ঝকঝকে সকাল হোলো। গ্রামে বিশ বাইশ ঘর লোকের বাস। একটা পোস্ট অফিস আছে। একটা পোস্ট কার্ড লিখে ফেললাম, যদিও সেটা আমার বাড়ি পৌঁছে ছিল, আমার বাড়ি ফেরার তিনদিন বাদে!
চাল, কেরোসিন তেল পাওয়া যায় একটা দোকানে, সেখান থেকে আর ও রসদ কেনা হোল। একটি প্রাইমারি স্কুল আছে দেখলাম, পরে আবিষ্কার করলাম, পোস্ট মাস্টার, প্রাইমারি স্কুলের টিচার, ওই দোকানের মালিক, যে ঘরে আমরা ছিলাম সেই হোটেল মালিক, এবং টুকটাক ডাক্তারি করেন যিনি
তিনি একজন ই ব্যাক্তি। তিনিই একাধারে সব।
সোজা রাস্তা চলে গেছে পিন্ডারি গ্লেসিয়ার অভিমুখে, আমরা গ্রামের খেত পেরিয়ে নামতে শুরু করলাম উলটো মুখে।
একেবারে পিন্ডারি নদীর ব্রিজ পেরিয়ে ওপারে সুন্দরডুঙ্গা নদের পাড় ধরে হাঁটা শুরু হোল। রাস্তা ধীরে ধীরে উঠছে জাতোলি গ্রামের দিকে। এখন আর তত কষ্ট হচ্ছে না। এখন খানিকটা অভ্যাস হয়েছে। অই ত দূরে ওই পাহাড় টার ফাঁকে জাতোলি গ্রাম দেখা যাচ্ছে। দেড় দু ঘন্টায় পৌঁছে যাব। হঠাৎ ই আবিষ্কার করলাম,, সামনের রাস্তা ভাঙা। সরু পায়ে চলা পথ ধরে আসছিলাম। বাঁ দিকে পাহাড়, ডান দিকে ঝোপঝাড় পেরিয়ে নেমে গেছে প্রায় এক শ ফুট নীচে নদী। সামনের দশ ফুট মত রাস্তা ভেঙে পড়ে গেছে। তারপর থেকে দিব্বি রাস্তা রয়েছে। কিন্তু এই খান টা পেরোব কি করে? বাঁ দিকে ঢালু পাথরের ওপর ঘাস, গাছের ডাল ধরে ধরে পেরোতে হবে। ফস্কে গেলেই গড়িয়ে নদীখাতে।
গোপাল সিং বলল আপনারা স্যাক খুলে ওখানে রেখে দিন। তারপর ওই লাঠি গাছের ডাল ধরে পেরোতে হবে ধীরে ধীরে। কি হবে কে জানে, ভয়ে ভয়ে এক এক করে সবাই পেরিয়ে গেলাম। উফ শান্তি। তরতর করে হেঁটে জাতোলি। ঘাসের ওপর বিশ্রাম, সামনে কাঠের দোতলা বাড়ি, লাল সিং এর, আর রাস্তা বরাবর ওই সামনের দিকে গাছপালার ভেতর যা বাড়িটা দেখা যাচ্ছে, পুষ্কর সিং এর। কিছু খাওয়ার পর ই উঠে পড়। সোজা রাস্তা ঢুকে গেছে জঙ্গলের মধ্যে, গভীর ঘন জঙ্গল, তার মধ্যে দিয়ে রাস্তা। আমরা পৌঁছে গেলাম ভৈরব নালার পাশে। একটি পরাক্রান্ত ঝরনা। বইয়ে পড়েছি, এ নাকি বর্ষায় ভয়ংকর, এই যে কাঠ, গাছের ডাল, লতাপাতা য় বাঁধা ব্রিজ, এসব উড়িয়ে নিয়ে চলে যায়। দেখে ত তেমন ভয়ংকর মনে হল না, পনেরো ফুট নীচে দিয়ে উপল বিক্ষত ঝরনা আপন খেয়ালে বয়ে চলেছে। গুঁড়ি, কাটা কাঠ, শক্ত লতা দিয়ে বাঁধা, দু চারটে পাথর দিয়ে ভারসাম্য রাখার প্রচেষ্টা, এই হল ব্রিজ। মোটামুটি ফিট তিনেক চওড়া আর পনেরো ফুট মত লম্বা, অনায়াসেই হেঁটে পেরন যায়। কিন্তু গোপাল সিং এর নির্দেশ এক জন এক জন করে পেরোবে। দু তিন জন চলে গেল, অসীম ব্রিজের ওপ্রান্তে পাথরে পা দিয়ে একটু হুড়োহুড়ি করেছিল, স্লিপ খেয়ে পড়ল। আমি পেরচ্ছি, পেছনের জন তখনও এসে পৌঁছয় নি। আমি ব্রিজের মাঝখানে পৌঁছে পিছন ফিরে বলতে গেলাম সাবধানে আসিস,ওপার টা শেওলায় পিছল।