Tripsee Treks  and Tours LLP
Blog and Travel with Us

মালদা - গৌড় - পাণ্ডুয়া



Pratik Mukherjee Pratik Mukherjee

পশ্চিমবঙ্গে মুর্শিদাবাদের মতোই আরেক ঐতিহাসিক দর্শনীয় স্থান হলো মালদা l মুর্শিদাবাদ ঘোরা হয়ে থাকলে মালদা অবশ্যই যান l ঐতিহাসিক ইমারত মালদাতে অনেকটাই বেশি মুর্শিদাবাদের তুলনায় l আর বেশ সাজিয়ে গুছিয়ে রাখা আছে বলা যায় l যদিও মালদা একটু বেশী অবহেলিত l এমনকি এই গ্রুপে সেই অর্থে মালদা নিয়ে লেখা আমি পাইনি তাই কলমটা নিজেই ধরলাম l

ছোট্ট করে ইতিহাস:

মালদা শহর দুটি ভাগে বিভক্ত l মিউনিসিপালিটি অনুসারে পুরোনো মালদা এবং ইংলিশ বাজার, এই দুই নিয়ে মালদা মিউনিসিপ্যালিটি তৈরী হয়েছে l মালদা বলতে গেলে অপেক্ষাকৃত নতুন শহর l আসল ইতিহাস লুকিয়ে গৌড় নামক একটি স্থানে যা শুরুতে রাজা শশাঙ্কের, পরে পাল বংশ, সেন বংশ হয়ে স্বাধীন মুসলিম শাসক ইলিয়াস শাহীর হাতে এসে পড়ে l প্রায় একশো বছর লখনৌতি নামে রাজধানী হয়েও ছিলো মুঘলদের হাতে পড়বার আগে l তাহলে বুঝতেই পারছেন ভরপুর ইতিহাসে ভরে আছে গৌড় l ওইদিকে পান্ডুয়াও কিছু সময়ের জন্য রাজধানী ছিলো বাংলার সুলতান আমলে l

প্ল্যানিং প্লটটিং:

মালদা ঘোরার ইচ্ছে বেশ অনেকদিন ধরেই ছিলো, ছোট থেকে ইতিহাস আমায় খুব টানে l শুধু যাওয়া হয়ে ওঠেনি lআসলে অনেকের আত্মীয় জেলায় থাকে তাই তাদের ছোটবেলাতেই এইসব জায়গা ঘোরা হয়ে যায়, আমার সেই সুযোগটা নেই l হয় কলকাতা, অথবা একদম পশ্চিমবঙ্গের বাইরে সবার বাস l তাই হুট করে এই বছর জানুয়ারি মাসের শেষের দিকে প্ল্যান করে ফেললাম l নেট ঘাঁটাঘাঁটি আর একটু খোঁজ খবর নিতে গিয়ে দেখলাম মালদা ঘুরতে যাওয়া মানে শুধু গৌড় নয়, সাথে জুড়ে যায় পাণ্ডুয়া -আদিনা l এককথায় গৌড় - আদিনা - পাণ্ডুয়া l কিন্তু তিনটে জায়গা ঘুরতে বেশি হ্যাপা নিতেও হচ্ছে না l

​আমি আপনাদের দুই ভাবে ঘোরার প্ল্যান দেবো l এক হলো রয়ে সয়ে বসে ঘোরা l এই প্ল্যানে ঘুরলে এক রাত আপনাকে মালদায় থাকতেই হবে l পরেরদিন সকালে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিতে পারেন অথবা সকালে গাড়ি নিয়ে ফারাক্কা বা দিনাজপুরের বানগড় ঘুরে রাতে রওনা দিন l দ্বিতীয় প্ল্যান হলো হার কিপ্পন সফর যা ব্যাকপ্যাকারদের পছন্দ হবে l এই সফরে সকালে মালদা পৌঁছেই ঘুরতে বেরিয়ে পড়বেন আর বিকেলের মধ্যে শেষ করে রাতের ট্রেন ধরে সোজা নিজের ডেরায় ফেরা l হোটেল লাগবে না কোনোরকম l মানে আজ রাতে রওনা দিয়ে পরশু ভোরে ফেরত আসা l সারাদিন ঘোরাঘুরি করে এমনিও টায়ার্ড হয়ে যাবেন তো রাতে ট্রেনের ঘুমটা ভালোই হবে l কিন্তু হ্যাঁ, গায়ে হাত পায়ে ব্যাথা হলে আমার দোষ নেই l

