“বহু দিন ধরে,বহু ক্রোশ দূরে,বহু ব্যয় করি বহু দেশ ঘুরে.....
দেখিতে গিয়েছি পর্বতমালা,দেখিতে গিয়েছি সিন্ধু......
দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া
একটি ধানের শীষের ওপর একটি শিশির বিন্দু।।“.....
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
বন্ধু চৈতালীর অনুরোধে পুজোর লেখা লিখতে বসে যখন ভাবছি কি লিখব তখনই চোখের সামনে ভেসে উঠল তুষারশুভ্র কিন্নর-কৈলাশ।তাই আজ আমি হিমাচল প্রদেশের কল্পার কথা লিখব।ভগবানের আর্শীবাদে দেশ এবং বিদেশের বহু যায়গায় ঘোরার সৌভাগ্য হয়েছে,কিন্তু খুব কম স্থান মনে যায়গা করে নিয়েছে,কল্পা তার মধ্যে অন্যতম।কল্পা শতদ্রু নদীর উপত্যকায় অবস্থিত ।এটি উত্তরভারতের হিমাচল প্রদেশের কিন্নর জেলার ছোট একটি জনপদ।
সিমলা থেকে জাতীয় সড়ক ৫ ধরে ২২২ কিমি গেলে কল্পা,পাহাড়ে একদিনে এতটা রাস্তা পাড়ি দেওয়া কার্যত অসম্ভব।তাই সিমলা থেকে রওনা হয়ে আমরা পথে রামপুর বলে এক পাহাড়ি শহরে একরাত্রি বাস করে কল্পার পথে রওনা দিলাম।সাড়ে চারঘন্টার দীর্ঘ রাস্তা,পথে বিশেষ কিছু দেখবার নেই। শতদ্রু নদীর ওপর তৈরী hydro electric plant করছাম ড্যাম ছাড়া দেখবার কিছু নেই।করছাম এবং ওয়ংটু গ্রামের মাঝে করছাম ড্যাম অবস্থিত ।
করছাম ড্যাম
তারপর আবার যাত্রা,এবারে বরফে ঢাকা কৈলাশ আমাদের সাথে সাথে চলতে থাকল।এখান থেকেই খাড়াই ওঠা শুরু।আরো একঘন্টা খাড়াই ওঠার পর আমরা রেকং পেয় পৌঁছালাম।রেকং পেয় একটা ছোট বাজার,এখানে বেশ কয়েকটা বড় দোকান চোখে পড়ল।এখান থেকে কৈলাশ পর্বত একেবারে সামনে,তখন পড়ন্ত বিকেলের আলোয় চূড়ায় নানারঙের খেলা।এবং হাড়কাঁপানো ঠান্ডা। এখান থেকেই সাংলা আর কল্পার রাস্তা আলাদা হয়ে যায়।
আমরা কল্পার রাস্তা ধরলাম, অজস্র খানাখন্দে ভরা রাস্তায় গাড়ির গতি বাড়ানো অসম্ভব,বেশ অনেকটা খাড়াই ওঠার পর রাস্তার অবস্থা অপেক্ষাকৃত ভালো হল।
পাহাড়ি রাস্তায় আমার কোন ক্লান্তি আসে না, কারন প্রতিটি বাঁকে তার আলাদা আলাদা সৌন্দর্য ।গাড়িতে বসে বসে সেই সৌন্দর্য উপভোগ করছিলাম,হঠাৎ একটা বাঁক নিতেই সামনে ভেসে উঠল স্বপ্নের কৈলাশ।দিনের শেষ আলো বরফের চূড়ার ওপর পড়ে উজ্জ্বল কমলা রং ধারণ করেছে,গাড়ি থামিয়ে ওই নির্জন রাস্তায় আমরা নেমে বাক-রহিত হয়ে খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলাম।সামনেই প্রকৃতির অপূর্ব সৃষ্টি।
রাস্তা থেকে প্রথম দেখা কল্পা
