পৃথিবীর বুকে আরেক ছোট্ট স্বর্গীয় ভুবন। ভারতের উত্তরাখণ্ডের চামোলী জেলায় অবস্থিত। ইহা হিমালয় রেঞ্জের টিপলা হিমবাহের পাদদেশে অবস্থিত। ভ্যালি অফ ফ্লাওয়ার্স ১৯৮২ সালে জাতীয় পার্ক ঘোষণা করা হয় এবং এখন এটি একটি বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান।
পার্কের শুরু ঘাঙ্গারিয়া বেস ক্যাম্প থেকে ৩ কি.মি. দূর থেকে। তবে পার্কটি ৮৭.৫০ বর্গকি.মি. বিস্তৃত এবং এটি প্রায় ৮ কিলোমিটার দীর্ঘ এবং প্রশস্তে ২ কিলোমিটার বিস্তৃত।
ভ্যালি অফ ফ্লাওয়ার্স আবিষ্কৃত হয় ১৯৩১ সালে। ফ্রাঙ্ক স্মিথ, এরিক শিপটন এবং আর.এল. হোলসওয়ার্থ, ব্রিটিশ পর্বতারোহীরা মাউন্ট কামেটে সফল অভিযানে ফিরে আসার সময় প্রতিকূল আবহাওয়ায় তাদের পথ হারিয়ে ফেলে এই ফুলে ভরা উপত্যাকায় এসে উঠেন। ফ্রাঙ্ক স্মিথ পরে একই নামের একটি বই রচনা করেন, যা সাড়া ফেলেছিল চারপাশে।
উপত্যকাটি বছরের ছয় থেকে সাত মাস ধরে তুষারে আবদ্ধ থাকে। জুলাই মাসে ফুলে ভরে ওঠে পুরা উপত্যকাটি।
নিকটতম প্রধান শহর গোধওয়ালের যোশীমঠ, যা হরিদ্বার ও দেরাদুনের সাথে মনোরম আঁকাবাঁকা রাস্তা দ্বারা সংযুক্ত, যোশীমঠ থেকে হরিদ্বার ও দেহরাদুন ২৭০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত।উপত্যকায় প্রবেশের বেশ খানিকটা পথ আগের থেকে হিমালয়ের হিম বাতাস সাথে ফুলের গন্ধ যেকোন ব্যক্তির মনকে চাঙা করে দিবে নিমিষেই। মনোবল বাড়িয়ে দেয় কয়েকগুন, যা দিয়েই উচ্চতাকে জয় করে হেঁটে ঘুরে দেখতে পারবেন পুরো উপত্যকাটি। রঙিন হাজারো ফুলের মাঝে দিয়ে উঁকি দেওয়া হিমালয় রেঞ্জের টিপলা হিমবাহ এবং চারপাশের বিশালতার মাঝে নিজেকে খুবই ক্ষুদ্র লাগে ক্ষণিকের জন্য।
আমাদের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল এই ভ্যালি অফ ফ্লাওয়ার্স। তবে তার সাথে যাওয়া আসার মাঝে উত্তরাখণ্ডের বেশ কিছু শহর কিংবা অংশও আমরা ঘুরে দেখি। যার মাঝে ছিল দেরাদুন, মুসৌরী, যোশীমঠ, আউলি, মানাগ্রাম ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য জায়গা।
আমাদের যাত্রা!!!
