Tripsee Treks  and Tours LLP
Blog and Travel with Us

জার্ এর দেশে



Abhik Biswas Abhik Biswas

কথায় আছে বাঙালির পায়ে খুর লাগানো আছে তাই তারা এক জায়গায় স্থির থাকতে পারেনা, ঘুরে বেড়াতে তাদের হবেই। তো সেই বাঙালি গোত্রীয় হয়ে আমিও বা থেমে থাকি কিকরে বলুন। গত বছর অব্দি আমি দুবাই এ কর্মরত ছিলাম; ঈদ এ মধ্যপ্রাচ্য বেশ অনেকদিনের ছুটি থাকে আমাদের দূর্গা পূজার মতন। তাই ঈদ এর ২-৩ মাস আগে থেকেই এই ভাবনায় ছিলাম যে এই ছুটি তা কিছু করে হোক ব্যবহার করতেই হবে। যেমন ভাবা তেমন কাজ। দেখতে আরম্ভ করলাম কোথায় যাওয়া যেতে পারে। শুধু ইচ্ছে থাকলেই তো হয় না, পকেটের জোরও থাকতে হবে। তাই দেখতে দেখতে হঠাৎ একদিন দেখি এমিরেটস এ মস্কো আপ এন্ড ডাউন এর টিকেট তা কম্পেরাটিভলি বেশ কম দেখাচ্ছে অন্য ডেস্টিনেশন এর থেকে। ঠিক করে ফেললাম (উইথ বর-বৌ ডিসকাশন অবশ্যই) যে রাশিয়া এ যাবো। মস্কো আর সেন্ট পিটার্সবার্গ। এই আমাদের রাশিয়া যাত্রার প্রস্তাবনা।

আমরা প্ল্যান করেছিলাম ৭ দিন এর টুর। ৪ দিন মস্কো ও ৩ দিন সেন্ট পিটার্সবার্গ।

৯/৮/২০১৯ এ আমরা এমিরেটস বিমান সহযোগে মস্কো র উদ্দেশে রওয়ানা দিলাম। আমি, আমার স্ত্রী এবং আমাদের ৮ মাসের আয়ুষ।

মস্কো তে ২ টি এয়ারপোর্ট আছে। একটি হলো

​১: শেরেমেতিয়েভো ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট

​আর অন্যটি

২: ডোমোদেদোভো ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট

আমাদের গন্তব্য ছিল দ্বিতীয় টি। এখানে বলে রাখি মস্কোর দুটি এয়ারপোর্টই শহর থেকে বাইরে এবং দুটি দু দিকে। সিটি সেন্টার থেকে ২টি এয়ারপোর্ট এর ই দূরত্ব মোটামুটি ৪০ থেকে ৪৫ কিলোমিটার। দুটি এয়ারপোর্ট থেকেই শহরে যাওয়ার অনেক রকম ট্রান্সপোর্ট আছে কিন্তু যেহেতু আমরা ডোমোদেদোভো দিয়ে গিয়েছিলাম তাই আমি সেই রুটটাই বলছি, অন্য এয়ারপোর্ট টি থেকেও বিভিন্ন উপায়ে শহরের ভিতরে আসা যায়, সেটা আমি আমার লেখার শেষে মেনশন করে দেব।

এয়ারপোর্ট এ নেমে প্রথম যে জিনিসটি করবেন সেটি হলো একটি সিমকার্ড তুলে নেবেন বেশি ডাটা প্যাক ওলা (কাউন্টার এয়ারপোর্ট এই পাবেন)। এই সিমকার্ড এ আপনাকে পুরো রাশিয়া টুর বাঁচাবে।

ডোমোদেদোভো এয়ারপোর্ট থেকে ভালো এবং বেশ কম খরচায় যে উপায় এ মস্কো সিটি আসা যায় সেটি হলো AeroExpress ট্রেন সার্ভিস। এয়ারপোর্ট এর লাগোয়া এ স্টেশন আছে যেখানে আপনারা খুব সহজেই টিকেট কিনতে পারবেন।

এই ট্রেন সহযোগে যাওয়ার কিছু অসুবিধা আছে যেটা আমার ক্ষেত্রে হয়েছিল তাই আমি এটাকে এভোইড করেছিলাম।

​১: এই ট্রেন টি এয়ারপোর্ট থেকে মস্কো পাভেলেটস্কি নামক একটি স্টেশন এ আসে যেখান থেকে আবার আমাকে ট্যাক্সি বা মেট্রো করতে হতো আমার হোটেল সংলগ্ন জায়গায় যাওয়ার জন্য যেটা অনেকটা ব্রেক জার্নি হয়ে যেত আমার জন্য, আর আমার বাচ্ছা দীর্ঘ ৬ ঘন্টা ফ্লাইট এর পর আর স্থির থাকছিল না এবং ওর ঘুম ও পেয়েছিলো। তাই আমরা গাড়িতে যাওয়ায় স্থির করলাম।

​২: এই ট্রেন টি লোকাল ট্রেন এর মতো, তাই পাভেলেটস্কি স্টেশন এ আসার জন্য অনেক সময় নেয় যেটা অতক্ষণ ট্রাভেল এর পর আর পোষায়নি।

আমরা একজন এয়ারপোর্ট কর্মচারীর কাছ থেকে বাকি ২ টি উপায় সম্মন্ধে জানতে পারি।

১: প্রিপেড ট্যাক্সি র ২: উবের।

সেই লোকটি আমাকে এটাও বলে দিলো যে উবের এ প্রিপেড ট্যাক্সির তুলনায় প্রায় অর্ধেক খরচ হবে তাই যদি প্রিপেড ট্যাক্সি নিতেই হয় তাহলে দর-দাম করে নিতে।

যথারীতি আমি প্রিপেড ট্যাক্সি বুকিং এ গিয়ে বেশ খানিক বেগ পেলাম। প্রথমত কেউ ইংলিশ বলে না, উপরোন্ত বোঝেও না। এটুকু বুঝলাম আমার যেহেতু বাচ্ছা আছে আর এতো গুলো লাগেজ আছে তাই একটি বড় গাড়ি ভাড়া করতে হবে এবং আমার হোটেল অব্দি ভাড়া পড়বে ২৫০০ রুবেল। (মোটামুটি এক এ অংকের ইন্ডিয়ান টাকা)। এতটা বেশি ভাড়ার জন্য প্রস্তুত ছিলাম না। এয়ারপোর্ট থেকে হোটেল মোটামুটি ৫০ কিলোমিটার কিন্তু সেই তুলনায় ভাড়াটা বেশ বেশি। অগত্যা গেলাম দ্বিতীয় অপসন এ 'উবের'। এখানেও একটি নতুন জিনিস জানলাম যে নরমাল উবের রাশিয়া তে চলে না, আমাকে ডাউনলোড করতে হলো উবের-রাশিয়া app (Yandex.Taxi Ride-Hailing Service. Book a car:-Available in Google play store and in iOS also).

বুক করলাম উবের। উবের এসে আমাকে ফোন করছে, আমি বলছি ইংলিশ এ, সে বলে রাশিয়ান এ।সে আমাকে যেখানে আসতে বলে আমি সেখানে এসে তাকে খুঁজে পাই না। অনেক্ষন পর ক্যানসেল করি বুকিং। আবার একটা বুকিং করি। সে ক্ষেত্রেও এক এ ব্যাপার। এবার বিরক্তি লাগতে থাকে কারণ এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে চলে এসেছিলাম। আর অগাস্ট মাসেও ১৩ ডিগ্ৰী টেম্পারেচার আর পরনে সামান্য একটি গেঞ্জি। মেইন চিন্তা টা বাচ্ছা তাকে নিয়েই,যে ওর না ঠান্ডা লেগে যায়। মাঝে মধ্যে মনে হচ্ছিলো ট্রেন এ করে চলে গেলেই হয়তো হতো।প্রায় ১/২ ঘন্টা অভাবে দাঁড়িয়ে থাকার পর বাইরে এক সাধারণ ট্যাক্সি ওলা আমাদের অবস্থা বুঝতে পারে যে আমরা কোনো গাড়ি পাচ্ছি না। সে জিজ্ঞেস করে আমার হোটেল এর নাম এবং বলে ২০০০ রুবেল নেবে সেখানে ছাড়ার জন্য।

উবের এর দরুন আমি তখন ভাড়াটা জেনে গেছি যে কত হতে পারে। উবের এ দেখছিলো ১২০০ তাই আমি সেটা বলেই দর-দাম শুরু করলাম। শেষে ১৫০০ এই এসে রাজি হলো লোকটা এবং আমরা হোটেল এর দিকে রওয়ানা দিলাম।

