তৃতীয় পর্ব
আজ ২৮শে আগষ্ট ২০১৭.....আজ আমরা যাবো ক্ষীরাও গ্রাম থেকে শেফারড ক্যাম্প।।
সারা রাত বজ্র বিদ্যুৎ সহ বৃষ্টি হয়েছে ক্ষীরাও তে।আজকেও তার কোন পরিবর্তন নেই, বৃষ্টি পড়েই চলেছে। সকাল ছটায় চা এসে হাজির। স্লিপিং ব্যাগের ভিতর থেকে বেরতে ইচ্ছা করছেনা। সাবজী উঠো চা পি লিজিয়ে। গা হাত পায় প্রচন্ড ব্যাথা। জিজ্ঞেস করলাম ক্যায়া হোগা? এইসা চলেগা তো আজ ইহাপে রূকনা পারেগা। কথা শেষ হতে না হতেই শুভজিতদার ডাক- তিলক কি হবে গো? গাইডজি বলল থোরা দের বাদ ডিসিশন লেনা হে। গৌতমদা আর অমিতাভদা চা খেলনা। বাইরে বেরনোর জো নেই। সকাল ৭ টার সময় ব্রেকফাস্টের জন্যে ডাক পড়ল। গায়ে রেইনকোটটা চাপিয়ে বাইরে বেরোলাম। একটু এগিয়ে গিয়ে খাওয়ার জায়গা। খেয়ে একটা ছোট আলোচনা সেরে আবার যে যার তাবুতে। মাথায় একরাশ চিন্তা। কি হবে? ঘড়ির কাঁটা তখন ৯ টা পেরিয়ে গেছে। আজ মনে হচ্ছে আর বেরোতে পারবনা। অবশেষে ১০ টার সময় বৃষ্টি থামল। কিন্তু আকাশের মুখ ভার। বেরতেই হবে, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব। ১০. ৩০ নাগাদ ব্যাগ গুছিয়ে বেরিয়ে পড়লাম শেফারড ক্যাম্পের উদ্দেশ্যে। সবুজে ঘেরা পথ উপরের দিকে উঠে গেছে। নীচ দিয়ে বয়ে চলেছে নদী। কখন যে আবার বৃষ্টি নামবে বোঝা মুশকিল। একটা ছোট চড়াই ভেঙে উঠে এলাম একটা রিজের উপর। রিজটা থেকে দেখা যায় ক্ষীরাও গ্রাম।সামনেই দেখা যাচ্ছে গ্রামের একটা মন্দির।চারিদিকে নানা রকমের ফুলে ভরে আছে। আর একটা অদ্ভুত গন্ধে মন মাতাল হয়ে উঠছে। এই রিজটা সোজা উঠে গেছে একটা পাহাড়ের মাথায়। বৃষ্টিতে রাস্তার হাল খারাপ।প্রানান্তকর খাড়া চড়াই ভেঙে আমরা উঠে এলাম পাহাড়ের মাথায়। সেখান থেকে যা দেখলাম সেটা ছিল একটা অন্য অনুভূতি। যত দুর চোখ যাচ্ছে শুধু সবুজের সমাহার। অনেক নীচ দিয়ে বয়ে চলেছে নদী, আর মেঘের সমুদ্র। তার মাঝখান দিয়ে সবুজের বুক চিরে পথ চলে গেছে বহু দুরে। দুরে দেখা যাচ্ছে ধোঁয়াশা পাহাড়।
হাতছানি দিয়ে ডাকছে, মনে মনে বলে উঠলাম আসছি তোমার কাছে। শুয়ে পড়লাম ঘাসের উপর। পিছন থেকে প্রেমজি আর গুমানজির ডাক সো গায়া কেয়া? আমি বললাম, কেয়া কারু যানে কা মন হি নেহি কার রাহা হ্যা। মিনিট দশেক বসার পর চলা শুরু করলাম স্বপ্নের পথে। সামনে সৈকতলাম, আর জীবনকে দেখতে পেলাম। ওরা দুপুরের খাওয়া সারছে। প্যাক লাঞ্চ ছিল আমাদের কাছে। রুটি, আপেল আর একটা ক্যাডবেরি। খেয়ে আবার পথ চলা শুরু। 