বিধিসম্মত সতর্কীকরণ: এই লেখা পড়ে সিমলা ঘোরার প্ল্যান করার চেষ্টা ব্যর্থ হলে কতৃপক্ষ দায়ী নয়
-------------------------------------------------------
প্রথম প্রশ্ন হলো, পাহাড়ি শহর কি আমি ভালোবাসি?
উত্তর, না এবং হ্যাঁ I সুন্দর পাহাড়ি জায়গা, যা হঠাৎ-বড়োলোকের মতো হঠাৎ-শহর হয়ে গেছে, সেগুলো আমার নাপসন্দ; যেমন.... (রাগবেননা কেউ প্লিজ).. দেরাদুন, নৈনিতাল, মিরিক ইত্যাদি; বরং ঐতিহ্য বয়ে চলা পাহাড়ি শহর আমার বেশি পছন্দের I মানে, আমি বোঝাতে চাইলাম যে হঠাৎ গজিয়ে ওঠা শহরের থেকে প্রাচীন শহর আমার প্রিয় I
যে কারণে দার্জিলিং আমার কাছে গ্যাংটকের থেকে অনেক বেশি গ্রহণযোগ্য I
দ্বিতীয় প্রশ্ন হলো, আমি কি সেই শহরে গিয়ে ঐতিহ্যমন্ডিত জায়গা দেখে বেড়াই?
নাঃ, এক্কেবারে নাঃ I
তৃতীয় প্রশ্ন তাহলে আসাই স্বাভাবিক, আমি তাহলে কি করি ঐসব শহরে গিয়ে?
বিচ্ছিরি এক উত্তর এটার , আমি কিছুই করিনা... চল্লিশটা পয়েন্ট দেখতে ছুটিনা, মিউজিয়ামও দেখতে লাইন দিইনা I
চতুর্থ, ও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন, তাহলে আমার কেন ভালো লাগে?
প্রাচীন শহরটার গন্ধ যখন আমার অলফ্যাক্টরি নার্ভে খেলে বেড়ায়, আমি ল্যাদ খেতে খেতে বেশ রেলিশ করি I ল্যাদ খাওয়াও বোর লাগলে উদ্দেশ্যহীন হাঁটতে বেরোই, এ গলি, ও গলি.. এ বাঁকের মুখে হঠাৎ কোনো রংচটা মূর্তি, ওই পাহাড়ের আড়ালে চলে যাওয়া অখ্যাত কোনো ব্রিটিশ স্থাপত্য- আমি হাঁ করে দেখি I আমার ভালো লাগে I সেই মূর্তির বা ওই স্থাপত্যের ইতিহাস খোঁজার চেষ্টাও খুব একটা করিনা; কিন্তু ওই সব মিলিয়ে মনের ভেতর একটা আলোড়ন, একটা শিরশিরে অনুরণন- ভালো লাগে, বড্ডো ভালো লাগে I
তাই আমায় ডালহৌসি মুগ্ধ করে, দার্জিলিং আপন করে নেয় I আর সিমলা? আসছি তার কথায়…
শিবালিক ডিলাক্স সিমলা ঢোকার আগে তারাদেবী স্টেশন থেকেই শহরের ডালপালা ছড়ানোর আঁচ পাচ্ছিলাম; কাছের এ পাহাড় জ্যামজমাট, তো দূরের ও পাহাড় বাড়ি-ঘরে মুখ ঢেকেছে I তা হবে নাই বা কেন? একটি রাজ্যের রাজধানী, সে একটু আড়ে-বহরে বাড়বেনা?