ঈদের পর দিন ২৩ই আগষ্ট, ২০১৮ রাতে যাত্রা শুরু করি আমরা ৯ জন।
২৪-ই আগষ্ট ভোরে সবাই এসে মিলিত হই দর্শনা সীমান্তে। দ্রুত দুপাশের আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে ঢুকে পড়লাম দাদাদের দেশে! গেদে রেলষ্টেশন থেকে টিকেট কেটে উঠে পড়ি কলকাতাগামী লোকাল ট্রেনে। কলকাতায় নেমে মেট্রোতে চড়ে চলে গেলাম নিউ মার্কেট এলাকার হোটেলে।
সাময়িক বিশ্রাম সাথে ট্রেকিং আনুষঙ্গিক কেনাকাটা শেষে সবাই শিয়ালদহ রেলষ্টেশন থেকে রওনা হলাম উত্তরাখণ্ডের হরিদ্বারের উদ্দেশ্যে। ট্রেনটি ছিল “দুন এক্সপ্রেস”। টুকটাক খাবার, ঘুম, ষ্টেশনে ষ্টেশনে নেমে প্রতিটা এলাকা সামিট করতে করতে অবশেষে ৫ ঘন্টা দেরি করে প্রায় ৩৯ ঘন্টা পর ২৬ই আগষ্ট সকালে সেই ট্রেন আমাদের দয়া করে নামিয়ে দেন হরিদ্বার ষ্টেশনে।
২৬-ই আগষ্ট তারিখ হরিদ্বারের বৃষ্টি ভেজা সকাল দেখে সবার মনে মনে একটু একটু শঙ্কা জাগা শুরু হয়ে যায় ট্যুর নিয়ে। ষ্টেশনের সামনেই ছিল জীপ সমিতির অফিস। তাদের ওখান থেকে দেখে শুনে একটি জীপ ঠিক করে নেন আমাদের ট্যুরের অন্যতম হিন্দি টকিং টম শাওন ভাই। ঝিরিঝিরি বৃষ্টি নিয়ে শুরু হইল যাত্রা ২৯০ কি.মি. দূরের গোবিন্দঘাটের দিকে। তবে জীপে একটা সিট খালি থাকলেও বৃষ্টি মশাই বেশিক্ষণ ছিল না আমাদের সাথে। গঙ্গা নদীর বিধ্বংসী স্রোত দেখতে দেখতে যখন যাচ্ছিলাম হৃষীকেশ দিয়ে তখনই হালকা অনুমান করতে পারছিলাম, যে উপরের দিকে কি চলতেছে। জানি না বাকিরা কি ভাবছিল, তবে কেউ কিছু বলে নি এই বিষয়ে দলের মনোবল আরও কমে যাবার চিন্তায়।
হৃষীকেশের পরেই আঁকাবাঁকা পথে এগিয়ে যাচ্ছিল জীপটি, এক পাশে ভঙ্গুর পাথুরে পাহাড় আরেক পাশেই খাদের নিচে বয়ে চলা গঙ্গার স্রোত ও তার রং কিছু একটার ইঙ্গিত দিয়ে বুঝাতে চাইছিল আমাদের। যার প্রথম আলামত পেয়ে যাই যাত্রার ১-২ ঘন্টার মাঝেই। ছোটখাটো এক পাহাড়ের পাথর ধ্বস। তবে প্রথম দেখে ২০-৩০ মিনিটেই ছেড়ে দিল মনে হয় আমাদের ভাগ্য।
জীপ ছুটে পার হতে থাকে একে একে সুন্দর সুন্দর ছোট শহর। এর মাঝে দেবপ্রয়াগ, কীর্তিনগর, শ্রীনগর, রুদ্রপ্রয়াগ, কর্নপ্রয়াগ ইত্যাদি শহর ভুলার মত না, কেউ চাইলেই এই শহর গুলোতে এসে ২-৩ দিন বসে বসে পাহাড়-নদীর রুপ দেখেই পার করে দিতে পারবে।
ট্যুরের প্রথম ধাক্কা নিয়ে অপেক্ষায় ছিল চামোলি শহরের কোন এক পুলিশ চেকপোস্ট! রাত তখন ৭-৮টা, থামিয়ে দিল আমাদের স্থানীয় পুলিশ। বিশাল আকারের পাহাড় ধ্বস হয়েছে ১কি.মি. সামনে, রাস্তা বন্ধ, কাজ শুরু হয়েছে তবে ভোরের আগে রাস্তা খোলার চান্স নাই, তাই আমাদের এই শহরের হোটেলে থেকে সকালে যাত্রা শুরু করতে উপদেশ দেন তারা। চরম হতাশা কাজ করছিল মনে মনে, শঙ্কা পূর্ব পরিকল্পনা থেকে ছিটকে যাওয়ার। একদিন পরিকল্পনা থেকে ছুটে যাওয়া মানে কয়েকটা জায়গা না দেখেই ফেরা!