মস্কো ১ম দিন: দিনটা শুরু হলো একটু আলসেমিতে যেহেতু শেষ রাতের ওই লড়াই এর পর সবাই বেজায় ক্লান্ত ছিলাম। আর যেহেতু সঙ্গে ৮ মাস এর বাচ্ছা আছে তাই আমরা একটুও হুড়োহুড়ি করিনি ঘোরার জন্য। লক্ষ ছিল ছুটি কাটানো আর টুকটাক মেইন জায়গা গুলো যতটা পারা যায় দেখে নেওয়া। তাই প্রথমে হোটেল এর ব্রেকফাস্ট সেরে এসে বেশ সময় নিয়েই সবাই রেডি হলাম। প্রসঙ্গত ব্রেকফাস্ট টি হোটেল এ দারুন দিয়েছিলো। ব্রেড, জ্যাম, মাখন, গোটা ফল, বিভিন্ন রকম চা, কফি, অরেঞ্জ বা আপেল জুস এসব তো ছিলই; সাথে ছিল হ্যাম, বেকন, ওমলেট, সসেজ আর সাথে লাইভ কাউন্টার এ ডিমের পোচ। আর ডেজার্ট এ ৩-৪ রকমের কেক র মিষ্টি। মানে এতো ভারিটিজ রকমের খাবার দেখে কাল রাতের সব দুঃখ ভুলে গেলাম আর শুরু হয়ে গেলো মস্কো পর্ব।

আমাদের হোটেল টি ছিল ইজমাইলভ নামক জায়গায়। হোটেল এর নাম ইজমাইলভ বিটা হোটেল। আমাদের ৪ রাতের খরচ পড়েছিল ১৫৫০০ রুবেল (ব্রেকফাস্ট নিয়ে)। হোটেল টির রুম যে খুব উৎকৃষ্ট মানের তা নয় কিন্তু ইকোনমিক ট্রাভেলার এর জন্য ভালো অপসন ।

ব্রেকফাস্ট করে আসার পর ছেলে তখনও ঘুমানোর জন্য আমি বেরোলাম জায়গাটা একটু জানা বোঝার জন্য আর ট্রান্সপোর্ট অপসন জানার জন্য। দুবাই থেকেই মস্কো মেট্রো নিয়ে একটু পড়াশোনা করে এসেছিলাম এবং জানতাম এখানকার মেট্রো ব্যবহার করে খুব সহজেই সিটি তে ট্রাভেল করা যায়। চললাম কাছাকাছি সেই মেট্রো স্টেশন এর খোঁজে।

হোটেল থেকে বেরোতেই কিছুটা এগোতেই একটি বাস স্টেশন পেলাম, নাম পার্টিজানস্কায়া এবং তার থেকে ঢিল ছোড়া দূরত্বে পার্টিজানস্কায়া মেট্রো স্টেশন। মস্কো তে মেট্রো স্টেশন গুলো ২য় বিশ্বযুদ্ধের সময় বাঙ্কার হিসেবে বানানো হয়েছিল এবং পরে সেগুলিকে মেট্রো স্টেশন এ পরিবর্তন করা হয়, তাই মেট্রো স্টেশন গুলোর অ্যাভারেজ গভীরতা প্রায় ৮০-১০০ মিটার। মস্কোর মেট্রো স্টেশন হলো সত্যিই একটি দেখার জায়গা। প্রত্যেকটি স্টেশন এ হিস্টরিকাল ইভেন্টস মেমোরেবলে করে রাখা আছে। আমি একটা মেট্রো পাস বানিয়ে চললাম মেট্রো সফর করতে। কিছু কেনাকাটার ছিল তাই কয়েকজন কে জিজ্ঞেস করে নামলাম ইলেক্ট্রোজাভোডস্কায়া স্টেশন এ। বাইরে ঝিরঝির বৃষ্টি পড়ছিলো তার মধ্যেই একটু ঘুরে দেখলাম জায়গাটা। প্রচন্ড রকম এর সবুজ দেখে মন ভোরে গেলো। যে কারণে দুবাই থেকে বেরিয়ে পড়া সেই সবুজ অনেকদিন বাদে দেখলাম। টুকটাক কেনাকাটি করে চলে এলাম হোটেল ফিরে।

পার্টিজানস্কায়া মেট্রো ও বাস স্টেশন (ভিতরে)

ইলেক্ট্রোজাভস্কায়া মেট্রো স্টেশন

​সবাই রেডি হয়ে বেরোলাম মোটামুটি ১-১:৩০ বাজে তখন। গন্তব্য ফেমাস 'রেড স্কোয়ার'। চলে এলাম পার্টিজানস্কায়া মেট্রো স্টেশন এ এবং মেট্রো ধরলাম রেড স্কোয়ার এর দিকের। রেড স্কোয়ার এর মেট্রো স্টেশন টির নাম 'প্লোশ্চাদ রেভোল্যুটেসিই'। নাম তা শুনতে যতটা খটোমটো কিন্তু স্টেশন টি অত্যন্ত মনোরম। চারিদিকে ২য় বিশেষ যুদ্ধের সৈনিক দের মূর্তি। দাঁড়িয়ে কয়েকটি ছুবি তুলে নিলাম খচখচ করে। এবার এগিয়ে চলা রেড স্কোয়ার এর দিকে। মেট্রো স্টেশন এর বাইরে এসে মোটামুটি ভিড় অনুসরণ করে চললেই আপনি চলে আসবেন রেড স্কোয়ার এর কাছে। প্রথমেই যে মনুমেন্ট টা আপনার চোখে পরবে সেটি হলো 'স্টেট হিস্ট্রি মিউজিয়াম'। মিউজিয়াম কে সামনে রেখে বাঁদিকে একটি রাস্তা চলে যায় যেটায় একটি গেট ক্রস করলেই আপনি চলে আসবেন যাকে বলে রেড স্কোয়ার এর মূল আকর্ষণীয় জায়গায়। ডানদিকে আছে বিখ্যাত 'ক্রেমলিন', সামনে 'সেন্ট বাসিল'স ক্যাথেড্রাল' আর বাঁদিকে 'গাম হাইপারমার্কেট' ও ‘কাজান ক্যাথেড্রাল’। চলতে থাকলাম এই রাস্তা ধরে সোজা সেন্ট বাসিল'স ক্যাথেড্রাল এর দিকে।

ক্রেমলিন ওয়াল

 

সেন্ট বাসিল'স ক্যাথিড্রাল মস্কো শহরে অবস্থিত একটি গীর্জ্জা। এটি একটি রুশ অর্থোডোক্স গীর্জা যার পূর্ণ নাম ক্যাথিড্রাল অফ ইন্টেরসেশন অফ থিটোকোস অন দ্য মৌট। ১৫৫৫-১৫৬১ খ্রিষ্টাব্দে মস্কোর রেড স্কোয়ার চত্বরে নির্মিত এই সুউচ্চ স্থাপনাটির স্থাপত্যশৈলী ও অঙ্গসজ্জা নয়নাভিরাম। এর মিনার ও গম্বুজ সমূহ বহুবর্ণিল। কাজান এবং আস্ত্রাখানের বন্দী করাকে স্মরণীয় করে রাখার উদ্দেধ্যে রাশিয়ার জার ইভান IVএর ফরমানে এটি নির্মাণ করা হয়েছিল। এইটি শহরের কেন্দ্রীয় জ্যামিতিক হিসেবে চিহ্নিত করে এবং ১৪শ শতক থেকেই এটি বৃদ্ধির কেন্দ্র। ১৬০০ খ্রিষ্টাব্দে 'ইভান'স বেল টাওয়ার' নির্মাণ সমাপ্ত হওয়া পর্যন্ত এটি ছিল মস্কো শহরের উচ্চতম স্থাপনা।

সেন্ট বাসিল'স ক্যাথিড্রাল

মন ভোরে দেখতে থাকলাম এতদিন ছবিতে দেখা মনুমেন্ট টিকে। এতো সুন্দর রঙিন গম্বুজ যা কল্পনাতীত। ৩ তে বেজে যাওয়ার জন্য ক্যাথেড্রাল বন্ধ হয়ে যায় ও সকলকে চলে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করা হয়।তাই ক্যাথেড্রাল চত্বর ছেড়ে আবার আমরা পাশের রাস্তায় নেমে আসি। এই রাস্তাটির চারিধারে স্বল্পস্থায়ী দোকান এর পসার। তাতে সুন্দর সুন্দর মেমেন্টো বিক্রি হচ্ছে। সঙ্গে আছে বেশ কিছু কাফে ও খাবার জায়গা। ক্যাথেড্রাল থেকে বেরিয়ে সিকিউরিটি দের কাছ থেকে জানতে পারি সমস্ত হিস্টরিকাল মনুমেন্ট ই ৩ টের সময় বন্ধ হয়ে যায় তাই আর অন্য কোথাও যাওয়া হলো না সেদিন। প্ল্যান করলাম পরদিন সকাল সকাল এসে ক্রেমলিন ঢুকতে হবে।