যানবাহন:

দেখুন গাড়ি নিয়ে গেলে আপনি নিজেরটা নিজে বুঝে নিন l সেক্ষেত্রে লেখার এই অংশটা বাদ দিয়ে চলে যান l কিন্তু যারা ট্রেনে যাবে তারা পড়তে পারেন l জেলা থেকে যারা আছেন তারা একবার দেখে নেবেন ট্রেনগুলো শুধু আপনার স্টেশন ধরছে কিনা l আমি কলকাতার থেকে ট্রেনের লিস্ট দিচ্ছি l IRCTC ঘাঁটলেই দেখবেন হাওড়া স্টেশন, শিয়ালদহ স্টেশন  থেকে গুচ্ছের ট্রেন আছে, এমনকি কলকাতা স্টেশন (আগের সেই চিৎপুর ) থেকেও ট্রেন আছে l সারাদিনে এতোগুলো ট্রেন দেখে একটু কনফুসিয়া যেতে পারেন তাই গোটাকতক ভালো ট্রেন বলে দিচ্ছি l দেখুন আমার প্ল্যান অনুযায়ী ভোর বা দুপুরে রওনা দেওয়া বোকামো l রওনা দেবেন সন্ধ্যে বা রাতের দিকে l ইচ্ছে করলে অফিস করে টুক করে স্টেশন পৌঁছে যেতেও পারবেন, বেকার সি এল নিতে হবে না l আর রাতের ট্রেন ধরে পৌঁছাবেন মালদা একদম ভোর বেলায় l

রাতের ট্রেনের লিস্ট:

গৌড় এক্সপ্রেস, পদাতিক এক্সপ্রেস, দার্জিলিং মেল, কাঞ্চনকন্যা এক্সপ্রেস, হাটে বাজারে এক্সপ্রেস l গৌড় ধরেই আমি গেছিলাম l ট্রেন হিসেবে যথেষ্ট ভালো l রাত 10.15pm এ ছাড়বে আর পৌঁছবে ভোর 6am কিন্তু লেট করে ওই 7am এই পৌঁছায় l যদিও তাতে ঘুরতে অসুবিধা হবেনা l ফেরার ট্রেন হিসেবে বলবো যদি সক্কাল সক্কাল ফিরতে চান তাহলে সকাল 8.10am এ আছে তেভাগা এক্সপ্রেস যেটা দুপুর 2.25pm এ কলকাতা স্টেশন পৌঁছায় l এছাড়া নিউ জলপাইগুড়ি - হাওড়া শতাব্দী এক্সপ্রেস (ভাড়াটা সত্যি গায়ে লাগে যদিও), বেলার দিকে কাঞ্চনজঙ্ঘা, আর তারপর রাতের দিকে তিস্তা তোর্সা, রাধিকাপুর, গৌড় এক্সপ্রেস, উত্তরবঙ্গ এক্সপ্রেস, সরাইঘাট, দার্জিলিং মেল... এই সব ট্রেনগুলো ভোরে কলকাতা পৌঁছয় l আপনি বিন্দাস বাড়ি গিয়ে ফ্রেশ হয়ে অফিস চলে যেতে পারবেন, আবার একটা সি এল বাঁচলো! আসলে দেখবেন মালদা হয়ে মোটামুটি উত্তরবঙ্গের, আসামের সব ট্রেন যাচ্ছে l তাই সারাদিন ট্রেন থাকে l আপনি শুধু প্ল্যান অনুযায়ী ট্রেন নিন, কারণ মালদা কম সময়ে ঘুরে চলে আসাটা পুরো ট্রেনটাইমের উপর নির্ভর করছে l

যাত্রা শুরু:

অফিস থেকে বেরিয়ে সোজা বাড়ি, তারপর ফ্রেশ হয়ে ডিনার করে বেরিয়ে পড়লাম 8.45pm নাগাদ l মেট্রোয় ধর্মতলা, তারপর একটা ফাঁকা বাস l ভগবান জানে কি হয়েছিল সেদিন, ফাঁকা বাস পাশের অন্য ফাঁকা বাসের সাথে ফর্মুলা ওয়ান খেলতে খেলতে আমায় একদম ঘড়ি ধরে আট মিনিটে শিয়ালদহ নামিয়ে দিলো l বিগ বাজারের দিকে নামানোয় আমার বেশ সুবিধাই হয়েছিলো l