সারাদিনের সকল ক্লান্তি এবং হতাশা নিমিষেই দূর করে দেয় চামোলির হোটেল থেকে বৃষ্টির মাঝে অলকানন্দা নদীর রুপ এবং তার পানির সুর।
২৭-ই আগষ্ট সকালের রুপটাও ছিল স্বপ্নের মতই। দ্রুত গুছিয়ে আবার যাত্রা শুরুর পর আবার ধাক্কা খেলাম সেই চেকপোস্টে গিয়ে। সকালে আবার নতুন করে ধ্বস হয়েছে আরেকটি জায়গায়। সময় লাগবে ঠিক হতে, কারণ এটাও ছিল বিশাল আকারের!
২-৩ ঘন্টা অপেক্ষার পর আস্তে আস্তে এগিয়ে যাই জীপ সহ ঐ পাহাড়ের সামনে। ১ম পর্যায়ে রাস্তা ঠিক করতে আসা এস্কেভেটরের দুমড়ানো মুচড়ানো রুপ দেখে যে কোন মানবেরই তার মেরুদন্ড দিয়ে শীতল পানি বয়ে যাওয়ার মত শীতল অনুভূতি জাগবেই। যেই ধ্বস নেমেছে তা পুরোটা ঠিক করতে ২দিন তো লাগবেই, প্রাথমিক পর্যায়ে একটু ঠিক করে গাড়ি পার হওয়ার সুযোগ দেয় পুলিশ। কারণ এইসব পাহাড়ি রাস্তাই ঐ অঞ্চলের প্রধান এবং একমাত্র যোগাযোগের মাধ্যম। কাদাময় পাহাড়ের ঐ অংশটি পার হতে ৪-৫ মিনিট লাগলেও আমাদের কাছে মনে হচ্ছিল ২-৩ ঘন্টা, একপাশ থেকে অনবরত ছোট ছোট পাথর বর্ষণ এবং আরেক পাশে খাদ!!
এই ধাপে বেঁচে রওনা হলাম গোবিন্দঘাটের দিকে। পথে পথে ধ্বসের শঙ্কার সাথে নতুন যোগ হইল আরেক চিন্তা। ২টার আগে গোবিন্দঘাট যেতে না পারলে ঐদিন আর যাওয়া হবে না বেসক্যাম্প ঘাঙ্গারিয়াতে, যার মানে পরিকল্পনা থেকে একদিন পিছিয়ে যাওয়া।
এই পথের রাস্তা ছিল এক কথায় স্বর্গীয়। পথের শেষের দিকে পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে প্রায় ৬১০০ফুট উপরে পৌঁছে যাই যোশীমঠ। ভ্যালী অফ ফ্লাওয়ারের নিকটবর্তী বড় শহর। যদিও কালক্ষেপণ না করে আমরা চলে যাই গোবিন্দঘাট, ততক্ষণে ৩টা বেজে যায়। আবার ধাক্কা দিতে প্রস্তুত পুলিশচেকপোষ্ট! বেশ কয়েকবার অনুরোধ করার পর চেকপোষ্ট থেকে থানায় কথা বলে আমাদের অনুমতি নিয়ে দেন সেই পুলিশ ভাই, সাথে বলে দেন তাড়াতাড়ি হেঁটে যেতে কারণ সন্ধ্যার পরই ঐ এলাকায় হিংস্র বন্যপ্রাণীদের আনাগোনা বেড়ে যায়।