তো বাড়িঘর, পাইন দেবদারু দেখতে দেখতে নামলাম সিমলা I ছোট্ট মিষ্টি স্টেশন, আমার সুশীলজি ( #ইস্মার্ট_বাঙগালি_ডেরাইভার খ্যাত) দাঁড়িয়েই আছেন গাড়ি নিয়ে I বেরিয়েই শহরটাকে এক ঝলকে খারাপ লাগলোনা I রাস্তাঘাটও খুব পরিচ্ছন্ন, বেশ সুন্দর I সুশীলজি হোটেলের আগেই নিয়ে চললেন আন্নাডেল, খায় না মাথায় দেয় বুঝলামনা, আমি একটু গাম্বাট তো, আসার আগে সেই শহরের দ্রষ্টব্য স্থান কি কি আছে, অতসব দেখে আসিনা, ফলে জানিওনা I
তো বেশ সুঠাম রাস্তা দিয়ে চললাম এঁকেবেঁকে... কিছুদূর গিয়েই একটা মোর, বিধানসভা চক; ডানদিকে বিধানসভা, বোঝা যাচ্ছে পুরোনো, কিন্তু বেশ নতুন করে রাখা, সেই গন্ধটা মাথাচাড়া দিয়েই মিলিয়ে গেলো !! তার পাশ দিয়ে শুরু হচ্ছে ম্যাল রোড I আমরা বাঁদিক নিয়ে এগোলাম... আহা কি যে সুন্দর রাস্তা... বড় বড় পাইন, দেবদারু ছাওয়া জঙ্গুলে রাস্তা চলেছে নিরুদ্দেশে, হঠাৎ ডালহৌসি মনে পড়লো, বেশ নির্জন এক সিমলা চোখের সামনে...Iপৌঁছলাম আন্নাডেল, এক সময়ের সাহেবদের সৌখিন গলফ কোর্স, আজ সেনাবাহিনীর দখলে I
ভীষণ সুদৃশ্য একটি জায়গা, ঢুকেই একটি আর্মি মিউজিয়াম, বিভিন্ন যুদ্ধের স্মারক, সেনাবাহিনীর ব্যবহৃত বিভিন্ন অস্ত্র, পোশাক ইত্যাদি I পেরিয়ে পেছনদিকে গেলেই, চমক... বিস্তীর্ণ সবুজ ঢেউ... গলফ কোর্স.. আর তার উল্টোদিকে আবার বাড়িঘর নিয়ে পাহাড় উঠে গেছে I নামতে দেয়না সেখানে, তবে দেখতে মানা নেই I
দেখলাম, ভালোই লাগলো I এবার চললাম হোটেল I হোটেলটা এইচপিটিডিসির, 'হোটেল হলিডে হোম' নাম I ঢুকলাম ওল্ড বাস স্ট্যান্ড রোডে, প্রথমেই বাবা ভালকু মিউজিয়াম দেখে নিলাম, অসাধারণ ছোট্ট একটি মিউজিয়াম, ভালকু রামের অদ্ভুত জীবন, সাথে রেলের বিভিন্ন পুরোনো জিনিসপত্র, সেই গন্ধটা হঠাৎ নাকে লাগলো !!!ব্যাস, আজকের মতো শেষ... হোটেল চললাম.. সিমলার এই অঞ্চলটা বেশ অগোছালো, পুরোনো ছোঁয়া আছে I
আমাদের হোটেলটা বলা যায় ম্যালের ঠিক উল্টোদিকে I ঘরের জানলা থেকে ওই ওপরে ম্যাল, চার্চ, আর একটা বিশাল জাতীয় পতাকা দেখা যাচ্ছে I
বেশ ক্লান্ত আজ.. এতো ঘোরাঘুরির অভ্যাস নেই !!!
দুপুরে খেয়েদেয়ে জমাটি ঘুম... ঘুম ভাঙলো বিকেল পেরোনোর মুখে I ভেবেছিল ম্যালে যাবো, কিন্তু ওই যে ল্যাদ.... ভাবলাম শুধু, গেলামনা I
বরং বারান্দায় ক্যামেরা নিয়ে বসলাম... বাঁদিকে আকাশ আয়োজন করছে সন্ধ্যা আহ্নিকের, কমলা চ্ছটা ছড়িয়ে পড়ছে কৌণিক অবকাশে I সামনে ম্যালের পাহাড়টা বাড়িঘরে গিজগিজে, ওই মায়া-আলো মন্ত্রবলে কমলা রঙে বহুমাত্রিক ছবি বানিয়ে দিচ্ছে ওই পাহাড়ে; ছবির কোলাজ যেন, স্থির, শুধু রং পাল্টে পাল্টে ছবির চরিত্র পাল্টাচ্ছে.... আস্তে আস্তে গাঢ় থেকে গাঢ়তর হচ্ছে সে ছবি... পৃথিবীর আলো নিভে এলে যান্ত্রিক আলো করে আয়োজন... টিমটিমে আলোগুলো জমাট করছে রাতের অন্ধকার I কত যে ছবি, কত যে সম্ভার... প্রয়োজন শুধু কল্পনার...
....................
