প্রথম প্রস্তাবটা আসে কলেজের লাইব্রেরিতে, অতনু স্যারের থেকে, "কিশান, সান্দাকফু ট্রেকে যাবে নাকি?" এর আগে আমরা একসাথে অনেককটা জায়গায় ঘুরে এসেছি, সবকটিই পাহাড়ে, কিন্তু ট্রেকিং? না এর আগে কোথাও ট্রেক করিনি। তাই প্রস্তাবটা পেয়ে একইসাথে খুশি এবং চিন্তিত দুটোই হয়েছিলাম। খুশি কারণ আবার একসাথে পাহাড়ে ঘুরতে যাচ্ছি, তাও আবার সান্দাকফুতে, পশ্চিমবঙ্গের সর্বোচ্চ জায়গায়; অন্যদিকে চিন্তিত কারণ এবার আমরা গাড়িতে চড়ে পাহাড়ে উঠবো না, পুরোটাই পায়ে হেঁটে ট্রেক করে। তবে বাংলাকে জয় করার এই সুযোগ তো ছাড়তে পারি না। তাই বলে দিলাম, "আমি সবসময় আছি, সান্দাকফু যাবো।"
উপরের ঘটনাবলী সান্দাকফু যাওয়ার মাস ছয় আগেকার। সান্দাকফু যাওয়ার দিন ঠিক হয় ১৮ই অক্টোবর। আমাদের হাতে সময় ছিল প্রায় ছয় মাস, সেইমতো আমরা প্রস্তুত হতে শুরু করি, শারীরিকভাবে এবং মানসিকভাবেও। অবশেষে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ এসে উপস্থিত হয়। ১৮ই অক্টোবর আমরা পাঁচজন শিয়ালদহ স্টেশনে একজোট হই ৯টা নাগাদ। আমরা যাবো পদাতিক এক্সপ্রেসে, ট্রেন ছাড়বে ১১টা ২০তে। ভিতরে ভিতরে উত্তেজনায় ফুটছি আমরা পাঁচজনেই, জানিনা সামনে কী অপেক্ষা করছে, হিমালয় আমাদের অভ্যর্থনা করার জন্য কেমন ভাবে নিজেকে সাজাচ্ছে৷ ডিনার সেরে ট্রেনে চড়লাম, কিছুক্ষণ পরেই পদাতিক এক্সপ্রেস হুইসিল বাজিয়ে যাত্রা শুরু করল নিউ জলপাইগুড়ির দিকে। দুগ্গা দুগ্গা।
#প্রথম_দিন
নিউ জলপাইগুড়ি থেকে ধোত্রে
সকাল ৯টা বেজে ৩০মিনিট। আমরা সবেমাত্র নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনে এসে পৌঁছেছি৷ পরিকল্পনা অনুযায়ী আমরা আজ থাকবো 'ধোত্রে' গ্রামে। গাড়ি আগে থেকেই বুক করা ছিল। স্টেশনের বাইরে আসতেই আমাদের ড্রাইভারের সাথে দেখা হল৷ ড্রাইভারের নাম উমেশ, নেপালি ছেলে, বেশ অমায়িক। ব্যাগপত্র গাড়িতে তুলে নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশন থেকে যখন আমাদের যাত্রা শুরু হল তখন ঘড়িতে ১০টা বেজে গেছে। আকাশের আজ মুখ ভার, চারিদিক মেঘলা হয়ে আছে। আমরা এখন চলেছি মিরিক রোড ধরে, এ রাস্তার দুধারে প্রায় সমতল জমিতে অসংখ্য চায়ের বাগান।
যেদিকে চোখ যায় শুধু সবুজ আর সবুজ, আর তার স্থানে স্থানে লাল,নীল, হলুদ জামাকাপড় পড়া নানা বয়সের শ্রমিক চা চয়ন করছে। এ যেন একপ্রকার রঙমিলান্তি, বেশ ভালো লাগছিল দেখতে। কিন্তু গাড়ি শিলিগুড়ি শহর ছাড়িয়ে, মিরিক রোড থেকে ডানদিকে মাটিগাড়া-কার্শিয়াং রোড ধরতেই চারিদিকের দৃশ্যপটের পরিবর্তন ঘটলো। সামনেই দেখা দিল ঢেউখেলানো অনতিউচ্চ পাহাড়ের সারি
গাড়ি যতই এগোতে থাকলো, দুপাশের ঝুপসি জঙ্গল ততই ঘন হয়ে আসতে লাগলো। কিছুক্ষণের মধ্যেই সুকনা অরণ্যকে ডানদিকে রেখে আমাদের গাড়ি পাহাড়ের চড়াই রাস্তা ধরলো।