দ্রুত নিজেদের নাম এন্ট্রি করে কার্ড বানিয়ে আরেকজীপে করে চলে যাই পুলনা ভিলেজ। সেখান থেকেই ট্রেকিং শুরু, যেতে হবে ৬০০০ফুট থেকে ১০০০০ফুট উচ্চতায় প্রায় ১০ কি.মি.। এদিকে হাতে সময় আছে ৩ ঘন্টার মত সন্ধ্যা হতে। পরে সময় ও বন্যপ্রাণীর কথা চিন্তা করে ঘোড়ায় চড়ে রওনা হই। হেলতে দুলতে ঠিক সন্ধ্যার দিক পৌঁছাই ঘাঙ্গারিয়ায়। এ যেন আরেক ডিপ ফ্রিজ!! হোটেলের পানি ছুয়ে দেখাও চ্যালেঞ্জের ব্যপার হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল।ভারতে যাবার পর ঐ রাতেই ভালো করে খেতে পেরেছিলাম, এই কঠিন জায়গায় ১০০০০ফুট উপরে ঠান্ডার মাঝে খিচুড়ি ও ফ্রাইড রাইস স্বর্গীয় খাবার হয়ে দাঁড়িয়েছিল আমার জন্য। আশপাশ হালকা ঘুরে পরিকল্পনা আবার সেনাপতি থেকে শুনে, শুয়ে পড়ি এক স্বপ্নের দিনের অপেক্ষায়।
২৮-ই আগষ্ট ছিল স্বপ্নের ভোর। এদিকে বৃষ্টিও থেমে নীল আকাশের দেখা পাওয়া, যা ছিল স্বপ্নের চেয়েও একটু বেশী কারণ ১ সপ্তাহ পর সূর্য উঁকি দিয়েছে ওইদিন সকালে। ঠান্ডার মাঝেই শুরু করলাম ট্রেকিং। প্রায় ১কি.মি. যাওয়ার পর টিকেট এবং নাম এন্ট্রি করা লাগে। বিদেশী নাগরিক হওয়ায় ভারতীয়দের থেকে ৪গুন বেশি ৬০০রুপী দিয়ে টিকেট কাটার সাময়িক বিরতির পর আবার চলা শুরু। প্রায় ৩ কি.মি. পর ভ্যালির প্রথম অংশ পাওয়া যায়, ততক্ষনে সূর্য তার তাপ ছড়াতে শুরু করেছে কিন্তু বার বার হার মানছিল হিমশীতল বাতাস এবং মেঘের কাছে। ঠাণ্ডায় এটাই আমার প্রথম ট্রেক, একদিক থেকে আরামই আছে! গরম লাগে না বেশী, ঘামও হয় না। তবে উচ্চতার কারণে একটু যেতেই মাথা ঝিম ঝিম, অল্পেই হাঁপিয়ে উঠছিলাম। উঠতে হবে প্রায় ১৪০০০ ফুট উপরে!
