! পাশে পাশে একটা নদী যাচ্ছে। বহুদূরে সুতোর মতো কোনো ঝর্ণা দেখতে পেলেও ছবি তুলছি জুম করে। তখনও ভাবিনি কোথায় যাচ্ছি আর কি কি দেখতে চলেছি। পৌছালাম সাচেন। জঙ্গলের মধ্যে ক্যাম্প। ২জন প্রতি একটা টেন্ট থাকায় আমি একা একটা টেন্টে। যদিও আমার মতো লম্বা মানুষের জন্য এটা বেশ সুবিধাজনক ছিল। সেই রাতের অভিজ্ঞতা বলতে, ১নং করতে বেরোনোর জন্য পাশের টেন্টের অনুপমের কাছে গালাগাল খেলাম ওদের না ডেকে একা বেরোনোর জন্য। পরে ২নং এর চাপ আসতে যখন তাদের ডাকলাম তখনও গালাগালই খেলাম সুজিতের কাছে ঘুম ভাঙানোর জন্য। অগত্যা একাই এক হাতে টর্চ অন্য হাতে লাঠি নিয়ে অনেকটা নীচে নেমে সেরে এলাম।

৫ই নভেম্বর,

গন্তব্য শোকা, বেশ ভালোই হাঁটছিলাম। মনে হলো আগেরদিনের মতোই ব্যাপারটা। চাপ নেই। একটা ঝুলন্ত ব্রিজ পেরোলাম। তারপর শুধু ওঠা। সেকি ওঠা রে ভাই। আমার চিন্তাভাবনা অনুযায়ী আমি ওখানেই থেমে যাবো ভাবছিলাম। কিন্তু ওখানে তো কোনো থাকার জায়গা নেই। বাকিদের ফিরে আসা অবধি থাকবো কোথায়? সুতরাং উঠতেই হলো। পৌছালাম শোকা। পথিমধ্যে আমাদের গাইড রমেশ আমাদের কিউই (kiwi) খাওয়ালো গাছ থেকে ছিঁড়ে।

শোকা জায়গাটা বেশ মজাদার। এখানে ৪জি মেলে। ইনস্টাগ্রামে ফটো আপলোড করা যায়। গুগলে তাপমাত্রা জানা যায়। -২ ডিগ্রিতে স্লিপিংব্যাগে ঢুকে প্রেমিকাকে ফোন করে "গরমে পচো" বলা যায়। আর যেটা যায়, অসাধারণ কিছু দৃশ্য দেখা এবং ছবি তোলা।

দুপুরবেলা খাবার সময় রমেশ জানালো একজন বন্ধু আমাদের সাথে যোগ দিচ্ছে। সে দুদিনের হাঁটা একদিনে হেঁটে পৌঁছেছে। ট্রেকেরস হাটে বিশ্রাম নিচ্ছে।

আলাপ করতে গেলাম। টেনশনটা আমার বেশি ছিল কারণ পাটিগণিতের হিসেবে সে আমার টেন্ট পার্টনার হবে। নাম আকাশ। নয়ডাতে থাকেন। আই আই টি রুরকীর প্রাক্তনী। পেশায় একটি মার্কিন সংস্থায় কাজ করে। নেশা যেকোনোরকম এডভেঞ্চার। ১৫০ এর মতো ট্রেক করেছে এই বয়সেই। তা এই আকাশ ভাইয়া অচিরেই আমাদের দলের দলপতি হয়ে উঠলো নিজগুনে। আমার বাড়তি পাওনা ওর টেন্ট পার্টনার হবার সুবাদে প্রচুর গল্প শুনতে পাওয়া।