পুরো ব্রিজ টা একবার ওল্টানো র মত দুলে স্থির হল। শিরদাঁড়া দিয়ে একটা হিমশীতল স্রোত বয়ে গেল!ওপারে পৌঁছে সবাই জড় হলাম। মৃদু বৃষ্টি হচ্ছে, খাড়া পাহাড়ের গা বেয়ে তিন তলা মত উঠতে হবে, খালি বুটের ডগা রাখার মত পাথরের খাঁজ আছে, বাঁ দিকে ঝুরো মাটির পাহাড়, আর ডানদিকে নীচে ভৈরব নালা। মনের অবস্থা তখন " তোরা যা ভাই আমি নেই",কিন্তু পালানোর ত উপায় নেই। ফিরলে সবাইকেই ফিরে যেতে হবে। চোখ বন্ধ করে সাহস সঞ্চয় করলাম। পানু সিং, নন্দন ওরা ত অত মালপত্র নিয়ে চার হাত পা য়ে দিব্বি উঠে গেল।
উঠে পড়েছি, আস্তে আস্তে সবাই উঠে পড়ল। খানিকক্ষণ আমার বিশ্বাস ই হচ্ছিল না। তারপর বিছুটি গাছের জঙ্গল দিয়ে ছোঁয়াছ বাঁচিয়ে হাঁটা। তুমুল বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল। আমরা ঘন জঙ্গলের মধ্যে এক ফোঁটা বৃষ্টি ও গায়ে পড়ছে না। গাছের ফাঁক দিয়ে যা দেখা যাচ্ছে পাশের খাদ,, তুমুল বৃষ্টি হচ্ছে। অবশেষে আমরা পৌঁছলাম ডুঙ্গিয়াডং, জঙ্গলের মধ্যে পাহাড়ের একটা ওভার হ্যাং, ঠিক গুহা বলা যায় না, একটু চাতাল মত, পাশেই দু শো ফুট নীচে সুন্দরডুঙ্গা নদী, ঝোপঝাড় এ দেখা যাচ্ছে না, কিন্তু জলের গর্জন শোনা যাচ্ছে। সেই অল্প জায়গায় কোনোক্রমে আমাদের দুটো তাঁবু লাগানো হল।
পান সিং এর ওপর ভার পড়ল জল সংগ্রহ করে আনার। আমি ভাবছি এই জঙ্গলের মধ্যে জল কোথায় পাবে। নদী ত অনেক নীচে, আর ঝরনা ও ত কাছে পিঠে নেই। আমি পেছন পেছন চললাম। একটু এগিয়েই জংগলের মধ্যে ঢালু পাহাড়ের গায়ে বসে পড়ল। অবাক হয়ে লক্ষ করলাম, ঘাসের মধ্য দিয়ে, এঁকেবেঁকে একটা ক্ষীণ জলের ধারা, দেখাও যাচ্ছে না ভালো করে। সেখানেই পাঁচ লিটারের জেরিকেন হাতে বসে পড়ল পান সিং।
তারপর সেই ক্ষীণ প্রায় অদৃশ্য জল ধারার গতিপথে, মাটি আঁচড়ে, খানিক তুলে একটা বাঁধ দিলো। এতক্ষণে কাদা গোলা জল একটু দেখা গেলো। তার পাশে উবু হয়ে বসে, নিশ্চিন্ত হয়ে একটা বিড়ি ধরাল, আর আমার সাথে গল্প করতে শুরু করল। শিরশির করে জল এসে সেই ছোট্ট গর্ত ভর্তি হল, কাদা থিতিয়ে গেল। একটা স্টিলের কাপে করে ওপর থেকে সাবধানে জল তুলে জেরিকেনে ঢাললো। সময়ের ত দাম নেই। প্রায় চল্লিশ মিনিট লাগলো, এক জেরিকেন জল ভরতে।
