Tripsee Treks  and Tours LLP
Blog and Travel with Us

রুইনসারা তাল ( প্রথম পর্ব )



Nilay Chatterjee Nilay Chatterjee

বার বার ফোন করছি , ধরছে না। মাথাটাও গরম হচ্ছে। ওরে ফোনটা ধর না, মনে মনে বলছি। এদিকে বাইরে বৃষ্টি আর থামছেই না। সকাল ৬টায় বেরুবার কথা ছিল এখন ঘড়িতে বেলা ১ টা। হ্যাঁ, এবার ফোন ধরল কল্যান, ঘুম জড়ান গলা। ‘যা বৃষ্টি, একটু ঘুমিয়ে পরেছিলাম। কি করবি বল?’ – কি করবো মানে? আমি রেগেমেগে বললাম। মালপত্র সব রুকস্যাকে বাঁধা শেষ, স্যাডল ব্যাগ ও রেডি, বাইক , ও আনুসাঙ্গিক যন্ত্রপাতি সব ভরা হয়ে গিয়েছে। এখন ব্যাটা বলে কিনা কি করবি? যাইহোক ঠিক হোল আমরা বেরুব , যত দেরিই হোক। ৩টে পর্যন্ত দেখব বৃষ্টি থামে কিনা , না থামলে বৃষ্টিতেই বেরুব।সময় আর কাটে না, ২টো নাগাদ বৃষ্টি একটু কমল।সঙ্গে সঙ্গে কল্যানকে ফোন। ওরে চল, এবার রাস্তায় নাম। ঠিক হল , ডানকুনি টোলে আমরা হাজির হব ঠিক ৩টার সময়। ওমা, রাস্তায় বেরুতে দেখি সব জায়গায় জল জমে গেছে। এখন বেরিয়ে তো পরেছি আর চিন্তা করে কি হবে, নিজেকেই বললাম। ৩টের একটু আগেই আমি পৌছে গেছি। যা! , খেয়াল পড়ল তাড়াহুড়ায় সন্দেশের প্যাকেটটা ফেলে এসেছি। ভেবেছিলাম রাত্রে খাবো, জলভরা সন্দেশ। মনের দুঃখ কাটতে না কাটতেই দেখলাম কল্যান আসছে। যথারীতি পাকামো করে কোন গার্ড পরেনি। বাইকে দুরপাল্লায় যেতে হলে যেগুলি একান্তই জরূরী। দেখি একটা বাজারের ব্যাগে সেগুলো ঝুলিয়ে বাবু এসেছেন। বকাবকি করে সেগুলো পরালাম। তার পর গলা ছেড়ে হেসে বললাম এবার “সোয়াইক গেল যুদ্ধে”। বুঝতে পারছি আমার ওই রকম বিচ্ছিরি হাসি শুনে কল্যানের গা, পিত্তি জ্বলছে, কিন্তু রাগ চেপে বলল , আর ন্যাকামো করতে হবে না এবার চল। ঠিক হোল আজ রাত্রিবাস আসানসোলে।

ডানকুনি পেরোতেই টপ গীয়ার। ঘড়িতে ৩.১০। বৃষ্টি হয়ে যাওয়াতে চারপাশ সবুজে সবুজ। কোথায় বাড়ি বসে তেলেভাজা আর মুড়ি মেখে বসব তা নয় রাস্তায়। মানুষের শখ বলিহারী। নিজেই মনে মনে বললাম।হুশ করে সিঙ্গুর যে কখন পার হয়ে গেল খেয়ালই করলাম না। শক্তিগড় আসতেই কেমন যেন বাইক নিজে থেকেই থেমে গেল। ল্যাংচা ডাকছে। মহানন্দে খাওয়া দাওয়া করে আবার রাস্তায়। আলোচনা করে ঠিক করলাম সোজা পানাগড় গিয়ে দাঁড়াব। তাই হল। পানাগড় গিয়ে মনে হোল , দার্জিলিং মোড়’ থেকে ডান দিকে ঘুরে কিছুটা গেলেই “ইছাই ঘোষের” “দেউল’। কিরে কল্যান যাবি নাকি? উত্তরে, বাইকে স্টার্ট দিয়ে সোজা এগিয়ে গেল সে। আজ যে রাত্রিবাস আসানসোলে।