যাই হোক পাথুরে পথে উঠতে উঠতে হঠাৎ চোখ আটকে গেল দূরের সাদা পাহাড়ে। যেটি ছিল “টিপলি” হিমবাহ। মনে মনে অনুভূতি হচ্ছিল এভারেষ্ট তো তাইলে জয়ই করে ফেললাম। চারপাশ থেকে শীতল বাতাসের সাথে ভেসে আসা ফুলের ঘ্রাণ আর সাথে চারপাশের বিশাল পাহাড়গুলোয় মেঘের খেলা, সব মিলিয়ে এক স্বর্গীয় সুখ যা কখনই লিখে প্রকাশের মত না। ফুলের প্রধান সময়ের কিছু দিন পর যাওয়া এবং টানা বৃষ্টির জন্য ফুলে ভরা ভ্যালি না পেলেও স্বর্গীয় সুখটি একফোঁটাও কম মেলেনি আমাদের।
স্বর্গীয় সুখের মাত্রা বাড়িয়ে দিতে ট্রেকিং পথের একটু পর পর রয়েছে উপরের পাহাড় থেকে বয়ে আসা বরফ গলা ও বৃষ্টির জমে থাকার শীতল পানির ঝর্ণা, যা পরবর্তীতে অলকানন্দা নদী হয়ে গঙ্গার সাথে মিশে।
ভ্যালিটি ৬-৭কি.মি. এলাকা জুড়ে বিস্তৃত। আমরা একবারে হিমবাহের নিচে না গেলেও কাছাকাছি গিয়েছিলাম। সব মিলিয়ে ১২-১৩ কি.মি. হাঁটা হয় আশা যাওয়া মিলিয়ে আমাদের। চেষ্টা করেছিলাম যতটুকু সম্ভব জায়গাকে অনুভব করার।
বিকেলে ক্লান্ত শরীর কিন্তু ভরপুর স্বর্গীয় অনুভূতি নিয়ে সবাই বেসক্যাম্পে এসে যার যার মত সময় কাটালাম, মাঝে পরের দিনের পরিকল্পনা গুছিয়ে নিলাম সবাই।
২৯-ই আগষ্ট ভোরে উঠে হালকা ফ্রাইড রাইস খেয়ে শুরু করলাম ট্রেকিং, লক্ষ্য পুলনা ভিলেজ। আসার সময় ঘোড়ায় আসলেও এবার ট্রেকেই বিশ্বাসী থাকলাম আমরা। তবে ৩ জন কে ক্লান্তি এবং পায়ে ব্যাথা জনিত কারণে ঘোড়াতেই ফিরেছিল। প্রায় ১১টার মাঝেই আমরা ফিরে আসি “গোবিন্দঘাট”। এবার যা হবে সবই বোনাস!!!!
আমাদের হিন্দি টকিংটম শাওন এবং রনি ভাইয়ের কল্যাণে দ্রুত জীপ ঠিক করে নিলাম। লক্ষ্য বদ্রিনাথ মন্দির হয়ে মানা। কোথাও রাস্তার উপর দিয়েই বয়ে যাওয়া পাহাড়ি ঝর্ণা, আবার কোথাও পাহাড় ধ্বসের কাদাময় রাস্তা, সব মিলিয়ে ঘোবিন্দঘাট থেকে মানা যাওয়ার রাস্তাটা ছিল এখন পর্যন্ত আমার দেখা সেরা রাস্তা। প্রথমে প্রায় ১০৮০০ফুট উপরে অবস্থিত এই বদ্রিনাথ মন্দির।
এরপর ছুটে চলা ভারতের শেষ গ্রাম “মানা” এর দিকে। একপাশে পাহাড় এবং অন্যপাশে অলকানন্দা নদীর রুপ দেখতে দেখতে কখন যে চলে গেলাম গ্রামের প্রবেশমুখে টের পাওয়াই দায়। সরুরাস্তা হওয়ার গাড়ি বাইরে রেখেই ঢুকে পড়লাম গ্রামটিতে। সাজানো গুছানো এই পরিষ্কার গ্রামে প্রায় ৫০০-৬০০জনের মত মানুষ থাকে। বছরের ছয় মাস বরফে ঢেকে থাকায় বাসিন্দারা তখন গ্রাম