2 ঘন্টা এরকম পথ চলার পর শেষ হল বুগিয়াল। আবার শুরু হল বৃষ্টি। মেঘে ঢেকে গেল চারিদিকে। বুনো গাছের জঙ্গলে ভরে আছে চারদিক। নানা রকমের ফুল ফুটে আছে তাতে। পিছনে তাকিয়ে দেখলাম অনেক দুরে দেখা যাচ্ছে শুভজিতদা আর গৌতমদা কে। আমার সাথে আছে অমিতাভদা। এবার একটা চড়াই ভাঙলাম, তারপরেই রাস্তা ঢুকে গেছে ওই বুনো গাছের জঙ্গলের ভেতর। আগে যারা গেছে তারা যে রাস্তা করে করে গেছে ভালোই বোঝা যাচ্ছে। মাথা হাইটের গাছ গুলো, এটা অদ্ভুত একটা পথ। পথের নিশানা দেখে পথ চলা। বৃষ্টি পড়ছে সমান তালে। প্রায় এক ঘণ্টা চলার পর শেষ হল এই রাস্তা। পথ হারানোর ভয় খুব এখানে। অমিতাভদা একটু ধীরে হাঁটছে। মেঘের জন্য সামনের রাস্তা ঠিক দেখা যাচ্ছে না। বিকাল ৪ টে বাজে। এখনো অনেক পথ বাকি। শুভজিত দা আর গৌতম দা ও এসে গেল। একবার ওঠা আবার নামা। এভাবেই চলতে থাকলাম। রাস্তা খুবই পিছল। কিছুক্ষন চলার পর প্রচন্ড জোরে বৃষ্টি নামল। আমরা চার জন বসে পড়লাম প্লাস্টিকের সিট মাথায় দিয়ে। 5 টা বেজে গেছে। অদ্ভুত একটা পরিবেশ চারিদিকে। মিনিট পনেরো পর বৃষ্টি থামলো। উঠে আবার চলা শুরু। ঘড়িতে ৫.৩০, দুর থেকে দেখা গেল দেবাশিস কে। হাত নেড়ে জানিয়ে দিল এসে গেছে আজকের ক্যাম্প।অমিতাভ দার পায়ের অবস্থা খুব খারাপ। সামনে পড়ল কাদায় মাখামাখি একটা খাড়া ঢাল। আছার খেলাম দুবার। তারপর ঘাসের গোড়াকে আকড়ে ধরে নিজেকে টেনে তুললাম। এভাবেই পৌছে গেলাম শেফারড ক্যাম্পে। ছোট এক ফালি জায়গা, কোন রকমে বানানো হয়েছে তাবু। সব ভিজে একাকার, স্লিপিং ব্যাগ গুলোও স্যাতস্যাতে। কিচেন তাবুর দিকে গিয়ে দেখলাম রান্না হচ্ছে। পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে একটা নদী। একটু ফ্রেশ হয়ে এসে চা আর বিস্কুট খেলাম। মাথাটা একটু ব্যাথা করছে। সন্ধা ৭ টা নাগাদ খাওয়া সেরে তাবুতে চলে এলাম। একটা তাবুতে চার জন কোন রকমে শুলাম। বৃষ্টি ও কমে গেছে এখন। সারা দিনের পথ চলার পর আবার কালকের জন্য অপেক্ষা।
২৯ শে আগস্ট ২০১৭ আজ যাবো সেফারড ক্যাম্প থেকে স্নাউট ক্যাম্প
সেফারড কাম্পে সারা রাত ঘুম হয়নি ভাল। চারজনে কোন রকমে শুয়েছিলাম। তার উপর স্লিপিং ব্যাগ পুরো ভেজা। সকাল 6 টায় ধর্মা চা নিয়ে হাজির। সাবজী চায়ে। উঠ যাও সাবজী জলদি। চা খেয়ে ব্যাগ গুছিয়ে নিলাম। বাইরে বেরোলাম তাবু থেকে। আজ ওয়েদার মোটামুটি ঠিক আছে। মেঘের আনাগোনা আছে, বৃষ্টি টা কমেছে। ৭ টার সময় প্রাতরাশের জন্য ডাক পড়ল। রুটি আর জেলি খেয়ে তাবু থেকে ব্যাগ বের করে নিলাম। সকাল ৮ টার সময় বেরিয়ে পড়লাম স্নাউট ক্যাম্পের দিকে। প্রথম দিকটায় সেই বুনো গাছের জঙ্গল। তারপর একটা হালকা চড়াই ভাঙতেই সবুজে ঘেরা বুগিয়াল। সরু সূতোর মত রাস্তা চলে গেছে বহুদুর। পাশে সব বড় বড় পাহাড় গুলো দৈত্যের মথ দাঁড়িয়ে আছে। কোথা থেকে আবার এটটা মেঘ উড়ে এসে ঢেকে দিল সবকিছু। হালকা বৃষ্টি শুরু হল আবার। আমার পিছনে আছে গৌতমদা। সামনে