আরে বলতেই তো ভুলে গেছি আমাদের প্লান কি। আসলে আমরা যাব কলকাতা থেকে দেরাদুন এবং সেখান থেকে একটা ছোট্ট ট্রেক “ রুইনসারা তাল”।

route-map

রুট ম্যাপ

দেখতে না দেখতেই দুর্গাপুর চলে এল। মসৃন রাস্তা এবার একটু টোল খেতে আরম্ভ করেছে। কিছুদুর অন্তর অন্তর ডাইভারশন । শিল্পনগরী বড় বড় চুল্লীতে তার উপস্থিতি জানান দিচ্ছে।আকাশে কারখানার ধোঁয়া। অনেক কিছু হারালেও এখন ও দুর্গাপুর বেঁচে , শপিং মল হাইওয়ের উপরে তার প্রমান দিচ্ছে।দুর্গাপুর ছাড়িয়ে অন্ডাল মোড়ের কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে গেলাম দুজনে। এখানে আবার কি রে – কল্যাণ বলল। ওরে বেড়ানো মেনে কি কেবলি বেড়ানো ? খাবার দাবারও খেয়ে দেখতে হবে। তুই এখানে দাঁড়া আমি আসছি। অন্ডাল মোড় থেকে বামদিকে যে রাস্তা তা চলে গেছে সেটা অন্ডাল রেল স্টেশনে যাবে।ওই রাস্তায় একটা মিষ্টির দোকান থেকে কিনলাম গরম অমৃতি। তবে লাল বা কমলা রঙের নয় , কালচে রঙ, কড়া করে উপরটা ভাজা। কামড় দিলেই ... আহ !। এই অঞ্চলের বাইরে এই অমৃতি আমি কোথাও খাইনি। কল্যাণকে দিতেই কোন কথা না বলে একদম মুখের মধ্যে চালান করে , এক কামড় দিয়েই বলে উঠল আহা ! বেঁচে থাক ভাই।সন্ধ্যা অনেক আগেই নেমেছে। কোলিয়াড়ি এলাকা । দূরে মাঠের মধ্যে থেকে আগুন জ্বলছে , কিছুই নয় ঐগুলো কয়লা পোড়াচ্ছে। বাতাসে ধোঁয়ার গন্ধ। দোষটা আমারই। হাইওয়ে থেকে আসানসোল ঢোকার অনেকগুলো রাস্তা আছে। আমি একদম প্রথমটাতে ঢুকে পড়েছিলাম। এতে অসুবিধা হল এই যে আমরা চাইছিলাম এমন একটা হোটেল যেটা কিনা হাইওয়ের ধারে অন্তত কাছাকাছি থাকবে এবং বাইকদুটি সুরক্ষিত থাকবে। অনেক খুঁজে এবং পুরো শহর ঘুরে অবশেষ এ ঠাই মিলল। যথারিতী কল্যাণ বলতে আরম্ভ করল এইটা কোন হোটেল হোল, তুই যে কি করিস! আমি বললাম ওরে রাস্তায় বেড়িয়ে ঘরের সুখ কোথাও পাবি না।

hotel asansol

​আসানসোলের হোটেল

কল্যাণ একজন অভিজ্ঞ ট্রেকার। ওর মুখ থেকে একথা আশা করিনি। বকুনি দিলাম একটু। কাল সকালেই বেড়িয়ে পড়ব। যাব বেনারস।প্রায় ৪৭৫ কিমি রাস্তা।সকাল ৫ টায় ঘুম থেকে উঠেই আবার তাড়া লাগাতে শুরু করলাম। টার্গেট ৬ টা। বাইকগুলো একটু পরিস্কার করে নিয়ে কেবল চা খেয়েই বেরিয়ে পড়লাম। চল চল, রাস্তায় কোথাও খেয়ে নোব। অনিচ্ছা সহকারে সে বাবু রাজী হলেন। কয়েক মিনিটের মধ্যেই আবার হাইওয়ে। ফাকা রাস্তা। মসৃন। খোলা হাওয়া। নতুন সকাল। এবার কেবল এগিয়ে চলা।

