Tripsee Treks  and Tours LLP
Blog and Travel with Us

ফুলের উপত্যাকা



Anurag Sarkar Chakraborty Anurag Sarkar Chakraborty

নামটা শুনেই অভিজ্ঞ পর্বতপ্রেমীরা বুঝেই গেছেন কোন জায়গাটার কথা বলছি? হ্যাঁ, ঠিকই বুঝেছেন, Valley of Flowers, Uttarakhand। 1931 সালে জায়গাটার নামকরণ করেন একজন ব্রিটিশ পর্বতারোহী “ফ্রাঙ্ক সিডনি স্মিথ”। বর্তমানে এটি UNESCO WORLD HERITAGE SITE-এর অন্তর্ভুক্ত। প্রকৃতির সাথে ছোটবেলা থেকেই আমার ভালোবাসা একটু বেশিই। যতদূর মনে পড়ে জ্ঞান হয়ে প্রথম পাহাড় দেখেছিলাম কাশ্মীরে। ব্যাস হয়ে গেলো, Love at first site!! তারপর থেকে চম্বা, খাজিয়ার, সাংলা, কল্পা, শিমলা, মানালী অনেক ঘুরেছি। কিন্তু এই ফুলের উপত্যকা বিশেষ কারণে আমার কাছে বেশ গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এটি আমার জীবনের প্রথম ট্রেক। যা হয়, আর কি !!!! দিন যত এগিয়ে আসছিল ভেতরের চাপা উত্তেজনার পারদের মাত্রাও চড়ছিলো। অবশেষে ৯ই আগস্ট, ২০১৯ এ আমরা যাত্রা শুরু করলাম।আমরা মানে আমরা চার বন্ধু। হাওড়া থেকে উপাসনা এক্সপ্রেসে পরেরদিন হরিদ্বার পৌছালাম। যেহেতু ট্রেন প্রায় ৭ ঘন্টা দেরিতে ছেড়েছিলো, তাই পৌঁছাতেও সেরকমই দেরী হলো। পরেরদিনের গন্তব্যস্থল ছিলো গোবিন্দঘাট।

সেইমতো সক্কাল সক্কাল বেরিয়ে পড়লাম গাড়িতে চেপে। আমার চার বন্ধু (আত্রেয়ী, অভিজিৎ, তিতাস আর সায়ান্বেষা) ছাড়াও আমাদের দলে অপরিচিত অনেকেই ছিলেন। রাস্তায় যেতে যেতে আলাপও হয়ে গেলো তাদের সাথে প্রাতরাশ, মধ্যাহ্নভোজ সব মিলিয়ে প্রায় রাত ১১ টা নাগাদ পৌছালাম গোবিন্দঘাটে। মাঝরাস্তায় দেখলাম রুদ্রপ্রয়াগ, ভারত সরকারের চারধাম প্রজেক্টের কাজ। ভাবছেন এতটা রাস্তায় মাত্র এইদুটো জিনিস চোখে পড়লো ! বাকি সময়টা স্বপ্ন দেখছিলাম, মানে ঘুমাচ্ছিলাম। হোটেলে পৌঁছে নৈশ্যভোজ সারতে খানিক রাত হলো, কিন্তু তা সেরে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়েও পরলাম। গবিন্দঘাট থেকে ভ্যালি অফ ফ্লাওয়ার্স একদিনে যাওয়ার নয়। প্রথমদিন ঘাঙ্গারিয়াতে থাকতে হয়, পরেরদিন যায় ভ্যালিতে। এবার গবিন্দঘাট থেকে ঘাঙ্গারিয়া মানুষে দুভাবে যায়।

১। গোবিন্দঘাট থেকে সোজা ঘাঙ্গারিয়া ১৪ কিলোমিটার হাঁটা।
২। গোবিন্দ ঘাট থেকে গাড়ি করে পুলনা (৪ কিলোমিটার) এবং তারপর পুলনা থেকে ১০ কিলোমিটার হেঁটে ঘাঙ্গারিয়া।

 আমরা দ্বিতীয় অপশনটা নিয়েছিলাম। এর মধ্যে ঘটেছিলো এক কান্ড। গোবিন্দঘাট থেকে গাড়ি করে পুলনা যাচ্ছি, সবাই প্রকৃতিকে ক্যামেরাবন্দি করতে ব্যাস্ত। আমিও বাদ যাই কেন? কিন্তু পকেটে হাত দিতে মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো, ফোন নেই। পুলনা নেমে আমার বড় ব্যাগও তন্ন তন্ন করে খুঁজলাম, পেলামনা। বুঝলাম গোবিন্দঘাটের হোটেলের রিসেপশনে ফেলে এসেছি ফোন। কিন্তু অনেকেই আমাকে ভরসা দিলো যে এরা পাহাড়ী মানুষ, অত্যন্ত সৎ, ফিরে গিয়ে ফোন পাওয়া যাবে। দেখলাম একদম ঠিক।ট্রেক শেষ করে ফোনের খবর নিতে আবার সেই হোটেলে গেলাম। হোটেলের রিসেপশনের ভদ্রলোক সত্যি অমায়িক, যেন তিনি জানতেন আমি ফোনটা নিতে ফিরব। যেতেই হাসিমুখে আমার ফোনটা ফেরত দিলেন। আর হারানিধি ফেরত পেয়ে আমার মুখেও হাসি ফিরল। এই কারণেই যেকটা ছবি আমি লেখার সাথে দিচ্ছি তা সবই আমার বন্ধুদের তোলা (বিশেষ করে আত্রেয়ী-এর)।