এবার চলে এলাম পাশের গাম হাইপারমার্কেট এ। সুবিস্তৃত শপিং মল। এতক্ষন ঘুরে যে দুটো বস্তুর দরকার পড়েছিল তা হলো খাওয়া আর টয়লেট যাওয়া। গাম হাইপারমার্কেট শপিং মল হলেও টয়লেট টি পে এন্ড ইউস। আমার এবং আমার স্ত্রীর পারহেড ৫০ রুবেল করে লাগলো। যাই হোক যস্মিন দেশে যদাচার। এবার দরকার খাওয়া। পেয়ে গেলাম একটি বার্গার এর দোকান। গাম বার্গার। সুস্বাদু নরম বীফ বার্গার আর সাথে লোকাল বিয়ার। উফফ কিযে স্বস্তি লাগছিলো বলে বোঝানো যাবে না। দুজনে পেট এবং মন ভোরে খাওয়া দাওয়া শেষ করে যখন বেরোলাম তখন প্রায় ৭ টা বেজে গেছে।

মস্কোভা নদী

স্তালিনীক মনুমেন্ট

 

গাম মার্কেট থেকে বেরিয়ে মেইন রাস্তা পেরিয়ে পেয়ে গেলাম মস্কোভা নদী। সবাই হেটে চলতে লাগলাম নদীর ধার ধরে। মনোরম হাওয়া দিছিলো আর সাথে মনোরম নদীর দৃশ্য। হাটতে হাটতে প্রায় ২-৩ কিলোমিটার ওভাবেই চলে এলাম। সামনে দেখলাম একটি স্তালিনীক মনুমেন্ট দেখা যাচ্ছে। তখন প্রায় ৯ টা বেজে গেছে। এবার হলো সমস্যা। আমরা রেড স্কোয়ার থেকে এতটা দুরে চলে এসেছি যে মেট্রো স্টেশন টিতে যেতে অনেকটা হাটতে হবে । আর সঙ্গে বাচ্ছা থাকায় পারাম্বুলেটর নিয়ে অতটা হাটা আর পোষাচ্ছিলো না। শরণাপন্ন হলাম উবের এর। এবার র কোনো সমস্যা হয়নি।একদম পায়ের সামনে উবের টি এলো এবং ১৫-২০ মিনিটের মাথায় আমরা হোটেল পৌঁছলাম। রাস্তায় ড্রাইভার ছেলেটির সাথে একটু আধটু কথা বার্তা হলো। সে মস্কো তে আছে প্রায় ১০ বছর। ট্যাক্সিই চালায়। বাড়ি কাজাকস্থান এ। মস্কো তে আছে পেটের দায়ে কারণ নিজের দেশে কাজ নেই। বুঝলাম এই সুন্দর মনোরম শহর গুলোর মধ্যেও কোথাও না কোথাও এরকম অনেক গল্প লুকিয়ে আছে। যাক ঘরে ফিরে রাতের খাওয়া সেরে এবং বাচ্ছাকে খাইয়ে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়লাম। লক্ষ কাল যতটা সম্ভব তাড়াতাড়ি গিয়ে ক্রেমলিন এ ঢোকা। তাই ১ম দিনের শুভরাত্রি হলো।

মস্কো ২য় দিন: আজ সকালে তাড়াতাড়ি উঠে রেডি হয়ে ব্রেকফাস্ট খেয়ে বেরিয়ে পড়লাম ক্রেমলিন দর্শন এ। ক্রেমলিন এ ঢোকার টিকেট গেট এর সামনের মেট্রো স্টেশন টি হলো 'বিব্লিওটিক ঈমানী লেনিন'। কিন্তু আজ তাড়াতড়ির জন্য ডাইরেক্ট উবের বুক করলাম এবং পৌঁছে গেলাম ক্রেমলিন এর টিকেট কাউন্টার এ। ২টি জায়গা থেকে আপনারা টিকেট নিতে পারেন ভিতরে যাওয়ার জন্য ১: 'স্টেট ক্রেমলিন প্যালেস টিকিটস অফিস' এটি মেইন রাস্তার ধারে আর ২: 'ক্যাস্সি মস্কোভিষকগো ক্রেমলিয়া' এটি এন্ট্রি গেট এর পাশে নিচে নেমে। আমি ২য় টিতে গেলাম। বিভিন্ন অংকের অনেক রকম প্যাকেজ এর টিকেট রয়েছে। চাইলে আপনারা ওখানে গাইড ও বুক করতে পারেন বা অডিও গাইড ও ভাড়া নিতে পারেন। সবটাই বিভিন্ন টিকেট এর প্যাকেজ এ আছে। আমি সাধারণ ২টি টিকেট নিয়ে এলাম যাতে ভিতরের মেইন মনুমেন্ট গুলোতে এবং আরমেরি চেম্বার এ ঢোকা যাবে।

ক্রেমলিন এ ঢোকার আগে জায়গাটি সম্মন্ধে একটু বলে নেওয়া যাক। মস্কো ক্রেমলিন মস্কোর কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত একটি শক্তিশালী কমপ্লেক্স যার দক্ষিণে মস্কোভা নদী, পূর্বে সেন্ট বাসিল'স ক্যাথেড্রাল এবং রেড স্কোয়ার এবং পশ্চিমে আলেকজান্ডার গার্ডেন অবস্থিত। এটি রাশিয়ান ক্রেমলিনগুলির (রাশিয়ান উপাসনালয়) মধ্যে সর্বাধিক পরিচিত।এর মধ্যে পাঁচটি প্রাসাদ, চারটি ক্যাথেড্রাল এবং ক্রেমলিন টাওয়ারগুলির সাথে ঘেরযুক্ত ক্রিমলিন প্রাচীর অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। এছাড়াও, এই কমপ্লেক্সের মধ্যে 'গ্র্যান্ড ক্রেমলিন প্রাসাদ' আছে যা আগে 'জার' দের বাসস্থান ছিল। কমপ্লেক্সটি এখন রাশিয়ান ফেডারেশনের রাষ্ট্রপতির সরকারি বাসভবন এবং ২০১৭ সালে ২,৭৪৬,৪০৫ দর্শনার্থী সহ মিউজিয়াম হিসাবে কাজ করে।

ক্রেমলিন এর ভিতরে দেখার জন্য প্রধান জায়গা গুলি হলো : 'সেনেট', 'জার্ বেল', 'জার্ ক্যানন', 'অর্চ্যাংগেল ক্যাথেড্রাল', 'অ্যানানসিয়েসন ক্যাথেড্রাল', 'অস্সুম্পশন ক্যাথেড্রাল', 'গ্রান্ড ক্রেমলিন প্রাসাদ', 'আরমারী' ও 'ইভান'স বেল টাওয়ার'। বিখ্যাত এছাড়াও কিছু টাওয়ার আছে ক্রেমলিন ওয়াল এ সেগুলিও দেখার বস্তু যেমন 'কুতাফায়া টাওয়ার', 'ট্রিনিটি টাওয়ার', 'স্পশকায়া (সেভিয়ার) টাওয়ার', 'বোরোভিতস্কায়া টাওয়ার' ইত্যাদি।

 

 

ক্রেমলিন এর ভিতরে প্রধান মনুমেন্ট গুলি

 

অর্চ্যাংগেল ক্যাথেড্রাল (ভিতরে)

 

মনুমেন্ট গুলি সম্পর্কে কিছু কথা

​অস্সুম্পশন ক্যাথেড্রাল: এই ক্যাথেড্রালটিকে মস্কোভিৎ রাশিয়ার মাতৃ গীর্জা হিসাবে বিবেচনা করা হয়। এটির বর্তমান আকারে এটি ইতালীয় স্থপতি অ্যারিস্টোটেল ফিয়োরাবন্তীর দ্বারা মস্কো গ্র্যান্ড ডিউক ইভান III এর নির্দেশে ১৪৭৫-৭৯ এর মধ্যে নির্মিত হয়েছিল। ১৫৪৭ থেকে ১৮৯৬ সাল পর্যন্ত এখানেই রাশিয়ান রাজতন্ত্রের রাজ্যাভিষেক অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এছাড়াও, এটি রাশিয়ান অর্থোডক্স চার্চের বেশিরভাগ মস্কো মেট্রোপলিটন এবং পৃষ্ঠপোষকদের সমাধিস্থল এবং এটি মস্কো ক্রেমলিন যাদুঘরের অংশ হিসাবেও কাজ করে।