rupin-pass-tripsee

dhanbad

আস্তে আস্তে প্রকৃতির পরিবর্তন শুরু হল। সামান্য উচু নিচু রাস্তা। সবুজের হাতছানি। চার দিকে ছোটখাটো টিলা। আস্তে আস্তে পেরিয়ে এলাম নিরসা,ধানবাদ, পরেশনাথ এর কোল দিয়ে জংগলের বুক চিরে রাস্তা। দিনের বেলাতেই নিঝুম রাস্তা। একঝাক টিয়াপাখি ট্যাঁ ট্যাঁ ডাকতে ডাকতে উড়ে গেল। আমি আগে আগে আসছিলাম, কল্যাণ পিছনে। বাইক আস্তে করলাম, অ কাছে আসতে বললাম, একটু দাঁড়াই। ব্যাগ থেকে কেক বার করে ওকে দিলাম।আমিও খেলাম। চারপাশ দেখে কল্যাণ ও চুপ। কথা বেমানান এখানে। মাঝে মাঝে ট্রাকের শব্দ। পোড়া ডিজেল এর গন্ধ জংলী গন্ধ কে চাপা দেওয়ার চেষ্টা করেও অসফল। আরেকটু এগলেই বারথি। গঞ্জ শহর। হাজারিবাগ নাশ্যানাল পার্ক এখান থেকে ১৮ কিমি, আর তিলাইয়া ড্যাম ১৭ কিমি। আমরা পেরিয়ে এসেছি প্রায় ১৮০ কিমি রাস্তা। এবার একটু রেষ্ট না নিলেও চলছে না। একটি চায়ের দোকানে দাড়ালাম। পুরি সবজি খাবি? আমি জিগ্যেস করলাম। এমনভাবে কল্যাণ ঘাড় ঝাকালো যে ঘাড় খুলে যাওয়ার জোগাড়। বললাম কাছেই বরাকর নদী, যাবি নাকি। মুখে কোন তাপ উত্তাপ নেই। গম্ভীর ভাবে বলল, অনেক হয়েছে, এবার চল। সুতরাং এগিয়ে চলা। প্রকৃতি এখানে অকৃপন। মাঝে মাঝে বুনোফুল। কেমন যেন গন্ধ। কিছুদুর এগুতেই ডোবী। এখানে NH-2, NH- 83 আর। NH - 99. এখান থেকে রাস্তা চলে গেছে বুদ্ধগয়া, পাটনা,গয়া। আর একটি রাস্তা চলে গেছে ঝাড়খন্ডের দিকে। জানতাম, যে রাস্তা দিয়ে যাচ্ছি সেটা হোল লাল করিডোর এর মধ্যে। কল্যাণ যদি ভয় পায় তাই ওকে কিছু বলিনি।আর ১০ কিমি আসতেই এসে গেল শেরঘাটি। দাঁড়ালাম, কল্যাণ কে বললাম একটা গল্প শুনবি? তিনি বাবু একটু ফিক করে হেসে বলল তুই গল্প বলবি? আমি বললাম শোন তবে।। এই এলাকার নামের পিছনে একটা গল্প আছে। কথিত আছে জেনারেল ফারিদ খান এখানে একটা শের শিকার করেছিলেন। ফারিদ ‘শের সুরী’ নামে পরিচিত ছিলেন তিনি হুমাউন কে পরাজিত করে দিল্লীর সুলতান হন নাম নেন শের শাহ সুরী। যিনি ইতিহাসে শের শাহ নামে সমধিক পরিচিত। এই যে রাস্তা দিয়ে যাচ্ছি সেটা ওনার তৈরি ভাবতে পারছিস। গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠছে।ইতিহাস বলে এই শেরঘাটিতেই প্রবাল পরাক্রমশালী আউরংজেব আক্রমন করেছিলেন দখল নেওয়ার জন্য কিন্তু স্থানীয় আদিবাসী কোল দের প্রবল বাধার সামনে পরে আর এগুতে পারেননি। মোরহার নদীর তীরেই আটকে গিয়েছিলেন। আর জানিস এখান থেকে মাত্র ২৫ কিমি এগুলেই বুদ্ধগয়া। এটা আর অকে বলিনি এখন এইটা মাওবাদী উপদ্রুত এলাকা বলে সমধিক প্রচলিত। বললে যদি......।।

