সালটা ২০১৪ । দুর্গাপুরের এক বেসরকারি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের সহকারী অধ্যাপক তখন । আগস্ট মাস নাগাদ কলেজ ম্যানেজমেন্ট এর স্বৈরাচারী এবং শিক্ষা ব্যবস্থার পরিপন্থী নানান সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে মাস রেজিগনেশন দিয়ে বেরিয়ে এসেছি । আন্দোলন চলছে । হাতে চাকরি নেই । ডিসেম্বর মাসের ২৩ তারিখ, শীতের সকালে চায়ের দোকানে বসে আছি, হঠাৎ নিবেদিতার ফোন ।
-- ব্যাগ পত্র গোছাও, আর সোজা চলে এসো।
আগামীকাল সন্ধ্যেবেলা শিয়ালদা থেকে কাঞ্চনকন্যা এক্সপ্রেস এর দুটো টিকিট তৎকালে ম্যানেজ করেছি । এনজেপি পর্যন্ত ।
হঠাৎ করে যেন আকাশ থেকে পড়লাম । কোন আলোচনা নেই, কোন প্রিপারেশন নেই, জাস্ট ঘুরতে যাব বলেই বেরিয়ে পড়া আর কি । আমি বললাম,
-- কোথায় যাবে ?
সংক্ষিপ্ত উত্তর এল,
-- ট্রেনে উঠে ঠিক করব ।
জিজ্ঞেস করলাম, ফেরার টিকিট ?
উত্তর এল, নেই ।
আমি আর কথা বাড়ালাম না । ব্যাগ গুছিয়ে রওনা দিলাম কলকাতার দিকে । সন্ধ্যেবেলা কলকাতা পৌঁছে টুকটাক যা যা গোছানোর গুছিয়ে নিলাম । পরদিন সকাল বেলায় কিছু অতি প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের বাজারটুকু সেরে নিলাম । সন্ধ্যেবেলা ট্রেন । বাড়ি থেকে বেরিয়ে ট্যাক্সি ধরে সোজা শিয়ালদা স্টেশন । সাথে দুজনের দুটো ব্যাগ । শিয়ালদা স্টেশনে পৌঁছে ‘ComeSum’ থেকে দুটো বিরিয়ানির প্যাকেট তুলে নিলাম ট্রেনে ডিনার করবো বলে । জলের বোতল নিয়ে নিলাম । ট্রেনে বসে ঠিক করতে লাগলাম যে কোথায় যাওয়া যায় । নিবেদিতা বলল চলো ঘুরে আসি সান্দাকফু । কিন্তু কিভাবে ? ঠিক করলাম ২৫ শে ডিসেম্বর সকাল বেলা এনজেপি তে নেমে তারপর ওখান থেকে শেয়ার গাড়ি ধরে মিরিক যাব । মিরিখে একটা দিন থেকে ওখান থেকে গাড়ি ধরে মানেভঞ্জন । মানেভঞ্জন থেকে ল্যান্ড রোভার করে সান্দাকফু যাব । সান্দাকফু - ফালুট । ট্রেনে আমাদের আশপাশের বাঙ্কগুলোতে একটি দক্ষিণ ভারতীয় পরিবারের রিজার্ভেশন রয়েছে । ১০-১২ জন হবে । প্রচুর পরিমাণে খাবার দাবার নিয়ে এসে ওনারা বেশ গুছিয়ে বসেছেন । সেই দেখে আমাদেরও খিদে পেয়ে গেল । আমরাও ডিনার সেরে ফেললাম । কিছুটা গল্প করে একটু রাত্রি হতেই এবার শুয়ে পড়ার পালা । বর্ষাকালে কখনো গ্রামে গেছেন ? হঠাৎ বৃষ্টি হলে পুকুরের ধারে গিয়ে সন্ধ্যেবেলার নির্জনতায় একটু দাঁড়ালে শুনতে পাবেন নানান ধরনের ব্যাঙের ডাক । আর নির্জনতার মধ্যে সেই ডাক আপনার কান ঝালাপালা করে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট । আজকে ট্রেনে আমাদের চারপাশের ব্যক্তিদের গর্জনে ঠিক এমনি কান ঝালাপালা করার অবস্থা । কানের মধ্যে হাত চাপা দিয়ে একটু ঘুমানোর চেষ্টা করলাম । কিন্তু ঘুম যে আসবেনা, সেটা আমরা দুজনেই বুঝে গেছি । অদ্ভুত একটা উত্তেজনার মধ্য দিয়ে চলছি । এর আগে যতবারই ঘুরতে গেছি, তাতে ন্যূনতম প্লানিং ছিল । কিন্তু এবারের ঘুরতে যাওয়াটা আমার কাছে একটা বিরাট বড় সারপ্রাইজ । তার সাথে রয়েছে প্রতি পদে পদে নিজেদের ইনস্ট্যান্ট সিদ্ধান্ত নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার ব্যাপার ।
ট্রেন লেট ছিল । একটু বেলার দিকে এনজেপি নামলাম । এনজেপি নেমে সেখান থেকে মিরিক যাওয়ার গাড়ির খোঁজ করতে লাগলাম । আজ ২৫ শে ডিসেম্বর । ট্যুরিস্টে ছয়লাপ চারিদিক । গাড়ি ভাড়া ও চড়চড় করে বাড়ছে । কোন শেয়ার গাড়ি পেলাম না । তাই মিরিকের দিকে যাওয়ার প্ল্যান টা ক্যানসেল করতে হলো । এনজেপি থেকে অটো করে শিলিগুড়িতে এসে শিলিগুড়ি থেকে দার্জিলিং যাব ঠিক করলাম । একটি অটোর উপরে ব্যাগপত্র চাপিয়ে বসে পড়লাম । চেনাজানা এক ট্রাভেল এজেন্টের থেকে দার্জিলিং এ একটি রুম বুক করে নিলাম । যদিও দার্জিলিং গিয়ে হোটেল পেতে খুব একটা অসুবিধা হতো বলে মনে হয় না । শিলিগুড়ি এলাম
এবং শিলিগুড়িতে এসেই একটি শেয়ার টাটা সুমো পেয়ে যেতে সামনের দুটো সিট আমরা বুক করে নিলাম । লাগেজ ওপরে তুলে দিলাম । শাল সেগুনের বুক চিরে শুকনার জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে তীরের বেগে ছুটে চলেছে আমাদের গাড়ি । এ স্বাদের ভাগ হবে না । পাহাড়ের অমোঘ হাতছানিতে সাড়া দেওয়ার মধ্যে যে আনন্দ রয়েছে তা একমাত্র পাহাড় প্রেমীরাই বুঝতে পারবেন । এই প্রেমের স্বাদ জীবনের প্রথম প্রেম এর থেকে কম কিছু না ।
