Tripsee Treks  and Tours LLP
Blog and Travel with Us

পাহাড়ি রেলযাত্রা ও সৌন্দর্যে মোড়া হাফলং



Subhrangsu Dasgupta Subhrangsu Dasgupta

লামডিং ছাড়াতেই শুরু হল পাহাড় চড়া, আর রেলপথের দুপাশে দৃশ্যপটের পরিবর্তন। ধীরে ধীরে ফুটছে সকালের আলো। উষার কিরণ প্রতিভাত হচ্ছে সবুজ পাহাড়-জঙ্গলে। ডাবল ইঞ্জিন লাগিয়ে কু ঝিক ঝিক শব্দে এঁকে বেঁকে পাহাড়ে চড়ছে গুয়াহাটি-শিলচর প্যাসেঞ্জার। হোজাই জেলা ছেড়ে ট্রেন প্রবেশ করল আসামের পার্বত্য জেলা ‘ডিমা হাসাও’য়ে। আমাদের গন্তব্য আসামের একমাত্র হিল স্টেশন ‘হাফলং’ (Haflong)। আগের দিন রাতে গুয়াহাটি থেকে ছাড়া ট্রেন লামডিং পৌঁছেছিল ভোর ৫টায়। লামডিং (Lumding) থেকে বদরপুর (Badarpur) – এই ১৭০ কিমি পাহাড়ি রেল পথ – ভারতীয় রেলের অন্যতম সুন্দর ব্রড গেজ রেল যাত্রা। অনেক টানেল, নদী, ব্রীজ পেরিয়ে এই পাহাড়ি রেল যাত্রা, যার সাক্ষী হওয়াটা ছিল এবারের উত্তর-পূর্বে বেড়ানোর একটা গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। আমাদের যাত্রার প্রথম ভাগ অবশ্য অর্ধেক পথ, ‘নিউ হাফলং’ স্টেশন অবধি।

লামডিং থেকে হাফলং – এক রমণীয় পাহাড়ি রেল যাত্রাঃ

লামডিংয়ের পর ট্রেন থামল ‘হাতিখালী’ স্টেশনে। এরপর ‘দিবলং’, ‘লাংটিং’ – সবুজ প্রকৃতির মাঝে ছোট ছোট স্টেশন। লাংটিংয়ে পার হলাম একটা সুন্দর পাহাড়ি নদীর উপর ব্রীজ। এরপর ঠিক পাহাড়ের গায়ে একটা স্টেশন – ‘মুপা’। এঁকেবেঁকে সরীসৃপের মত পাহাড় চড়ছে ট্রেন। প্রতিটি বাঁকেই যেন নতুন নতুন দৃশ্য। পড়ল এ পথের প্রথম টানেল। নিকষ কালো গহ্বরে ঢুকে পড়ল ট্রেন। পাহাড় ভেদ করে টানেল থেকে বেরিয়েই পাহাড়ি ঝোড়ার উপর ব্রীজ। দুপাশে ঘন সবুজ পাহাড়-জঙ্গল। দূরে নীল পাহাড়ের মাথায় সাদা মেঘের জটা। রেলপথের পাশে কখনও এক ফালি পাহাড়ি উপত্যকা, কোথাও বা খাদ। কদাচিৎ দু একটা ছোট ছোট গ্রাম পাহাড়ের গায়ে। পাহাড়ের নীচে কোথাও সুপারি গাছের সারি। আর যেটা না বললেই নয়, সবুজ পাহাড়ের গায়ে, রেল পথের ধারে ফুটে থাকা শরতের কাশ ফুলের সারি, পুরো পথটা জুড়েই। দেবীপক্ষের আগমন জানান দিচ্ছে পাহাড়েও। হঠাৎ দেখলে মনে হয় যেন পাহাড়ে বরফ পড়েছে।