আওরঙ্গাবাদ জেলা হল ভারতের বিহার রাজ্যের ৩৯টি জেলার অন্যতম। মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের নামানুসারে এই জেলার সদর শহরের নামকরণ করা হয়েছিল আওরঙ্গাবাদ।যাকগে, আবার এগিয়ে চলা, রাস্তায় গাড়ি চলাচল খুব কম। অদ্ভুত নিস্তব্দতা। মাঝে মাঝে আমার বাইকের আওয়াজই আমার কানে লাগছে। কল্যান পিছনে আসছে। ওকে বলেছি দিনের বেলা হলেও হেডলাইট জ্বালিয়ে আসতে, এতে সুবিধা হয় কি, যে সামনে যাচ্ছে সে আয়না দিয়ে সহজেই বুঝতে পারে পিছনের লোক আসছে কিনা।কালো পিচের রাস্তা, দু ধারে মাঝে মাঝে চাষের জমি, কুঁড়ে ঘর মাঝে মাঝে ,ছোট ছোট দোকান, দূরে দূরে গ্রামের চিহ্ন। প্রায় ৫০ কিমি আসার পর যখন চা খাওয়ার জন্য মনটা একটু চা চা করছে , সামনেই দেখি রাস্তার উপর এক বিশাল গঞ্জ । জমজমাট এলাকা। একটা চা এর দোকানে দাঁড়ালাম। যা, একটু চা বল আমি বললাম কল্যান কে। বলার সঙ্গে সঙ্গেই দোকানে ঢুকে কল্যান বেশ ভারিক্কী ভাবে বলল “তানি চা পিলাও হৌ, শক্কর কম, পুরা দুধ, পানি মৎ দেনা” । আমি অইশুনে ফিক ফিক করে হাসতে লাগলাম। এখানে জিটি রোড বেশ সরু। চা, পান, খৈনীর দোকান, উচ্চস্বরে হিন্দি, ভোজপুরী গান বাজছে, যত্র তত্র ছেঁড়া পান মশালার প্যাকেট। বড় বড় মোষের গাড়ি করে মাল

