কলকাতা শহরে কেমন যেন একটা অদ্ভুত মায়া আছে। শুধু টানে আর টানে। ঠিক যেমনটি টানে ঢাকা, রাজশাহী আর প্রিয় পার্বতীপুর। ঢাকা টানে টাকায়, পেশায়, বেঁচে থাকার তাগিদে আর জৌলুশে। রাজশাহী টানে মায়ায়, আবেগে, প্রেমে আর ভালোবাসায়।পার্বতীপুর টানে সরলতায়, আর কৈশোরের ফেলে আসা স্মৃতিতে, নিখাদ মমতা মাখা মুখ গুলোতে, আর এবার পেলাম কোলকাতাকে। তার মানে এই নয় যে প্রথম দর্শনেই কলকাতার প্রেমে পড়েছি।
আগেই বলেছি যতবার ভারতের নানা প্রান্তে ঘুরে বেড়াতে গিয়েছি প্রতিবার কলকাতা হয়েই গিয়েছি, থেকেছি, খেয়েছি। আর প্রত্যেক বারই কোথায় যেন একটা অজানা টান, একটা কেমন মায়ার বাঁধন অনুভব করেছি।
আসলে এ জন্য বোধহয় বেশ কিছুটা দায়ী প্রিয় লেখক সুনীল ও সমরেশ। উপন্যাস পড়ার শুরু থেকে সেই সাতকাহন, উত্তরাধিকার, কালবেলা, কালপুরুষের সমরেশ, আর আমার সবচেয়ে প্রিয় উপন্যাস পার্থিব এর। এছাড়া আরও অসংখ্য বই তো আছেই। তার উপর রয়েছে প্রতিবার এই শহর দিয়ে যাওয়া-আসার সময় নিজের মত করে কিছু সময় কাটাতে না পারার একটা মন কেমন করা অনুভূতি।
তাই এবার যখন এক সপ্তাহের জন্য কলকাতায় যাবো প্ল্যান করছিলাম, তখন থেকেই খুব খুব ইচ্ছা ছিল, এই কদিনে যতটা পারি ওকে তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করবো। মন-প্রান ভরে। সুযোগের সৎব্যবহারে আমি এমনিতেই কখনো অলস নই, তার উপর যদি হয় অমন এক মায়ার শহরের জন্য পাওয়া একান্ত কিছু সময়, তাহলে আমাকে আর পায় কে? ব্যাস আমিও উপভোগ করতে লাগলাম ওকে আমার মত করে সাধ্যের সবটুকু আবেগ দিয়ে।
কলকাতা পৌছাতে সন্ধা পেরিয়ে গিয়েছিল আর হোটেল খুঁজে নিয়ে উঠতে উঠতে প্রায় রাত। তাই ফ্রেস হয়ে পরিবার নিয়ে তেমন কোথাও আর যাওয়ার উপায় ছিলনা সারাদিনে ওদের ভ্রমণ ক্লান্তিতে। ভালোলাগার যায়গায় ভ্রমনে আমার কোন ক্লান্তি নেই। ঠিক যেমন থাকেনা ভালোলাগার মানুষের সাথে সীমাহীন সময় কাটানোর কোন ক্লান্তি। তো সেদিন একটু নিচে নেমে খাওয়া-দাওয়া করে, আশেপাশে একটু পায়চারী করে ফিরে এসেছিলাম রুমেই।
রুমে ফিরে কারো চোখ টিভিতে, কারো ফেসবুকে আর আমার চোখ পাশের কাঁচের খোলা জানালা দিয়ে দুরের কিন্তু দৃশ্যমান শিমুল গাছের দিকে, রাতের অন্ধকারেই চোখে পরছে থোকা থোকা ফুটে থাকা পলাশ ফুলেদের দিকে, মির্জা গালিব স্ট্রিটের পুরনো দালান কোঠায়, ইটে খাঁজে খাঁজে, শ্যাতশ্যাতে সিঁড়িতে, আগাছা জন্মে যাওয়া প্রাচীন খোলা ছাদে, রাস্তার পাশের কলের ধারে ঝরে জলে, ধীর লয়ে এগিয়ে যাওয়া কোন ট্রামে, হলুদ ট্যাক্সি ক্যাবে, দূর থেকে দেখতে পাওয়া চায়ের দোকানের ভাঁড়ে, পুরনো বাড়ির কার্নিশ, পলেস্তারা উঠে যাওয়া দেওয়ালে আর জং ধরা রেলিং এ শুকোতে দেয়া কোন জীর্ণ কাপড়ে।
কোথাও খুঁজে ফিরছি প্রেমিক রবীন্দ্রনাথকে, কোথাও বিদ্রোহী নজরুলকে, কোথাও শুষ্ক মুখের হত দরিদ্র জীবনানন্দকে, রাশভারী ঈশ্বরচন্দ্রকে, বনেদী মধুসূদনকে, কোথাও পরিপাটি বুদ্ধদেবকে, এই বুঝি পাশ থেকে ঘোড়ার গাড়ি ছুটিয়ে ছুটে গেল রাজা রামমোহন! আবার কোথাও যেন দেখছি আধুনিক সুনীলকে। এক হাতে সিগারেট আর অন্য হাতে চায়ের ভাড় নিয়ে দাড়িয়ে কথা বলছে সদ্য জলপাইগুড়ি চা বাগান থেকে অবসর কাটিয়ে ফেরা সমরেশের সাথে!