মাঝপথে এক জায়গায় গাড়ি থামিয়ে একটু চা, টিফিন সেরে নেওয়া । ব্যাস, গরম চায়ে চুমুক দিয়ে একটু উষ্ণতার স্বাদ নিয়েই আবার চলা শুরু । গুন গুন করে গান গাইতে গাইতে এগিয়ে চলেছি দার্জিলিং এর পথে । শেয়ার গাড়ি । তাই দার্জিলিং পৌঁছে স্ট্যান্ড এর কাছেই নেমে যেতে হলো । সেখান থেকে খুঁজে খুঁজে হোটেলে গিয়ে উঠলাম । হোটেলে পৌঁছে একটু ফ্রেশ হয়ে গরম জলে স্নান সেরে নিলাম । তারপর ডাইনিং এ এসে লাঞ্চ সেরে রুমে গিয়ে একটু রেস্ট নিলাম । বিকেল বেলা বেরোতে হবে । অনেক কাজ । কিছুটা সময় রেস্ট নিয়ে আমরা রেডি হয়ে নিলাম । বেরিয়ে প্রথমে এক কাপ গরম চা এর খোঁজে । চা শেষ করে কয়েকটা ট্রাভেল এজেন্সির দ্বারস্থ হলাম, আগামীকাল সকালবেলা মানেভঞ্জন যাওয়ার গাড়ির খোঁজ করতে । ভরা টুরিস্ট সিজন । দার্জিলিং থেকে মানেভঞ্জন যাওয়ার গাড়িতে আড়াই থেকে তিন হাজার টাকা দাবি করে বসলো । অনেকক্ষণ ঘোরাঘুরি করে আরেক কাপ চা এ চুমুক দিতে দিতে একটু মাথা খাটানোর চেষ্টা করলাম । স্থানীয় লোকেরা কিভাবে যাতায়াত করে সেটা জানতে হবে । তাহলেই হয়তো কিছু একটা উপায় বেরিয়ে আসতে পারে । এই ভেবে একজন ট্রাফিক পুলিশ কে জিজ্ঞাসা করলাম যে এখান থেকে মানেভঞ্জন যাওয়ার জন্য কি ধরনের যোগাযোগ ব্যবস্থা রয়েছে ? উনি জানালেন, নিচে ওল্ড বাস স্ট্যান্ডের পাশ থেকে মানেভাঞ্জন যাওয়ার জন্য সকাল বেলা একটি ট্রেকার ছাড়ে । স্থানীয় বাসিন্দারা ওতে যাতায়াত করেন । আমরা সেখানে গিয়ে খোঁজ পাওয়ার কিছুটা আশার আলো দেখতে পেয়ে ওই ভদ্রলোককে ধন্যবাদ জানাতে গেলে উনি জিজ্ঞাসা করলেন আমরা কোথায় যাব ? আমি বললাম সান্দাকফু । টুকটাক কথাবার্তা সেরে ওনার কাছ থেকে বিদায় নিলাম । চললাম ওল্ড বাসস্ট্যান্ডের দিকে । সেখানে গিয়ে জানতে পারলাম সকাল আটটা নাগাদ একটি ট্রেকার দার্জিলিং থেকে মানেভঞ্জন যায় । ভাড়া ৫০ টাকা যাত্রীপ্রতি । খোঁজখবর নিয়ে সেখান থেকে ফিরে এসে কিছু কেনাকাটা সেরে ফেললাম । কেনাকাটা বলতে কিছু খাবার দাবার আর কিছু প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র । হোটেলে ফিরে রাত্রে তাড়াতাড়ি খাওয়া দাওয়া সেরে পরদিন সকালে উঠে রওনা দিলাম মানেভঞ্জন এর গাড়ি ধরার উদ্দেশ্যে । কিন্তু সময় সাথ দিল না । আমরা সেখানে পৌঁছানোর কয়েক মিনিট আগেই মানেভঞ্জন যাওয়ার গাড়িটি সেখান থেকে ছেড়ে বেরিয়ে গেছে । একটা খারাপ লাগা ঘিরে ধরছিল । আরো একটু খোঁজখবর করে জানতে পারলাম যে পনেরো কুড়ি মিনিট পর একটি রিম্বিক যাওয়ার গাড়ি ছাড়ে এখান থেকে । যেটি মানেভঞ্জন হয়ে যায় এবং সেটির ভাড়া যাত্রী প্রতি ১০০ টাকা । যেহেতু মাঝপথে সেভাবে যাত্রী পাওয়া যায় না, তাই একজনের জন্য পুরো ভাড়া দিতে হবে এই শর্তে রাজি হওয়াতে গাড়িতে দুটো সিট পেলাম । আবার নতুন করে খুশিতে উদ্বেলিত হয়ে উঠলাম । গাড়ি ছাড়লো । আমরা মানেভঞ্জনের পথে । দার্জিলিং থেকে যার দূরত্ব মেরে কেটে ঘন্টা দুয়েকের । দার্জিলিং - ঘুম - লেপচাজগত- সুখিয়াপোখরি ছাড়িয়ে আমরা এখন মানেভঞ্জনে ।
মানেভঞ্জন পৌছালাম সাড়ে দশটা - পৌনে এগারোটা নাগাদ । পৌঁছে প্রথমে সেখানকার ল্যান্ড রোভার অ্যাসোসিয়েশনে গিয়ে খোঁজখবর নিতে শুরু করলাম । আমাদের প্রাথমিকভাবে ইচ্ছা ছিল যে ট্রেকিং করে সান্দাকফু পৌঁছানোর । কিন্তু প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাপনা ছিল না । প্রস্তুতি ছিল না ট্রেকিং এর । তাই সমস্ত ইচ্ছেয় জল ঢেলে ঠিক করেছিলাম যে ল্যান্ড রোভারে চেপে সান্দাকফু যাব । মানেভঞ্জন থেকে সান্দাকফুর দূরত্ব হলো ৩২ কিলোমিটার । মাঝখানে কয়েকটি জায়গাতে হল্ট করা যায় । যারা ট্রেকিং করে যায় তারা মানেভঞ্জন থেকে চিত্রে - মেঘমা হয়ে টুমলিং বা টংলুতে গিয়ে রাত্রি যাপন করে । পরের দিন সেখান থেকে গইরিবাস পর্যন্ত গিয়ে সেখানে রাত্রি যাপন আর তার পরদিন কালাপোখরি - বিকেভঞ্জন হয়ে সান্দাকফু । তারপর সেখান থেকে পরেরদিন ফালুট । আবার ফিরে আসা অথবা রিম্বিক হয়ে নেমে আসা । তাই আমরা ভেবেছিলাম যে ল্যান্ড রোভার এ করে প্রথম দিন সান্দাকফু পৌঁছে পরদিন সেখান থেকে