ছেড়ে চলে যায় নিচের শহর এলাকায়। অভাবের ছাপ তাদের মাঝে দেখা গেলেও হাসিমুখ গুলো তা বুঝতে দেয়নি আমাদের। গ্রামে বেশকিছু সময় ঘুরে দেখে নিলাম পুরো গ্রামটি। সবচেয়ে ভালো লেগেছে বিশাল দুই পাহাড়ের মাঝে দিয়ে ছুটে চলা ঝর্ণাটিকে। ভারতের শেষ কফি হাউস থেকে কফি খেয়ে আবার রওনা হলাম আমরা “যোশীমঠ” উদ্দেশ্যে। প্রায় বিকেল ৪টার দিক ফিরে আসি পাহাড়ি যোশীমঠ শহরে।
সময় নষ্ট না করেই চলে যাই যোশীমঠ- আওলি- যোশীমঠ কেবলকার ষ্টেশনে। জীবনের প্রথম কেবলকার যাত্রা, যেতে হবে ৩.৯৬ কি.মি.। আওলি হচ্ছে ভারতের চিত্তাকর্ষক ঢাল এবং পরিচ্ছন্ন পরিবেশের কারণে একটি জনপ্রিয় স্কিইং গন্তব্য। যদিও ওটার সময় আরো কিছু দিন পর থেকে, তবে প্রচুর ঠান্ডা শীত আসার পূর্বেই অনুভব করেছিলাম আউলিতে। কনকনে শীতল বাতাসে খুব কষ্টই হয়েছে। হালকা পকোড়া এবং নুডলস খেয়ে আবার রওনা দিলাম যোশীমঠ উদ্দেশ্যে। উঠার থেকে নামাটা ছিল খুবই মজার। মনে হচ্ছিল আকাশ থেকে দুনিয়াতে নেমে আসছিলাম সাথে অনুভব করছিলাম বুকের মাঝে প্রায় ১০০০০ফুট থেকে ৬২৫৩.৪ ফুটে নেমে আসার একটি চাপ। উপর থেকে যোশীমঠ এবং এলিফ্যান্ট হিল দেখতে এক কথায় অসাধারণ, ভাবছিলাম এগুলো যখন শীতে বরফে ঢেকে থাকে তখন দেখতে না আরও কত সুন্দর লাগে!! ভাবতে ভাবতে চলে এলাম যোশীমঠ শহরে আবার। হোটেল নিয়ে ওইদিনের মত আমাদের জম্পেশ দৌড়াদৌড়ি শেষ করলাম আমরা। ঐদিনই প্রথম স্ট্রিট ফুড খেলুম, ভালোই অনুভূতি ছিল।
রাত নামার আগেই আবার পুরোনো শঙ্কা আবার উঁকি দেওয়া শুরু হইল সবার মনের মাঝে। দুই-তিনটা দিন ভালো থেকে আবার বৃষ্টির আনাগোনা। সন্ধ্যা থেকে শুরু মুষলধারে বৃষ্টি, আবার পাহাড় ধ্বসের আশংকা!! এরই মাঝে খবর আসতে শুরু করে বন্যা পরিস্থিতির অবনতির।
৩০-ই আগষ্ট ভোররাত পর্যন্ত টানা বৃষ্টির খবর শুনে শঙ্কাময় মনে ঘুম থেকে উঠি রুমের জানালা দিয়ে এলিফেন্ড হিলের রুপ দেখতে দেখতে। পুরো ট্রিপে আমাদের উপর থাকা খোদার অদৃশ্য রহমতের কথাকে ভরসা করে রওনা হলাম উত্তরখন্ডের রাজধানী দেরাদুনের লক্ষ্যে। সারাদিন লেগে গেল এই আঁকাবাঁকা পথে, সাথে তো ছিল একটু পর পর পাহাড় ধ্বসের চিহ্ন। তবে দিনে আর বৃষ্টি না হওয়ায় বেঁচে যাই।