একের পর এক টানেল ও ব্রীজ পেরিয়ে এই রেল যাত্রা। বছর চারেক হল মিটার গেজ থেকে ব্রড গেজ হয়েছে রেলপথ। শিলচরগামী এই ট্রেনের যাত্রীদের অধিকাংশই বাঙালি। তবে আমরা ছাড়া বোধহয় আর কোন পর্যটক নেই ট্রেনে। এত সুন্দর রেল যাত্রা নিয়ে স্থানীয় যাত্রীদের তেমন উৎসাহ নেই মনে হল। তাদের বোধহয় গা সওয়া হয়ে গেছে। অসাধারণ প্রাকৃতিক শোভা দেখতে দেখতে পেরিয়ে গেলাম ডিমা হাসাও জেলার একের পর এক স্টেশন – ‘মাইবাং’, ‘দাওতুহাজা’, ‘ফাইডিং’, ‘মাহর’। গাড়িতে যেমন পাহাড় চড়ার সময় দেখা যায় নিচে ফেলে আসা পাকদন্ডী পথ, ঠিক তেমনই ট্রেন যাত্রায় কখনও চোখে পড়ছে নিচ থকে উঠে আসা আঁকা বাঁকা রেললাইন। এরপর ৮ নম্বর টানেল পেরিয়ে ‘মিগ্রেনদিশা’ স্টেশন। সেটা ছাড়িয়ে একটি ল্যুপ ও দায়াং (Dayang) নদীর উপর আইকনিক রেল ব্রীজ। দায়াং নদীর ব্রীজ পেরিয়েই সকাল ৯টা নাগাদ ট্রেন পৌঁছল ‘নিউ হাফলং’ (New Haflong) স্টেশনে।

পাহাড়ের কোলে ছবির মত কি সুন্দর একটা রেল স্টেশন! পঞ্চমীর দিন প্রভাতের এক স্মরণীয় ট্রেন যাত্রার পর আরেক ভাল লাগার জগতে যেন পোঁছে গেছি। স্টেশনের ঠিক পাশ দিয়ে উঠে গেছে গাড়ির খাড়াই রাস্তা হাফলং (Haflong) শহরে যাবার। নিউ হাফলং স্টেশন থেকে শৈল শহর হাফলংয়ের দূরত্ব ৭.৫ কিমি। অটো ধরে চললাম সে পথে। সবুজে সবুজ পাহাড়ে চড়াই বেয়ে পাকদন্ডী পথে উঠতে থাকল অটো। আধ ঘন্টায় পৌঁছে গেলাম হাফলং শহরে।

স্নিগ্ধতায় ভরা হাফলং

সবুজে ছাওয়া সুন্দর, শান্ত, ছিম ছাম একটা শৈল শহর। ছোট একটা লেকের পাশ দিয়ে চড়াই উঠে পোঁছলাম আমাদের থাকার জায়গা ‘নশরিং গেস্ট হাউসে’। নিরিবিলি পরিবেশে বাগান ঘেরা দোতলা বাড়ি। ডাকাডাকির পর বেরিয়ে এসে বাঙালি ম্যানেজার রাহুল আমাদের স্বাগত জানাল। এর সাথে কথা বলেই ফোনে বুকিং করেছিলাম। একতলায় পাশাপাশি তিনটি ঘর আমাদের জন্য বরাদ্দ। ঘরে ঢুকেই তোফা ব্যবস্থা দেখে মনটা আরো খুশি হয়ে গেল। বিশাল ঝকঝকে রুম ও বাথরুম, পরিস্কার পরিচ্ছন্ন। এসি, গিজার সহ সব রকম অ্যামেনিটি যুক্ত। সামনে টানা বারান্দায় চেয়ার পেতে বসে প্রকৃতি উপভোগ করার সুযোগ। গেস্ট হাউসের মালিক মিঃ হাগজেই পরিস্কার বাংলা বলেন। কম্পাউন্ডের পিছন দিকে দেখা যায় পাহাড়ের সুন্দর দৃশ্য। একটু বাদেই ঘরে চলে এল হালকা ব্রেকফাস্ট।

​কোন নতুন জায়গায় এসে ঘরে বসে থাকতে মন চায় না। বেরিয়ে পড়লাম পায়ে পায়ে শহরটাকে একটু দেখব বলে। সামান্য চড়াই উৎরাই, নিরিবিলি পাহাড়ি রাস্তা। লেকের পাশ দিয়ে চললাম এখানকার মেইন মার্কেটে। ৩৩০০ ফুট উচ্চতায় আসামের একমাত্র হিল স্টেশন হাফলং। ‘ডিমা হাসাও’ (Dima Hasao) তথা পূর্বতন নর্থ কাছার জেলার সদর হাফলং। শহর হলেও ফাঁকাফাঁকা, কোন ভিড় নেই, কোলাহল নেই। এক অদ্ভুত শান্ত, দূষণ মুক্ত পরিবেশ হাফলংয়ের। স্নিগ্ধতায় ভরা এই শৈল শহর। এখনও তেমন পর্যটকের ভিড় নেই উত্তর-পূর্বের এমন সুন্দর হিল স্টেশনে, অজ্ঞাত কারণে। উপজাতি অধ্যুসিত হাফলংয়ের জনসংখ্যার একটা বড় অংশ বাঙালি। একসময় এ অঞ্চলের পরিস্থিতি ছিল খুব অশান্ত। তবে এখন সব স্বাভাবিক। প্রধান চকে ‘Say no to Terrorism’ বলে একটা সরকারি হোর্ডিং চোখে পড়ল। তবে এমন শান্ত পরিবেশে যে একসময় অশান্তির কালো মেঘ ছিল, তা আজ বিশ্বাসই হয় না যেন।