৬ই নভেম্বর,

 সকাল সকাল প্রাতরাশ করে এক ঝলক সোনার মতো পান্ডিমকে দেখে হাঁটা শুরু হলো। গন্তব্য জংড়ি। আজ আবার প্রচণ্ড কুয়াশা। আর চলেছি জুরাসিক যুগের আকাশচুম্বী সব গাছের মধ্যে দিয়ে। দু একটা ডাইনোসর বেরিয়ে হাই হ্যালো করে গেলেও অবাক হতামনা।  মাঝে বিশ্রামের জন্য ফেডাঙ এ থামা হলো। জায়গাটা মাঠের মতো। কিন্তু কুয়াশার জন্য তিন হাত দূরের কিছু নজরে আসছিলনা। এইবার বুঝলাম চাপ কাকে বলে। আকাশ ভাইয়া এতই তাড়াতাড়ি চলেছে যে শোকা থেকে শুরু করার পর তার টিকি ধরতে পারিনি কেউ। এইবার বাকি ৭  জনেরও মধ্যেও চারটে ভাগ হয়ে গেল। পল্লব কতটা আগে বুঝতে পারছিনা। দেওড়ালি ধাপে পৌছালাম আমি আর সুজিত। কুয়াশাতে পিছনে বাকি চারজন এবং রমেশ কে কতদূর আছে বুঝতে পারছিনা। ভুল দিকে চলে এলাম কিনা সেটাও বুঝছিনা। পাথরে লাঠি ঠুকে আওয়াজ করলে অন্য কেউ পাল্টা আওয়াজ দিয়ে নিজের উপস্থিতি জানান দিচ্ছেনা। যেটা শুনতে পাচ্ছি সেটা আমার করা আওয়াজের এ প্রতিধ্বনি। যা হোক, যা আছে কপালে বলে আবার এগোতে রইলাম। কিছু পর পল্লবের দেখা পেলাম। পল্লব বললো, "তোরা এত দেরী করছিস বলে বসে একটু ঘুমিয়ে নিলাম।" জংড়ি পৌঁছে দেখি আকাশ ভাইয়া দিব্যি রোদ পোহাচ্ছে আর নিজের সোলার চার্জার চার্জ করছে। সে নাকি ২ ঘন্টা আগে পৌঁছে গেছে। আর একটুপর অনুপমের দেখা মিলল। বাকি ৩ জনকে নিয়ে রমেশ পৌছালো আরো প্রায় ৪০ মিনিট পরে। বাঁচোয়া যে দুপুরের খাওয়া মাঝপথে সেরে নিয়েছিলাম। একে কালীপূজোর রাত, তারউপর আমার ঠান্ডা নিয়ে যতটুকু যা কল্পনাশক্তি ছিল তাকে দশ গোল মারার মতো ঠান্ডা। সন্ধেটা বেশ আড্ডা হলো কাঁপতে কাঁপতে। রাতে শুয়োরের মাংস দিয়ে রুটি খেয়ে সোজা স্লীপিং ব্যাগ। কাল আবার ভোর ভোর উঠে জংড়ি টপ দেখতে হবে। জীবনে প্রথম কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখবো বলে কথা। আকাশ ভাইয়ার পরামর্শে ফোটানো জলের বোতলটাও স্লিপিং বাগে ঢোকালাম। নাহলে নাকি সকালে উঠে দেখতে হবে জল জমে গেছে।

৭ই নভেম্বর,

​ভোরবেলা উঠে প্রাতঃকৃত্য সারতে গেছি, রমেশ দরজা ধাক্কাচ্ছে, "আরে লম্বুজী, জলদি কিজিয়ে। ইসকে বাদ কুছ নেহি মিলেগা দেখনেকো।" রমেশ এর মধ্যেই আমাদের ডাকনাম দিয়েছিল। ত্রিদিপকে ইয়াক, অমিতকে ভালু, আমাকে লম্বুজী।" ওঠা শুরুর সময়ই দেখলাম অন্ধকারের মধ্যে সারি সারি বিন্দু বিন্দু আলো উঠছে উপরে। মনে অন্য দলগুলো এগিয়ে গেছে। শেষ আমিই পরে আছি। উঠতে শুরু করলাম একাই। মাঝপথে সুজিতের সাথে দেখা। বেচারা টর্চ নিয়ে বেরোতে ভুলে গেছে তাড়াহুড়োতে। অনুপম আর পল্লবের টর্চের ভরসায় যাচ্ছিল। ১নং করতে থেমেছিলো। বাকিরা ওকে ছেড়ে এগিয়ে গেছে। অগত্যা সে দাঁড়িয়ে আছে। যা হোক আমি আলো দেখিয়ে উদ্ধার করলাম সেযাত্রায়। উপরে পৌঁছে চোখ ঝিলমিলিয়ে গেল। কতগুলো প্রথম রোদ মাখা সোনালী শৃঙ্গ। পান্ডিম আগেই চিনতাম। কাঞ্চনজঙ্ঘা চিনতে পারলাম। বাকিগুলোর নাম,ঠিকুজিকুষ্ঠি অনুপম গড়গড় করে উগরে দিয়ে বুঝিয়ে দিলো যে সে রীতিমতো পড়াশুনো করে এসেছে।