তাঁবুর প্রান্ত খাদের ধারে। অন্ধকারে কেউ ঘোরাঘুরি করবি না। কাঠের আগুন জ্বালিয়ে রান্না হোলো।সন্ধ্যাতেই ডিনার সেরে আমরা তাঁবুর ভেতর সেঁধিয়ে গেলাম। ওরা তিনজন আগুনের ধারে শুয়ে পড়ল।
রাত্রে নাকি ভালুক আসতে পারে। তিনদিক ই ত গভীর জঙ্গল, আর এ পাশে নীচে নদী, আমরা পাথরের আড়ালে।
*** **** ***
পরদিন আটটায় হাঁটা শুরু, প্রাতরাশের পর একটু পাহাড়ের ওপর উঠে জঙ্গলে র ধার ঘেঁষে, এসে পড়লাম নদীর ধারে। ঝুরো মাটি, কখনো পাথুরে, নদীর ধার দিয়ে হাঁটা। পনেরো বিশ ফুট নীচে নদী, সহজ হাঁটা রাস্তা, দূরে বরফের রেখা দেখা যাচ্ছে পাহাড়ের মাথায়, আবার বিপত্তি, রাস্তা গেছে ভেঙে ..ধস নেমে চলে গেছে নদীতে। অগত্যা ঘষটে, বসে, হাঁচড়েপাঁচড়ে নদীর ধারে নেমে আসা, একটু এগিয়ে আবার ওঠা। আজ আর বেশি কষ্ট নেই। ঘন্টা তিনেকের মধ্যেই অভীষ্ট কাঁঠালিয়ার প্রান্তর দৃ্ষ্টি গোচর হল। এবাং বারোটা য় পৌঁছে গেলাম উপত্যাকায়। অনেক টা ঘাসের উঁচুনীচু জমি। দূরে অন্য দলের তাঁবু দেখা যাচ্ছে। আমরা উপত্যকা য় ঢোকার মুখেই তাঁবু ফেললাম। সামনে একটি শেফার্ড হাট। ভেড়া রাখার জায়গা, যথেষ্ট বড়, কিন্তু হামাগুড়ি দিয়ে ঢুকতে হবে। ভেতরেও একই উচ্চতা।
ওইখানেই রান্নায় লেগে গেল। সামনে দাঁড়িয়ে উপত্যকায় চোখ রাখলাম। পেছন দিকে খাড়াই পাহাড়, বালুনি টপের দিকে চলে গেছে। বাঁ দিক থেকে নেমে আসছে সুকরাম নালা, সামনের পাহাড় থেকে সুন্দরডুঙ্গা নালা, আর ডানদিকের পাহাড়ের আড়াল থেকে আসছে, মাইকতোলি নালা। আমাদের তাঁবুর থেকে আর একটু এগিয়ে গেলে ই তিনটি ঝর্ণার সংগম। আকাশ মেঘে ঢাকা, আসার পথে বা এখানে, কোথাও কোনো পর্বতশৃঙ্গ দেখা যাচ্ছে না। তুমুল ঠাণ্ডা য় সন্ধের আগেই ডিনার সেরে তাঁবুর মধ্যে। মুষলধারে বৃষ্টি। রাত একটা নাগাদ পাশের তাঁবু থেকে শংকর এর আর্ত চিৎকার " তাঁবু পড়ে গেছে," অগত্যা ওদের দুজনকে ও আমাদের তাঁবুতে ডেকে নিয়ে, বসে বসে বাকি রাত।
**** **** ****
আজ সকাল সকাল বেড়িয়ে আমরা মাইকতোলি বেস ক্যাম্প এর দিকে এগোব। ওইদিকের পাহাড়ে খানিক দূর উঠলে পান ওয়ালি দুয়ার শৃঙ্গ দেখা যাবে তাই সাত টায় রওনা। উপত্যকার মধ্য দিয়ে একটু এগিয়েই মাইকতলি নালা ফুট দশেক চওড়া আর সমপরিমান গভীর হৈ হৈ করে ঝর্ণা ছুটে চলেছে, কিন্তু পেরোব কি করে? দুটো সরু গাছের ডাল পাতা আছে,, বাঁধা ত নেই ধরার ও কিছু নেই! অন্য দলের গাইড লাল সিং এলো গোপাল কে সাহায্য করতে। গোপাল প্রথমে ওপারে চলে গেল তারপর এপারে আমাদের লিডার দেবাশিষ পাথরের সাথে বেঁধে একটা দড়ি আটকালো, যার অপর প্রান্ত ওপারে গোপালের হাতে। এক এক করে লাল সিং এর হাত ধরে আর দড়ি ধরে ওপারে! তারপর পাহাড়ে উঠব কি, রাস্তায় ই নেই, পাথরের খাঁজে খাঁজে হলুদ হয়ে যাওয়া বড় বড় ঘাস সেই টেনে ধরে একটা একটা করে পাথরে ওঠা। ঘাস ছিঁড়ে গেলেই কোথায় যে পড়ব, আর আটকানো র কিছু নেই।