অ্যানানসিয়েসন ক্যাথেড্রাল: এটি ক্রেমলিন এর ক্যাথেড্রাল স্কয়ারের দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত, যেখানে এটি গ্র্যান্ড ক্রেমলিন প্রাসাদটির কমপ্লেক্সের মূল ভবনের সাথে সরাসরি সংযুক্ত। এটি মূলত মস্কোভিৎ জার্ এর ব্যক্তিগত চ্যাপেল ছিল, এবং এর মঠাধ্যক্ষ ২০ শতকের গোড়ার দিক পর্যন্ত রাশিয়ান রাজপরিবারের ব্যক্তিগত কনফেসর হিসাবে রয়ে গেছে। এখন এটি মস্কো ক্রেমলিন যাদুঘরের অংশ হিসাবেও কাজ করে।

অর্চ্যাংগেল ক্যাথেড্রাল: রাজধানী সেন্ট পিটার্সবার্গে স্থানান্তরিত হওয়া অবধি এটি ছিল রাশিয়ার প্রধান সমাধিক্ষেত্র। রাজপরিবার থেকে শুরু করে শহরের প্রধান নোবল দের এখানে কবর দেওয়া হয়েছে।এটি ১৩৩৫ এবং ১৫০৮ এর মধ্যে একটি ইতালীয় স্থপতি অ্যালোসিয়ো দ্য নিউর তত্ত্বাবধানে ১৩৩৩ সালে নির্মিত একটি পুরাতন ক্যাথেড্রালটির স্থানে নির্মিত হয়েছিল।এখন এটি মস্কো ক্রেমলিন যাদুঘরের অংশ হিসাবেও কাজ করে।

ইভান'স বেল টাওয়ার: ইভান দ্য গ্রেট বেল টাওয়ার মস্কো ক্রেমলিন কমপ্লেক্সের অভ্যন্তরে একটি গির্জা টাওয়ার। মোট উচ্চতা ৮১ মিটার (২৬৬ ফুট) এর সাথে এটি ক্রিমলিনের দীর্ঘতম টাওয়ার এবং কাঠামো। এটি ১৫০৮ সালে তিনটি রাশিয়ান অর্থোডক্স ক্যাথেড্রাল, যেমন অ্যাসম্পশন (টাওয়ারের নিকটতম), আর্চেঞ্জেল এবং অ্যানোনিশনের জন্য নির্মিত হয়েছিল, যাদের নিজস্ব বেলফ্রি নেই। এটি মস্কো ক্রেমলিন যাদুঘরের অংশ হিসাবে কাজ করে।

মোটামুটি বেশ কিছু জায়গা দেখে যখন বেরোলাম তখন প্রায় ৩ টেই বেজে গেছে। ক্রেমলিন এর সব জায়গা দেখা হলো না। আপনারা যদি সমস্ত দর্শনীয় স্থান গুলো দেখতে চান তাহলে সকাল ৭-৮ তার মধ্যে পৌঁছে যাওয়ার চেষ্টা করুন নয়তো দুদিন লেগে যাবে পুরো দেখে উঠতে।

​ক্রেমলিন থেকে বেরিয়ে ডান দিকে ঘুরে হাটতে লাগলাম ক্রেমলিন ওয়াল এর পাশের রাস্তা ধরে। আপনারা অনেক সিনেমায় হয়তো এই বিশেষ জায়গাটিকে দেখতে দেখবেন। বেশ রোমাঞ্চকর লাগছিলো মিশন ইম্পসিবল ৪ সিনেমার কথা ভেবে যে এই ক্রেমলিন ই নাকি ধ্বংস দেখানো হয়েছিল আর এই রাস্তা দিয়েই দৌড়ে পালাচ্ছিল টম ক্রূজ।

​পাশে বয়ে চলেছে মস্কোভা নদী ও দুরে দেখলাম 'ক্রাইস্ট দি সেভিয়ার ক্যাথেড্রাল'। এই ক্যাথেড্রাল টি বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থোডক্স খ্রিস্টান ক্যাথেড্রাল।এখনকার ক্যাথেড্রাল টি হলো আসল ক্যাথেড্রাল এর দ্বিতীয় সংস্করণ। উনিশ শতকের সময়ে নির্মিত মূল গির্জাটি নির্মাণে 40 বছরেরও বেশি সময় লেগেছিল।এটি সোভিয়েত নেতা জোসেফ স্টালিনের আদেশে ১৯৩১ সালে ধ্বংস করা হয়েছিল। এই ধ্বংসযজ্ঞটি সোভিয়েতদের একটি বিশাল প্রাসাদকে বানানোর জন্য করা হয়েছিল ১৯৩৭ সালে যার নির্মাণকাজ শুরু হয়েছিল, তবে ১৯৪১ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মানি সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রমণ করলে সেই নির্মাণ থামানো হয়। এর স্টিলের ফ্রেমটি পরের বছর বিচ্ছিন্ন করা হয়েছিল এবং প্রাসাদটি কখনও নির্মিত হয়নি। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পরে বর্তমান গীর্জাটি ১৯৯৫ এবং ২০০০ সালের মধ্যে সেই এক ই জায়গায় পুনর্নির্মাণ করা হয়েছিল।

 

গোর্কি পার্কে

 

বেশ কিছুটা আসার পর ক্যাথেড্রাল এর ছবিতে যে ব্রিজ টা দেখা যাচ্ছে সেখান থেকে একটি উবের করলাম আমাদের পরবর্তী গন্তব্য 'গোর্কি পার্ক'। গোর্কি পার্ক এর এন্ট্রি গেট এর নিকটতম মেট্রো স্টেশন টি হলো 'উক্তর'স্কায়া'। যদিও এটা মেইন গেট থেকে ২-৩ মিনিটের হাঁটা পথ। এছাড়া বাস ও আছে এখানে আসার জন্য।

গোর্কি পার্ক হলো ৩০০ একর এর এক সুবিস্তৃত সেন্ট্রাল পার্ক। এটি মস্কোভা নদীর একদম ধার ঘেসে অবস্থিত এবং গোর্কি পার্ক এর মধ্যে বিখ্যাত অংশটি হলো নেসকুচনি গার্ডেন যেটি আগে এম্পেরর এর সময় কাটানোর জায়গা ছিল। মস্কোভা নদীর ধার দিয়ে পার্ক এর রাস্তা দিয়ে হেটে যেতে ভীষণ ভালো লাগবে এবং এই পার্ক এ ঢোকার কোনো মূল্য নেই তাই অনেক লোকাল যুবক যুবতী বৃদ্ধ বৃদ্ধার ভিড় হয় এই পার্ক এ সন্ধের দিকে। কয়েকটি জায়গায় তারা একসাথে জড়ো হয়ে একে অপরের সাথে মজার নৃত্যে মজে থাকে। সে দৃশ্য না দেখলে কল্পনাতীত। কত প্রানোচ্ছল সেই নাচ যা আপনার সারা দিনের দুঃখ্য ভুলিয়ে দেবে।

পার্ক টির মধ্যে বেশ কিছু স্থায়ী এবং কিছু অস্থায়ী দোকান রয়েছে। দেখলাম বেশ কয়েকটি লোকাল মহিলাকে নিজের ছোট বাচ্ছা কে সঙ্গে নিয়ে ছোট ভুট্টার দোকান করেছে। ২টি ভুট্টা নিলাম তার থেকে, দাম ১০ রুবেল প্রতি ভুট্টা। যতটা না খিদে পেয়েছিলো কিন্তু তার থেকেও বেশি মহিলাটিকে সাহায্য করার মনোভাব এলো। মনে হলো কি ভারত কি রাশিয়া, মায়েরা সকল জায়গাতেই সমান। সন্তানের জন্য তারাও নেমে পরে জীবনযুদ্ধে। ভুট্টা খেতে খেতে ঘুরতে লাগলাম বাগানটিতে। বেশ মনোরম জায়গা সঙ্গে ঠান্ডাও পড়ছিলো আস্তে আস্তে। বেশ কিছুটা আসতে দেখলাম কিছু অস্থায়ী দোকান বসেছে যারা বার্গার, সসেজ বিক্রি করছে। সেখানে ১টি বার্গার ও একটি (পর্ক) সসেজ খেয়ে বেরিয়ে গেলাম পার্ক থেকে। বেশ অনেকটাই রাত হয়ে গেছিলো প্রায় ৮:৩০ বাজে তখন। ঝট করে একটি ট্যাক্সি নিয়ে ফিরে চললাম হোটেল এর দিকে।