ট্রেন বেশ দেরিতেই প্লাটফর্মে দিয়েছিলো l যদিও সময়মতোই ট্রেন ছেড়েছিলো l টিটিই কে টিকিট দেখিয়ে সোজা চাদর চাপিয়ে ঘুম দিলাম l ঘুম যখন পরের দিনকালে ভাঙলো দেখি ট্রেন গৌড় স্টেশনে দাঁড়িয়ে আছে l এরপরেই মালদা ঢুকবে l ভোর 6am নাগাদ মালদা ঢোকার কথা, কিন্তু ভোর সাড়ে ছয়টা অব্দি ট্রেন গৌড়েই  দিয়েছিলো l মালদা ঢুকলো সকাল সাতটায় l

ফেব্রুয়ারির সকালে মালদা বেশ ঠান্ডা ঠান্ডা, হালকা কুয়াশা l ট্রেন থেকে নেমে সোজা এক নম্বর প্লাটফর্মের দিকে গিয়ে স্টেশন থেকে বেরোলাম l বাইরে বেরোলেই দেখবেন টোটো, রিক্সা গিজগিজ করছে l রথবাড়ি অব্দি হলে কুড়ি টাকা রিক্সা ভাড়া, ইংলিশ বাজারের দিকে হলে তিরিশ থেকে চল্লিশ চাইবে l টোটোয় উঠলে ফ্ল্যাট রেট দশ টাকা l আমার হোটেল গীতাঞ্জলি ছিলো, নেতাজি মোড়ে, তাই রিক্সা চল্লিশ টাকাই নিলো l আসলে সরকারি হোটেল মালদা টুরিস্ট লজে রুম পাইনি l গীতাঞ্জলির রুম বেশ ভালো l সময় নষ্ট না করে ফ্রেশ হয়ে, হোটেলে ব্রেকফাস্ট খেয়ে রথবাড়ি মোড় চলে এলাম l একটা কথা বলে রাখি, গৌড়, পাণ্ডুয়া, আদিনা ঘুরতে হলে আপনাকে গাড়ি ভাড়া করে ঘুরতে হবে l কোনো অটো টোটো ভাড়া করে ঘোরা যাবেনা l আপনার যদি গাড়ি নিয়ে বাছবিচার না থাকে তাহলে রথবাড়ি মোড়ের ডানদিকে দেখবেন সারি সারি অ্যাম্বাসেডর দাঁড়িয়ে l সোজা চলে যান, দরদাম করুন কিন্তু গড়পড়তায় ওই 1050 টাকা চাইবে গৌড়, আদিনা, পাণ্ডুয়া ঘোরার জন্য l আর শুধু গৌড় হলো 450 টাকা l আর যদি একটু ভালো গাড়ি মানে ইন্ডিকা, অল্টো এইসব ভাড়া নেন তাহলে 2000 টাকা লাগবে এই তিনটে সাইট ঘুরতে l শীতকালে গেলে অ্যাম্বাসেডর নেওয়াটাই ভালো, সস্তা পড়বে l গরমে এ সি অ্যাম্বাসেডর নিলে 1450 টাকা পড়বে l

পরের দিন সকালে ফারাক্কা গেলে 400 থেকে 500 মধ্যে রফা করুন, কিন্তু বানগড় যেতে হলে 1400 -1500 ধরে চলুন l সকাল 9.30am গাড়ি ছাড়লো, গৌড় যাত্রা শুরু l

সাইটসিইং:

ড্রাইভারের ওপর ভরসা করুন, সে ধরে ধরে সব কটা সাইট ঘুরিয়ে দেবে l তবুও আপনি আপনার লিস্ট হাতে রাখতে পারেন l লিস্ট আমি করে দিচ্ছি l গাড়ি একটু চলার পরেই দেখবেন গ্রাম বাংলা শুরু... আম বন চারদিকে l প্রথমেই পড়বে হাতি বাঁধা স্তম্ভ, তারপরেই রামকেলিতে চৈতন্য মহাপ্রভুর মন্দির, তাঁর পায়ের ছাপ, মদনমোহন জিউ মন্দির l 