শুভজিতদা আর দেবাশিষ। সামনে প্রেমজী আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। কিন্ত কেন? একটু এগিয়ে গিয়ে দেখি রাস্তা পুরো ধ্বসে গিয়ে মিশেছে ক্ষীর গঙ্গার সাথে। নিচ দিয়ে প্রবল বেগে বয়ে চলেছে ক্ষীর গঙ্গা নদী। প্রেমজী অতি সাবধানে হাত ধরে পার করিয়ে দিল সেই জায়গা। সামনে পড়ল একটা পাহাড়ি ঝোড়া। ঝোড়া টা টপকিয়ে একটা বাঁক ঘুরতেই দুরে দেখা গেল পানপাতিয়া স্নাউট। দেখা যাচ্ছে নাম না জানা কত শৃঙ্গ। বৃষ্টি টা কমে গেল। আমরা সঙ্গে থাকা প্যাক লাঞ্চ বের করে খেয়ে নিলাম। রুটি সাথে তরকারি, খেঁজুর আর একটা ক্যাডবেরি। পাহাড়ের উপর দিকের বুগিয়ালে নজর যেতেই দেখি একপাল ভেড়া চরে বেরাচ্ছে। কিছুক্ষন বসলাম সেখানে। মেঘ রোদের লুকোচুরি চলছে সারা বুগিয়াল জুড়ে, আর মাঝে মাঝে মেঘের ফাঁক দিয়ে উঁকি মারছে শৃঙ্গরাজী। মনটা হারিয়ে গেল অন্য এক জগতে। হঠাৎ শুভজিতদার ডাক তিলক চল!!! আবার উঠে চলা শুরু। আমরা আস্তে আস্তে প্রবেশ করছি সবুজের রাজত্ব ছেরে পাথরের রাজত্বে। দূরে পিঙ্কু দা কে দেখলাম বসে আছে একটা পাহাড়ের মাথায়। আমাদের বলল ওই দিক দিয়ে আয় , গৌতম দা অনেক আস্তে হাঁটছে। তাই একটু ধীরেই চলছি। বড় বড় বোল্ডার টপকে উঠে এলাম উপরে। দূরে দেখা গেল পিঙ্কুদা চেছাচ্ছে, কি ব্যাপার??? শ্রিয়ন্ত আটকে পড়েছে একটা ধ্বসা জোনে। ও আর এগতে পাচ্ছেনা। ওর পা কাঁপছে থর থর করে। অনেক নীচে সেই ক্ষীর গঙ্গা বয়ে চলেছে। প্রেমজি নিজের জীবন বাজি রেখে খাদের কিনারায় ঝুলে শ্রীয়ন্তকে বের করল। আমরা তখন কিছুটা পিছনে দাঁড়িয়ে দেখছি সেই দৃশ্য। আমাদের ও এখন ওটা পেরতে হবে। কোন রকমে হাচড়া তে পাচড়াতে প্রায় হামাগুড়ি দিয়ে খাদের ধারে ঝুলন্ত অবস্হায় পেরিয় গেলাম সেই জায়গা। নীচে তাকালেই বুক শুকিয়ে যায়। আবার শুরু হল বৃষ্টি, একটা চড়াই ভাঙতেই দেখা গেল স্নাউট ক্যাম্প। স্নাউট মানে হলো একটা হিমবাহের শেষ প্রান্ত। তাবু পড়েছে আমাদের। স্নাউট ক্যাম্পের উচ্চতা প্রায় 4000 মিটার। পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে ক্ষীর গঙ্গা নদী। বাঁ পাশ দিয়ে উঠে গেছে পাথরের দেওয়াল। ডান দিকে পাহাড় গুলো দেখে মনে হয় এখুনি ধ্বসে পড়বে। অনবরত পাথর ভাঙার শব্দ হচ্ছে। গরম চিকেন স্যুপ এসে হাজির। অসাধরন সুন্দর একটা জায়গা। দুরে উঁকি মারছে বরফ শিখর। মন ভোলান দৃশ্য। দেখা যাচ্ছে আমাদের আগামী দিনের পথ। সবুজের লেশ মাত্র নেই। শুধু ধূসর পাথর। সময় এখন 3.30। আজকের রাস্তা ছিল সব থেকে আরামদায়ক। সন্ধ্যা হতে এখন ও বাকি অনেকটা সময়। তাই ক্যামেরা নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম ছবি তুলব। এখানে আমরা পূজা