ফালুট গিয়ে তারপর সেখান থেকে ফিরব । কিন্তু বাধ সাধলো কিছু ব্যাপার । আমরা সংখ্যায় মাত্র দুজন । দুজনের জন্য একটি ল্যান্ড রোভার ভাড়া করতে মানেভঞ্জন থেকে সান্দাকফু যাওয়ার জন্য এবং সেখানে নাইট স্টে করে পরদিন ফিরে আসা ৪৮০০ টাকা মতো নেয় । আরো একদিন এক্সট্রা থাকতে গেলে আরও অতিরিক্ত টাকা দিতে হবে । তাছাড়া মানেভঞ্জন থেকে সান্দাকফু যাওয়ার পুরো রাস্তাটাই গ্রাভেল রোড । তাই মাত্র দু'জন করে যাওয়া বেশ ঝাঁকুনি সাপেক্ষ ব্যাপার । অতঃপর নিরুপায় হয়ে আমরা খোজ করতে লাগলাম আমাদের মতোই ভবঘুরে কোন জুটি যদি জুটে যায় । কিন্তু বিধি বাম । একটি দলের সন্ধান পেলাম । তারা ৭ জন রয়েছে । আমাদেরকে তাদের দলে নিতে ইচ্ছুক । কিন্তু সমস্যা হল যে ল্যান্ড রোভার এ ৮ জনের বেশি বসা যায় না । আর তাদের ল্যান্ড রোভার এ সান্দাকফুর জন্য বেশ কিছু সবজি লোড করা হয়েছে, তাই সেখানে বসার জায়গা সংকুলান হবে না । আরো একটি দলের সন্ধান পাওয়া গেল । তারা একটি ফ্যামিলি । সঙ্গে বাচ্চা রয়েছে । আর আমি এবং নিবেদিতা দুজনেই চাইছিলাম না এরকম কোন দলের সাথে যেতে । তাই একটু অপেক্ষা করতে মনস্থির করলাম । ল্যান্ড রোভার অ্যাসোসিয়েশনের একজন জানালেন যে কিছুক্ষণ আগেই একটি তিন জনের দল সান্দাকফুর জন্য রওনা হয়ে গেছে, আমরা একটু আগে এসে উপস্থিত হতে পারলে তাদের সাথে গাড়ি শেয়ার করতে পারতাম । যাইহোক তারা বেরিয়ে গেছে । আমরা মিনিট কুড়ি মতো বসে রয়েছি, এখনো কোনো দলের দেখা পায়নি । আর কিছুক্ষণের মধ্যে যদি কাউকে না পাই, তাহলে আমাদের নিজেদের এই একটি পুরো গাড়ি ভাড়া করে সান্দাকফু যেতে হবে । এমন সময় তিনজনের দলটি কিছুদুর গিয়ে ফিরে এসেছে । তাদের কিছু কাগজপত্র সংক্রান্ত সমস্যা বা কিছু একটা হয়েছে । তারা ফিরে এসে ল্যান্ড রোভার অ্যাসোসিয়েশনে কথা বলার সময় সেখান থেকে আমাদের ডেকে পাঠান এবং বলেন যে আমরা তাদের সাথে যেতে ইচ্ছুক কিনা । আমরা তো আহ্লাদে আটখানা । তিনটে বাচ্চা বাচ্চা ছেলে । সদ্য উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে কলেজে ভর্তি হয়েছে । প্রথম বর্ষ । প্রথমবার বাবা মাকে ছেড়ে বাড়ির বাইরে । আমাদের ভিশন ইন্টারেস্টিং লাগলো । তারাও আমাদেরকে সাদরে গ্রহণ করল তাদের সঙ্গী হওয়ার জন্য । কিন্তু তারা মাত্র একদিনের জন্য যেতে চায় আর আমাদের ইচ্ছে ছিল অন্তত দুদিন সেখানে থাকার । যাইহোক তাদের সাথে সহমত এ আসতে হল এবং আমরাও ঠিক করলাম যে আজকে সান্দাকফু পৌঁছে আজকের রাতটা সেখানে রাত কাটিয়ে পরদিন সকালে সেখান থেকে ফিরে আসব ।
তন্ময়, দ্বীপায়ন, আবির, নিবেদিতা ও আমি, পাঁচ মূর্তি ১৯৫৭ সালের একটি ল্যান্ড রোভারে সওয়ারী । কিছুটা এগিয়ে এসে সিঙ্গালিলা ন্যাশনাল পার্কের এন্ট্রি পার্মিট নিতে হয় । সিঙ্গালিলা ন্যাশনাল পার্কের এন্ট্রি গেট ছাড়িয়ে গাড়ি যতই এগিয়ে চলল, রাস্তার চড়াইও তত বাড়তে শুরু করেছে । প্রথম দুই তিন কিলোমিটার এই বুঝে গেছি জার্নিটা কি রকম হতে চলেছে । বোল্ডার বসানো পাথুরে রাস্তায় গাড়ীর ঝাঁকুনিতে মাঝে মাঝেই এদিক ওদিক ঠোকা লাগছে । কিন্তু রাস্তার দুপাশের চোখজুড়ানো, মনভুলানো দৃশ্য সবকিছু ভুলিয়ে দিচ্ছে । কিছুক্ষণ আগে পর্যন্ত আমরা দুজন ছিলাম, তারপর আমাদের তিনজন নতুন বন্ধু মিলিয়ে ৫ জন এবং আমাদের গাড়ির ড্রাইভার ফিনজো । সব মিলিয়ে আমরা ছয় জন এখন । সান্দাকফু আসার প্ল্যান টা হঠাৎ করে করা । তাই সান্দাকফু তে কোথায় উঠব তার কোন ব্যবস্থাপনা ছিল না । বস্তুত সেখানে গিয়ে কোথায় থাকা যায় সেই সম্বন্ধেই খুব একটা বেশি আইডিয়া ছিল না । গাড়িতে ওঠার আগে ফিনজো কে জিজ্ঞাসা করেছিলাম যে সান্দাকফুতে গিয়ে আমরা কোথায় থাকতে পারি । ফিনজো জানিয়েছিল ওখানে শেরপা চালেট বলে একটি হোম স্টে রয়েছে । আর তার পাশে সানরাইজ আরেকটি হোমস্টে । ইয়ুথ হোস্টেল রয়েছে, কিন্তু এই মুহূর্তে কোথাও ফাঁকা পাওয়া খুব মুশকিল । আর যদি ওখানে ফাকা না পাওয়া যায় তাহলে নিচে নেমে আসতে হবে । গইরিবাসের দিকে । সেখানে ফিনজোর এক দিদির বাড়ি রয়েছে । কোথাও কোনো ব্যবস্থাপনা না হলে ওর দিদির বাড়িতেই থাকার বন্দোবস্ত করে দেবে । সেই শুনে আমি খানিক আস্বস্থ বোধ করেছি । আবির এবং তন্ময় ও সেরকম ভাবে কোন হোম স্টে বুক করে আসেনি । তারা ফিনজোর সাথে কথা বলে নিয়েছে । গাড়ি চলতে শুরু করেছে । বেশ কিছুক্ষণ গাড়ি চলার পর আমরা এখন চিত্রে তে ।