এরপরেই শুরু হবে এই ঐতিহাসিক সৌধ গুলো :

1. বারদুয়ারী / বড়োসোনা মসজিদ

2. দাখিল দরওয়াজা

3. চিকা মসজিদ - গুমটি গেট (একই সাইটে)

4. ফিরোজ মিনার

5. কদম রসুল মসজিদ - ফতে খানের সমাধি (একই সাইটে)

6. লোটন মসজিদ

7. গুনমন্ত মসজিদ

8. তাঁতীপাড়া মসজিদ

9. বল্লাল বাটী

10. চমকাতি মসজিদ

11. কোতোয়ালি দরওয়াজা (বাংলাদেশ বর্ডার)

12. জাহাজঘাটা

13. বাইশ গজি প্রাচীর

একটা ডিয়ার পার্ক আছে যেটা বাদ দিতেও পারেন l

বড়োসোনা মসজিদটা বেশ সময় নিয়ে ঘুরুন, অনেক অ্যাঙ্গেল থেকে ছবি তুলুন, বেশ ভালো লাগবে l খুঁটিয়ে দেখুন গুমটি গেট, লোটন মসজিদ যেখানে রঙিন কাজ দেখতে পাবেন দেয়ালের গায়ে l টেরাকোটার নিদর্শন পাবেন তাঁতীপাড়া মসজিদে l টেরাকোটার সাথে রঙিন মিনে করা কাজ চমকাতি মসজিদে দেখতে পাবেন l কোতোয়ালি দরওয়াজার দেওয়াল চড়লে দেখতে পাবেন ওপারের বাংলাদেশ, রাজশাহী ডিস্ট্রিক্ট l

পাণ্ডুয়া:

1. কুতুবশাহী মসজিদ

2. একলাখি মসজিদ

3. আদিনা মসজিদ

আদিনা মসজিদ এক অদ্ভুত সৃষ্টি l বাংলা, আরব, পারস্য বাইজেন্টাইন শৈলীর নিদর্শন একসাথে পাওয়া যায় এই মসজিদে l হাতে সময় নিয়ে দেখুন, যদি সেদিন ফেরার তাড়া না থাকে তাহলে বাগানে একটু বসুন, সূর্যাস্তের আলো মসজিদের ভাঙা চূড়ায় ঠিকরানো দেখুন বেশ ভালো লাগবে l অনেকটা হাজারদুয়ারীর সামনে যেমন সাজানো বাগানে লোকে বসে জিরিয়ে নেয়, সেরকম সুন্দর ভাবে সাজানো l সব জায়গাগুলোর ব্যাপারে আমি বিস্তৃত বর্ণনা করলাম না l ঘুরতে ঘুরতে ইতিহাস শুনে নিতে পারেন যদি গাইড নেন l অথবা গুগল ঘেঁটে পড়াশোনা করে নিতে পারেন l আমি শুধু ঘোরার উপায় বাতলাবো আর ছবি দেখাবো l আরেকটা কথা, হাতে যদি সময় থাকে একটু বিকেলবেলায় মহানন্দা নদী দেখে আসতে পারেন, মালদার বুক চিড়ে চলে গেছে এই নদী l নদীর পাশে বসে একটু জিরিয়ে নেওয়াও যায় l সাইটসিইং খুব ভালো করে ঘুরলেও বিকেল 5pm এর মধ্যেই শেষ হয়ে যায়, তাই নদীর পাড়ে যাওয়াই যায় l

গুরুত্বপূর্ণ সতর্কীকরণ :