মস্কো ৩য় দিন: আজকের গন্তব্য বিখ্যাত 'বোলশোই থিয়েটার'। বোলশোই ব্যালে এবং বোলশোই অপেরা বিশ্বের প্রাচীনতম এবং খ্যাতিমান ব্যালে এবং অপেরা সংস্থাগুলির মধ্যে রয়েছে। এটি এখন পর্যন্ত বিশ্বের বৃহত্তম ব্যালে সংস্থা যাতে 200 এরও বেশি নৃত্যশিল্পী আছে।থিয়েটারটি 'দ্য বোলশোই ব্যালে একাডেমির' মূল সংস্থা। সংস্থাটি 28 মার্চ ১৭৭৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, যখন এম্পেরর ক্যাথরিন II প্রিন্স পিটার আউউসসফকে নাট্য সম্পাদনা, বল এবং অন্যান্য ধরণের বিনোদনের জন্য লাইসেন্স প্রদান করেছিলেন।প্রথমদিকে, এটি একটি ব্যক্তিগত বাড়িতে অভিনয় ছিল, তারপরে এটি পেট্রোভকা থিয়েটার কে অর্জন করে এবং ১৭৮০ সালের ৩০ শে ডিসেম্বর এবং এটি নাটক ও অপেরা প্রযোজনা শুরু করে, পরবর্তীকালে যা বোলশোই থিয়েটারে পরিণত হয়। ১৮০৫ সালের ৮ই অক্টোবর আগুন পেট্রোভকা থিয়েটার টিকে ধ্বংস করে দেয় এবং নতুন ইম্পেরিয়াল থিয়েটারটি ১৩ এপ্রিল ১৮০৮ এ প্রতিস্থাপন করা হয়। তবে ১৮১২ সালে মস্কোতে ফরাসী আগ্রাসনের সময় সেটিও আগুনে ধ্বংস হয়ে যায়। পরে ১৮২১ থেকে ১৮২৪ এর মধ্যে নতুন করে বোলশোই থিয়েটার টি বানানো হয়।

 

থিয়েটার টির ভিতর টি খুব সুন্দর করে সাজানো কিন্তু দুর্ভাগ্য বসত আমরা যেদিন গেছি তার ২ দিন আগেই ওই সিজিন এর লাস্ট শো হয়ে গেছিলো এবং শো ছাড়া ভিতরে ঢোকার অনুমতি নেই। অগত্যা থিয়েটার এর সামনে যে বৃহৎ ফাউন্টেন টি আছে তার পাশে বেশ কিছুক্ষন বসে থাকলাম। বেশ সুন্দর আবহাওয়া ছিল তাই বসতে বেশ ভালো লাগছিলো। পরের দিনই আমাদের মস্কো ছেড়ে চলে যাওয়ার পালা তাই বেশ অনেক্ষন ধরে জায়গাটা উপভোগ করে নিচ্ছিলাম।

প্রায় ১-১.৫ ঘন্টা পর পাশের রাস্তা ধরে হাটতে থাকলাম রেড স্কয়ারের দিকে। লক্ষ শেষ বারের মতো প্রাণ ভোরে দেখে নেওয়া কারণ কাল চলে যাবো সেন্ট পিটার্সবার্গ।

রেড স্কয়ারে বেশ কিছু সময় কাটিয়ে ফিরে এলাম আমাদের হোটেল এ। পরের দিনের জন্য প্যাকিং করে নিয়ে হোটেল এর কাছের ই একটা ছোট্ট মার্কেট দেখতে বেরোলাম। মার্কেট টির নাম 'ইজমাইলভ মার্কেট'। এটি একটি ছোট মেলা তোলার মতো, যেখানে প্রচুর মেমেন্টো বিক্রি হচ্ছে। সেখানে পাওয়া যাচ্ছে রাশিয়ান বিখ্যাত 'মাত্রয়ষ্ক ডল', 'সাইবেরিয়ান ফক্স এর চামড়া', 'ভাল্লুকের চামড়া', এছাড়া ফ্রিজ ম্যাগনেট। বেশ কয়েকটি ফ্রিজ ম্যাগনেট তুলে নিয়ে আরো কিছু সময় কাটিয়ে চলে এলাম হোটেল এ।

৪থ দিন:মস্কো টু সেন্ট পিটার্সবার্গ: আজ যাবো সেন্ট পিটার্সবার্গ। মস্কো থেকে প্রায় ৫০০ কিমি উত্তরে অবস্থিত একটি শহর। এটি ১৭০৩ খ্রিস্টাব্দে জার্ পিটার দি গ্রেট এর দ্বারা প্রতিষ্ঠিত। যখন পিটার অনুভব করেন যে রাশিয়া কে বাড়াতে গেলে দেশের বাণিজ্য ও আমদানি রপ্তানি বাড়াতে হবে, কিন্তু রাশিয়ার দক্ষিণ দিক তখন অটোমান তুর্কিরা দখল করে আছে এবং পূর্বে বেরিং সাগর অনেক দুর, তখন তিনি রাশিয়ার রাজধানী মস্কো থেকে সেন্ট পিটার্সবার্গ এ সরানোর জন্য তৎপর হন। পূর্বে এই শহরটি সুইডেন এর রাজার দখলে ছিল, পরে পিটার দি গ্রেট এটি তাদের থেকে দখল করে এই শহর প্রতিষ্ঠা করেন। কথিত আছে এই শহর প্রতিষ্ঠা কালে ১০,০০০ শ্রমিক মারা যায় এবং যাদের অভিশাপে পিটার এবং তার পরিবার প্রত্যেকে জীবনে সুখী হয়নি এবং বেদনাদায়ক মৃত্যু হয় তাদের। যদিও এই 'পিটার দি গ্রেট' ই রাশিয়া কে বিশ্বের কাছে এক সাবলম্বী দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন।

​মস্কো থেকে সেন্ট পিটার্সবার্গ যাওয়ার জন্য অন্যতম উপায় হলো ট্রেন। বিভিন্ন ধরণের ট্রেন সার্ভিস আপনারা নিতে পারেন যার মধ্যে নাইট স্লীপার ট্রেন থেকে শুরু করে সুপারফাস্ট 'সাপসন' ট্রেন ও আছে। সাপসন এর যাত্রার সময় ৩।৫-৪ ঘন্টা। যদিও বেশি লেট করে ফেলে সেন্ট পিটার্সবার্গ যাওয়ার জন্য সাপসন এর টিকেট পেলাম না, নিতে হলো একটি স্লীপার ট্রেন এর টিকেট।এটি ডে জার্নির স্লীপার তাই বুকিং করে ফেললাম।

​ট্রেন টি ছাড়লো কুরস্কায়া স্টেশন থেকে। কুরস্কায়া স্টেশন টি বেশ বড় একটি রেল স্টেশন। মস্কোবাসীর কাছে এটির নাম মস্কো কুরস্কায়া ভস্কাল(রাশিয়ান ভাষায় স্টেশন) নামে। ট্রেন টির স্লীপার কোচ এর জন্য যে পরিমান ভাড়া দিয়েছিলাম সেই পরিমান ভালো বলা যায় না। অত্যধিক ছোট্ট একটি কূপের মধ্যে চারটি বেড, বাক্স/ট্রলি রাখার জায়গার অভাব। এক এক জনের জন্য ভাড়া দিয়েছিলাম প্রায় ৩৫০০ রুবেল যেটি প্রায় ইন্ডিয়ান যে কোনো ট্রেনএ এক এ জার্নির জন্য AC ২ টিএর এর ভাড়া কিন্তু এখানে যা দেখলাম সেটি অত্যধিক খারাপ অবস্থা।

​যাক ট্রেন ছাড়ার পর কিছুদূর যাওয়ার পর বাইরের দৃশ্য দেখে আসতে আসতে কষ্ট উপশম করতে থাকলাম। দেখতে দেখতে এক এক করে সমস্ত নদী পেরিয়ে যেতে থাকলো। রাশিয়ার প্রধান নদী ভল্গার পাস্ দিয়ে ট্রেন ছুটে চললো সমস্ত জঙ্গল এর বুক চিরে। কোচে বেশ কয়েকজন এর সাথে আলাপ হলো। একটি পরিবার এসেছিলো মঙ্গোলিয়া থেকে, কেউ এসেছে ইতালি থেকে, কেউ এসেছে আমাদের এ মতো মধ্যপ্রাচ্যের দেশ থেকে। গল্প করতে করতে সময় কাটাতে কাটাতে ট্রেন ৮ ঘন্টা পার করে ঢুকলো 'মস্কোভস্কি রেল টার্মিনাল' এ। এটি সেন্ট পিটার্সবার্গ এর মূল স্টেশন। যখন নামলাম তখন রাত ৮টা প্রায়। আমাদের হোটেলটি স্টেশন থেকে একদম হাঁটা পথেই ছিল তাই আসতে আসতে পা বাড়ালাম হোটেল এর দিকে। চারিধারের পরিবেশ অনেক বদলে গেছে। হটাৎ করে যেন ২-৩ শতাব্দী আমরা এগিয়ে গেছি ইতিহাসে। প্রায় ৫-১০ মিনিট হাঁটার পর পৌঁছে গেলাম আমাদের হোটেল 'হোটেল ডেমুট'। যে ঘরটি বুক করেছিলাম সেটি একটি সার্ভিসড এপার্টমেন্ট, মানে রান্না করার সমস্ত উপকরণ মজুত ছিল। রাতের মতো খেয়ে বিশ্রাম।