এবার হালকা টিফিন করা দরকার হয়ে পড়েছে । সেই মতো চিত্রেতে একটি ছোট্ট তাবুর মত ঘরের মধ্যে গরম চা, নুডুলস খেয়ে নিলাম । অল্প একটু ছবি তুলে নিলাম । সামনের দিকে থাকা পাহাড়ের সারি এক অভূতপূর্ব দৃশ্যের অবতারণা করেছে । চিত্রে থেকেও উঁকি দিচ্ছে কাঞ্চনজঙ্ঘা, স্লিপিং বুদ্ধ । আমরা খুব বেশী সময় অতিক্রান্ত না করে সেখান থেকে আবার ল্যান্ড রোভারে চেপে বসলাম । রাস্তা বলতে প্রায় কোন রাস্তাই নেই । বড় বড় পাথর বসানো গ্রাভেল রোড । তার উপর দিয়ে ১৯৫৭ সালের ল্যান্ড রোভার ছুটে চলেছে । আমাদের পরবর্তী গন্তব্য টংলু । এইখান থেকে সমস্ত কাঞ্চনজঙ্ঘা রেঞ্জ একসাথে খুব সুন্দর ভাবে দেখা যায় । তাই এখানে নেমে একপ্রস্থ ছবি না হলে কি আর হয় । সিঙ্গালিলা ন্যাশনাল পার্ক ফেব্রুয়ারি মার্চ মাসে সেজে ওঠে রোডোডেনড্রনের রঙিন পোশাকে । তা ছাড়াও বিভিন্ন বন্য প্রানীদের বসবাস এখানে । তাই চলার পথে শক্ত করে ল্যান্ডরোভারের লোহার রডগুলি ধরে থাকার সাথে সাথে চোখ থাকছিল আশেপাশের ঘন জঙ্গলে এবং দূরে তুষারাবৃত পর্বতমালা তে ।
মানেভঞ্জন থেকে সান্দাকফু মাত্র ৩২ কিলোমিটার হলেও এই দূরত্ব অতিক্রম করতে প্রায় চার থেকে পাঁচ ঘন্টা লেগে যায় । কারণটা আর কিছুই না, এখানে রাস্তা বলতে যা বোঝায় তা হল বড় বড় পাথর বিছানো কিছুটা সমতল জায়গা । টামলিং ছাড়িয়ে আমরা গইরিবাসের দিকে এগিয়ে চলেছি । এদিকে ঝাকুনিতে শরীরের কল কব্জা ঢিলে হয়ে যাওয়ার জোগাড় । আমাদের থাকার জায়গার ঠিক নেই । তাই গইরিবাস থেকে যদি ফোন করে সান্দাকফুতে কিছু বুক করা যায় তো খুব ভালো হয় । নতুবা সান্দাকফু দেখে আমাদের ফিরে আসতে হবে কালিপোখরি বা গইরিবাসে ফিনজোর দিদির বাড়িতে । ফিনজোর দিদির বাড়িতে একপ্রস্থ টিফিন করা গেল । টিফিন বানাতে বলে আমরা পাশের পাহাড় টাতে বেশ কিছুটা উঠে এসেছি, আর পাহাড়ের মধ্যে গুল্ম জাতীয় গাছের ঝোপ থাকায় খুব সহজেই পথ হারিয়ে ফেলেছি । যাদের ঝোপ জঙ্গলে ঘোরার অভিজ্ঞতা আছে, তারা এটা বেশ ভালোভাবে জানেন যে জঙ্গলের মধ্যে ঢুকে পড়লে কিছু চিহ্ন দেখে দেখে এগোতে হয়, নতুবা জঙ্গলের মধ্যে সমস্ত দিক একইরকম মনে হয় এবং ঘুরেফিরে একই জায়গায় বারবার করে চলে আসার সম্ভাবনা থাকে । এভাবে পথ হারিয়ে বিপদ ডেকে নিয়ে আসতে পারে । আমরাও খানিকটা হতভম্ব হয়ে পড়লাম । কিন্তু ধৈর্য না হারিয়ে ধীরে ধীরে সেখান থেকে নেমে এলাম । অনেকটা সময় অতিক্রান্ত হয়েছে । খাওয়া দাওয়া কমপ্লিট করার মধ্যে ফিনজো ওপরের সানরাইজ হোমস্টে তে থাকার জায়গার বন্দোবস্ত করে ফেলেছে । এখান থেকে সান্দাকফু, খুব অল্প দূরত্বের মধ্যে বেশ অনেকটাই উচ্চতায় উঠতে হয় । আর ওঠার রাস্তা টা বেশ খাড়াই । পিছনের দিকে তাকালে মনে হয় যে প্রায় সোজা উঠে আসছে । ডিসেম্বর মাস । কনকনে ঠান্ডায় প্রায় জমে যাওয়ার মত অবস্থা । আমরা গইরিবাস থেকে আসার পথে ল্যান্ড রোভারের ঝাকুনি আর রাস্তার পাশের গভীর খাদ দেখে নিবেদিতা বেশ ভয় পেয়ে গেছে । বারবার বলছে, এটাই শেষবার আশা । আর আসবো না । কিন্তু আবার চারদিকের সৌন্দর্যে এতটাই মুগ্ধ হয়ে উঠেছে যে অন্য কোন কিছুর খেয়ালই নেই । অবশেষে আমরা এখন সান্দাকফুতে । পশ্চিমবঙ্গের সবচেয়ে উচ্চতম বিন্দুতে অবস্থান করছি । সান্দাকফুতে একটা মজার ব্যাপার হলো, পাহাড়ের মাথার উপর দিয়ে যে রাস্তা গেছে, সে রাস্তার একপাশে ভারত আর একপাশে নেপাল । সারা পৃথিবী জুড়ে যেখানে সীমান্তু সমস্যা নিয়ে যুদ্ধ বেধে যায়, সেখানে চোখের নিমেষে এক দেশ থেকে আর এক দেশে চলে যেতে পারবেন । খেলার ছলে । অথবা রাত্রিরে শুতে গেলেন নেপাল এ আর সকাল এ উঠে ব্রাশ করলেন ভারত এ । এক অনন্য অনুভূতি । শেরপা চালেট এবং সানরাইজ হোম স্টে দুটি নেপালে অবস্থিত। ভারতের দিকে একটি ইয়ুথ হোস্টেল রয়েছে । সান্দাকফু আসার আগে একজন পুলিশ কর্মীর সাথে পরিচয় হওয়ার সময় তিনি বললেন, "It is Hell and It is Heaven”. আমি একটু শুধরে নিয়ে ব্যাপারটাকে এভাবে বর্ণনা করলাম, “ A Road like Hell Suddenly Reaches the Heaven. And Yes, It is The Heaven.”