ওই ঠান্ডায় বেশিক্ষণ বাইরে না থেকে গাড়িতে উঠে বসলাম।তারপর আবার খানিকক্ষণ খাড়াই ওঠা,এরপর পুরো রাস্তাতেই দুপাশে শুধু বরফ।মিনিট কুড়ি চলার পর গুগল ম্যাপ বলল আমরা এসে গেছি,কিন্তু যেখানে আমরা দাঁড়ালাম সেখানে কোন হোটেল নেই,কল্পা তে এমনিতেই হোটেলের সংখ্যা খুব কম,তায় এতো ঠান্ডায় বেশিরভাগ হোটেল বন্ধ এবং পর্যটক খুবই কম।এবার হোটেল মালিককে ফোন করা হল,তার বলা রাস্তা ৪/৫ বারের চেষ্টায় খুঁজে পাওয়া গেল।একে সরু রাস্তা তায় রাস্তায় বরফ পড়ে আছে,এবং খাড়াই রাস্তা,গাড়ি নড়াচড়া করানোই সমস্যা,চালক ভালো হবার দরুণ খুব বেশি অসুবিধা হয়নি,অবশেষে একটা আস্তাবলের পাশ দিয়ে একটু নীচের দিকে নেমে একটা ফাঁকা মাঠের শেষে একটা সাধারণ সবুজ তিনতলা বাড়ি চোখে পড়ল,জানলাম ওটাই আমাদের হোম স্টে।দেখে মোটেই ভক্তি এলো না।হোটেলের ২০/৩০ মিটার আগেই গাড়ি থেমে গেল।গাড়ি থেকে নেমে দেখি বরফ,গাড়ি আর যাবেনা,বাইরে ঠান্ডা বাড়ছে বেশিক্ষণ থাকা মুশকিল,এবার বাকি রাস্তা বরফের ওপর দিয়ে হেঁটে যেতে হবে।হোটেল থেকে দুটো ছেলে এসে অবলীলায় আমাদের ভারী সুটকেসগুলো টেনে নিয়ে চলে গেল ।পরে জেনেছিলাম একজন ওই হোটেলের মালিক।অনভ্যাসের দরুণ বরফে হাঁটা খুব সহজ হয়নি,ওইটুকু রাস্তা যেতে অনেকটা সময় লেগে গেল।গাড়িতে হিটারের জন্য ঠান্ডা বুঝতে পারিনি,এবার বুঝলাম,হোটেলে পৌঁছে জানলাম -৮ডিগ্রি।আরো দুটো খবর পেলাম এক, ঠান্ডার জন্য হোটেলে কেউ নেই,শুধু আমরাই আছি।আর দু্ই, হোটেলে লিফ্ট নেই,তিনতলা অবধি হেঁটে উঠতে হবে।যাইহোক দুটোই খুব খারাপ খবর।শেষে চা আর পকোড়ার কথা বলে তিনতলায় উঠলাম,অতঃপর ঘর দেখে মন ভালো হয়ে গেল।আরো ভালো লাগল যখন ঘরের পর্দা সরাতেই সামনে ভেসে উঠল বরফে ঢাকা কৈলাশ।
রেকং পেয় মার্কেট থেকে বরফে ঢাকা কল্পা
এত কাছ থেকে এত সুন্দর বরফের পাহাড় আমি কখনও দেখিনি,যেন হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যাবে।ওই সৌন্দর্য দেখে পথের সব কষ্ট নিমেষে ভুলে গেলাম।প্রকৃতির আপন খেয়ালে সৃষ্ট শিবলিঙ্গও স্পষ্ট দৃশ্যমান।কিন্তু আসল অবাক হওয়া তখনও বাকি,পাহাড়ে রাত নামে তাড়াতাড়ি,তাই আমরা তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে নিলাম,যদিও গিজার বন্ধ ছিল আর মাত্র এক বালতি গরমজল আমাদের দেওয়া হয়েছিল,তাতে কোনমতে হাত মুখ ধোয়া যায়।তারপর আমরা চা নামক ঠান্ডা পানীয় আর পকোড়া নামক ন্যাতানো ঠান্ডা কিছু একটা খেলাম।অতঃপর বাইরের ঠান্ডায় কাবু হয়ে সবাই ইলেকট্রিক কম্বলের নীচে গিয়ে ঢুকলাম।বাইরে অন্ধকার,-৯℃ তাপমান,রুম হিটারে ঠান্ডা কমছে না,তাই কম্বলের গরমে একটু চোখ লেগে এসেছিল।হঠাৎ দেখি বাইরেটা আলোয় আলো,আলোর উৎস দেখবো বলে কম্বল ছেড়ে বাইরে এসে পরদা সরাতেই আমি অভিভূত,হতচকিত।নির্মেঘ আকাশে গোল থালার মতো চাঁদ,সেই আলো পড়েছে কৈলাশের বরফে,ওই অত আলো সেই আলোরই বিচ্ছুরণ।অপার্থিব সেই দৃশ্য।বলে বোঝানো অসম্ভব।