নেমে এসে প্রাতরাশ সেরে আবার চলা শুরু। আজকে রোদ ঝলমল করছে। বিশেষ চড়াই উৎরাই নেই। গাছপালা নেই। অসম্ভব সুন্দর জায়গা দিয়ে চলার পথ। দু পা এগোই তো ২০টা ছবি তুলি। মাটিতে শুয়ে পরে রোদ পোহাচ্ছি। এগোনোর কোনো ইচ্ছেই নেই। শেষে রমেশ মুখের কথা না পেরে ভয় দেখালো, পিছনের যে মেঘ তা উঠেছে সেটা আমাদের ঘিরে ফেললে গতকালের মতো দাঁড়াবে। অগত্যা এগোতে রইলাম। মাঝে কোকচুরাং। এখানে আমরা থামছেনা। ফেরার সময় থাকবো। আমাদের গন্তব্য থানসিং। কোকচুরাং জায়গাটা দারুন বেশ। প্রেকচু নদীর পারে বিশাল বিশাল ডিমের আকৃতির পাথর। আমার ভাষায় ডাইনোসরের ডিম। এই পাথরের মধ্যে দিয়ে পথ খুঁজে এগিয়ে কাঠের সেতু দিয়ে প্রেকচুর অন্য পারে পৌঁছে আবার প্রেকচুর পাড় দিয়ে চললাম। থানসিং জায়গাটা দুদিকের পাহাড়ের মাঝে উপত্যকা। আলো পড়তেই প্রবল ঠান্ডা সাথে হাওয়া শুরু হলো। আজ আর আড্ডা হলোনা তেমন। অনেক ভোরে উঠেছি সবাই। খাওয়া মিটিয়ে সবাই শুয়ে পড়লাম। ঠান্ডা একটু বেশিই লাগছিলো। আজ টুপি পরেই স্লিপিংব্যাগে ঢুকলাম।

৮ই নভেম্বর,

​সকালে উঠেই চমক, অন্তত আমার কাছে। লম্বা মানুষ বলে টেন্টে এমনিতেই পা মাথা থেকে যাচ্ছে। তার উপর rucksack আছে। ভেজা ঠেকতে টুপিতে হাত দিয়ে দেখি যেটুকু অংশ টেন্টে লেগেছিল সবখানে বরফ জমেছে। rucksackএরও একই অবস্থা। আগেরদিন আমাকে পরামর্শ দিয়ে আজ ভুলটা নিজেই করেছে। বোতলের জল জমে বরফ।

ঝকঝকে রোদ দেখে চনমনে হয়ে প্রাতরাশ করেই রওনা দিলাম। গন্তব্য লামুনে। আজ অনেক কম চলা। কারণ আজ রাতেইতো গোয়েচালা ভিউ পয়েন্ট ১ এর উদ্দেশ্যে মহাঅভিজানে নামতে হবে। লামুনে পৌঁছাতে ২ ঘন্টাও লাগলোনা। আজ সন্ধে নামার আগে অনেক সময় হাতে। তার উপর আজ টেন্টের দরজার ফাঁক দিয়ে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা যাচ্ছে। দুপুরে খাবার পর জমিয়ে তাস খেলা হলো। আশেপাশের অন্য দলগুলোর সাথে আলাপ আড্ডা হলো। আমার সাথে একটু বেশীই আড্ডা হলো অন্য দলগুলোর, কারণ ধূমপায়ীর অভাব নেই, কারোর লাইটার কাজ করছেনা (আকাশ ভাইয়ার মতে এখানে বাতাসের চাপ কম তাই) আর ছোট দেশলাই যারা এনেছিল শেষ। আমি নিয়েছিলাম ১০ টাকার বড় দেশলাই। সুতরাং অতগুলো ধূমপায়ীর আমিই ভরসা।