পৃথিবীর সর্বোচ্চ পাঁচটি পর্বত শৃঙ্গের মধ্যে চারটি একসাথে দেখা যায় এখান থেকে । মাউন্ট এভারেস্ট, লোৎসে, মাকালু এবং অতি অবশ্যই “Sleeping Buddha” কাঞ্চনজঙ্ঘা । পান্ডিম, সিম্ভো, গোয়েচা পিক, থ্রি সিস্টার্স সহ মোট ১১ টা উঁচু পর্বত শৃঙ্গ আপনি চায়ের কাপ হাতে একই চেয়ারে বসে দেখতে পারেন । যেন মনে হবে ১ লক্ষ দর্শক ভর্তি যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গন এর মাঝখানে আপনি চেয়ার নিয়ে বসে আছেন, আর গ্যালারির দিকে তাকিয়ে মুগ্ধ হয়ে ফুটবল পাগল বাঙালি কে দেখছেন । যেন মনে হবে স্বর্গে বসে আপনি চারদিকে নজরদারি করছেন আর প্রানভরে তার সৌন্দর্য তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করছেন । রূপের ডালি সাজিয়ে প্রকৃতি এখানে তার অকৃপণ ভালোবাসা উজাড় করে দিয়েছে । সান্দাকফু । প্রায় এক ফুট শক্ত করে জমে থাকা বরফ, হিমাঙ্কের নিচে থাকা তাপমাত্রা, শনশন করে বয়ে চলা ঝড়ো বাতাস, বাতাসে অক্সিজেনের অভাব, জমে যাওয়া জল, অ্যাডভেঞ্চার প্রিয় কিছু মানুষজন আর প্রকৃতি এবং শুধুই প্রকৃতি । বেলা বয়ে এসেছে । সানরাইজ হোমস্টের সামনের ফাঁকা জায়গায় ল্যান্ড রোভার থেকে নেমে ব্যাগ পত্র নামিয়ে নিলাম । ফিনজো তার বাহন কে নিয়ে নীচে গইরিবাসে ফিরে যাবে । কারণ সান্দাকফুর হিমাঙ্কের বেশ কিছুটা নিচে থাকা তাপমাত্রায় পরদিন সকালে গাড়ি স্টার্ট নিতে চাইবে না । তাই আবার সে নিচে থেকে উপরে আসবে আমাদের ফিরিয়ে নিয়ে যেতে । ব্যাগটা নামিয়ে হোমস্টের দিকে এগিয়ে গেলাম । সেখানে কথাবার্তা বলে রুমে ব্যাগপত্র রেখে আমরা বাইরে বেরিয়ে এলাম । প্রকৃতির রূপে মোহিত আমরা । সূর্য ঢলে পড়ছে পশ্চিম আকাশে । তাই সানসেট দেখার জন্য আমরা সবাই মিলে ঠিক করলাম কিছুটা দূরে একটা পাহাড়ের চূড়ায় গিয়ে সানসেট দেখব । সেই মতো আমরা সকলেই গেলাম । কিছুটা ট্রেকিং করে উঠতে হয় । সেখান থেকে পড়তি বেলায় সান্দাকফু থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা সহ আরো নানান পর্বত শৃঙ্গ গুলোকে এক অদ্ভুত মায়াবী লাগছিল । পাহাড়ের উপর থেকে নিচে থাকা মেঘের উপর সূর্যের আলোর রিফ্লেকশন দেখে মনে হচ্ছিল যেন কোন এক মহাসমুদ্র শুরু হয়েছে । আবার এটাও মনে হচ্ছিল যে, আমরা যেখানে বসে আছি সূর্যটা তার থেকে অনেক নিচে নেমে যাচ্ছে । এভাবে কেটে গেছে প্রায় তিন ঘন্টা । সূর্যাস্তের পর অন্ধকার নেমে আসছে ।
সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ঠাণ্ডার তীব্রতা । আমাদের ও ফিরতে হবে হোমস্টে তে । আসার সময় যতটা সহজেই আমরা উঠে গেছিলাম, ফেরার সময় ততটা সোজা হলো না । ঝুরো বরফের মধ্যে নিবেদিতার একবার পা হড়কালেও বিপদ কিছু ঘটে নি । আমরা ফিরে এলাম হোমস্টে তে । এর মাঝে একটি ছোট্ট ঘটনা ঘটে গেছে । আমাদের সাথে যে তিনজন তরতাজা যুবক এই ট্যুরে সঙ্গী, তাদের মধ্যে একজন তার লাগেজ ব্যাগটি হোমস্টের বাইরেই ফেলে সানসেট দেখার জন্য চলে গেছিল । কিন্তু তিন ঘণ্টা পর ফিরে এসে দেখে তার ব্যাগ টি যেখানে ছিল সেখানেই রয়েছে । কেউ হাত পর্যন্ত দেয়নি । পাহাড়ে ঘোরার অভিজ্ঞতা থেকেই আমার একটা জিনিস বার বার মনে হয়েছে যে, যেখানে মানুষকে প্রকৃতির সাথে প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করে বেঁচে থাকতে হয়, সেখানে মানুষজন নিজেদের মধ্যে লড়াই করার কোন কারণ খুঁজে পায় না । প্রতিনিয়ত প্রকৃতির খামখেয়ালীপনার উপর নিজেদের অভিজ্ঞতা এবং একে অপরের সাথে বাধো বাধো হয়ে থেকে যখন পথ চলতে হয় তখন ছোটখাট ব্যাপারে নিজেদের মধ্যে কোন দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয় না । আর পার্বত্য অঞ্চলের মানুষরা যেমন কঠোর পরিশ্রমী হয় তেমনি নির্ভীক, সৎ এবং সুন্দর মনের অধিকারী ও হন । হোমস্টে তে ফিরে এক কাপ করে চা আর কিছু টিফিন না হলেই হচ্ছিল না । বন্দোবস্ত করা গেল । আমরা নিজেদের রুমে বসে আড্ডা দিচ্ছি । বাইরে শনশন করে হাওয়া বইছে । শীত বাড়তে লাগলো । তাপমাত্রা হিমাঙ্কের বেশ খানিকটা নিচে । অন্তত -১০ হবে মনে হচ্ছে । হোম স্টের এটেনডেন্ট এসে আমরা রাত্রে কি খাব সে ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করে গেল । যদিও এখানে খাবারের ব্যাপারে খুব একটা বেশি চয়েস এর সুযোগ নেই বা