দেব। প্রেয়ার ফ্ল্যাগ রেডি হচ্ছে। আমরা সবাই যাত্রার শুভ কামনা করে সবাই মিলে তাবুতে ঢুকে চুটিয়ে আড্ডা। সঙ্গে চা আর পাপড় ভাজা। যেন অমৃত। বাইরে ঠান্ডার প্রকোপ ক্রমশ বারছে । হাওয়া চলছে খুব। দেখতে দেখতে বেজে গেল পাঁচটা। দুরের পাহাড় গুলো আসতে আসতে মুখ ঢাকছে, ভ্যলি জুরে নিস্তব্ধতা গ্রাস করছে। ক্ষীর গঙ্গার তীব্র গরজন। পিছনের সবুছ ভ্যালিটায় অন্ধকার নামছে। তাবুতে ঢুকলাম একটু রেষ্টের জন্য। চোখটা বুজে এল কিছুক্ষনের জন্য, বাঁশির আওয়াজে ঘুম ভাঙতেই দেখি বাইরে পুরো অন্ধকার। ডিনারের ডাক পড়েছে। মাথায় হেড ল্যাম্প লাগিয়ে খেতে গেলাম। খাওয়া দাওয়া সেরে রাত ৮ টার মধ্যে যে যাযর তাবুতে। আমি গৌতম দা আর অমিতাভ দা এক তাবুতে। স্লিপিং ব্যাগ খুলে শুয়ে পড়লাম আগামীর অপেক্ষায়।
পানপাতিয়া কল অভিযান ২০১৭
চতুর্থ পর্ব
আজ ৩০ শে আগস্ট যাবো স্নাউট ক্যাম্প থেকে মোরেন ক্যাম্প
সাবজী চায়ে! চায়ের কাপ হাতে নিয়ে বাইরে বেরোলাম। ঝকঝকে পরিবেশ। শিখর চূড়া গুলো সব ঝকঝকে করছে, সঙ্গে হিমেল হাওয়া। দুরে আমাদের আজকের পথ দেখা যাচ্ছে। শুধু পাথর আর পাথর। আমরা আছি 4000 মিটার উচ্চতায়, যাব 4700 মিটার উচ্চতায়। প্রাতরাশ সেরে ব্যাগ গুছিয়ে বেরিয়ে পরলাম। সকাল ৮ টা, পাথুরে রাস্তা উপরের দিকে উঠে গেছে। পাশের পাহাড় থেকে খসে পড়ছে পাথর সবসময়ই। কানে আসছে গ্ল্যাসিয়ার ভাঙার শব্দ। আমরা যেখান দিয়ে হেঁটে চলেছি সেটা একটা আস্ত গ্ল্যাসিয়ার। পুরু বরফের আস্তরন। তার উপরে মোরেন আর বোল্ডারের ছড়াছড়ি। সব বয়ে নিয়ে চলেছে ওই গ্ল্যাসিয়ার। কিছুক্ষন বসলাম রেষ্টের জন্য। দু চোখ ভরে দেখছি হিমালয়ের অপার সৌন্দর্য। আবার চলা শুরু। গাইড বলল ইহাতে যাদা দের মত রুকো, এ পুরা রক ফল জোন হ্যা!! কাব উপারসে পাথর গিরাগে পাতা নেহি হ্যা। শুভজিত দা বলল চল তাড়াতাড়ি এখান থেকে, বলা মাত্র পাশের পাহাড় থেকে হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়ল বিশাল বিশাল সব পাথর। হাঁড় হিম করা দৃশ্য। উঠে এলাম একটা রিজের উপর। মাথা তূ্লে দাঁড়িয়ে আছে একের পর এক কত নাম না জানা শৃঙ্গ। ওয়েদার খারাপ হতে লাগল বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে। মেঘ এসে ঢেকে দিল পুরো ভ্যালিটা। শুরু হল টিপ টিপ করে বৃষ্টি। থামলে চলবেনা, সামনে যে তুষার সাম্রাজ্য। যেতে আমাদের হবেই। বৃষ্টির মধ্যেই একের পর এক বোল্ডারের রিজ টপকে চলেছি। রাস্তা বলে কিছু নেই। বৃষ্টিতে অবস্থা আরো খারাপ । একটু করে এগচ্ছি আর বসে পড়ছি। মোরেন আর নুড়ি পাথর গুলো বৃষ্টির জলে কাদায় পরিনত হয়েছে। পা ফেলছি আর স্লিপ খেয়ে নেমে যাচ্ছি নিচে। অমিতাভদা আর গৌতমদার অবস্থা আরো খারাপ। শুভজিতদা