hotel asansol

রাস্তা

আসছে, ধীর গতিতে রাস্তা পেরিয়ে যাচ্ছে। থমকে যাচ্ছে জিটি রোড। কানে মোবাইল আর মুখ ভর্তি পান খেতে খেতে একজন যুবক চলে গেল সামনে দিয়ে। দু তিন জন বাচ্চা কল্যানের বাইকটাকে দেখছে। আবার যাত্রা শুরু হলো । শহর ছাড়াতেই আবার সেই একই রাস্তা। সামনে মাইল ফলক গুলোতে কত কত নাম, দ্রুত পিছনে ফেলে এগিয়ে চলছি। এসে গেল ডেহরি–অন-শোন। ট্রেনে যেতে যেতে বহুবার শোন নদী পেরিয়েছি। আজ সেই নদী সড়কপথে পেরুচ্ছি। লম্বায় প্রায় ৩০৬১ মিটার। এটা বর্তমানে ভারতীয় রেল এর দ্বিতীয় বৃহত্তম সেতু। ১৯০০ সালের ২৭এ ফেব্রুয়ারী এটা খুলে দেওয়া হয়। এখন এই ব্রীজের নাম জহর সেতু। ব্রিজের ধারে দাঁড়িয়ে দেখলাম নদীর মাঝে মাঝে পলি জমে আছে। দূর থেকে দেখা যাচ্ছে অনেকে স্নান সারছে , মানুষ এবং পশু। কিরে স্নান করবি নাকি? আমি জিজ্ঞ্যাসা করলাম। তুই কি পাগল হলি নাকি , এই বলে বাইক স্টার্ট করে সোজা এগিয়ে গেল কল্যান। আমি কিছুক্ষণ হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে আবার চলা শুরু করলাম। একটু জোরে বাইক চালিয়ে কল্যান কে ধরে বললাম থাম থাম একবার । ওমা! সে দেখি শোনেই না। পরে বুঝলাম আমারই ভুল, হেলমেট এর কাঁচ না সরিয়েই আমি ডাকছিলাম, আর সেও তো হেলমেট ঢাকা। দেখলাম এভাবে হবে না। পুরো হিন্দি সিনেমার মতো ওকে ওভারটেক করে গ্যাঁচ করে দাঁড়ালাম এবার সাসারাম এ থামবো, বুঝলি ।সাসারাম..এসেই গেল। হোটেলে খেতে খেতে ভাবছিলাম। ছোট্টবেলায় ইতিহাসে পড়া সেই সাসারাম। শের খাঁ থেকে শেরশাহ হয়ে ওঠার কাহিনী।আজও শহরটাকে জড়িয়ে রেখেছে সেই ইতিহাস। শেরশাহ ছিলেন বিহারের অন্তর্গত সাসারামের জায়গিরদার হাসান খান শূরের পুত্র। ১৫৩১ মতান্তরে ১৫৩৪ সালে শের খান জালাল খানকে পরাজিত করে বিহারের শাসনক্ষমতা গ্রহণ করেন। এই সাসারাম থেকেই তাঁর উত্থান আর এইখানেই তার সমাধিস্থল ,এক দর্শনীয় স্থান। হাতে সময় নেই এখনো যেতে হবে অনেকখানি। দেখতে দেখতে পেরিয়ে এলাম মোহানিয়া , মোঘলসরাই। আর কিছুটা গেলেই বেনারস।বাঙ্গালীর অনেক আবেগজড়ানো জায়গা। সাহিত্যে, চলচিত্রে বার বার উঠে আসা বেনারস। সন্ধ্যে নেমে এসেছে রাস্তায় । উফ! কখন যে পৌঁছব। রাবড়ি আর কুলফির কথা মনে পড়তেই পেট আর মাথাটা কেমন যেন করে উঠল। এতক্ষন গতির আর রাস্তায় মোহে ভুলে ছিলাম যে পেটেও কিছু দিতে হবে। কল্যানও বেশ কাহিল। ওর এই প্রথমবার এত দূর বাইকে ভ্রমণ। কিছু খাওয়ার কথা বলতেই এবার আর কোন ট্যান্ডাইমেন্ডাই না করে সুবোধ বালকের মতো রাজী হয়ে গেল। হাইওয়ের ধারে ধাবায় গ্লাসে করে চা খাওয়ার মজা... দুঃখিত আমি সেটা লিখে বোঝাতে পারব না। আর মাত্র ২০ কিমি বাকি বেনারস আসতে। জায়গায় জায়গায় রাস্তার ধারে নিকশ কালো জমাট বেঁধে আছে। মাথার উপর এক বিস্তীর্ণ কালো চাঁদোয়া খাটানো আছে আর তাতে যেন অজস্র জোনাকী জ্বলছে। সামান্য ঠাণ্ডা হাওয়া । দূরে দূরে রাস্তার ধারে বাড়িগুলোর আলো মিট মিট করে জ্বলছে। উলটো দিক থেকে আসা ট্রাকের আলোমাঝে মাঝেই চোখ ঝলসে দিচ্ছে। ক্রমশ কাছে আসছে বেনারস। বেশ কিছুটা চলার পরে বাইকের গতি মন্থর হয়ে এল। রাস্তায় জ্যাম, অটোর দেখা মিলছে। বাইক আর অন্যান্য যানবাহন বাড়ছে।বেনারসের কাছে ২ কিমি আগে থেকেই জ্যাম, কল্যান পিছনে কোথায় আছে কিছুই বুঝতে পারছি না।