থাকার সম্ভাবনাও নেই । তার মধ্যেই আমরা কে কি খাব সেটা জেনে নিতে বেশ ভালো লাগলো । রুমের মধ্যে খাটের উপর একটা ব্ল্যাঙ্কেট এবং দুটো মোটা মোটা লেপ দেওয়া রয়েছে । এই ঠান্ডার সাথে লড়াই করে টিকে থাকার জন্য । যদিও এটা যথেষ্ট কিনা জানিনা, কিন্তু এত ভারী ভারী দুখানা লেপ গায়ে দিলে কি চরম অস্বস্তির মধ্যে রাত কাটবে তা ভেবেই অস্বস্তি হতে শুরু করল । গল্পের মধ্যে একবার ইচ্ছে হয়েছিল যে বাইরে গিয়ে সান্দাকফুর চারিদিকে তাকিয়ে দেখি, কিন্তু হাওয়ার শব্দ, বরফের কুচি উড়ে বেড়ানোর মধ্যে বাইরে বেরোনোর রিক্স নিতে পারলাম না । এক একবার মনে হচ্ছে যেন এই কাঠের হোমস্টে টি কখন না উড়িয়ে নিয়ে যায় । তাই কাঁচের জানলার মধ্য দিয়েই বাইরের দৃশ্য দেখার চেষ্টা করলাম । একটু পরেই খাবার ডাক এলো । খেয়ে দিয়ে নিজেদের রুমে এসে বসলাম । একদিনে মানেভঞ্জন থেকে শুরু করে ১৪০০০ ফিট উচ্চতায় আমরা চলে এসেছি । তাই অক্সিজেনের অভাব বোধ হচ্ছে । ভয় হতে লাগলো পাছে একিউট মাউন্টেন সিকনেস না করে বসে । সে ক্ষেত্রে অতিদ্রুত এখান থেকে নেমে যাওয়ার মতো কোন উপায়ও দেখতে পাচ্ছি না । মোবাইল নেটওয়ার্ক নেই । যেখানে যুদ্ধটা প্রকৃতির সাথে, সেখানে মানুষ বোধহয় নিজেদের প্রতি বেশি সদয় হয়ে ওঠে । নিবেদিতার অক্সিজেন ডেফিশিয়েন্সি ফিল হচ্ছিল বলে আমাদের হোমস্টেতে থাকা অন্যান্য গ্রুপের লোকজন কেউ কোকা সিক্স আবার কেউ কেউ বা একটু ব্র্যান্ডি নিয়ে এসে হাজির । একজন দিলেন রসুনের সুপ খাওয়ার দাওয়াই । যাই হোক, তার আর ব্যবস্থা বা বন্দোবস্ত করা গেল না এ মুহূর্তে । কোকা সিক্স খেয়ে কাজ কিছু হল কিনা বুঝতে পারলাম না, কিন্তু মানসিকভাবে একটু শক্তি পাওয়া গেল । ইয়ুথ হস্টেলে থাকা একাটি দলের একজন আবার খবর পেয়ে একটি কর্পূরের কৌটো নিয়ে হাজির । কখনও কখনও একটি ব্ল্যাঙ্কেট এবং দুটি মোটা মোটা লেপ চাপা দেওয়ার পর অক্সিজেন ডেফিশিয়েন্সি আরো বেশি বেশি করে ফিল হচ্ছিল । জানিনা কি কারনে । রাত্রে ঘুম হলো না । সারা রাতটা জেগেই কাটলো । পরদিন ভোরে উঠতে হবে । সান্দাকফু থেকে সানরাইজ, এই স্বপ্নটা বেশ কয়েক বছর ধরে মনের মধ্যে লালন পালন করছিলাম । গতকাল সূর্যাস্তের দৃশ্য উপভোগ করেছি, তা সারাজীবন মনের মধ্যে নিয়ে বেড়াবো । ভোর রাতেই বিছানা ছেড়ে কোনরকম একটু ফ্রেশ হওয়ার চেষ্টা করলাম । বাথরুমের জলে হাত দেওয়া যায় না । বালতির মধ্যে জমে গিয়ে বরফ হয়ে গেছে । একটু রাত থাকতে বাইরে বেরিয়ে এলাম । ভীষণ ঠান্ডা আর জমে যাওয়া শক্ত বরফের উপর দিয়ে কোন ভাবে একটু হেঁটে বাইরে বেরিয়ে এসে একটা বসার জায়গা তে বসলাম । রাত্রে ঘুম হয়নি, তাই ভীষন টায়ার্ড লাগছে । কিছুক্ষণ বসার পর পুব আকাশে একটা নীলচে আলোর রেখা দেখতে পেলাম । মনটা এক অদ্ভূত ভালোলাগায় ভরে উঠল । ক্যামেরা বের করে ছবি তুলতে লাগলাম । তারপর সূর্যের প্রথম আলো কাঞ্চনজঙ্ঘার মাথা ছুয়ে এভারেস্টে, লোৎসে, মাকালু, থ্রী সিস্টারস, পান্ডিম, সিম্ভো, গোয়েচা পিক, চারদিক যেন সোনায় মুড়ে দিল । সে দৃশ্য কথায় বর্ণনা করা যায় না ।
এক জায়গায় বসে পৃথিবীর পাঁচটি সর্বোচ্চ শৃঙ্গের মধ্যে চারটি চোখের সামনে ভাসছে । এটাই স্বর্গ, এটাই স্বর্গ । এর থেকে সুন্দর দৃশ্য আর এ জীবনে দেখব কিনা জানিনা, কিন্তু আজ নিজের জীবনটাকে সার্থক বলে মনে হচ্ছে । মোহিত হয়ে গেলাম । সব ক্লান্তি দূর হয়ে গেল । মনের মধ্যে একরাশ ভালোলাগা আর ভালোবাসার আবেশ মেখে নিলাম । নিচে মেঘগুলো সাত সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো সাদা হয়ে রয়েছে, আর দূরে বরফাবৃত কাঞ্চনজঙ্ঘা শুয়ে শুয়ে সূর্যকিরণ মেখে সূর্যরশ্মি স্নাত হয়ে সকলের মন ভরিয়ে দিচ্ছে ।