শুরু হয়ে গেলো আমাদের পদয়াত্রা। মালপত্র গেলো খচ্চরের পিঠে। ২০ মিনিট হাটঁছি, খানিক বসছি, আবার হাটঁছি। চলতে থাকলো এরকম করেই। মাঝে যখনই খিদে পেয়েছে হয় ম্যাগি নাহয় আলুর পরোটা খেয়েছি। আলুর পরোটা গুলো বেশ সুন্দর খেতে (আমি ভয়ানক পেটুক আর ভোজনরসিক)। রাস্তায় চলতে চলতে স্বভাববশত বিভিন্ন মানুষজনের সাথে আলাপ হলো। কেউ রাজস্থানী, কেউ আবার মনিপুরী, কেউবা আবার মারাঠী। সেদিন সত্যজিৎ রায়ের ছবি প্রিন্ট করা একটা T-Shirt পড়েছিলাম। অনেক অবাঙালি সেটা দেখে বললো, “Satyajit Ray, you are from Bengal, right?”। মাঝখানে একটা জায়গা এলো, তার নাম “ভুইন্দার”;। আগের রাস্তাটা এতটা খাড়াই ছিলোনা যতটা ছিলো এই জায়গার থেকে। কিন্তু যত কঠিনই হোক না কেন, প্রকৃতির সাথে সরাসরি যোগাযোগ (যেটা গাড়িতে ভ্রমণ করলে হয়না) একটুও বুঝতে দেয়নি সেটা কঠিন। যদিও অভিজ্ঞ ও দক্ষ ট্রেকারদের কাছে এটা অনেক সহজ ট্রেক। কিন্তু যেহেতু প্রথমবার, তাই খানিক কঠিনই ছিলো আমার কাছে।

ট্রেকে গিয়ে একটা জিনিস শিখেছিলাম সেটা হল …..মনের জোর। আমার এক বন্ধু আত্রেয়ীর গতরাতে হোটেলে ঢোকার মুখে পা মচকে, তা ফুলে যাওয়া সত্ত্বেও সে বললো, “আমি ট্রেকিং করতে এসেছি, খচ্চরের পিঠে চাপতে নয়। হ্যাঁ খানিক আসতে চলবো, কিন্তু হেঁটেই যাবো “। যাই হোক, এই করে সন্ধ্যে সাড়ে ছয়টায় পৌছালাম ঘাঙারিয়া। রাতে গুরুদ্বারে কাটালাম। পরদিন সকাল সকাল প্রাতরাশ করে বেরিয়ে পরলাম সেই মূল গন্তব্য …..ফুলের উপত্যকার উদ্দেশ্যে।

যাত্রা শুরু করলাম সকাল সাড়ে আটটা নাগাদ। ঘাঙারিয়া গুরুদ্বার থেকে পাঁচ মিনিট মত হেঁটে একটা জায়গা আসে, যেখান থেকে ভ্যালি অফ ফ্লাওয়ারস আর হেন্ডকুন্ড সাহিব-এর রাস্তা ভাগ হয়ে যায়। আমরা গেলাম উপত্যকার দিকেই। খানিকটা এগিয়ে টিকিট কাউন্টার।ভারতীয়দের জন্য ১৫০ টাকা আর বিদেশিদের জন্য ৬০০ টাকা। বিশাল লাইন,টিকিট কেটে  আবার রওনা দিলাম। বর্ষাতি রাখতে হয়েছে, কারণ যখন তখন বৃষ্টি হচ্ছে আর খুব সাবধানে পা ফেলতে হচ্ছে, কারণ বৃষ্টিতে রাস্তা পুরো ভেজা। সরু রাস্তা, একপাশে খাদ আরেক পাশে পাহাড়ের গায়ে জঙ্গল।ঘাঙারিয়া থেকে এক কিলোমিটার যাবার পর থেকেই সাত-আট রকমের ফুলের দেখা মেলে। নাজানি ফুলের উপত্যাকায় কতরকম ফুলের সমারোহ দেখবো! তবে আশেপাশে বড় গাছের খুব একটা দেখা পেলাম না। হয়ত সেই কারনেই ফুলের গাছ গুলি সযত্নে বেড়ে উঠতে পেরেছে। জীবনে প্রথমবার এরকম রাস্তায় চলছি। তাই একটু ভয়ও কাজ করছিলো। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার, খানিক পরে প্রকৃতির সৌন্দর্য সেই ভয়টা পুরোপুরি মুছে দিলো। একদম নির্ভয়ে হাঁটা শুরু করলাম। মাঝে একটু কোথাও জায়গা পেলে শুকনো ফল, চকলেট দিব্যি পেটে পুরে চলেছি আর বন্ধুদের সাথে মজা করতে করতে উঠছি ওপরে। আমরা জেনে এসেছিলাম যে এই রাস্তা তিন-চার কিলোমিটারের। কিন্তু হাঁটতে গিয়ে দেখি রাস্তায় আর শেষই হয়না। হবে কি করে? একে আসতে হাটঁছি, তার ওপর আবার খাড়াই রাস্তা। মাঝে মাঝে দাঁড়িয়ে বিভিন্ন কেত দিয়ে ছবি তুললাম আর পাহাড়ের পাথর বেয়ে খানিকটা উঠে ঝর্ণা থেকে জলও ভরলাম। দেখলাম কিছু ক্ষয়প্রাপ্ত গ্লেসিয়ার আর বিভিন্ন পাহাড়ী ফুল। আকাশে মেঘ রৌদ্রর খেলা, সাদা মেঘ