৯ই নভেম্বর,

​রমেশ বলেছিল রাত আড়াইটায় তৈরি থাকতে। আমরা নতুন তাই সময় নিয়ে বিশ্রাম নিয়ে চলবো। আমি তো উত্তেজনায় একটার সময় উঠে পরে টেন্ট থেকে বেরোলাম। আবার চমকের পালা, বরফ পড়েছে, টেন্টগুলো সাদা, সামনের জমি সাদা। হটাৎ দেখি পায়ের কাছে একটা হাতমোজা পরে। সঙ্গে সঙ্গে তুললাম, কারণ এটা আমাদেরই কারোর সন্দেহ নেই আর এটা আজকের অভিযানের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সরঞ্জাম। হাঁকডাক করে সবার ঘুম ভাঙিয়ে নিজেদের হাতমোজা দেখতে বললাম। পাওয়া গেল সেটা সন্তোষের। আমার থেকে হাতমোজা আর বাকিদের ঘুম ভাঙানোর জন্য গালাগাল দুটোই জুটলো সন্তোষের। আমি গেলাম ২নং সারতে তাড়াতাড়ি। কারণ অন্য জায়গার চারটে টয়লেট লামুনেতে নেই। দুটো মাত্র। আর সব দলগুলো আজ কমবেশি একই সাথে রওনা হবে। সব সেরে তৈরি দুটোর মধ্যে। এদিকে বাকিরা ঘুমাচ্ছে। রমেশের খোঁজে গেলাম। সেও ঘুমোচ্ছে। তাকে, আমাদের কুক রণবীর আর রণবীরের সহায়ক অর্জুনকে ঘুম তুলে চা বসানোর ব্যবস্থা করলাম। তারপর আমি আর রমেশ বাকিদের ঘুম ভাঙাতে গেলাম। সবাই হাজির। চা খেয়ে তৈরি শুরু করার জন্য খোঁজ পড়ল সন্তোষ কোথায়। খুঁজে পাওয়া গেল সে টেন্ট থেকেই বেরোয়নি এখনো। যা হোক, তাকে ঠেলেঠুলে তৈরি করে ৩:১০  এ আমরা শুরু করলাম।

 অত্যধিক ঠান্ডা সঙ্গে হাওয়া। বেশ বুঝতে পারছি পায়ের আর হাতের আঙুলগুলো অবশ লাগছে। আকাশ ভাইয়া আর রমেশছাড়া কারোর হেডটর্চ নেই। হাত অবশ। টর্চ, লাঠি ধরতে বেশ অসুবিধা হচ্ছে। টুপিতে টর্চ গুঁজে চালাচ্ছি। কিন্তু এবড়োখেবড়ো রাস্তায় সেও পরে যাচ্ছে বারবার। অন্ধকারে রমেশ দেখালো সমিতি লেক। তখন আমার মনোভাব, "ধুত্তোর! লেক কে মার গুলি। আর কতটা চলতে হবে বলতো খুলে!" দেখতেও পাচ্ছিনা অন্ধকারে যে কতটা উঠেছি, আর কতটা উঠতে হবে। একটু আগে পিছনে আমাদের ক্যাম্পিং সাইট এর আলো গুলো দেখে যাচ্ছিল। এখন সেটাও যাচ্ছেনা। এদিকে ব্যাটা রমেশ বসতে দিচ্ছেনা একটুও, কখন বলছে, সূর্য উঠে যাবার পর পৌঁছে মজা পাওয়া যাবেনা। কখন বলছে পাথর ঠান্ডা, বসলে তোমার 'পিছওয়ারা' ঠান্ডা হয়ে যাবে, তা থেকে পেটে গ্যাস হবে। আমার গ্যাস হলে আকাশ ভাইয়া টেন্ট থেকে বের করে দেবে আমাকে, ইত্যাদি।

 