সেন্ট পিটার্সবার্গ ১ম দিন: দিন শুরু হলো সেন্ট পিটার্সবার্গ এ। পিটার্সবার্গ শহরটির যে প্রধান রাস্তাটি আছে সেটি হলো 'নেভস্কি এভিনিউ'। পুরো শহরটি মোটামুটি এটিকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে। আমাদের হোটেল থেকে এটি ছিল ঢিল ছোড়া দুরত্বে। সকালে ব্রেকফাস্ট এর জন্য যখন ব্রেড র বাটার কিনতে এলাম কাছের গ্রোসারি তে তখন দেখলাম নেভস্কি এভিনিউ দিয়ে অগণিত বাস অনবরত যাচ্ছে সিটি সেন্টার এর দিকে। ব্রেকফাস্ট করে বেরিয়ে পড়লাম আজকের গন্তব্য 'উইন্টার প্যালেস', 'হার্মিটেজ মিউজিয়াম ও থিয়েটার', 'প্যালেস স্কোয়ার'। নেভস্কি এভিনিউ তে আসতেই পেয়ে গেলাম বাস, নম্বর ১৯১। সোজা নিয়ে গিয়ে নামালো প্যালেস স্কোয়ার এর কাছে বাসস্টপ এ। বাস থেকে নেমে চোখ ধাঁদিয়ে গেলো। এতো সুন্দর শহর যা ভাবা যায়না। চারিদিকে টিপিকাল ইউরোপিয়ান ছাপ যা মস্কো কে অনেক পিছনে ফেলে এসেছে। এগিয়ে চললাম উইন্টার প্যালেস এর দিকে।

উইন্টার প্যালেস টি হলো পিটার দি গ্রেট এর সময় থেকে রাশিয়ান জার্ এবং তার ফ্যামিলির রয়েল রেসিডেন্স ও রাজকাজের জায়গা। বর্তমানে এই প্যালেস টি 'হার্মিটেজ মিউজিয়াম' এ পরিণত করা হয়েছে। পিটার দি গ্রেট যে উইন্টার প্যালেস টি বানান সেটি এখন রক্ষণশালায় রূপান্তরিত এবং এখন যে বড় প্যালেস টি দেখা যায় সেটি ধাপে ধাপে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন জার্ বানিয়েছেন। উইন্টার প্যালেস বানানোর পিছনে মুলত যার হাত রয়েছে তিন হলেন 'এম্পেরর ক্যাথরিন II'। তার সময়েই এই উইন্টার প্যালেস টির মূল স্থাপনা শুরু হয়।

উইন্টার প্যালেসের সামনে

হার্মিটেজ মিউজিয়াম এ বেশ কিছুক্ষন সময় কাটিয়ে বুঝলাম এ শেষ করার বস্তু নয়। বিশাল বড় এবং গাইড ছাড়া আপনি হারিয়েই যেতে পারেন যেটা আমার সাথে হয়েছিল। পারাম্বুলেটর যাবে না বলে আমার স্ত্রী আমার ছেলে কে নিয়ে অপেক্ষা করছিলো নিচে আর আমি গেছিলাম ২য় তলায় দেখতে। আসতে আসতে এমন এক জায়গায় এসে পৌঁছলাম যেখান থেকে বেরোনোর রাস্তায় খুঁজে পাচ্ছিলাম না। শেষে এক গাইড এর সহায়তায় নিচে আসার রাস্তা পাই। তবে রাশিয়ান এম্পেরর দের জায়গা গুলি একটু দেখার সুযোগ হয়েছিল যার মধ্যে ছিল দি 'রয়্যাল থ্রোন রুম'।

রয়্যাল থ্রোন রুম

মিউজিয়াম টি দেখে বেরিয়ে সামান্য কিছু খেয়ে চলে এলাম নেভা নদীর ধারে উইন্টার প্যালেস এর পাশের রাস্তা ধরে। নেভা নদী সেন্ট পিটার্সবার্গ এই গাল্ফ অফ ফিনল্যাণ্ড এ পড়েছে। এখান থেকে ফিনল্যাণ্ড এর রাজধানী হেলসিংকি খুব কাছে। প্যালেস এর পাশের রাস্তা দিয়ে চলতে চলতে পৌঁছে গেলাম পিটার টি গ্রেট এর বানানো আসল উইন্টার প্যালেস এ যেটি একটি কুঁড়ে ঘরের ন্যায়। ভিতরে ঢুকে পিটার এর নিজস্য ঘর ও আসবাবপত্র দেখলাম। এক বয়স্ক মহিলা ওখানে গার্ড এর ন্যায় বসে ছিল, তার সাথে কথা হলো এবং সে বললো সে গৌতম বুদ্ধা কে চেনে এবং বোধগয়া যাওয়ার তার খুব ইচ্ছা। কিছুক্ষন সময় কাটানোর পর বেরিয়ে এলাম মেইন রাস্তায়। নেভা নদীর মধ্যেই একটি আইল্যান্ড এর মতো জায়গায় পিটার ও পল ফোরট্রেস। কিন্তু সেটা কালকের গন্তব্য তাই প্যালেস স্কোয়ার এর পাস দিয়ে নেভ্স্কি এভিনিউ এর দিকে চললাম। ঠিক করলাম হেঁটেই ফিরবো হোটেল তাতে শহরটা ভালো করে দেখা যাবে।

​প্যালেস স্কোয়ার থেকে যে রাস্তা দিয়ে আসছি তার দুদিকে ঊনবিংশ শতকের সমস্ত বাড়ি ঘর, ইউরোপীয় ধাঁচে বানানো। ছবির মতো সুন্দর এক রাস্তা দিয়ে হাটতে থাকলাম। দুধারে অনেক কাফে ও রেস্তোরা, আর সবথেকে যেটা আকর্ষণীয় সেটা হলো স্ট্রিট আর্টিস্টস। কেউ পেইন্টিং করছে, কেউ গান করছে, কেউ নাচ করছে, কেউ জাগলিং করছে তো কেউ গিটার নিয়ে জ্যামিং করছে। আস্তে আস্তে যখন সন্ধে হয়ে গেলো পুরো নেভ্স্কি এভিনিউ বদলে গেলো এক মায়াময় জগতে। দেখলাম প্রচুর ইয়ং ছেলে মেয়ে নেমে গেছে রাস্তায় গান-বাজনা করার জন্য। তারা এভাবেই পয়সা অর্জন করছে ও দিন চালাচ্ছে। কেউ কেউ ঘোড়ার গাড়ি চালাচ্ছে, কেউ বিয়ার এর মোবাইল দোকান করেছে, কেউ বা বিক্রি করছে মেমেন্টো ও সুভিনিওর। তুলে নিলাম কয়েকটি সুভিনিওর। আবারো চলতে থাকলাম। নেভ্স্কি এভিনিউর দুদিকে প্রচুর হোটেল, রেস্তোরাঁ, সুভিনিওর শপ ও কাফে। তাই দেখতে দেখতে বেশ ভালোই সময় কাটছিলো। সময় অনেক পেরিয়ে গেলো সেই সঙ্গে আমরাও পৌঁছে গেলাম আমাদের হোটেল এ।

ওয়াটার ক্যানেল (নেভ্স্কি এভিনিউ তে

স্ট্রিট পারফর্মার্স

 

সেন্ট পিটার্সবার্গ ২য় দিন: আজকের গন্তব্য 'পিটার এন্ড পল ফোরট্রেস' এবং 'পেটারহফ প্যালেস'। নেভ্স্কি থেকে ধরে নিলাম সেই বাস নম্বর ১৯১, নামতে হবে দব্রল্যুবভা আভে স্টপএ, তারপর পিছন দিকে কিছুটা পথ হেটে একটি ছোট সাঁকো পেরোলেই পিটার ফোরট্রেস এ পৌঁছে যাওয়া যাবে। হিসেবে মতো তাই পৌঁছে গেলাম। এই ফোরট্রেস টিতে ঢুকতে কোনো টিকেট লাগে না কিন্তু ভিতরে একটি ক্যাথেড্রাল আছে যার নাম ‘পিটার এন্ড পল ক্যাথেড্রাল’ সেটায় ঢুকতে টিকেট লাগে।

পিটার এবং পল ফোর্ট্রেস হলো রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবার্গের মূল দুর্গ,১৭০৩ সালে পিটার দ্য গ্রেট এটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ১৯২০ সাল পর্যন্ত এটি বলশেভিক সরকারের কারাগার এবং ফাঁসি স্থল হিসাবে ব্যবহৃত হয়েছিল।আজ এটি সেন্ট পিটার্সবার্গের ইতিহাসের কেন্দ্রীয় মিউজিয়াম এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসাবে রূপান্তরিত হয়েছে। সেন্ট পিটার্সবার্গে মিন্টের (মনেটিনি ড্রওয়ার) দখলকৃত কাঠামো বাদে মিউজিয়ামটি ধীরে ধীরে ফোরট্রেস এর মালিক এর অংশগত হয়ে উঠছে।