কতক্ষণ যে ওই ঠান্ডায় দাঁড়িয়ে ছিলাম ।মনে হয়েছিল স্বর্গ যদি কোথাও থাকে তা এখানেই।তারপর হুঁশ এলো বেলের শব্দে,ডিনার....।হাড় কাঁপানো ঠান্ডায় কোনমতে ডিনার সেরে আবার ইলেকট্রিক কম্বলের নীচে।তখন -১১℃।সারারাত ঘুমানোর পর সকাল ৪টের সময়,আবার পরদা সরিয়ে বাইরে তাকালাম....তখনও চাঁদের আলোয় সেই অপার্ সৌন্দর্য,ঠান্ডার জন্য বেশিক্ষণ দাঁড়াতে পারলাম না।তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়লাম। কারন কাল সূর্যোদয় দেখতে হবে। অ্যালার্ম দিয়ে রাখলাম। যা ক্লান্ত, অ্যালার্মে ঘুম ভাঙলে হয়। তবে যথা সময়ে ঘুম ভাঙল, অপেক্ষা করতে থাকলাম সূর্যদেব এর ,তারপর এলো সেই সূর্যদয়ের মাহেন্দ্রক্ষণ,চোখের সামনে রামধনুর খেলা শুরু হলো,এই একই দৃশ্য দেখেছিলাম কেদারনাথে,তবে ওটা দূর থেকে আর এ একেবারে চোখের সামনে।অপূর্ব সেই দৃশ্য। সে দৃশ্যকে ভাষায় বর্ণনা করার মত সাহিত্যজ্ঞান ভগবান আমাকে দেননি।
হোটেলের জানলা থেকে
ভোরের প্রথম আলোয় কল্পা
বরফে ঢাকা কল্পা
অত ঠান্ডায় থাকতে আমার আর আমার বাচ্চাদের খুবই কষ্ট হচ্ছিল,তার ওপর জল নেই তাই আমরা বাকি দুদিনের বুকিং ক্যানসেল করে সাইট সিয়িং করে সাংলা চলে যাবার সিদ্ধান্ত নিলাম।আবার সেই বরফের ওপর দিয়ে হেঁটে গাড়িতে বসলাম।কল্পায় কয়েকটা মন্দির ছাড়া সেরকম কিছু দেখার কিছু নেই,তাড়াতাড়ি সেসব দেখে আরেকবার প্রাণ ভরে কৈলাশ দেখে কল্পা কে বিদায় জানিয়ে আমরা সাংলার পথে রওনা দিলাম।
জরুরী তথ্য:কল্পায় খুব ভালো হোটেল কিছু নেই,বেশিরভাগই হোম স্টে,আগে থেকে বুকিং করে যাওয়াই ভালো,ওখানে মাঝারী মানের হোটেল বুকিং শুরু ₹ 1500-2500 প্রতিদিন,হোম স্টে ₹৩০০০-৩৫০০ প্রতিদিন।খাবার দাবারের কষ্ট সেরকম নেই,কিন্তু জল খুব মাপা।কল্পাতে সারা বছরই ঠান্ডা থাকে,সংগে গরম জামা পর্যাপ্ত থাকা দরকার,তুষারপাত দেখতে চাইলে ডিসেম্বর থেকে মার্চ উপযুক্ত সময়,সেই সময় তাপমান -৯℃ থেকে -১৩℃ থাকে,যাদের শ্বাসকষ্টের সমস্যা আছে তারা উপযুক্ত ব্যবস্হা নেবেন।আর অবশ্যই প্রয়োজনীয় ওষুধপত্র সংগে নেবেন।
Name- Rupa Bhattacharya
City- Kolkata
Hobbies-Reading,writing,Travelling
Previous Tours- Himachal Pradesh (all), Assam, Kaziranga, shilong, Meghalaya, cherrapunji, chandipur, Darjiling,Gangtak,Dharamshala,Dalhousie, Macleodganj, Chandigarg, Amritsar,Hardwar, Kedarnath, Badrinath, Agra, Mathura, Vrindavan, Barsani, Mumbai, Mahabaleshwar, lonavala, panchgani, khandala, chennai, puducherry, Hydrabad, and so many places in India and abroad also like US, Malaysia, Singapore, Australia