বলল তিলক দাঁড়াও!!! কত গুলো যে রিজ টপকালাম কে যানে!! পায়ে কোন সার নেই। বৃষ্টির কোন বিরাম নেই।।। অঙ্কিতের অবস্থা ও খারাপ। ও ঘাবড়ে গিয়ে কাঁপতে লাগল থর থর করে। বসে পড়ল মাটির উপরেই। পা ফেলতেই ভয় পাচ্ছে ও। ওকে বললাম ইয়ার উঠো থোরা দুর হাম লোগোকা ক্যাম্প!!!! অঙ্কিত বলল ও ক্যাম্প আ গায়া??? চোখ পুরো লাল হয়ে গেছে ওর। আমরা তখন বৃষ্টিতে পুরো ভিজে। শুভজিতদা আর দেবাশিষ তখন আরেকটা রিজের উপর বসে আছে। একজন পোর্টার এগিয়ে এসে অঙ্কিতের হাত ধরে টেনে নিয়ে চলল। সামনে আবার একটা রিজ। প্রায় হামাগুড়ি দিয়ে উঠে এলাম রিজটার উপরে। সামনে শুভজিতদা বসে। রিজটার উপর থেকে দেখা গেল অনেক দুরে কে একজন ইশারা করছে। মনে হয় আর বেশী বাকি নেই। মনে জোর পেলাম। একটা পা এগিয়ে ছি সবে পা পিছলে নেমে গেলাম অনেকটা নীচে। সবাই ভয় পেয়ে গেল। না কিছু হয় নি!! উঠে এলাম উপরে। আসতে আসতে অন্ধকার নেমে আসছে। সামনে আরেকটা রিজ। উঠে এলাম রিজের উপর। ওই রিজাটার উপরে উঠতেই দেখা গেল আমাদের তাবু। আর একটা রিজ টপকালেই আমাদের আজকের ক্যাম্প। সময় এখন সন্ধ্যা 6 টা। আলো আবছায়া র মধ্যে টলতে টলতে এসে পৌঁছলাম মোরেন ক্যাম্প। ডান পাশ দিয়ে উঠে গেছে ভঙ্গুর পাহাড় আর বাম দিকে সেই বিশাল গ্ল্যাসিয়ার। ক্যাম্প এ এসে গরম চা আর বিস্কুট। ধরে প্রাণ ফিরে পেলাম। তাবুতে না ঢুকে বাইরে ঘুরে বেরালাম কিছুক্ষন। মাথা প্রচন্ড ব্যাথা। রাতে ডিনার কোরলামনা। একটু জুইস খেয়ে শুয়ে পড়লাম। আগামী কাল আমাদের রেষ্ট ডে। রাতের বেলায় নামল প্রচন্ড বৃষ্টি , সঙ্গে বিদ্যুৎ ঝলকানি আর বাজ পড়ার বিকট আওয়াজ। দুর থেকে ভেসে আসছে এভালেঞ্চ এর আওয়াজ। বৃষ্টির এত তোড় যেন তাবু ফাটিয়ে দেবে। সে এক বিভৎস রাত। আগামী কাল আমাদের রেষ্ট ডে। রাত ৮ টার মধ্যে ঘুমিয়ে পড়লাম।
৩১ শে আগস্ট রেষ্ট ডে মোরেন ক্যাম্প
সারা রাত প্রবল বৃষ্টি আর বিদ্যুৎ ঝলকানি এবং সঙ্গে অনবরত এভালেঞ্চের শব্দে ঘুম হয়নি ঠিকঠাক। এক রাশ আশঙ্কায় রাত কাটিয়েছি। খালি মনে হয়েছে এই বুঝি সব ভাসিয়ে নিয়ে চলে যাবে। জনহীন হিমালয়ের গহনে আমরা কজন জীব এক অভাবনীয় রাত কাটালাম। রোজকার মত সকাল ৬ টায় আজ আর চা এলনা, কারণ আজ আমাদের রেষ্ট ডে। ঘুম ভেঙে গেল সকাল ৬ টায়। অভ্যাস হয়ে গেছে যে। বাইরে বেরলাম, আবহাওয়া পরিষ্কার আছে মোটামুটি। সামনে দেখা যাচ্ছে নীলকন্ঠ শিখর। ক্যামেরাটা বের করলাম, অনেকদিন পর আজ রোদের দেখা পেলাম। মিঠে রোদে বসে থাকলাম কিছুক্ষন, তারপর চা আর প্রাতরাশ সেরে বেরলাম ক্যামেরা নিয়ে। আমাদের গাইড প্রেম জী বলল আজ আপ লোগ কো ডেমো হোগা জুমারিং অর রেপলিং কা!!! সব লোগ স্যাক রেডি কার লো। ৯ বাজে নিকালনা হ্যা। এখনো এক ঘন্টা সময় আছে, আর কিছুক্ষন ক্যামেরা নিয়ে চলল ছবি তোলা। শুধু বোল্ডার আর বোল্ডার, অনবরত পাথর গড়িয়ে পড়ছে পাশের পাহাড় গুলো থেকে।