অনেকেই হয়তো আপনাকে জগজীবনপুর বলবে যেতে l ভুলেও যাবেন না l এটা অবশ্যই ঐতিহাসিক স্থান কারণ এখানে আগে একটা বৌদ্ধস্তূপ ছিলো l কিন্তু আপনি যদি বুদ্ধিস্ট স্টাডিস, বুদ্ধিস্ট আর্কিটেকচার নিয়ে পড়াশোনা না করেন তাহলে যাওয়ার দরকার নেই l একে অনেক দূর, অনেক ড্রাইভার ভালো করে রাস্তা জানেওনা, প্রায় ঘন্টা দুয়েক গ্রাম বাংলার ( কিছু জায়গায় পুরো জনমানবহীন ) ভেতর দিয়ে যাওয়ার পর পৌঁছাবেন জগজীবনপুর, যেখানে গিয়ে একটা বৌদ্ধ স্তূপের শুধু ফাউন্ডেশন দেখতে পাবেন l মোগলমারির মতো কিছুই দেখতে পাবেননা l পাশে সংগ্রহশালা তৈরী হয়েছে যেখানে এই স্তূপ থেকে প্রত্নতাত্ত্বিক খননকার্য চালিয়ে উদ্ধার করা প্রাচীন নিদর্শন রাখা হবে l এখনো চালু হয়নি এবং কবে হবে জানা যায়নি ( কারণ ওখানে স্টেট আর্কিওলজিক্যাল দপ্তরের কাউকে দেখতে পাইনি, শুনশান ছিলো ) বর্তমানে নিদর্শনগুলো কলকাতার বেহালায় স্টেট আর্কিওলজিক্যাল মিউজিয়ামে রাখা আছে, আর কিছু আছে মালদা ডিস্ট্রিক্ট আর্কিলোজিক্যাল মিউজিয়ামে l এখানে যেতে হলে অ্যাম্বাসেডর 1250 টাকা নেয় কমপক্ষে l অন্য গাড়ি হলে 2000 টাকা শুধু যাওয়া আসা l একটু আগেই বানগড়ের কথা উল্লেখ করেছি l বানগড় হলো দিনাজপুর জেলায় বালুরঘাট থেকে 45 কিলোমিটার দক্ষিনে l এখানে পুরাতাত্ত্বিক খনন করে প্রাচীন শহরের নিদর্শন... ঢিপি পাওয়া গেছে l কিন্তু আপনি যদি খুব ইতিহাস না ভালোবাসেন তাহলে এই জায়গা বাদ দিয়ে ফারাক্কা ব্যারাজ ঘুরে আসতে পারেন l তবে পরের দিন রাতের ফেরার ট্রেন ধরলে এই প্ল্যানগুলো করতে পারেন l কারণ গৌড়, পাণ্ডুয়া ঘুরতে আপনার পুরো একদিন লেগে যাবে l আমি সকাল 9am শুরু করে গৌড়, পাণ্ডুয়া, আদিনা মসজিদ ঘুরে মালদায় ফিরেছিলাম বিকেল 5pm নাগাদ l আর সেদিন রাতে থেকেও গেছিলাম কারণ পরের দিন জগজীবনপুরে বোকা হতে যাওয়াটা নিয়তিতে ছিলো l আমি চাইনা আপনারা এই ভুলটা করুন l

যদি করেন রাত্রিবাস:

মালদায় হোটেল অনেক আছে কিন্তু উল্লেখযোগ্য হলো পশ্চিমবঙ্গ সরকারের হোটেল মালদা টুরিস্ট লজ l এ সি এবং নন এ সি l বেশ ভালো রুম l মালদা টুরিস্ট লজে রুম না পেলে থাকতে পারেন হোটেল গীতাঞ্জলিতে l রুমের দাম মালদা টুরিস্ট লজ থেকে কম l এদের রেস্টুরেন্টের খাবার বেশ ভালো l সকালে কমপ্লিমেন্টারি ব্রেকফাস্ট ও পাবেন l হোটেল গীতাঞ্জলি হলো নেতাজি মোড় শপিং কমপ্লেক্সের ওপর l স্টেশন থেকে 40 টাকা রিক্সা ভাড়া, পঁচিশ মিনিট মতো লাগে যেতে l এটা ইংলিশ বাজারে l এছাড়াও রথবাড়ি মোড়ে অনেক হোটেল আছে l বেশ দামীতে থাকতে হলে রথবাড়ি মোড়ের কাছে সিলভার আর্কেড হোটেলে থাকতে পারেন l

ভুরিভোজ আর বিশেষ ভোজ:

মালদার খাওয়ার স্বাদ এন্ড পরিমাণ দুটোই খুব ভালো l হোটেল গীতাঞ্জলির যে রেস্টুরেন্ট আছে তাতে যাই অর্ডার দেবেন, মনে রাখবেন তা দুজনের জন্য যথেষ্ট পরিমাণ l সে ভাত থেকে ডাল, তরকারি, মাছ যাই বলেন না কেন l এক প্লেট মাছের কালিয়াতে বেশ বড়ো সাইজের মাছ, তাও দুই পিস l দাম কিন্তু একদমই বেশী না l কলকাতার থেকে অনেকটাই কম l এদিকে হাফ প্লেট কিছু ওখানে পাওয়া যায় না তাই আমার মতো একাবোকা ঘুড়ুনি ছেলেরা বেশ লস খায় l গৌড় থেকে যখন পাণ্ডুয়ার দিকে যাবেন তখন লাঞ্চ টাইম হয়ে যাবে, তাই পাণ্ডুয়ার পথে গাড়ি থামিয়ে অবশ্যই খাবেন পরদেশী ধাবাতে l কাঁসার থালায় খাবার পরিবেশন করে l দারুণ খাবার আর দাম কম l ওদের ফিশ থালিটা নেবেন, ভাত, ডাল, তরকারি, ভাজা, মাছ, চাটনি, পাঁপড় সহযোগে আপনার পড়বে মাত্র 110 টাকা তাও gst নিয়ে l মালদায় গেলেন আর সেখানের ইস্পেশাল কিছু ট্রাই করবেন না ? তাহলে একটা রিকশা/টোটো ধরে চলে যান মালদা মেডিকেল সেন্টার l এর পাশেই আছে সীতারাম মিষ্টান্ন ভান্ডার যা লোকের মুখে বাবুর মিষ্টির দোকান নামে পরিচিত l সেখানে গিয়ে ক্ষীরদই আর রসকদম অবশ্যই খাবেন l কিন্তু ক্ষীরদই ওরা 500gm এর নিচে বেচবে না l ভেঙে বিক্রি হয়না l রসকদম নামেই রস কিন্তু শুকনো মিষ্টি এবং বেশ অন্যরকম স্বাদের l প্যাকেট করে কিনে ফিরতে পারেন lসিলভার আর্কেড এর মাসালা জোন রেস্টুরেন্ট বেশ ভালো, খেয়ে দেখতে পারেন l

কেনাকাটা:

দেখুন কেনবার মতো স্পেশাল কিছুই নেই মালদাতে l কিন্তু হ্যাঁ, একদম খাঁটি আমসত্ত্ব পাবেন l নানারকম আমের নানারকম আমসত্ত্ব l ল্যাংড়া, হিমসাগর, আম্রপালি, লক্ষণভোগ এইসব নানারকম আমের আমসত্ত্ব পাবেন l আমরা যেগুলো কলকাতায় আমসত্ত্ব বলে দেখি সেগুলো আসলে ভেজাল, তাতে পেঁপে, কুমড়ো এসব মেশানো হয় l আমসত্ত্ব হয় শক্ত এবং আয়তকার শিট হিসেবে তৈরী হয় l 800 টাকা থেকে 2000 টাকা কেজি দরের আমসত্ত্ব কিনতে পারেন l গ্রাম হিসেবে কিনুন l 250gm নিয়ে আসতেই পারেন l চেখে দেখে কিনবেন, আমি ল্যাংড়া আমের আমসত্ত্ব কিনেছিলাম l আমসত্ত্ব কিনবেন চিত্তরঞ্জন মার্কেট থেকে, নেতাজি মোড়ের কাছেই l

সেই জলের খোঁজ:

এটা না লিখলে আমার সিগনেচার স্টাইল নষ্ট হয় l নেতাজি মোড় থেকে রূপকথা সিনেমা হল যাওয়ার পথে একটা ভালো মদের কাউন্টার পড়ে l এছাড়া চিত্তরঞ্জন মার্কেটের কাছে একটা আছে l রথবাড়ি মোড়ের কাছেও একটা কাউন্টার পাবেন তাই বয়ে নিয়ে যাওয়ার দরকার নেই l যদি বেশ ভালো বারে খেতে চান তো চলে যান সিলভার আর্কেড হোটেলের বার " ককটেলস এন্ড ড্রিমস " l ভেতরের পরিবেশ দারুণ লাগবে l কিন্তু দামি l সস্তায় পুষ্টিকর চাইলে রিক্সা নিয়ে চলে যান ইন্দ্রপ্রস্থ হোটেলের বার l কিন্তু এখানে শুধু ছেলেরা যাওয়াটাই শ্রেয় l