'আমি খুঁজছি, আমি খুঁজছি তোমার ঠিকানা,
অলি গলি ঘুরে ক্লান্ত তবু তোমায় পাচ্ছিনা I '
সিমলায় সকাল এলো বেশ বেলায়, বেশিরভাগ বড় শহরে যেমন হয়; যদিও পাহাড়ি শহরে ভোর হয় বেশ তাড়াতাড়ি, পাখির ডাক, ঘুম-ভাঙা পাহাড় বেশিক্ষন ঘুমাতে দেয়না, কিন্তু সিমলায় সেসব হলোনা ।
ধীরে সুস্থে তৈরী হয়ে চললাম নলদেরা; কুফরী যাবোনা ঠিকই ছিল ।শহরের বাইরে যেতেই মন খুশ ।শহর আর তার মাথায় বরফ-পাহাড়, বেশ ছবির মতন । নলদেরা বেশ কাছেই সিমলার, ওই মোটামুটি ২৫-২৬ কিমি।আমার মেয়ে উত্তেজিত, ঘোড়ায় চড়বে, আমরাও চড়ে বসলাম।দেবদারু, পাইন ঘেঁষে আঁকাবাঁকা এগোলাম।সিমলা আসার পর এই প্রথম সবুজ এতো কাছে। বেশ সুন্দর একটা পাহাড়ের মাথায় পৌঁছলাম, পাশ থেকেই শুরু গল্ফ কোর্স।কার্জনের সময়ে নাকি তৈরী।
নিচে, বেশ নিচে একটা জলাধার; ওই যে বেশ ছবির মতন।আমি আবার একটু অগোছালো, কিন্তু তাও ভালো লাগলো।থাকলাম খানিকক্ষণ।নেমে এলাম।সামনে একটা রেস্টুরেন্টে গেলাম, উপত্যকার চোখে চোখ রেখে বসলাম।ঢেউ খেলানো, আপেল খেত, সবুজ শান্তি।বেশ খানিক দূরে নাকি তত্তপানি, উষ্ণ জলাধার, যাওয়া বাতিল করলাম, মেয়ের একটু শরীর খারাপ, আমারও ম্যাল যাওয়ার তীব্র ইচ্ছে। ফিরে চললাম সিমলা।রাস্তায় ছায়ায় পেলাম পুরোনো বরফ-চিহ্ন। সুশীলজি নামালেন পাসপোর্ট অফিসের কাছে।সোজা রাস্তা ম্যাল রোড; ততক্ষণে মরিয়া আমি, সেই গন্ধ, সেই পুরোনো চার্ম খুঁজে পেতে।বড় বেশি ঝকঝকে, বড় বেশি ইঁটকাঠ, সিমলা তোমার মন নাই? এগোলাম ম্যাল রোড ধরে, বিশাল রেল বোর্ডের অফিস; হুমম দেখার মতন অফিস বটে।পাথর আর কাঠের; অবশেষে উৎসাহী আমি।তরতর করে পেরিয়ে এলাম অনেকখানি পথ।সিঁড়ি, কালীবাড়ির দিকে। পুজো দিয়ে ভক্তরা নামছেন, পাশ কাটিয়ে….. এক্কেবারে হতাশ।ছবিও তুললামনা, নেমে এলাম। (কেউ আঘাত পেলে দুঃখিত) ঝকঝকে মার্বেল বাঁধাই চত্বর, পুরোনো শার্সির মুখ লুকোনো নতুন রঙের প্রলেপে, পুরোনো পাথর আর থাম আধুনিক হয়ে বেমানান, পেছনে উঁকি মারছে সেই সময়ের একমাত্র সাক্ষী চিমনি!!!
যাক, বেশি আশা না করে এগোলাম।
দোকানপাট শুরু, পুরোনো গম্বুজ স্টাইলের বাড়ি, কাঠ আর পাথরে পুরোনোদিনের হাতছানি। গন্ধটা ফিরে ফিরে আসছে, কিন্তু মগজে কারফিউ….. উঁহু, হচ্ছেনা।একটা অসাধারণ বাঁক…. এসে পড়লাম স্ক্যান্ডাল পয়েন্ট; চারিদিকে পুরোনো বাড়ি, পুরোনো কিন্তু নতুনের মতো, ভালোলাগছেনা ছাতা।উঁকিঝুঁকি মারছে চালওয়ালা কিছু বাড়ি।কিন্তু তাল মেলাতে পারছেনা।বাড়িগুলোর পাশ দিয়ে হঠাৎ কোনো কাঠের সিঁড়ি, সেখান দিয়ে উঁকি ঝুঁকি পুরোনো সিমলার।কিন্তু, সেই হীরক রাজার দেশের মতন, রাস্তার দুপাশ যেন নতুন পলিথিনে ঢেকে রাখা হয়েছে, যাতে পুরোনো কিছু চোখে না পরে!!!