নদীর ব্রিজ এসে গেল। গাড়ি থিক থিক করছে। একটু ফাঁকা জায়গা দেখে দাঁড়ালাম। কল্যান আর আসেই না। সিগারেট খেতে ইচ্ছা করলেও খাওয়ার উপায় নেই কারন হাতের গ্লাভস খুলতে হবে। মিনিট ৫ সময় যেন অনন্তকাল লাগছে। অবশেষে কল্যান এল। চল ব্রিজ পেরিয়েই বাঁ দিকে নেমে যাব, একটা রাস্তা শহরে ঢুকছে, আমি বললাম। ব্রিজ পেরুতেই পাক্কা ১০ মিনিট। তারপরে বাঁ দিকে প্রায় ৬০ ডিগ্রী ঢালু পথ দিয়ে নামতেই চক্ষু চড়কগাছ। এটা রাস্তা? তাও আবার বেনারসের মতো বিখ্যাত শহরের!! যেখানে সারা পৃথিবী থেকে টুরিস্ট আসে। জায়গায় জায়গায় পিচ বলে কিছু নেই , বড় বড় নুড়ি পাথর, গর্ত। এর উপর দিয়েই অটো করে লোকজন যাচ্ছে, গাড়ি, বাইক,রিকশা, কি নেই? চারপাশে বিভিন্ন দোকান। আলো জ্বলছে, মাইকে উচ্চস্বরে গান,ভজন, শিব বন্দনা, আরও সব গান। পানের দোকান, রাস্তার ধারেই বড় বড় কড়াতে দুধ জ্বাল হচ্ছে। ইলেক্ট্রনিকস আর মোবাইলের দোকান। হোটেল কোথায় পাবো? কিছুই বুঝতে পারছি না। রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে অবশেষে গুগল ম্যাপ ভরসা। দেখলাম বেনারস হিন্দু ইউনিভার্সিটির কাছেই আমরা আছি। একটু এগিয়ে গিয়ে কল্যান কে বললাম ওরে হটেলের খোঁজ কর। বাইক রাখার ব্যবস্থা কিন্তু চাই। করিৎকর্মা ছেলে কল্যান। একে তাকে জিগ্যেস করে গলির গলি তস্য গলি দিয়ে গিয়ে একটা ধর্মশালার ব্যবস্থা করে ফেলল। বেশ ঝকঝকে তকতকে। তবে বাইক বাইরে একটা ঘেরা জায়গায় রাখতে হবে। আমি একটু খুঁতখুঁত করতে একটা ছেলে বলল “কই ডর নাহি বাবুজি , ইয়ে বনারস হায় , রাত মে ভি জাগতি হায় শহর’। সত্যিই তাই। ১১ তার সময় খেতে গিয়ে দেখলাম ভিড় একটু কম বটে কিন্তু অনেক দোকান খোলা,হঠাৎ দেখি একদল লোক গৈরিক পতাকা নিয়ে মিছিল করে আসছে, ভাবলাম রাজনৈতিক দলের লোকজন , যা আমরা পশ্চিমবঙ্গে দেখে অভ্যস্থ, কিন্তু এটা উত্তরপ্রদেশ, পিছনে বোঁচকা বুঁচকি নিয়ে অনেক নারী-পুরুষ ,বাচ্ছা। দেহাতী লোকজন, ভীরু পায়ে পায়ে তীর্থ করতে আসছে। এক পরিবারকে দেখলাম , পাগড়ী জড়ান এক পুরুষ, সম্ভবত পরিবারের কর্তা, এক কাঁধে দড়ি দিয়ে বাঁধা বিশাল এক পোঁটলা, অন্য কাঁধে একটা বাচ্ছা, আর ডান হাত দিয়ে এক বাচ্ছাকে কোলে তুলে হাঁটছেন, বামহাতে এক মহিলার হাত ধরা। সেই মহিলার এক হাত ধরে আছেন এক বৃদ্ধা। বাবা বিশ্বনাথ দর্শনে চলেছেন। হঠাৎ দেখি ফোন বাজছে।” নিলয়দা তুমি কোথায়?” আমি সুরজিত বলছি। আরে বল বল, আমি তো এখন বেনারস এ... আমি বললাম। “শোন, কাল সকালে তোমার সঙ্গে আমার দেখা হচ্ছে, আমি কাল সকালে বেনারস ঢুকবো “ ,কোথায় তুই এখন? আমি দিল্লি থেকে কলকাতা ফিরছি , কাল ভোরবেলা বেনারস পৌঁছে যাব। আমারতো আকাশ থেকে পড়ার জোগাড়। ধ্যাত, কি বলছিস। ও বিশ্বাস হচ্ছে না আমি তোমায় হোয়াটস অ্যাপে লোকেশন পাঠাচ্ছি। আচ্ছা পাগল ছেলে, বাইক ওর নেশা ,সুরজিত আমার ছোট ভাইএর মতন। ভারি ভাল আর প্রানবন্ত ছেলে। টাকা উপার্জনের নেশায় ভাইটি আর সবার মত পাগল হয়ে যায় নি। মনটা খুশিতে ভরে গেল। ও একা দিল্লী থেকে বাইকে আসছে রাত্রে, সাবধানে আসিস, এই বলে কল্যান কে বললাম দেখলি ? সে ব্যাটা বলে ‘ কি?’ - তোর মুণ্ডু,চল,হোটেলে চল। হোটেলে ফিরতে না ফিরতেই বাবুর বায়না।এই রে একটা জিনিস ভুলে গেছি, বলেই দৌড়ে পগার পার। চাবিটাও দিয়ে গেলো না। বসে বসে ভাবছি হরসুন্দরী ধর্মশালা, বাংগালিটোলা , সাহিত্যিক নিমাই ভট্টাচার্য এর গোধুলিয়া মনে পড়ে গেল।