কালচার শক :

ধরেই নিলাম আপনি সেদিন রাতে মালদা থেকে গেলেন আর আপনি মদ খেয়ে কাওতালি করেন না আর এদিকে একা এসেছেন আমার মতো l মানে আদ্যোপান্ত বোর হবেন l হতেই পারে আপনি একা অফিসের কাজে গেছেন, কি করবেন তাহলে? উপায় বলি? সোজা চলে যান রূপকথা সিনেমা হলে l নেতাজি মোড় থেকে হাঁটা পথ বলা যায় l মাত্র 10 মিনিট l আর এখানে ঢুকেই আপনি খাবেন কালচার শক l আমরা যারা শহুরে জীবনে অভ্যস্ত তারা সিঙ্গেল স্ক্রিন থেকে মাল্টিপ্লেক্সে এসে পড়েছি l মালদায় মাল্টিপ্লেক্স নেই তবে রূপকথা হলের এ সি সিটিং ব্যবস্থা সত্যি আমার কাছে নতুন অভিজ্ঞতা l নন এ সি জায়গার মধ্যে একদম পেছনে বেশ কিছু সিট একটা কাচ ঘেরা জায়গার মধ্যে রেখে চড়া দুটো এ সি চালিয়ে এ সি সিটিং ব্যবস্থা করা হয়েছে l দেখে মনে হবে যেন আপনি ইডেনের ভি আই পি বক্সে বসে খেলা দেখছেন l হ্যাঁ আমার অন্তত তাই মনে হয়েছিল গাললি বয় দেখতে দেখতে, বেশ মজার অভিজ্ঞতা l 110 টাকার বিনিময়ে আমার সন্ধ্যেটা ভালোই কেটেছিল l কিছু করার ছিলোনা বলেই চলে গেছিলাম l ভাবছেন আমার মতো ছেলে বারে না বসে সিনেমা দেখতে কেন গেলাম? না, আসলে বারে ডিউটি দেওয়া ততক্ষনে হয়ে গেছিলো l কিন্তু সত্যি বলতে একটুও ছোট করছিনা, স্ক্রিনের পিকচার কোয়ালিটি আর সাউন্ড দুটোই দারুণ, আর রূপকথা বেশ নামি হলের মধ্যে ধরা হয় মালদাতে l

এক্সট্রা পিঞ্চ :

প্যাশনেট ট্রাভেলার? পাসপোর্ট আছে? পুরো গৌড় কমপ্লিট করতে চান? তাহলে একটা বাংলাদেশের ভিসা তুলে নিন আর এন্ট্রি পোর্টে মহিদীপুর উল্লেখ করুন l যখন আপনি কোতোয়ালি দরওয়াজা ঘুরতে যাবেন তখন মহিদীপুর বর্ডার চেক পোস্ট দিয়ে ভিসা স্ট্যাম্প করিয়ে ঢুকে যান বাংলাদেশে l ওই পারে হলো চাঁপাই নবাবগঞ্জ ডিস্ট্রিক্ট যা রাজশাহী ডিভিশনের অন্তর্গত l মাত্র তিন কিলোমিটার দূরেই রয়েছে ছোট সোনা মসজিদ যা গৌড়ের অংশই বলতে পারেনl হেঁটে বা অটো ভ্যান/রিক্সাতে চলে যান l গাড়ি নিয়ে ঢুকতে গেলে আলাদা ভিসা আর পারমিট লাগবে যেটা আমার জানা নেই l অটো ভ্যান নিলে 20 মিনিট মতন লাগবে, না পেলে তিন কিলোমিটার হেঁটেই নিন, হ্যাঁ ফিরতেও তিন কিমি l ভারতীয় টাকাই দিয়ে দেবেন, ওরা হাসিমুখে নিয়ে নেবে l আমি মহিদীপুরের ইমিগ্রেশন অফিসে কথা বলেছি, ভিসা থাকলে নিশ্চিন্তে ঢুকতে পারেন l তাই এটা নিছক গল্প নয় l আমি যেতে পারিনি কারণ এটা নিয়ে কোনো লেখা বা ইনফরমেশন নেটে পাইনি l কিন্তু আপনারা যদি চান অবশ্যই ঘুরে আসবেন l আপনার গাড়ি কে বলবেন কোতোয়ালি দরওয়াজার সামনে অপেক্ষা করতে l