যাইহোক হ্যাঁচরপ্যাঁচর করে পৌছালাম ভিউ পয়েন্ট ১ এ। সবে আকাশে হালকা আলো দেখা গেছে। অন্য দলগুলোর কাছে শুনলাম, একদম ঠিক সময়ে পৌঁছেছি। বাকিরা কেউ ২০মিনিট কেউ আধ ঘন্টা আগে পৌঁছে এতক্ষন ঠান্ডায় কেঁপেছে। এরপরের দৃশ্য ছবি দেখে বোঝার চেষ্টাই ভালো। লিখে বোঝানো আমার কম্ম নয়। স্লিপিং বুদ্ধের গায়ে দিনের প্রথম সূর্যরশ্মি পড়ার দৃশ্য অনেক গুণীজন অনেকসুন্দর ভাবে বর্ণনা করেছেন। আমি নগন্য। প্রথম ট্রেকের গল্প নিয়ে প্রথম লেখার চেষ্টা। আমি বরং বলি কে কি করছিল সেই সময়টায়। অমিত একটা পাথরের উপর বসে একটা ডেয়ারি মিল্ক সিল্ক খেয়েই চলেছে কাঁচন্জঙ্ঘার দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে। পল্লব হাতমোজা খুলেও ছবি তুলতে পারছেনা কারন হাত এতটাই অবশ যে ফোনের touchscreen কে কাজ করাতে পারছেনা। অনুপম আর সুজিত আমাকে আর রমেশকে দিয়ে নানা পোজে ছবি তুলিয়েই যাচ্ছে। ত্রিদিপ আর সন্তোষ পাথরের উপর বসে বিশ্রাম নিচ্ছে আর বসে বসেই ছবি তুলছে। আকাশ ভাইয়া বলছে, কাশ্মীর, হিমাচল, উত্তরাখন্ড থেকে অরুণাচল অবধি এত ট্রেক করেছি, কিন্তু স্লিপিং বুদ্ধ প্রথম। এ জিনিস আলাদা। তোমরা ফালুট না কি বলছিলে, ভাবছি ফেরার সময় ওটাও করে যাই। আর আমি, পালা করে করে একটা করে হাতের মোজা খুলছি, আর ছবি তুলে যাচ্ছি।

যাইহোক, রমেশের তাড়ায় ফেরার পথ ধরতে হলো। নামার সময় উঁচু থেকে সমিতি লেক যেন একটা বড় আয়না। নামার পথে রমেশ আসল কথা খুলে বললো, আমাদের সেই ভাবে অভিজ্ঞতানা থাকায় ও চেষ্টা করছিল আলো ফোটার আগে পৌঁছে যেতে। আলো ফুটে গেলে আমরা দেখতে পেয়ে যেতাম কতটা উঠতে হবে, তাহলে আরো চাপে পরে যেতাম।

সমিতি লেকের উপর অংশ জমে বরফ। কয়েকটা পাথর ছুঁড়তে দেখলাম বেশ অদ্ভুত একটা ঘুঘুপাখি ডাকার মতো আওয়াজ হচ্ছে। বেশ মজাদার খেলা পেলাম ওটা। এর পর রমেশ দেখালো এর উপর দিয়ে হাঁটাও যায়, এমন কি নেচেও দেখালো। আমরা যদিও অতটা সাহসী হতে পারলামনা। ধরে ধরে সাবধানে দুএক পা নেমে ছবি তুলেই সন্তুষ্ট থাকলাম। এটা সেটা করতে করতে বহু দেরি যে নীচে নামলাম। তখন প্রায় ৯টা বাজে। আজ আর কারোর কোনো তাড়া নেই। অন্য দলের যে কয়েকজনের সাথে আলাপ হয়েছিল তাদের সাথে প্রচুর আড্ডা, ফোন-নম্বর আদানপ্রদান চললো। হাত পা ছড়িয়ে বিশ্রাম নিয়ে নিয়ে টুকটুক করে কোকচুরাং নেমে এলাম। কাল থেকে আর তাড়াতাড়ি ওঠার তাড়া নেই। পরদিন নতুন কি দেখবো সেই উত্তেজনা নেই। সেই আড্ডা, তাস খেলা, খাওয়া, ঘুম করেই কেটে গেল। পরেরদিন বাকিমে থেকে তার পরদিন ইউকসামে পৌঁছে যাবো।