সকালবেলা থেকে এখনও কিছু খাওয়া হয়নি, এতটা রাস্তা এলাম, এবার কিছু একটা না খেলেই নয়। উমেশকে সে কথা জানাতেই, সে কিছুক্ষণের মধ্যেই আমাদের একটি রোডসাইড ধাবায় নিয়ে গেল। সেখানে নামতেই টের পেলাম চারপাশের উষ্ণতার পারদ কিছুটা নেমেছে, বেশ শীত শীত করছে।সকলে মোমো অর্ডার করে রাস্তার ধারে পেতে রাখা একটি টেবিলে বসলাম। সামনে সবুজে মোড়া পাহাড় মাথায় জটার মত মেঘ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, পাশ থেকে হুশ হুশ শব্দ করে প্রচণ্ড বেগে গাড়ি চলে যাচ্ছে। চারধারের প্রকৃতিকে উপভোগ করতে করতে গরমাগরম আটখানা মোমো মুহূর্তের মধ্যে গলাধঃকরণ করলাম, বেড়ে লাগলো। খাওয়াদাওয়া শেষ করে আবার চড়ে বসলাম গাড়িতে,আবার আমাদের যাত্রা শুরু হল। সাপের মত এঁকেবেঁকে রাস্তা উঠে গিয়েছে উপরে; একদিকে সুউচ্চ পর্বত অন্যদিকে গভীর খাদ, কখনো ডানদিকে, তো কখনো বাঁদিকে। যতই উপরে উঠতে লাগলাম, নিচের উপত্যকা একটু একটু করে ডুবে যেতে লাগলো জমাটবাঁধা কুয়াশা আর মেঘের করালগ্রাসে। কুয়াশার চাদর গায়ে মেখে আরও আধঘন্টা এভাবে ওঠার পর চোখে পড়ল এক বিশাল হোর্ডিং 'Welcome to the land of white orchid - Kurseong'। দূর থেকে নজরে এল পাহাড়ের গায়ে কার্শিয়াং শহর এবং তার অজস্র বাড়িঘর; কী সুন্দর ধাপ কেটে কেটে তৈরি করা হয়েছে সবকিছু,এক অদ্ভুত নক্সায়। এতক্ষণ কুয়াশা তো ছিলই,এবার আমাদের সঙ্গী হল রাস্তার ঠিক পাশে শতাব্দী প্রাচীন 'দার্জিলিং-হিমালয়ান রেলওয়ে'। সেও আমাদের গাড়ির সাথে সাথে তাল মিলিয়ে এঁকেবেঁকে চলতে লাগলো মহানন্দে। তবে দার্জিলিঙের সেই বিখ্যাত টয়ট্রেনের দেখা পেলাম না অনেকক্ষণ, মিনিট পঁচিশ পর তুঙ্গ স্টেশনের কিছু আগে অপেক্ষার নিরসন হলো৷ দেখলাম একসময়ের পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারতের ঐতিহ্য বিখ্যাত টয়ট্রেন মুখ থুবড়ে পড়ে আছে রাস্তার ধারে। এরপর বিখ্যাত হিল-কার্ট রোড ধরে একে একে তুঙ্গ, সোনাদা অতিক্রম করে আমরা এসে পড়লাম 'ঘুম' স্টেশনে।
জীবনে প্রথমবার দার্জিলিং এসেছি,তাই প্রায় হাঁ করে দেখতে লাগলাম প্রকৃতিকে আর প্রাণভরে ক্যামেরা বন্দী করতে লাগলাম মুহূর্তগুলিকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই চলে এলাম লম্বা লম্বা পাইনগাছে ঘেরা লেপচাজগতে।মনটা চা-চা করছিল, তাই এখানে কিছুক্ষণের জন্য আমরা থামলাম।
কুয়াশামোড়া ঘুম-কে ডানদিকে রেখে এবার আমাদের গাড়ি বাঁদিকের রাস্তা ধরে ছুটতে শুরু করলো। এই রাস্তায় কিছুটা যাওয়ার পরই খেয়াল করলাম, এতক্ষণ যে জনকোলাহলের মধ্যে দিয়ে আসছিলাম, হঠাৎ করেই তা উধাও হয়েছে, তার বদলে সারা রাস্তা জুড়ে অদ্ভুত এক নিরবতা। ঘন কুয়াশার কারণে দশহাত দূরের জিনিসও ভালো করে দেখা যাচ্ছে না,আর কুয়াশা একটু হালকা হতেই উঁকি দিচ্ছে দৈতাকৃতি পাইনগাছের মাথাগুলি, সার বেঁধে আমাদের রাস্তা আটক করে রাখবে, এই বুঝি তাদের পরিকল্পনা।