দীর্ঘদিনের জমে থাকা স্বপ্নটা আজ বাস্তব । মনের মধ্যে ভালোলাগা উপচে পড়ছে । প্রাণের মধ্যে এসেছে এক নতুন চঞ্চলতা । আমরা ব্যস্ত প্রকৃতির রসাস্বাদনে । চেটেপুটে খেয়েও যেন স্বাদ মেটে না । প্রতি মুহূর্তে বদলে যাচ্ছে রূপসীর রূপ । সূর্যের প্রথম কিরণ যেন গ্যালন গ্যালন সোনা গলিয়ে ঢেলে দিয়ে যায় চারিদিক । বেলা বাড়ার সাথে সাথে তার বয়স যেন বাড়তে থাকে । তার যৌবন এর উচ্ছলতায় চারদিক মাতিয়ে তোলে । দেখতে দেখতে সময় কিভাবে পার হয়ে যাচ্ছে বুঝতেই পারলাম না । বেশ কিছুটা বেলা বাড়ার সাথে সাথে ফিনজো তার বাহন নিয়ে হাজির । আমরা তখনও ছবি তুলতেই ব্যস্ত । এদিকে গ্রুপের সবার সাথে কথা হয়েছে । তারা ফালুট এর দিকে যেতে রাজি হয়েছে । কিন্তু শিনজো আসতেই জানা গেল ডিসেম্বর মাস, তাই রাস্তায় বরফ জমে গিয়ে শক্ত হয়ে যাওয়ার জন্য তার উপর দিয়ে গাড়ি চালানো সম্ভব নয় । তাই ফালুট যাওয়া রিস্কি হয়ে যেতে পারে । আর বিপদসংকুল পরিবেশে আমাদের না যাওয়াই উচিত । তাই আমরা মনস্থির করলাম যে আমরা সান্দাকফু থেকে ফিরে যাব এবং ফিরে যাওয়ার সময় যদি কোথাও যাওয়া যায় সেটা বিবেচনা করা যেতে পারে ।
গত দিনে সান্দাকফু আসার সময় কালিপোখরির ওখানে কিছু দেশি মুরগি ঘোরাফেরা করছিল । পাহাড়ের স্থানীয় ভাবে চাষ করা দেশি মুরগির স্বাদ নেওয়ার ইচ্ছেটা বেশ পুরানো । তাই সকলের কাছে প্রস্তাবটা দিতে রাজি হয়ে গেল । ফিনজোকে জিজ্ঞেস করলাম যে আমরা কোথাও দেশি মুরগির মাংস খেতে পারি কিনা । সান্দাকফু থেকে ফেরার পথে ফিনজোর এক বোনের বাড়ি আছে যেখানে দেশি মুরগির মাংস খাওয়া যেতে পারে । তাই আমরা ফিনজোকে সেই মতো বললাম যে, দুপুরে আমরা ফেরার পথে কষা মাংস এবং সাথে পাহাড়ের কোন স্পেশাল রান্নার যদি স্বাদ নিতে পারি । জানালো যে সেখানে মুরগির মাংস এবং হাতে তৈরি রুটি পাওয়া যেতে পারে । আমরা সেইমতো কনফার্ম করলাম । মোবাইলে নেটওয়ার্ক নেই । তাই বাইরের জগতের সাথে যোগাযোগ বন্ধ ।
তার মধ্যেই ফিনজো তার মোবাইলে একটু নেটওয়ার্ক পেয়ে দুপুরের কষা মুরগি আর রুটির ব্যাপারটা কনফার্ম করে ফেলেছে । ইচ্ছে নেই তাও ফিরে যেতে হবে । আমরাও ব্যাগ পত্র গুছিয়ে প্রস্তুত হয়ে নিলাম । ব্রেকফাস্ট ফেরার পথেই করব । সেইমতো ওখানে সবকিছু মিটিয়ে দিয়ে ব্যাগপত্র গাড়িতে তুলে নিলাম । ইচ্ছে করছে না, মন চাইছে না, তাও একরকম জোর করেই শরীরটাকে টেনে টেনে গাড়িতে তুললাম । আমাদের সাথে থাকা কয়েকটি দল পায়ে হেঁটে ফালুটের উদ্দেশ্যে রওনা দিল । আমরা পরের বারের জন্য তুলে রাখলাম ফালুট কে । ভারাক্রান্ত মনে বিদায় জানালাম সান্দাকফুকে । ক্যামেরার মেমোরি কার্ড ভরে নিয়েছি কিন্তু চোখে যা দেখলাম তা হয়তো ক্যামেরায় ধরতে পারিনি বা পারার কথাও নয় । বারবার এটাই মনে হতে থাকলো, এই সংক্ষিপ্ত জীবনে যদি সান্দাকফু না আসতাম, তাহলে হয়তো পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর জায়গাটা অদেখাই থেকে যেত । আর সেটা হলে এ জীবন অসম্পূর্ণ । ফিনজোর বাহন চলছে তার নিজের গতিতে । সান্দাকফু থেকে কালিপোখরি পর্যন্ত রাস্তায় নামার সময় ততটাই ভয়ঙ্কর লাগছে । একটা ভয়ের সঞ্চার হয়েছে । আস্তে আস্তে তার বিশ্বস্ত হাতে স্টিয়ারিং ধরে গাড়ি চালাচ্ছে ফিনজো । কিছুটা নেমে এসে আবার ফিনজোর দিদির বাড়িতে ব্রেকফাস্ট । আশেপাশে কিছুটা ঘুরে দেখলাম । গাড়ির সিটে বসে দু'পাশে চোখ । একটি শৈলশিরার উপর দিয়ে আমরা চলেছি । এভাবে চলতে চলতে বেশ কিছুটা সময় পরে আমরা এসে পৌছালাম তার বোনের বাড়িতে । পাহাড়ের উপরে একটি গ্রাম । গ্রাম বলতে দুটি বাড়ি । তারমধ্যে একটি সুন্দর বাড়ির সাথে লাগোয়া একটি মুদিখানার দোকান । আমরা সেখানে যেতেই আমাদের বসতে বললেন । আমরাও আশপাশের প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখে ছবি তুলতে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম । বাড়ির পাশে রান্নাঘর । সেই রান্না ঘরের উপরে ইয়াকের মাংস সরু সরু করে কেটে শুকিয়ে রাখা আছে । প্রথমে ইচ্ছে হয়েছিল ইয়াকের মাংসের স্বাদ গ্রহণ করার, কিন্তু, রান্না ঘরের ধোঁয়াতে সেগুলো কালো হয়ে যাওয়াতে আর খুব একটা ইচ্ছে করলো না । এইটা তুলে রাখলাম ভবিষ্যতের জন্য । ছোট্ট পাহাড়ি বাড়ির মেঝেতে আমাদের জন্য সুন্দর করে আসন পেতে খাওয়ার বন্দোবস্ত করা হলো । অসাধারন সুস্বাদু সেই পাহাড়ি রান্না । হাতে গড়া রুটি সহযোগে আমরা আমাদের দুপুরের মধ্যাহ্নভোজন সারলাম । সাথে ছিল নানান রকমের চাটনি । খাওয়া দাওয়ার পর তাদেরকে বিদায় জানালাম । এবার আমরা মানেভঞ্জন এর পথে । মানেভঞ্জন ফিরে ফিনজো কে বিদায় জানালাম । একটি গাড়ি বুক করে আমরা পাঁচ মূর্তি আবার ফিরব দার্জিলিঙে ।