পিটার এন্ড পল ক্যাথেড্রালের ভিতরে

পিটার এন্ড পল ক্যাথেড্রালের ভিতরে [#পিটার দি গ্রেট এর সমাধি(একেবারে ডানদিকে), #শেষ জার্ নিকোলাস ও তার পরিবারের সমাধি যাদের বলশেভিকরা পুড়িয়ে মেরেছিলো]

১৭০০ শতকের পর যখন যখন ক্ষমতা পিটার এর হাতে আসে এবং তিনি সেন্ট পিটার্সবার্গ শহরটির স্থাপনা করেন, তখন তিনি রাজধানীও সেন্ট পিটার্সবার্গ এই নিয়ে চলে আসেন মস্কো থেকে। এরপর থেকে পিটার এবং তার পরিবারের সকলের সমাধি দেওয়া হয় এই পিটার এন্ড পল ক্যাথেড্রাল এ। তাই জার্ দেড় সমাধির মধ্যে পিটার পূর্ববর্তী সকলের সমাধি আছে মস্কো ক্রেমলিন এর আরচ্যাঙ্গেল ক্যাথেড্রালে আর পিটার এবং তার পরবর্তী জার্ দের সমাধি আছে এই পিটার এন্ড পল ক্যাথেড্রালে।

​ক্যাথেড্রাল এবং তার পার্শবর্তী চত্বর ঘুরে চলে এলাম ফোরট্রেস এর বাইরে, এবার যেতে হবে পেটেরহফ প্যালেস। বুক করলাম উবের কারণ পেটেরহফ প্যালেস টি মেইন সিটি থেকে অনেক দুর। পাবলিক ট্রান্সপোর্ট আছে যাওয়ার জন্য কিন্তু তাতে সময় লাগবে ২-৩ ঘন্টা মতন কারণ অনেকবার ব্রেক জার্নি করে যেতে হবে। আরেকটি উপায়ে যাওয়া যায় সেটি হলো ফেরি যা উইন্টার প্যালেস এর কাছে ফেরি স্টেশন থেকে ছাড়ে। হাতে বেশি সময় না থাকায় উবের এর ভরসাই নিলাম কারণ প্যালেস টি ৪ টের সময় এন্ট্রি টিকেট দেওয়া বন্ধ করে দেয়।

​মেইন সিটি থেকে পেটেরহফ প্যালেস প্রায় ৩৫-৪০ কিলোমিটার পথ। যেতে লাগলো প্রায় ১/২ ঘন্টা। রাস্তায় উবের ড্রাইভার এর সাথে গল্প হলো।গাড়িটা তারই, আগে সে আর্কিওলজিক্যাল ডিপার্টমেন্ট এ কাজ করতো কিন্তু কিছুদিন যাবৎ চাকরি থেকে বরখাস্ত হয়েছে, ঘরে একটি ১ বছরের ছোট বাচ্ছা রয়েছে। বাধ্য হয়ে উবের চালানোয় নেমেছে। তার কাছ থেকে জানতে পারলাম উইন্টারে পিটার্সবার্গ এর তাপমাত্রা প্রায় -৪০ হয়ে যায়, তখন আয় প্রায় থাকেই না।

পেটারহফ প্যালেস ('স্যামসন ফাউন্টেন)

ফরাসি কায়দায় বানানো এই প্যালেস টির মুখ্য বৈচিত্র হলো এর বহু ফাউন্টেন ও সুবিস্তৃত বাগান। রাজপ্রাসাদটির পুরো এলাকা হলো ৪৮.৩০ বর্গকিলোমিটার। এটি উপর থেকে নিচে ধাপে ধাপে বানানো এবং সেই ধাপে যে ফাউন্টেন টি আছে তার নাম 'স্যামসন ফাউন্টেন'। এটি সরাসরি সমুদ্রের সাথে যুক্ত ক্যানেল এর মাধ্যমে। এই প্যালেসটিও বর্তমানে মিউজিয়াম এ পরিবর্তিত করে ফেলা হয়েছে।

প্যালেসটির চারপাশে বাগানে ঘুরতে বেশ অনেক সময় চলে গেলো। ঘন গাছে ঢাকা বাগান, মাঝে মাঝে ১-২ টি করে ফোয়ারা। হাটতে হাটতে সমুদ্রের ধারে চলে এলাম। প্রথমে ঠিক করেছিলাম ফেরি ধরে পিটার্সবার্গ ফেরত যাবো কিন্তু সূর্যের আলো থাকার জন্য সময়ের খেয়াল ছিল না। ওখানে গিয়ে জানতে পারি শেষ ফেরি সন্ধ্যা ৮ তাই বেরিয়ে গেছে। অগত্যা প্যালেস এর বাইরে এসে

উবের করলাম। আজ আমাদের সেন্ট পিটার্সবার্গ এ শেষ দিন। বলা চলে রাশিয়া ঘোরার ও প্রায় শেষ দিন কারণ কাল মস্কো ফিরে গিয়ে দুবাই এর ফ্লাইট। তো কালকের দিনটা ট্রাভেলেই কেটে যাবে। তাই ঠিক করলাম অথেন্টিক রাশিয়ান খাবার খেতে হবে। উবের এ বসে বসেই খুঁজে বার করলাম সোভিয়েৎ আমল এর একটি কাফে। নাম ও ‘সোভিয়েৎ কাফে’। এটি নেভস্কি এভিনিউ এর একদম কাছেই। পেটরহফ থেকে ১/২ ঘন্টার মধ্যে পৌঁছে গেলাম সোভিয়েৎ কাফে তে।

বেশ সুন্দর বিংশ শতাব্দী ধাঁচের কারুকার্য করা কাফে। সোভিয়েৎ আমল এর রেডিও, টেলিফোন সবই রাখা আছে। বেশ পুরোনো বাক্স পাট্রা দিয়ে সাজানো বসার জায়গা। বসেই বেশ মনটা ভোরে গেলো। অর্ডার করলাম: ১. রাশিয়ান লোকাল বিয়ার ও কির রয়্যাল ককটেল, ২. স্টার্টারে বীফ ব্রস ও উখা মাছের স্যুপ, ৩. হেরিং ফিশ, পর্ক মোমো ও পর্ক এরই রেকটি আইটেম। খাবার এর টষ্টে এবং কোয়ালিটি বেশ ভালো। বলা বাহুল্য আমার স্ত্রী হেরিং ফিশ টি খেলনা কারণ ওটা কাঁচা পরিবেশন করেছিল (ওটা ওভাবেই খায়)। বাকি আইটেম গুলো বেশি ওই খেলো।

খাওয়া শেষে আজ ও হাটতে হাটতে হোটেলের দিকে এগোলাম শেষ রাতের মাধুর্য নিতে নিতে।

​৭ম দিন:সেন্ট পিটার্সবার্গ টু মস্কো: আজ ফিরে যাওয়ার পালা। পিটার্সবার্গ থেকে মস্কো যাওয়ার সাপসন এর টিকেট পেয়েছিলাম। এটিই রাশিয়ার দ্রুততম ট্রেন। দুপুর ১:০৫এর ট্রেন পিটার্সবার্গ থেকে, সময় লাগবে প্রায় ৩।৫০ ঘন্টা। হোটেল থেকে বেরিয়ে টুক টুক করে পৌঁছে গেলাম স্টেশন এ। পিটার্সবার্গ স্টেশন এ ঢোকার আগে ২ বার লাগেজ স্ক্যান হয় যেটি খুবই সময় সাপেক্ষ এক ব্যাপার। আমাদের বেশ সময় চলে গেলো ওতে কারণ পারাম্বুলেটর আর সঙ্গে অনেকগুলো ব্যাগ থাকার জন্য। শেষে প্রায় দৌড়ে ট্রেনটি ধরলাম। জায়গা করে নিয়ে বসে এবার হাইস্পীড ট্রেন এর আনন্দ নেওয়ার পালা।

ট্রেনে স্পিড ডিসপ্লে

মস্কোভয়স্কি (পিটার্সবার্গ) স্টেশনে সাপসন

মস্কো লেনিনগার্ডসকি স্টেশন এ যখন নামলাম তখন বিকাল প্রায় ৪ টা বাজে। কিছুক্ষন অপেক্ষা করে সাধারণ ট্যাক্সি পেলাম না। উবের বুক করে বেরিয়ে চললাম এয়ারপোর্ট এর দিকে। রাত ১১:৩০ এ দুবাই ফেরার ফ্লাইট। বেশ সময়মতোই এয়ারপোর্ট এ পৌঁছে গেলাম। ইমিগ্রেশন, সিকিউরিটি করে রেস্টুরেন্টে খেয়ে নিলাম রাতের খাবার। এবার গেট এ গিয়ে অপেক্ষা। ১০:৩০য় চড়ে বসলাম ফ্লাইটে। অন্ধকারের মধ্যে দিয়ে জানলা দিয়ে শেষ বারের মতন দেখে নিচ্ছিলাম রাশিয়া কে, তার মধ্যেই প্লেন উড়ান শুরু করে দিলো, ফিরে চললুম দুবাই

কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ও টিপস:

​১। গেটিং রাশিয়ান ভিসা: রাশিয়ান কনস্যুলেট এর নিয়ম অনুযায়ী ভিসা পাওয়ার জন্য আপনাকে প্রথমে একটি ডকুমেন্ট প্রডিউস করতে হবে সেটি হলো 'ট্রাভেল ভোউচের'। আপনি গুগল সার্চ করলেই অনেক কোম্পানি/ট্রাভেল এজেন্ট এর লিংক পেয়ে যাবেন যারা এর ভোউচের টি দিতে পারবে উইথ এ সার্টেন এমাউন্ট অফ ফিস। এই ট্রাভেল ভোউচের এ আপনার সমস্ত ডিটেলস লেখা থাকবে যেমন আপনার নাম (রাশিয়ান এ), আপনি কবে রাশিয়া এন্ট্রি করছেন, কবে এক্সিট করছেন, মাঝে আর কোথাও যাচ্ছেন কিনা, কোন শহরে কোন হোটেল এ উঠবেন, ইত্যাদি ইত্যাদি।

তাই ট্রাভেল ভোউচের এর এপলাই করার আগে আপনাকে ফ্লাইট টিকেট এন্ড হোটেল বুকিং সেরে ফেলতে হবে।

​২। ওল্ড ট্রাভেল হিস্ট্রি: রাশিয়া দেশটি ভিসা দেওয়ার বেপারে একটু সিলেক্টিভ। তাই আপনার যদি পুরোনো হিস্ট্রি থাকে এমন কোনো দেশে যাওয়া যেখানে টেররিস্ট একটিভিটি বেশি আছে, তাহলে আপনার ভিসা অনেকসময় বাতিল হতে পারে। কিন্তু ইন্ডিয়া পাসপোর্ট হোল্ডার দের ওরা ব্যাকগ্রাউন্ড ভেরিফিকেশন করে ভিসা দিয়েই দেয় এটা দেখেছি।

এই সমস্ত ডকুমেন্ট ক্লিয়ার করে তবেই ভিসা এপলাই করুন, নাহলে আপনার ফ্লাইট এন্ড হোটেল বুকিং ক্যানসেল করতে হতে পারে।

​৩। আনুমানিক খরচ: এপ্রিল টু অগাস্ট হলো রাশিয়া ঘোরার বেস্ট টাইম। মোটামুটি বেশ ভর্তি থাকে এই সময়। তাপমাত্রা ১০-২০ র মধ্যেই থাকে। তাই এই সময় হোটেল ভাড়াটাও একটু বেশির দিকেই হয়। মস্কোতে যত রেড স্কোয়ারের কাছে হোটেল নেবেন ততো বেশি ভাড়া হবে যেটা স্বাভাবিক তাই আমার প্রস্তাব হবে যেহেতু শহরটা মেট্রো এবং বাস দিয়ে ভালভাবে কানেক্টেড তাই একটু দুরেও চাইলে নিতে পারবেন, তাতে খরচটা একটু হলেও কম হবে। হোটেল বুকিং এর প্রচুর ওয়েবসাইট আছে। বুকিং করার সময় কাস্টমার রিভিউ টা দেখে নেবেন।প্রচুর সংস্থা আছে যারা হোটেল বুকিং করে তাদের সাহায্য নিতে পারেন। রাশিয়াতে প্রধান সমস্যা ভাষা। ১০ জনের মধ্যে ১ জন ও এখানে ইংলিশ বলে না তাই খুব কম খরচের হোটেল নেবেন না কারণ তাতে অনেক সময় ইন্টারন্যাশনাল স্টাফ থাকে না যে আপনাকে ইংলিশ এ হেল্প করবে।

​ফ্লাইট, ভিসা, ট্রাভেল ভাউচার, লোকাল ট্রাভেল, হোটেল ও ট্রেন মিলিয়ে মোটামুটি ভারতীয় মুদ্রায় আপনার খরচ হবে পারহেড ১-১.২০ লক্ষ টাকা। এটা আমি পুরো ট্রিপটার কথা বললাম। এই খরচ ১০-১৫% বাড়তেও পারে হোটেল এবং ফ্লাইট এর উপর।

​৪। যেটা আগেও বললাম রাশিয়াতে ইংলিশ বলার লোক খুব কম এ পাবেন, তাই সেটাই ভেঙে পড়ার কিছু নেই। গুগল ট্রান্সলেট ব্যবহার করুন, এবং আপনি যা বলতে চান লিখে দিন, তারাও তাদের ভাষায় লিখে আপনাকে ইংলিশ এ ট্রান্সলেট করে দেবে। তাই খুব যে সমস্যা হবে তা নয়। বয়স্ক মানুষদের বলবো আপনারা একটু রেড স্কোয়ারের কাছে হোটেল নিন আর হোটেল থেকেই ঘোরার জায়গা কন্ডাক্টেড টুর এ বুক করুন। রাশিয়া তে ট্যাক্সি ওলারা আমাদের কলকাতার মতনই দরদাম করে, তাই নির্দ্বিধায় দরদাম করতে পারেন, কিন্তু তার ভাড়ার রেফারেন্স টা আগে উবের এ দেখে নিন।

​৫। ব্যবহার গত দিক থেকে রাশিয়ানরা একটু নাক উঁচু, তাই অনেকসময় আপনি অসুবিধায় পড়েছে দেখলেও হেল্প করতে এগিয়ে নাও আসতে পারে। তাই প্রথম দিন থেকেই এই চিন্তা একদমই ঝেড়ে ফেলুন এবং আত্মনির্ভর হন।

​৬। শেরেমেতিয়েভো ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট থেকে ট্রেন আছে শহরে আসার জন্য। এটি বেলমোলস্কায়া স্টেশনে ড্রপ করবে। তারপর সেখান থেকে অন্য মেট্রো বা ট্যাক্সি করে আপনাকে আপনার হোটেলে যেতে হবে।

​৭। যেকোনো দেশের মতোই রাশিয়ার ও একটি গুরুত্বপূর্ণ ইতিহাস আছে এবং কোনো কোনো সময় সেটি খুবই রক্তক্ষয়ী ইতিহাস। তাই যাওয়ার আগে একটু রাশিয়ার ইতিহাসটি পড়ে যাবেন, ঘুরতে ভালো লাগবে।

​৮। খুব ছোট বাচ্ছা মানে যারা হাটতে পারে না সেরকম কাউকে নিয়ে যাবেন না কারণ অনেক হিস্টরিকাল মনুমেন্টস আছে যাতে উঁচু উঁচু সিঁড়ি আছে যেগুলো আপনি অটো ছোট বাচ্ছা নিয়ে সামলাতে নাও পারতে পারেন, তাই চেষ্টা করুন একটু হাটতে শিখলে নিয়ে যাওয়ার।

​৯। মস্কো এবং সেন্ট পিটার্সবার্গ এর অনেকজায়গায় আমরা কভার করতে পারিনি টাইম কন্সট্রেইন এর জন্য। আপনারা প্রপারলি প্ল্যান করুন এবং যতটা পারবেন হেটে ও পাবলিক ট্রান্সপোর্ট এ ঘুরুন। তাতে ভালো ঘুরতে পারবেন।

​১০। আমাদের ২জন এরই সেন্ট পিটার্সবার্গ শহরটি মস্কোর থেকে বেশি ভালো লেগেছে, এবং আক্ষেপ আছে হয়তো আর একদিন বেশি সময় থাকলে আরও কয়েকটা জায়গায় যাওয়া যেত। আমি আপনাদের সাজেস্ট করছি সেন্ট পিটার্সবার্গ শহরেও ৩ দিনের মতো ঘোরার সময় দিন মস্কোরই মতো।

আর কিছু তথ্য জানার হলে আমায় যোগাযোগ করতে পারেন। যতটা সম্ভব সাহায্য করার চেষ্টা করবো। ডিটেলস নিচে দেওয়া থাকলো।

Meet the Blogger

Abhik Biswas


Name- Abhik Biswas
Profession- Engineer
City- Current: Pune
Permanent: Hooghly
Hobbies- Cooking, Photography, Travelling, Gardening
Previous Tours- Kedarnath-Badrinath, Auli-Chopta, Delhi-Agra-Mussouri, Muscat(Oman), Sikkim(North Sikkim), Parts of Dooars



You may also like