অতনুস্যার এবং বিপ্লবস্যারের পূর্বপরিচিত কাঞ্চনকন্যা হোমস্টেতে চা খেয়ে, পাহাড়ের গা-ঘেঁষে মেঘেদের আনাগোনা দেখে, আমরা আবার গাড়িতে উঠলাম যখন, তখন চারপাশের নিস্তব্ধতা আরও প্রগাঢ় হয়েছে। এবার আর মাঝে কোথাও হল্ট নয়, আমাদের গাড়ি একবারে ধোত্রেতে গিয়ে থামবে। একে একে সুখিয়াপোখরি, মানেভঞ্জনকে পিছনে ফেলে দিয়ে আমাদের গাড়ি দুর্দার গতিতে যতই গন্তব্যের দিকে এগিয়ে যেতে লাগলো, বুঝলাম সভ্যজগৎ থেকে ততই বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছি আমরা। বেলা সাড়ে তিনটে নাগাদ এসে পৌঁছালাম ধোত্রে গ্রামে। আমাদের গাড়ি করে যাত্রা এইখানেই শেষ,এবার বাকি পথটুকু আমাদের পায়ে হেঁটেই উঠতে হবে। গাড়ি থেকে নামতেই একরাশ মিষ্টি-শীতল হাওয়া সারা শরীরে হিমেল অনুভূতি জাগিয়ে আমাদের জড়িয়ে ধরে অভ্যর্থনা জানালো।
বড় বড় পাইনের জঙ্গলে ঘেরা শান্ত-স্নিগ্ধ, ছোট্টো অথচ সাজানো-গোছানো ধোত্রে গ্রামটিকে একঝলক দেখলেই তার প্রেমে পড়ে যাওয়া যায়, আমিও গেলাম। ধোত্রেতে শেরপা লজ আগে থেকেই বুক করা ছিল।সেখানে পৌঁছেই আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম সবাই তখনই স্নান করে নেবো, কারণ আগামী তিন-চারদিন স্নানের ব্যবস্থা থাকবে না; আর থাকলেও এইরকম ভয়ানক ঠাণ্ডায় স্নান করে কেউ সময় আর শরীর কোনোটাই নষ্ট করবো না। এরপর যথারীতি স্নান করে যখন একগ্রাস গরম ভাত মুখে তুললাম, মনে হলো, অমৃত কোথায় লাগে এর সামনে। কষা ডিমের তরকারি দিয়ে চেটেপুটে ভাত খেয়ে, টহল দিতে বেরোলাম ধোত্রের আনাচে-কানাচে।
রাস্তার ধারে নানারকমের নাম-না-জানা রঙবেরঙের ফুল ফুটে রয়েছে,আমাদের ছুঁয়ে একের পর এক নানা আকারের মেঘেরা রাস্তার একধার থেকে আরেকধারে ছোটাছুটি করছে। এ এক অদ্ভুত অনুভূতি। ঠিক যেমন ছোটোবেলায় রূপকথার গল্পে আমরা মেঘের রাজ্যের কথা পড়তাম, এ যেন ঠিক তাই। তাদের কোনোকিছুরই পরোয়া নেই, তারা শুধু পাইনের মাথাগুলিকে আলতো স্পর্শ করে আদর করতেই ব্যস্ত। হাঁটাহাঁটি করতে করতে একসময় হঠাৎ করেই চারপাশের গাছগুলির গা বেয়ে ঝুপসি অন্ধকার নেমে এল। সেই অন্ধকার মাখা রাস্তায় গান করতে করতে আমরা ঘরে ফিরলাম। ইতিমধ্যে আমরা আমাদের গাইড বুক করে নিয়েছি এবং গাইড জানিয়ে দিয়েছে কাল সকাল সকালই আমাদের ট্রেকিং শুরু হবে। তাই হোমস্টেতে ফিরে কিছুক্ষণ গল্পগুজব করে, আগামী চারদিনের প্ল্যানিং করে, রুটি দিয়ে কষা মাংস সহযোগে নৈশভোজ সেরে চটপট লেপের তলায় সিঁধোলাম। সারাদিনের ক্লান্তি, উত্তেজনা আর আনন্দের বশে কিছুক্ষণের মধ্যেই চোখের পাতা ভারী হয়ে এল।
নাম - কিশান পাল
পেশা - কলেজের অধ্যাপক
নিবাস - কলকাতার টালিগঞ্জ
ঘুরেছি এখনও অবধি - পুরুলিয়ার অযোধ্যা পাহাড়, বাঁকুড়া-বিষ্ণুপুর, সুন্দরবন, শান্তিনিকেতন, ঘাটশিলা, সান্দাকফু,ধোত্রে, টংলু, উত্তরপ্রদেশের বেনারস, ওড়িশার দারিংবাড়ি।
শখ - অবশ্যই ঘুরে বেড়ানো,ছবি তোলা, বই পড়া, গান শোনা