 গল্পটা এখানেই শেষ হয়ে যেতে পারতো। কিন্তু হলনা, রণবীর, রমেশ আর অর্জুনের জন্য।

 ১০ই নভেম্বর,

ধীরেসুস্থে নাম শুরু হলো, রণবীর রাস্তার ধারের গাছের দল থেকে পা দিয়ে ঝুলে কসরত দেখালো কতরকম। আমাদের আলোচনা চলতে থাকলো, নির্ধারিত সময়ের একদিন আগে ট্রেক শেষ হবার পর কি করা হবে। একদিন কোথাও কাটানো হবে নাকি তৎকালে টিকিট কাটা হবে আগেরদিন।

এই করেই বাখিম এসে গেলাম। ঘটনাচক্রে ওইদিন ছিল সুজিতের জন্মদিন। কামাল দেখালো রণবীর & কোম্পানি। ওদের কাছে টুকটাক সরঞ্জাম যা ছিল, ময়দা, ডিম, জ্যাম, মধু এই দিয়েই ডেচকির উপর ফয়েল পেপার মুড়ে সুন্দর একটা কেক বানিয়ে সুজিতকে surprise দিলো। আমাদের বারবার বলা হয়েছিল যে, ভিতরের ঘরে একজন সোলো ট্রেকার আছেন যিনি তুরস্ক থেকে এসছেন। তাই হইহল্লা যেন না হয়। শেষমেশ দেখি হইহল্লাতে তিনি বাইরে এসে হাজির। এবং হাসিমুখেই আমাদের আসরে কিছুক্ষন কাটিয়ে গেলেন।

১১ই নভেম্বর, শেষদিনের নামা শুরু। কেউ তেমন কথা বলছেনা। সবাই চুপচাপ হেঁটে যাচ্ছে। ইউকসামে এলাম দুপুর নাগাদ। রমেশের সাথে চুক্তি হলো, সন্ধেবেলা সে আমাদের এলাকাটা ঘুরিয়ে দেখাবে। ওর সাথে গিয়েই সোনালী রঙের গামবুট ও কিনে ফেললাম। ফেরার গাড়ির ব্যবস্থা করা হলো।

ট্রেক শেষ, পরদিন সকালে শেষবার এর মতো পান্ডিমের ঝকঝকে চূড়োটাদেখে নিয়ে রওনা দিলাম।

শেষপাতে,

জংড়ি পৌঁছাতে একসাথে আকাশ ভাইয়া, ত্রিদিপ আর রমেশের জুতোর সোল খুলে গিয়েছিল। আকাশ ভাইয়া তার বাড়তি জুতোর ফিতে দিয়ে শক্ত করে বেঁধে সামাল দিলো। কিন্তু সেই যে জুতো ছিঁড়ে যাবার ভয় তাড়া করলো ত্রিদিপকে, রাস্তায় দড়ি কুড়োতে শুরু করলো। প্রথমদিকে একাই করছিল। পরদিন থেকে বাকিরাও ওকে সাহায্য করতে নামলাম। শেষমেশ আর দড়ি লাগেনি যদিও তেমন। কিন্তু আমাদের সবার চেষ্টায়, চোখে পড়েছে এরকম ২ ইঞ্চির দড়ি হলেও সেটা নীচে নেমে ইউকসামের Garbage Box এ জমা পড়েছে।

 সঙ্গের সাজসরঞ্জাম কিছুটা এই রকম।

Rucksack - অফিসবন্ধুর থেকে ধার করা।

ছোট backpack - অফিসবন্ধুর থেকে ধার করা।

Walking stick - এলাকার বাঁশবাগান থেকে কেটে আনা।পরবর্তীতে একজন বয়স্ক শ্বেতাঙ্গ ভদ্রলোকের থেকে উচ্ছসিত প্রশংসা পেয়েছিল।

জুতো আর জ্যাকেট কেনা। হেডটর্চ নেই তাই টুপি ফাঁকে পেনটর্চ।

Meet the Blogger

Rudrajit Banerjee


Name- রুদ্রজিৎ ব্যানার্জী
Age- ২৯
Profession- আমি সরকারী কর্মচারী।
City- চন্দননগর
Hobbies- যেকোনো এবং যেখানেই হোক, ফসিলস এর অনুষ্ঠানে পৌঁছে যাওয়া আর ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো।
Previous Tours- গোয়া, শিলং, বেতলা, বক্সা-জয়ন্তী, গোপালপুর।



You may also like