একসময় লাইব্রেরীতে বইটা আসতে না আসতেই ইস্যু হয়ে যেত। অপরাজিত উপন্যাস ও মনে এল,জয়বাবা ফেলুনাথ ও। “খাই কে পান বনারসীয়ালা, খুল জায় বন্ধ অকল….” বিচ্ছিরী গলায় গাইতেগাইতে এসেই হাতে পান ধরিয়ে দিল কল্যান। বেনারস এসেছি আর পান খাব না? কাল সকালেই বেরুতে হবে তাই এই যাত্রায় খাওয়া ঘোরা বাদ। সকালে ঘুম ভাঙল ফোন এর শব্দে। বেরিয়েছ? আমি মাত্র ৫০ কি.মি. দূরে। সুরজিতের ফোন।ঘড়িতে দেখি ৫ টা বাজতে চলেছে। তাড়াহুড়ো করে বেরুতেই দেখি শহরটা বদলে গেছে। দূর কোথা থেকে ভজন এর সুর ভেসে আসছে। ধীরে ধীরে লোকজন রাস্তায় বেরুচ্ছে। মনটা এমনিতেই ভাল হয়ে গেল। দুধের ক্যান সাইকেল এ নিয়ে যাচ্ছে গোয়ালারা। শান্ত সকাল। খালি পরিবেশের তাল কেটে দিচ্ছে সেই বিচ্ছিরী রাস্তা। ১০ মিনিটের মধ্যে আবার হাইওয়েতে। ফোন করছি সুরজিতকে ধরছে না। এদিকে লাল সুর্য উঠছে তার দিক থেকে চোখ ফেরানো যাচ্ছে না। রাস্তার দিকে একবার দেখছি আর একবার সুর্যের দিকে। অবশেষে তার দেখা মিলল।