বেলা যত বাড়ছে মেঘের আনাগোনা তত বাড়ছে। তাই দেরি না করে স্যাক নিয়ে চললাম কাছের একটা আইস ওয়ালে জুমারিং আর র্যাপলিং এর ডেমো দেখতে। ঘন্টা খানেকের পথ সোজা বড় বড় বোল্ডার আর গ্লেসিয়ার টপকে চলে গেছে অনেক নীচে। অনবরত কানে আসছে গ্লেসিয়ার ভাঙার শব্দ। একটা বিরাট এভালেঞ্চ হল , টন টন বরফ খসে পড়ল পাহাড়ের গা দিয়ে। ভয়ঙ্কর সে দৃশ্য। রোপ ফিক্সড করে আমরা সবাই একবার করে প্র্যাকটিস করলাম। ঘন্টা দুই কাটানোর পর এবার ক্যাম্প সাইটে ফেরার পালা। এ এক দারুন রোমাঞ্চ। ক্যাম্পে এসে কিছুক্ষন বিশ্রাম নিয়ে দুপুরের আহার সারলাম ভাত, সবজি আর সোয়াবিন সহযোগে। আর কোন কাজ নেই , সবাই মিলে চলল চুটিয়ে আড্ডা আর এদিক ওদিক ঘুরে বেরানো। বিকেলের দিকে বসল গানের আসর, হাঁসি ঠাট্টা মজায় কি ভাবে জে সময় চলে গেল বোঝা গেলনা। আসতে আসতে অন্ধকার নামছে নিশ্চুপ নীরালা পাহাড়ে। কেমন যেন একটা মায়াবি পরিবেশ। দুরের পাহাড় গুলো ঢেকে যাচ্ছে মেঘের আড়ালে। হিমশীতল হাওয়া বয়ে যাচ্ছে, সারা শরীরে এক অদ্ভুত রোমাঞ্চ জেগে উঠছে। বসে বসে দেখছি হিমালয়ের অপার সৌন্দয। সন্ধ্যায় চা আর পাপড় ভাজা খেয়ে চলল কালকের পথ নিয়ে আলোচনা।। বৃষ্টি শুরু হল আবার, মাথায় আবার গভীর চিন্তা ঢুকে গেল। 7 টার সময় ডাক পড়ল ডিনারের। বৃষ্টির মধ্যেই খাওয়া সেরে এসে তাবুতে ঢুকলাম। বাইরে তখন প্রচন্ড ঠান্ডা। কিছুক্ষন আড্ডা মেরে এবার ঘুমানোর পালা।। চিন্তা রয়ে গেল বৃষ্টি নিয়ে। বৃষ্টির কথা মাথায় নিয়ে ঘুমাতে গেলাম আগামীর অপেক্ষায়।।
১ লা সেপ্টেম্বর মোরেন ক্যাম্প থেকে পার্বতী গলি বেস ক্যাম্পরাতের বেলা একটু বাইরে বেরিয়েছিলাম। তখনো টিপ টিপ করে বৃষ্টি পড়ছে। রাতের গভীর অন্ধকার ভেদ করে কানে আসছে পাথর ভাঙার শব্দ। প্রচন্ড ঠান্ডা তাই বেশিক্ষন দাঁড়ালামনা, তাবুতে ঢুকলাম। ঘড়ির কাঁটায় তখন রাত ১টা। শুয়ে পড়লাম আবার। ঘুম ভাঙল সকাল ৬টা, সাব জী চায়ে!!! প্রতীদিন ওই একই সময়ে আমাদের ঘুম থেকে তুলে দেওয়া, ওদের আন্তরিকতা, সরল মানসিকতা নিয়ে সবার সাথে মেশা, ওরাই তো সব…. ওই সাব জী ডাকটা হৃদয় ছুঁয়ে যায়। চা খেয়ে জিনিস পত্র গুছিয়ে নিয়ে বাইরে বেরলাম।। আবহাওয়ার কোন পরিবর্তন নেই। ঘন মেঘের ঘনঘটা, সামনে কিছুই দেখা যাচ্ছে না। সকাল ৭ টায় প্রাতরাশ সেরে নিলাম। সারে সাতটা নাগাদ বেরলাম পার্বতী গলির উদ্দেশ্যে। আমরা এখন আছি 4300 মিটার উচ্চতায়। আমরা যাব 4800 মিটারে। বৃষ্টি মাথায় নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। বড় বড় বোল্ডার আর নুড়ি পাথরের উপর দিয়ে রাস্তা। রাস্তা বললে ভুল হবে।