আমাদের কোন হোটেল বুক করার ছিল না, কিন্তু, তন্ময়-দীপায়ন-আবির এর একটি হোটেল বুক করা ছিল । তারা আমাদেরকে অনুরোধ করল তাদের সাথেই একই হোটেলে রুম নেওয়ার জন্য । সেইমতো আমরা সম্মতি জানালাম । সান্দাকফু চোখে-মুখে-নাকে মেখে একটা অদ্ভুত আবহে চলেছি । এদিকে ফেরার টিকিট নেই । দীপায়ন কে জিজ্ঞেস করতে ও বলল যে তাদের কাছে সর্ব মোট চারটি টিকিট আছে । কিন্তু তারা তিনজন । তার মধ্যে দুটো টিকিট তন্ময় ও দীপায়নের । আরেকটি টিকিট এক বন্ধুর । সে আসতে পারেনি । আর আবীরের যে টিকিট রয়েছে সেটা অন্য এসি কম্পার্টমেন্টে । কিন্তু সেটা কনফার্ম নয় । আমি তাদের জানালাম যে আগামীকাল সকাল বেলা তৎকাল টিকিটের জন্য ট্রাই করবো । তারা বলল যে, আমি যদি টিকিট না পাই তাহলে তাদের সাথে যদি যেতে চাই ত যেতে পারি । কিন্তু কিভাবে ? জেনারেল টিকিট কেটে তারপর এক্সট্রা চার্জ বা ফাইন যা লাগবে সেটা দিয়ে যদি ওদের সাথে যেতে পারি । যদিও সেটা আইনি না বেআইনি জানি না । কিন্তু বিপদে পড়লে বিপদ থেকে উদ্ধার পেতে হবে। যেভাবেই হোক । আমি প্রথমে ঠিক করলাম যে তৎকাল টিকিটে বন্দোবস্ত করা যায় কিনা সেটা আগে দেখব । দার্জিলিং ফিরলাম । ফিরে হোটেলে উঠে ফ্রেশ হয়ে বিশ্রাম নিলাম একটু । সন্ধ্যেবেলা হাঁটতে হাঁটতে গেলাম ম্যালের দিকে । দার্জিলিং এখন অনেক বদলে গেছে । প্রথমবার দার্জিলিং এসেছিলাম ২০০১ সালে । কু-উ-উ-ঊ-ঊ ঝিক-ঝিক রেলগাড়ি, টয় ট্রেন লাইনের পাশে বসে থাকা ভুট্টাওয়ালা, ম্যালে ঘুরে বেড়ানো ঘোড়া, চায়ের কাপ হাতে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা, কিছু জিনিস এক থাকলেও বদলে গিয়েছে অনেক কিছুই । মাঝেও বেশ কয়েকবার দার্জিলিং গিয়েছি । তাই পরিবর্তনটা ধীরে ধীরে চোখে পড়েছে আমার । যাইহোক, কিছুটা আড্ডা দিয়ে আমরা পরের দিনের প্ল্যানিং করতে লাগলাম । যতবার দার্জিলিং এসেছি দার্জিলিং আমাকে খালি হাতে ফেরায়নি কখনও। প্রতিবারই কাঞ্চনজঙ্ঘার দেখা পেয়েছি । আমার প্রিয়তমা আমাকে তার রূপে, তার সৌন্দর্যে মুগ্ধ করেছে বারবার । টাইগার হিল থেকে সানরাইজ দেখতে পেয়েছি প্রত্যেকবার । কিন্তু সান্দাকফু থেকে ফিরে এসে আর টাইগার হিলে সানরাইজ দেখতে যাওয়ার ইচ্ছেটা খুব একটা ছিল না । এবার তিনমূর্তির বক্তব্য তাদের বাড়ি থেকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে যে দার্জিলিং যাচ্ছ, টাইগার হিল থেকে অবশ্যই ঘুরে আসবে । আবার তারা ভোর রাতে উঠে যেতেও নারাজ । আমি তাদেরকে বললাম তাহলে আমরা দিনের বেলায় যাব, কারণ এর আগে যতবার গিয়েছি সূর্যোদয়ের সৌন্দর্য দেখেছি, কিন্তু দিনেরবেলা সেখানকার দৃশ্য কিরকম সেটা কখনো দেখিনি । তার থেকেও আগে আমাকে আগামীকাল সকালে টিকিটের বন্দোবস্ত করতে হবে । গত রাত্রে ঘুম হয়নি, তাই আজকে বেশ জমিয়ে ঘুমোবো এটাই প্ল্যান । সত্যিই দারুন ঘুম হলো । ফ্রেশ হয়ে নিয়ে হোটেলের বাইরে বেরোলাম চায়ের জন্য । তারপর সেখান থেকে দার্জিলিং স্টেশন । কিন্তু স্টেশনে গিয়ে বুঝতে পারলাম যে আমার তৎকাল টিকিট পাওয়া একরকম অসম্ভব । মোবাইল থেকেও টিকিট পাওয়ার কোনো রকম কোনো সম্ভাবনা দেখলাম না । একটু হতাশ হলাম, কিন্তু ভেঙে পড়ার কোনো কারণ নেই । কিছু না কিছু একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে । তাই বাকি সাথীদের ফোন করে ডেকে নিলাম । বললাম, চলো একটু নস্টালজিক হয়ে পড়ি । লাইন দিলাম প্রায় সোয়া ঘণ্টা ব্রেকফাস্টের জন্য । সত্যজিৎ রায়ের স্মৃতি বিজড়িত কেভেন্টারস এ । পরক স্যান্ডউইচ, খাঁটি দার্জিলিং চা - সময়টা অদ্ভুত কাটলো । মনে হচ্ছিল উল্টোদিকের ঘড়িটা যদি ঘুরিয়ে আরো একদিন পিছিয়ে দিতে পারতাম । কেভেন্টারস থেকে ফিরে একটি গাড়ি বুক করে আমরা গেলাম টাইগার হিল । দুপুরের টাইগার হিল । সেখান থেকে সিকিমের বিভিন্ন শহর গুলোকে দেখা যায় । খালি চোখে একটু সমস্যা হয়, তবে ক্যামেরার লেন্স দিয়ে দেখলে বা বাইরে থাকলে খুব সুন্দর ভাবে বোঝা যায় । অবশ্যই আবহাওয়ার উপর নির্ভর করে ।
Name: Chandan Garai
Profession- Govt. Service
City- Ranibandh, Bankura / Kolkata
Hobbies- Photography, Travelling, Writting
Previous Tours- Kerala & Kanyakumari, Sandakphu, Sikkim, Spiti Valley, Sundarban, Dooars, Darjeeling, Kalimpong, Gopalpur – Chilika, Jungalmahal of Bankura, Purulia & Paschim Medinipur District etc.