ঐ রাতে দেরাদুনে হালকা হাঁটাহাঁটি তবে ভারি খাওয়া দেওয়া দেই সবাই মেলা দিন পর। মনে হয়েছিল দেরাদুন শহরের ধুনদরবার নানা রকম কাবাব এবং বিরিয়ানি নিয়ে অপেক্ষায় ছিল আমাদের। বাংলাদেশী বুঝতে পেরে হোটেলের ম্যানেজার বের হয়ে এসে আমাদের সাথে কিছুক্ষণ কথা বলতে এগিয়ে এলেন, দিক নির্দেশনা দিয়ে দিলেন পরের দিনের ঘুরাফেরার ব্যাপারে। শহরের ওই অংশটা ছিল মুসলিম এলাকা। আমাদের পেয়ে সবাই তাদের মনের কথা বলার চেষ্টা করেই গেল।
৩১-ই আগষ্ট সকালে আলসেমি ছাড়ছিলই না আমাদের, যেন চলছেই না আর। উঠে এইবার আমাদের লক্ষ্য দেরাদুনের আশেপাশে ঘুরা এবং পাহাড়ের রানী মুসৌরী ঘুরে দেখা। বছরের বেশীর ভাগ সময় মেঘের বনে ডুবে আর শীতে তুষার চাদরে ঢেকে থাকে এই শহর। শহরের কেম্পটি ঝর্ণা, মুসৌরী লেকসহ বেশ কিছু জায়গা মেঘে ভেসে ভেসে ঘুরে বেড়ালাম ঐদিন। মেঘে ভেসে নরম আইসক্রিম খেতে খেতে শহরের আঁকাবাঁকা পথে হেঁটে বেড়ালাম জুম্মার নামাজ আদায় করে।
সন্ধ্যায় আবার দেরাদুন শহরে ফিরে সবার ইচ্ছে হইল সিনেমা দেখার। দেখে নিলাম ঐদিনই মুক্তি পাওয়া “স্ত্রী” ছবিটা। রাতে স্ত্রীর সেই ভূতকে সাথে নিয়ে ২য় দিনের মত জম্পেশ খানাপিনা হইল সেই মুসলিম অঞ্চলে।
১লা সেপ্টেম্বর উঠে ১২.৪৫ এ ইন্ডিগো এর ফ্লাইটে চলে যাই দিল্লী !! কিন্তু ৩ ঘন্টার যাত্রা বিরতি কলকাতা যাওয়ার পথে এখানে। আশেপাশে যাওয়ার সাহস করেনি কেউ জ্যামের শহরের জ্যামের ভয়ে। ভয় কাটাতে মনে হয় ২০মিনিটের ব্যবধানে পর পর দুই দফা সাঁটিয়ে নিলাম কেএফসিতে। কিছুক্ষণ করে আবার ইন্ডিগো দিয়ে চলে এলাম কলকাতা। বিমান থেকে কলকাতার রাতের রুপটা মনে হচ্ছিল এই বিয়ে বাড়ির দেওয়াল!! লাইটিং করা ছিল হয়েক রঙের আলোতে।
পরের দিনটা নিজেদের মত কাটিয়ে ৩ তারিখ সকালে রওনা হয়ে বেনাপোল দিয়ে ফিরে আসি নিজের বাংলাদেশ।
এমন একটা ভ্রমণ ভালোভাবে শেষ করতে যা ছিল আমার সাথে তা হইল খোদার রহমত, একদল সাদা মনের এবং ভালো মানসিকতার ভাই এবং অগাধ বিশ্বাস। আব্দুল মাজিদ রকি, আব্দুস সাত্তার সোহাগ, সাদেকুর রহমান বাবলু, রনি মৃধা, আবু সুফিয়ান রানা, মানজারুল কাইয়ুম শাওন, নাজমুল ইসলাম চৌধুরী রানা, শুভ্র সমদ্দার --এই সাহসী মানসিকতার মানুষগুলো ছাড়া এই প্রতিকূল পরিবেশে এই ট্যুর ভালোভাবে শেষ করে আসা ছিল এক কথায় অসম্ভব। ধন্যবাদ সজল জাহিদ ভাই আপনার সুন্দর পরিকল্পনার জন্য।
Name- GOLAM MUKIT SARWAR
Profession- Civil Engineering
City- Dhaka, Bangladesh
Hobbies- Travelling, Mobile Photography
Previous Tours- Mt. Bhrigu Trek, Himachal Pradesh