একটা ট্যাক্সি থেকে যেন নেমে এসে ওদের সাথে দাড়িয়ে চা হাতে নিল তথাগত, পাশের জীর্ণ রাস্তা থেকে হুট করে এসে সুনীলের হাত থেকে সিগারেটটা নিয়ে নিল ফেলুদা। আর ওদের এইসব কাণ্ড-কারখানা দেখে দূর থেকে মিটিমিটি হাসছেন সত্যজিৎ রায়। ওরা সেটা খেয়ালই করেনি। আর এদিকে ঝরে পরা শেষ শিশিরের কনার দিকে অপলক তাকিয়ে আছে বিভূতিভূষণ!
এরই মাঝে একটি বনেদী ট্যাক্সি সিগন্যালে দাড়াতেই জানালার কাঁচে দেখা গেল চীর তরুণী সকল পুরুষের কাঙ্খিত নারী সুচিত্রা সেনের স্বর্গীয় মুখ! আহ সবাই সবকিছু ফেলে হা করে সেদিকেই তাকিয়ে থাকলো। জানালার কাঁচ নামিয়ে ধবধবে ফতুয়া পরা উত্তমকুমার ওদের কে কিছু একটা জিজ্ঞাসা করতেই সিগন্যালের সবুজ আলো দেখে বেরসিক ড্রাইভার ট্যাক্সি ছেড়ে দিল। আর ওরাও ছুট দিল সেই ট্যাক্সির পিছে পিছে!
একটা অদ্ভুত রোমাঞ্চ ঘিরে ধরল যেন আমায়। শরীরের সমস্ত রোমকুপ গুলো যেন জেগে উঠেছিল ফিরে গিয়ে সেই সময়ে। একা একা হাসলাম বেশ অনেকক্ষণ, আর নিজের মাথায় নিজের একটা আলতো টোকা দিয়ে বললাম, কোথায় হারালিরে তুই?
আহ, রাতভর, সন্ধ্যা রাতের সেই কল্পনার আবেশ যেন কাটছেইনা। আমি আচ্ছন্ন ওদের সকলের মাঝে, ওদের প্রিয় শহরে এসে। ওদের হেটে যাওয়া রাস্তা, শত-সহস্র গল্প-কবিতা-উপন্যাস লেখার পটভূমি, ওদের বাস করা এক একটা বাড়ির দেয়াল, রাতের আকাশ দেখে নতুন কবিতা বা গল্প লেখা ছাঁদ, কার্নিশে হেলান দিয়ে দাড়িয়ে, চা হাতে নিয়ে তোলা বন্ধুদের সাথে নানা রকম তর্ক তোলা এই শহরে আমি এখন!
ভাবতেই যেটুকু ক্লান্তি ছিল শরীরে সেটুকু উধাও, হালকা যে ঘুমের একটা রেশ এসেছিল সেটা যেন খোলা জানালা দিয়ে পালিয়ে গেল কোন দূর অজানায়। আর আমি শুধু ভোরের অপেক্ষায়...