কি পয়েন্টস:

1. ওখানের স্থানীয় মানুষ বলে সারাবছর টুরিস্ট আসে, কিন্তু আমি ফেব্রুয়ারির মাঝে গিয়ে দিনের বেলা ঘুরতে গিয়ে ঘেমে গেছি, তাই মে জুনে মালদা যাওয়া মানে যেচে বাঁশ নেওয়া l কি জানি বলে... কলাপাতা জড়িয়ে যাবেন পাতুরি হয়ে ফিরবেন!! তাই একান্তই যেতে হলে জুলাই মাস থেকে মার্চ মাসের মধ্যে যান l তবে হ্যাঁ আপনি আম প্রেমী হলে জুনের শেষেই চলে যান, ঘুরতে কতোটা পারবেন জানিনা, কিন্তু অনেক সস্তায় আম কিনে ফিরতে পারবেন l

2. ট্রেন যাবার সময় চেষ্টা করুন গৌড় এক্সপ্রেস নিতে l ভিড়টাও কম হবে NJP যাওয়ার ট্রেনগুলোর থেকে l জেনারেল স্লীপারের ভাড়া 220 টাকা, থ্রী এ সি পড়বে 595 টাকা l অন্য একটা দুটো ট্রেনে 10 টাকার মতো কম ভাড়া পড়ে, একটু irctc দেখে নেবেন l গৌড় এক্সপ্রেসের টিকিট একটু আগে বুক হয়ে যায়, শেষ বেলায় প্ল্যান করলে হাটেবাজারে এক্সপ্রেসের টিকিট পেয়ে যাবেন l কিন্তু মাথায় রাখবেন হাটেবাজারে বিহার যায়, বিহারগামী যে কোনো ট্রেনে উঠলে এ সি টিকিট কাটাই শ্রেয় l মালদাতে যেকোনো সময়ে রাতে নামতে পারেন, সারারাত টোটো, রিক্সা চলে l এছাড়া কলকাতা থেকে মালদা বাস সার্ভিসও আছে l শিলিগুড়িগামী সব বাস মালদা হয়ে যায় l

3. ফটোগ্রাফারদের জন্য একটা সাজেশান : ওয়াইড লেন্স নিয়ে যান l সামনে যাদের বিয়ে, তারা প্রি-ওয়েডিং শুট গৌড়ে করতে পারেন, বেশ ফাঁকা থাকে l আরেকটা কথা বলে রাখবো, চিকা মসজিদে আপনার থেকে DSLR দেখলে ওখানের গার্ডরা জোর করে 25 টাকা চাইতে পারে, কিন্তু ওটা শুধু ভিডিও করার চার্জ, বা ড্রোন চালানোর চার্জ l যদি স্টীল ফোটোগ্রাফি করেন কোনো টাকা দেবেন না l একটু ঘ্যানঘ্যান করবে , পেছন পেছন আসবে কিন্তু পাত্তা দেবেন না l

4. দুজনের মালদা ঘোরার খরচ আনুমানিক 4200 টাকা পড়বে l জেনারেল স্লীপার ট্রেন টিকিট, এ সি হোটেল, অ্যাম্বাসেডর ভাড়া, আর খাওয়া নিয়ে l আরো কমাতে নন এ সি রুম নিন , রাতে না থাকলে তো আরো কমবে, সেক্ষত্রে ট্রেন টিকিট এ সি করে নিতে পারেন l

​ব্যাস, সবই প্রায় বলে দিয়েছি, এবার সুবিধামতো দিন দেখে প্ল্যান করে বেরিয়ে পড়ুন l

Meet the Blogger

Pratik Mukherjee


Name- Pratik Mukherjee
Profession- Technical professional in Heavy Automotive Industry
City- Kolkata
Hobbies- Photography,Travelling and Travel Blogging. Love watching movies and listening EDM.
Previous Tours-
West Bengal: Murshidabad, Malda, Shantiniketan, Digha,Mogholmari & Kurumbera Fort, Purbasthali, Digha,
National: Ghatshila, Vizag, Bangalore, Hampi, Bijapur, Badami, Pattadakal, Aihole,
International: Bhutan, Sri Lanka, Cambodia, Thailand, Myanmar.



You may also like