আমি , শুভজিতদা, দেবাশিষ, অমিতাভদা আর গৌতমদা একসাথে চলছি।। একটার পর একটা রিজ পেরচ্ছি আর বসে পরছি। দুরে দেখা যাচ্ছে শুধু পাথরের স্তূপ। আমরা একে অপরের মুখের দিকে তাকাচ্ছি শুধু। আর কত এরকম রিজ পেরতে হবে বুঝতে পারছিনা। অমিতাভ দার পায়ের অবস্থা খুব খারাপ। বৃষ্টিটা একটু কমেছে, কিন্তু এইরকম ভেজা পরিবেশে হাঁটতে খুব কষ্ট হচ্ছে। প্যাক লাঞ্চ সাথেই আছে আমাদের, কিন্তু খাওয়ার কোন ইচ্ছে নেই। একটা ক্যাডবেরি খেয়ে হাঁটা লাগালাম। সামনে দেখা যাচ্ছে শিপটন কল আর বরফের দেওয়াল। আমরা ওই পথে যাবনা। আমাদের রাস্তা ডান দিকে । দেখা যাচ্ছে সেই পানপাতিয়া আইস ফল।। ওই পথেই আমরা যাব। আমরা এখন দাঁড়িয়ে আছি একটা রিজের উপর, এখান থেকে নেমে জেতে হবে পানপাতিয়া আইস ফলের উপর। অনেকটা নীচে।। নেমে গেলাম সেখানে।। পায়ের তলায় পুরু বরফের আস্তরন।
সব ঠিক চলছিল, হঠাৎ ঘন কালো মেঘ ঢেকে দিল পুরো জায়গাটা। সামনে কিছুই দেখা যাচ্ছেনা। শুরু হল বৃষ্টি আর সঙ্গে হিম শীতল হাওয়া, একটা অদ্ভুত শীহরণ খেলে গেল সারা শরীর জুরে।। সবাই রিজ থেকে নামার পর একটা রোপ বানিয়ে একসাথে চলতে বলল গাইড জী।। সামনে অজানা ভবিষ্যত।। বিশাল বড় বড় সব ক্রিভাস পাশ কাটিয়ে চলেছি। এক একটা মৃত্যু ফাঁদ । পায়ের তলায় মচমচে বরফের শব্দ। বরফের দেওয়াল টা টপকানোর পর যেখানে পৌছলাম তা দেখে আমরা তো ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকলাম একে অপরের দিকে। যেতে তো হবেই, সামনেই যে অপেক্ষা করে আছে তুষার সাম্রাজ্য, আর সেই সাম্রাজ্যের রাজা বিশাল চৌখাম্বা।।। উফফ!!! পা যেন আর চলছেনা, আমাদের উঠতে হবে একটা 300 ফুট রক ফল জোন বেয়ে।। 20 হাত দুরের রক ওয়াল থেকে অনবরত পাথর পড়ছে। আমরা যেখান দিয়ে উঠব সেটা পুরো লুজ বোল্ডার জোন, পাথরের উপর পা দিচ্ছি আর নরে উঠছি। নীচে বয়ে চলেছে সেই ক্ষীর গঙ্গার হিম শীতল জলরাশি আর হা করে আছে বড় বড় ক্রিভাস।সবার আগে আছে গাইড গুমানজি আর প্রেমজি। বৃষ্টি ও পরে চলেছে সমান তালে, ভিজে পুরো যা তা অবস্হা।সব যেন কেমন তাল গোল পাকিয়ে যাচ্ছে বুঝতে পারছি। হঠাৎ গুমানজী বলল ইধার সে রাস্তা নেহি হে।সবাই তো হতবাক!!!! তারপর একটা চিৎকার কানে ভেসে এল সব লোক পাথর কে আন্দার বেঠ যাও, পাথর গির রাহা হে!!!!! যে যেখানে ছিলাম সেখানেই বসে পড়লাম।। একটা বিশাল সাইজেরপাথর সাথে কাদা মাটি নিয়ে শুভজিতদার গা ঘেসে বেরিয়ে গেল সেই সময় পাশের 10 হাত দুরের দেওয়াল থেকে বিভৎস শব্দে খসে পড়ল বিশাল সাইজের পাথর আর তলিয়ে গেল হাঁ করা ক্রিভাসের ভীতর।। সে এক বীভৎস দৃশ্য, সারা শরীর তখন থর