আমি একা হলে ঠিক তক্ষুনি বেরিয়ে পরতাম নিশ্চিত! আমাকে ধরে রাখা ছিল মুশকিল। কিন্তু পরিবারিক দায়িত্ব আর ওদের নিরাপত্তার দায়বদ্ধতায় আটকে রইলাম, থাকতে হল। কিন্তু চোখে মুখে একটা শান্ত, স্নিগ্ধ, জনমানুষহীন, নীরব কোলকাতা দেখার অপেক্ষায় ভিতরে ভিতরে ছটফট করতে লাগলাম।
এক সময় ঘুমিয়ে গেলাম। কিন্তু আমি আমার সত্যিকারের প্রার্থিত কোন কিছু কখনো হারাইনি বা পাইনি এমন হয়নি। কখনোই না। আর তাই, অত রাতে ঘুমিয়ে পরেও আমার ঘুম ভেঙে গেল ঠিক পাঁচটায়। অথচ সকাল নটায় ঘুম ভাঙাই ছিল স্বাভাবিক। কারন আগের সারাদিনের ভ্রমণক্লান্তি আর অনেক অনেক রাত করে ঘুমোতে যাওয়া। কিন্তু বিধাতাও যে চাননা, আমি হারিয়ে ফেলি অমন একটা শান্ত, স্নিগ্ধ সকাল তাই ঘুম ভেঙে গেল আর আমিও উঠে পরে চুপিসারে বেরিয়ে পরলাম, বাসি মুখেই!
আহ, কি ছিল সেই সকালটা। রাতে বোধয় ভারী শিশির পরেছিল কোলকাতার গাছের পাতায় পাতায়। আমাকে ভোরের কোলকাতা দেখার আমন্ত্রন জানাতে, স্বাগত জানিয়েই। তাই সদ্য পাতা ঝরে যাওয়া গাছে-গাছে গজিয়ে ওঠা সবুজ কচি পাতা গুলো থেকে টুপটাপ করে ঝরে পরছিল রাতের বৃষ্টিতে জমে থাকা ফোঁটা ফোঁটা জল। আমাকে ভিজিয়ে দিচ্ছিল না যেন ছিল সেইসব দিনের সাহিত্যিকদের এক-এক জনের কাছ থেকে পাওয়া এক-এক ফোঁটা আশীর্বাদের ফোঁটা! সবকিছু জুড়ে একটা অন্যন্য রোমাঞ্চ খেলে যাচ্ছিল আমার ভিতরে-বাইরে।
পিচঢালা রাস্তাগুলো ঝরা শিশিরের জল যেন ধুয়ে মুছে ঝরা পাতার কার্পেট বিছিয়ে দিয়েছিল আমার জন্য! ফুটপাথের পাশে সদ্য বসা ভাঁড়ের চাওয়ালাকে যেন সুনীল পাঠিয়ে দিয়েছিল পরপার থেকে আমার কাছে! নীরব রাস্তায় একটি সাইকেলের টুংটাং শব্দে চলে যাওয়া দেখে মনে হল, কফি হাউজের মইনুল যাচ্ছে দুরের অফিসে এই সাত সকালে ট্রামের টাকা বাচাতে! আরও যে কত কি?
এরপর মাইরকুইস স্ট্রিট থেকে মির্জা গালিব স্ট্রিট ধরে, এসপ্ল্যানেড, পার্ক স্ট্রিট, ধরে হাটতে হাটতে ময়দানে গিয়ে পৌছালাম। দুরের আকাশ থেকে, গাছপালার বাঁধা ডিঙ্গিয়ে, সূর্যের আভা চোখে পরতেই মনে হল এই রে আমি তো এবার একা আসিনি। হোটেলে ওরা রয়েছে। ওরা এর আগে কখনো দেশের বাইরে আসেনি, তাই উঠে দেখতে না পেলে ভয়ও পাবে আর মন খারাপও করবে। তাই কল্পনা, আবেশ আর আবগের জগৎ থেকে ফিরতেই হল বাস্তবে।
ছুটে চললাম অপার প্রকৃতি আর ফেলে আসা কাল্পনিক দিনগুলোর কাছ থেকে ইট-কাঠ আর ইস্পাতের বাস্তবতায়।
পরিবেশের যেন কথাও কোন ক্ষতি না হয় সেটা লক্ষ্য রাখবো আমরা সবাই।
Name: Sajol Zahid (সজল জাহিদ)
Profession: Private Service
City: Dhaka (Bangladesh)
Hobby: Travelling and Writing
Previous Tours: Nalanda and Chupir Char