মুগ্ধ হলাম 'নগর নিগম' বা সিটি হল বা টাউন হল দেখে।রেনোভেট হয়েছে, কিন্তু ব্রিটিশ গন্ধ ম ম করছে।ভালো লাগলো 'সফ্টি'; কিন্তু কোথায় পাবো তারে?
নেই ঝকঝকে কাঞ্চনজঙ্ঘা, নেই জিমখানা ক্লাব, নেই গান্ধী চক, সুভাষ চক, নেই সেইসব বিশাল প্রাচীন গাছ, যা বয়ে চলে পুরোনো বহমানতা…… সিমলা ম্যাল,তুমি ধনী হতে গিয়ে গরিব হয়েছো আরো।
ক্রাইস্ট চার্চ, উত্তর ভারতের দ্বিতীয় প্রাচীন।দারুন গোথিক স্টাইলে তৈরী, ঝকঝকে হলুদ, দূর থেকে দেখা যায়, কিন্তু…… পাশের সিনেমা হলটা বরং পুরোনো ছোপ লাগা।
মরিয়া হয়ে ওসব জোকু হিল টিল ছেড়ে লোয়ার বাজার, লক্কর বাজার লক্কা পায়রার মতো পাক দিলাম।আশা নিরাশায় সিমলা কখনো মন ভরালো, কখনো ভীষণ হতাশ করলো।অবশেষে সেই মায়াবী সন্ধ্যা আবার, তাড়াহুড়ো করে ফিরলাম হোটেলে, ওই গোধূলি কোলাজের সাক্ষী হতে।
দিনের কুশ্রী, গায়ে-গা-লাগা বাড়িগুলো তখন ভোল পাল্টে মায়ার খেলায় মেতেছে সোনালী জরিতে জড়িয়ে নিয়ে।হোটেল বলেছিলো সন্ধ্যায় ক্রিস্টমাস ইভ, ডাইনিংয়ে তাড়াতাড়ি আসবেন।
মন্দ কাটলোনা সে সন্ধে- গজল, বাচ্চাদের গান নাচে মাতলো তীব্র শীতের রাত।
কোনো এক সময়ে প্রচন্ড ঠান্ডায় সিগারেট খেতে ইচ্ছে হলো।হোটেলের কর্মচারীর নির্দেশে হোটেলের পেছনদিকের সুঁড়ি পথ ধরলাম, হঠাৎ খুঁজে পেলাম সেই গন্ধ।সার সার বাড়ি, কাঠ আর পাথরের, অন্ধকার, কুকুর, মিটমিটে আলো টপকে এগিয়ে চললাম নিশির ডাকে।ঠান্ডায় জড়োসড়ো সিমলা ঘুমোনোর আয়োজন করছে।নিখুঁত পুরোনো দৃশ্যের পুনর্নিমাণ।আধ ঘন্টা এলোপাথাড়ি আমি, সিমলা খানিক মান রাখলো।পুরোনো দোতলা, ব্রিটিশ কাঠের রেলিং, রংচটা লোহার চেয়ার, কোথাও সমবেত গান, হা-ক্লান্ত এক শহর তার ধড়াচূড়া ছেড়ে নগ্ন, নিরাভরণ কায়ায়……. মায়ায় জড়ালো।
সিমলাকে মায়াকাজল পরাতে গিয়ে আসলে ধেবড়ে দিয়েছে আধুনিকতা।
পুরোনো পাহাড়ি শহরে গেলে, ‘আবার আসবো’ বলে আসি আমি।দার্জিলিং তো বটেই, ডালহৌসীকেও কথা দিয়ে এসেছি।ফিরে ফিরে গেছি দার্জিলিং, কালিম্পঙ।প্রথম সুযোগেই আবার যাবো ডালহৌসি।
'এতো শব্দ এতো চিৎকার, তবু কি নিদারুন দৈন্য,
একই স্লোগানে নানা গন্ধ, তুমি কোথায় ছিলে অনন্য?'
তোমায় কথা দিতে পারলামনা।
স্যরি, সিমলা।……
Name: Subhamay Pal
Age: 48
Profession: State Civil Servant
City: Kalyani
Hobby: Story telling