থর করে কাঁপছে।। উঠে দাঁড়ানোর ক্ষমতা নেই। কিছুক্ষন ওই ভাবেই বসে থাকলাম।। গুমানজী উপর থেকে নেমে ডান দিকের পাহাড়ের গা বেয়ে একটা রাস্তার দিকে এগিয়ে গেল, বলে গেল মে যাব বলুঙ্গা তাব আনা, পুরো একটা ধ্বসা পাহাড়, ওটার গা বেয়ে যেতে হবে আমাদের।। গুমানজী দুর থেকে আওয়াজ দিল আ জাও, আমরা যাব কি বসে থাকলাম চুপচাপ।। আমার হাঁটুতে প্রচন্ড টান লাগছে, গুমান এগিয়ে এসে সৌরভদার হাত টা ধরল , তার পিছনে আমি পা টেনে টেনে চলতে লাগলাম। আমার পিছনে হেমন্ত।। এই জোনটা পেরনোর পর পড়ল পার্বতী গলির সেই বিশাল দেওয়াল। প্রায় 60 ডিগ্রি মত হবে। অনেক উঁচুতে একটা রিজের উপর উঠতে হবে এই দেওয়াল টপকে।। আমি বসে পড়লাম, পা যন্ত্রনায় ছিঁড়ে যাচ্ছে। বৃষ্টির কোন বিরাম নেই। কিছুক্ষন তাকিয়ে বসে থাকলাম উপরের দিকে। না যেতেই হবে!!! উঠে আবার পা টেনে টেনে চলতে লাগলাম। একটু উঠছি আর দাঁড়িয়ে পড়ছি, প্রচন্ড স্লিপ করছে পা।দুরে সবাইকে খুব ছোট লাগছে। অনেক দুর এগিয়ে গেছে ওরা। আমার পিছনে আছে হেমন্ত, সামনে গৌতমদা আর অমিতাভদা। আমি মিডিলে। কি করে পৌছাব ভেবেই পাচ্ছিনা। রিজের উপর থেকে কে একটা ইশারা করে বলল ক্যাম্প দেখা যাচ্ছে। মনে সাহস পেলাম কিছুটা। ওই ভাবেই পা টেনে টেনে এগোতে লাগলাম।।। এদিকে অন্ধকার নামছে খুব তাড়াতাড়ি।। পার্বতী গলির রিজের উপরে কোন রকমে উঠে এসেছি কঠিন ৭০ ডিগ্রি খাড়া ঢাল পেরিয়ে। কিন্তু রিজের উপর উঠেই যেন কেমন সব তালগোল পাকিয়ে গেল। আমার পিছনে হেমন্ত আর তার কিছুটা আগে আমি। বৃষ্টি পড়ছে অঝোরে। দূরে আমাদের তাবু দেখা যাচ্ছে কিন্তু এগোতে পারছিনা। হেমন্তকে দেখলাম রিজের উপরেই একটা পাথরের উপর হেলান দিয়ে শুয়ে পড়ল। আমি ডাকলাম হেমন্ত আ জাও !! কোন সারা পেলামনা। আমিও টলতে টলতে কিছুদূর গিয়ে পাথরের উপর হেলান দিয়ে আকাশের দিকে মুখ করে শুয়ে পড়লাম। দু পাশে নেমে গেছে গভীর খাদ। আমার সারা শরীর কাপছে থর থর করে। কিন্তু ওখান থেকে এগোতে পারছিনা কিছুতেই। বৃষ্টি তে ভিজিয়ে দিচ্ছে সারা শরীর, দুর থেকে আওয়াজ ভেসে আসছে আমার নাম ধরে কেউ ডাকছে কিন্তু আমি আওয়াজ দিতে পারলাম না। প্রায় ২০ মিনিট শুয়ে ছিলাম ওইভাবেই। হঠাৎ কে একটা আমার পিঠের স্যাকটা খুলে নিল আর হাতটা ধরে টেনে তুলে নিল। সত্যি ওরা ভগবান। আমার পায়ে কোন সাড় ছিলনা। কোন রকমে টলতে টলতে রিজ থেকে নেমে যখন তাবুতে ঢুকলাম তখনও আমার কোন হূশ ছিলনা। রাতের খাবারও খেলামনা।। কখন যে ঘুমিয়ে পরেছি নিজেই জানি না।
পানপাতিয়ার কল অভিযান ২০১৭
আগামি সংখ্যায় সমাপ্য
Name- Tilak Pal
Age- 30
Profession- Business
City- kolkata
Hobbies- Trekking
Previous Tours- Deoria tal, Uttarakhand