hotel asansol

সুরজিত এর সাথে দেখা

এসেই বলে চা খাওয়াও। বিদেশ বিভুইয়ে রাস্তায় চেনা পরিচিতদের দেখলে এক অদ্ভুত আনন্দে মন ভরে যায়। কল্যানের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিলাম। সুরজিত আজকেই ফিরবে। অনেক সাহস থাকলেই তবে একা দিল্লি থেকে কলকাতা বাইক চালিয়ে ফেরা যায়, মজার ব্যাপার হল সে শহরে একজন সাধারণ মানুষ যাকে ভিড়ের মধ্যে থেকে আলাদা করা যাবে না।কেউ হয়ত জানবেই না সুরজিতের মধ্যে কতটা আডভেঞ্চারপ্রিয় মানুষ লুকিয়ে আছে।রাস্তার খোঁজখবর নিলাম। তার পর বিদায় জানিয়ে আবার রাস্তাকে সাথি করে চলা। ও চলল কলকাতার

দিকে আর আমরা দিল্লির দিকে।………………………

চল এবার শুরু করা যাক, কল্যাণ বলল। যাব তো বটে কিন্তু কোথা দিয়ে যাব? একটা রাস্তা আছে

জৌনপুর, সুলতানপুর হয়ে লখনোউ । আরেকটা রাস্তা হোল এলাহাবাদ , রায়বেরিলি হয়ে লখনোউ NH-19 and NH- 30। জৌনপুর, সুলতানপুর হয়ে রাস্তাটা কম NH-731 ধরতে হবে সেক্ষেত্রে। ঠিক হোল লোকাল লোকজনের পরামর্শ নোব। তাই হোল। একজন কে জিজ্ঞাসা করতে সে বলল - আপ এক কাম কিজিয়ে ৯/১০ কিলোমিটার চলা যাইয়ে , এক চৌক আয়েগি , উশসে ডাইনেওয়ালা রোড পকড় লিজিয়ে সিধা জৌনপুর । তাই হল , কিছুদূর যাওয়ার পরে রাস্তায় বোর্ড দেখলাম জৌনপুর।তবে ৯/১০ কিমি. নয় প্রায় ২৫ কিমি। তখনও লোকজন বিশেষ জাগে নি, চায়ের দোকানে ইতস্তত জটলা, কেউ বা আবার রাস্তার ধারে উবু হয়ে বসে খবরের কাগজে চোখ বুলিয়ে নিচ্ছে। রাস্তার ধারে কিছু ফলের দোকান, প্যাকিং বাক্স ছড়িয়ে আছে, খড় , রঙ্গিন কাগজ রাস্তার ওপর জমে আছে, দু তিনটি ষাঁড় অলস ভাবে দাঁড়িয়ে আছে, স্তূপীকৃত গোবর ছড়ান চারপাশে। রাস্তা পেরিয়ে ডান দিকে ঢুকে কিছুটা এগুতেই দেখি রাস্তার কাজ চলছে। আক্ষরিক অর্থে সিঙ্গেল লেন হয়ে গেছে। ওরে কল্যাণ , এই রাস্তায় তোমার জোরে যাওয়া যাবে না।পরিস এমন সময় কে যেন বলল বাবু আপলোগ কহা জায়েগি। মুখ ঘুরিয়ে দেখলাম এক বয়স্ক ভদ্রলোক খাটিয়ার উপর বসে প্রশ্নটা করলেন। সাদা চুল, পরনে ধূতি আর শার্ট , কাঁধে একটা চিরাচরিত গামছা। খাটিয়ার উপর খবরের কাগজ। বাধ্য হয়ে বাইক থেকে নেমে কাছে গেলাম, হমলগ কলকাতা সে অ্যাতে হায় লখনউ জায়েঙ্গে। ---- তো ইশ রস্তা কিউ পকড়া? রাস্তা সহি নহি হাঁয় আপ ব্যক করকে হাইওয়ে সে জাইয়ে। আমরা ঠিক করলাম তাই করব। বাইক ঘোরাতেই আবার ডাক। চায় তো পিকে জাইয়ে ।অগত্যা কী আর করা, বসলাম। একটা বাচ্চা ছেলে , ওনার নাতি , বললেন , দোকান থেকে চা নিয়ে আসতে সঙ্গে বিস্কুট। কথায় কথায় জানা গেল জায়গাটার নাম সেওয়াপুরি। চা পর্ব শেষ হতেই ভদ্রলোক হাঁক মারলেন বহু থোরি বাহার আ না। আমি চমকে উঠলাম। বেশ পিছিয়ে পড়া গ্রাম্য এলাকায় অপরিচিত লোকজনের সামনে বাড়ির বউ কে ডাকা একটু অন্যরকম লাগল। ভেবেছিলাম একগলা ঘোমটায় ঢেকে কেউ আসবেন , দেখলাম , তা নয় ঘোমটা আছে কিন্তু সেটার বাড়াবাড়ি নেই। বহু, ইয়ে লোগ কোলকাতা সে অ্যায়ে হাঁয়, থোড়া ঘর দিখা দেনা। জাইয়ে বাবুজি হমারা ঘর দেখিয়।ঘরে ঢুকতেই চমক। একটা বড় ফ্লেস্ক। তাতে একজনের ছবি । ভোটের প্রচারের জন্য বানানো। মেরি স্বামী চুনাও মে খরা হুয়ে হ্যাঁয়। এতক্ষণে পরিষ্কার হোল ব্যাপারটা। পরিবারটি রাজনীতির। তাই ছুত্মার্গ অনেকটা কাটিয়ে উঠেছেন এরা। কিছু ছবি তুলে বিদায় নিলাম।ফ্যামিলি লেকে আনা একবার। গলার স্বরে আন্তরিকতার ছাপ স্পষ্ট । ঠিক হ্যাঁয় ভাবি , ফির কভি। ভাবলাম, এত সহজে বাড়িতে আসার আমন্ত্রণ কেবল মাত্র এইরকম লোকজনই করতে পারেন।ভাগ্যিস এনারা আমাদের মত শহুরে মধ্যবিত্ত নন। মেরা ফোন নম্বর লে লেনা। ভদ্রলোক বললেন।অ্যাতে হাঁয় বাবুজি... বলে নমস্কার করে ফের পথে নামলাম।

কল্যাণকে বললাম এবার তুই আগে চল ঠিক ৫০ কিমি পর দাঁড়াবি। কল্যাণ এগিয়ে গেল। দেখতে দেখতে যাচ্ছি। ছোট ছোট জনপদ পড়ছে। রাস্তায় লাইন দিয়ে ট্রাক এর সারি। বেশ কিছুটা যাওয়ার পর রাস্তার ধারে দেখি বেশ জটলা , প্রায় ২০০ মিটার এগিয়ে যাওয়ার পর কেমন যেন মনে হল , যাই তো একবার দেখি । মনটা কেমন কু ডাক দিল। ব্যাক করে জটলার কাছে এসে দেখি কল্যাণ রাস্তায় শুয়ে , চারদিকে দিয়ে রক্ত পড়ছে। জামাটা ছেড়া , বাইকটার windshield ভেঙ্গে চুরমার। কয়েকজন লোক বাইকটাকে তোলার চেষ্টা করছে, কয়েকজন কল্যাণকে জল দিচ্ছে। ভাই আমার কোন দোষ নেই , প্রথমেই কল্যাণ বলল।

hotel asansol

hotel asansol

Meet the Blogger

Nilay Chatterjee


Name- Nilay Chatterjee
Profession- Service
City- Howrah
Hobbies- Trekking, Biking and photography
Previous Tours- Kolkata to panchachulli Biking and trekking (2019)



You may also like