শেষ অব্দি সবাই উঠে এলো এবং নটা নাগাদ পৌঁছে গেলাম একটু দাঁড়ানোর মত সমতল জায়গায়। পানওয়ালি দুয়ার সূর্যের আলোয় ঝকমক করছে।এতক্ষণের পরিশ্রম সার্থক হল। কি অসাধারণ সে দৃশ্য, কিন্তু আধঘন্টা র মধ্যে মেঘে ঢেকে গেল। পরে যে দল টি উঠে এল, কিছুই দেখতে পেল না। আবার একই রাস্তায় নেমে এসে,, আজ এখানেই বিশ্রাম।
*** **** ****
বালুনি টপের দিকে আর যাওয়া হোলো না, মেঘলা আকাশ কোনো পিক ই দেখা যাবে না। তাই আজ সকাল আটটায় ফেরা শুরু, টানা জাতোলি চলে যাব। একই রাস্তা দিয়ে ফেরা, লাঞ্চে ঠিক ছিল ছোলার ছাতু, কাউকে বলিনি, ও আমি খাই না। সন্তর্পণে পাথরের আড়ালে ছাতুর ডেলা রেখে আবার নামতে শুরু করলাম। গোপাল আশ্বাস দিয়েছিল জাতোলি তে পাহাড়ি ছাগলের মাংস খাওয়া হবে, সেই আনন্দে তিনটা র মধ্যে পৌঁছে গেলাম। গোপাল বাড়ি থেকে কিছু আলু সেদ্ধ আর রাইশাক সেদ্ধ নিয়ে এল। গোগ্রাসে তাই খেলাম।
মাংস কখন আসবে, জিজ্ঞাসা করে হতাশ হলাম।যার আশায় হইহই করে এলাম, সে এখন দূর অস্ত। ছাগল ত পাহাড়ে চরতে গেছে, সন্ধ্যাবেলায় ফিরবে তারপর কাটা হবে, আর দুটো ট্রেক টিম আছে, মাংস ভাগাভাগি করে নেওয়া হবে,শেষ অব্দি রাত সাড়ে নটায় সেই মাংস তৈরি হয়্র এল। লাল সিং এর একতলার ঘরে আমরা রাত্রিবাস করলাম। দোতলায় এক অস্ট্রেলিয়ান ভদ্রমহিলা এসেছেন, তিন মাসের বাচ্চা কে পিঠে বেঁধে। তিনি আর এগোলেন না, আমাদের সাথেই ফেরার পথ ধরলেন, পরদিন। জাতোলি যে একমাত্র দোকান টি ছিল, সেখানে অনুসন্ধান করে জানা গেল শুধুমাত্র পানামা সিগারেট পাওয়া যাবে, আর কিচ্ছু নেই। চাল ডাল, তেল, নুন, বিস্কুট, পাঁউরুটি, কিচ্ছু নেই। পরদিন খাতি হয়ে ঢাকুরির অসাধারণ বাংলো।
পরদিন ওই অসম্ভব উৎরাই দিয়ে নেমে হাঁটু আটকে গেল। আর পা ভাঁজ করে হাঁটতে ই পারছিনা।প্রচন্ড যন্ত্রণা। বন্ধুরা সান্ত্বনা দিল সমতলে গেলেই সব সেরে যাবে। এরপর কৌসানী, নৈনিতাল হয়ে ট্রেনে বাড়ি।
Name : Amiya Ranjan Chatterjee
Age: 64
Profession : Retired Bank Employee (UCO Bank)
Residence: Uttarpara ( West Bengal)
Hobbies: Travelling, Photography et.al
Previous tours : 25+ treks in past 30 years