পাহাড়ের আল দিয়ে চরে বেরাচ্ছে। মাঝে মাঝে পাহাড়ি ঝোরা আমাদের সঙ্গ দিচ্ছে, কখনো বা লুকোচুরি খেলছে। এভাবে চলতে চলতে খেয়ালই করিনি যে কখন ভ্যালি অফ ফ্লাওয়ারসের মূল আকর্ষণের জায়গায় পৌঁছে গেলাম। পর্বতের কোলে নানা রঙের ফুলগাছে ঢাকা একটা সুন্দর জায়গা, যা দেখে বলতেই হয়, “আহা কি দেখিলাম, জন্মজন্মাতরেও ভুলিবনা”।চারিদিকে নানান ফুলের সমারোহ, যেমন তাদের বর্ণের বিভিন্নতা তেমনি বিভিন্নতা তাদের আকারেও। কোনটি লাল, কেউ হলুদ, কেউবা সেজেছে নীল আভরণে।কেউ একা ফুটে আছে কেউবা থোকা হয়ে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছে। কাকে ছেড়ে কাকে দেখবো! যেন এক ফুলের স্বর্গে বিচরণ। দুচোখ ভরে দেখতে থাকলেও আশ মেটে না।প্রায় পাঁচ হাজার রকম ফুলের বৈচিত্র্য এই উপত্যাকাতে দেখা জায়।আমরা অত প্রকারের না দেখতে পেলেও মন আমাদের ভরে গেছে। যাই হোক সেখানে খানিক ভোজন সেরে নিয়ে ঠিক করলাম আরও খানিকটা এগোবো, মার্গারেটের সমাধি পর্যন্ত। কিন্তু ফেরার কথাটাও মাথায় রাখতে হবে, কারন সন্ধ্যার মধ্যে না ফিরতে পারলে অন্ধকারে বিপত্তি হতে পারে।

(Joan Margaret Legge; এক ব্রিটিশ সংস্থা, ROYAL BOTANIC GARDES, KEW-এর একজন ব্রিটিশ উদ্ভিদবিজ্ঞানী যিনি এই ফুলের উপত্যকায় ফুল পরীক্ষা করতে এসে পদস্খলনে পরলোকগমন করেন ১৯৩৯ সালে। পরে তার বোন সেই জায়গায় যান এবং দিদির নামে সমাধি তৈরী করেন)।  কিন্তু মনে হয় আমরা একটু বেশীই মোহিত হয়ে গেছিলাম ।অতটা দূরে যাওয়ার পক্ষে বেশ দেরীই হয়ে গেছে। ওঠাটা যতটা সহজ ছিলো, নামা ততটাই ঝুঁকিপূর্ণ, কারণ একে সরু রাস্তা, তার ওপর বৃষ্টির জন্যে রাস্তা পিচ্ছিল। অগত্যা আরো খানিকটা এগিয়ে ছবি তুলে আমরা এবার ফিরে আসার সিধান্ত নিলাম।আমরা তিন বন্ধু একে ওকে ধরে বেশ ধীরে সুস্থেই নামা শুরু করলাম। ওঠার সময়ে ছবি তুলেছি, নামার সময়ও বা ছাড়ি কেন? সুতরাং ছবি পর্বও চললো। আমরা ফিরে চলছি ঘাঙারিয়ার উদ্দেশ্যে। পিছনে পড়ে রইল ফুলের উপত্যকা। ফিরতে একদমই ইচ্ছা করছিল না। ফুলেদের কথা দিয়ে আসলাম……...আবার ফিরব বন্ধু।

কিন্তু জানিনা সে কথা ভবিষ্যতে রাখতে পারব কিনা...।।

Meet the Blogger

Anurag Sarkar Chakraborty


Name: Anurag Sarkar Chakraborty
Residence: Chittaranjan (Permanent), Madhyamgram (Present)
Hobbies: Traveling, Trekking (newly included), Collecting information about Indian Railway
Previous treks: Valley of Flowers



You may also like