হাফলং ভ্রমণ ও রহস্যে মোড়া জাতিঙ্গাঃ

দুপুরে আর্লি লাঞ্চ সেরে গেস্ট হাউসের নিজস্ব গাড়িতে বেরিয়ে পড়লাম হাফলংয় ও আশেপাশের দ্রষ্টব্যগুলো দেখার সাইটসিয়িং ট্যুরে।

হাফলং ভিউ পয়েন্টঃ

প্রথম গন্তব্য ছিল ভিউ পয়েন্ট। শহরের সর্বোচ্চ স্থান। শুরুতেই সমগ্র হাফলংকে উপর থেকে দেখে নেওয়া। ওয়াচ টাওয়ার থেকে শহর ও চারপাশের পাহাড় ও উপত্যকার অসাধারণ এক ভিউ। সবুজের নানান শেড পাহাড়ে। উপর থেকে চোখে পড়ে পাহাড়ের কোলে সুন্দর সুন্দর বাড়ি, শহরের দুটি লেক, রাস্তা ঘাট, স্কুল, চার্চ। অনেকগুলি চার্চ আছে হাফলংয়ে, পাশাপাশি আছে মন্দিরও, এমনকি একটি মসজিদও। হাফলংয়ের বার্ডস আই ভিউ মন ও ক্যামেরায় বন্দী করে নেমে চললাম পরের গন্তব্যের দিকে।

দূর্গা স্থানঃ

শহরের এক কিনারে নির্জন পরিবেশে গাড়ির রাস্তা থেকে কিছুটা নেমে দূর্গা মন্দির। মূলত নেপালীদের মন্দির এটি। এখান থেকে পাহাড় ও নিচের উপত্যকার দারুণ দৃশ্য দেখা যায়। পরদিন ষষ্ঠী। তাই চলছে দূর্গা পুজোর প্রস্তুতি।

লেক ও হ্যাঙ্গিং ব্রীজঃ

শহরের মাঝে পাহাড় ঘেরা হাফলং লেক। বেশ শান্ত পরিবেশ। লেকের উপর আছে একটি ঝুলন্ত দড়ির ব্রীজ, পারাপারের জন্য। লেকের একপাশে পাহাড়ের ঢালে রক গার্ডেন। সামান্য দূরে এখানকার বোটানিকাল গার্ডেন।

সার্কিট হাউসঃ

বোটানিকাল গার্ডেন পেরিয়ে ৫০০মি চড়াই রাস্তায় উঠে পৌঁছলাম সার্কিট হাউসে (Circuit House)। দিনের একটি নির্দিষ্ট সময় এলে গেটে অনুমতি নিয়ে তবে ভিতরে ঢুকতে দেয়। সরকারি সার্কিট হাউসের কম্পাউন্ডটি হাফলংয়ের অন্যতম দ্রষ্টব্য, কারণ এখান থেকেই দেখা যায় হাফলংয়ের অন্যতম সেরা ভিউ। এখান থেকেই অনেক নিচে চোখে পড়ে সবুজ পাহাড়ের প্রেক্ষাপটে আইকনিক রেল ব্রীজটি, যেটা পেরিয়ে ট্রেন পৌঁছয় নিউ হাফলং স্টেশনে। ব্রীজের নিচ দিয়ে বয়ে চলা দায়াং নদী। অসাধারণ সুন্দর একটা দৃশ্য। সার্কিট হাউসের দুটো বড় বিল্ডিং ও তার সামনে পার্ক। দূর্দান্ত লোকেশনে অবস্থিত হাফলংয়ের সার্কিট হাউসে একবার এসে থাকার প্রবল ইচ্ছে রইল ভবিষ্যতের জন্য।

আব্রাহাম ভিউ পয়েন্টঃ

এবার হাফলং শহর ছেড়ে জাতিঙ্গার পথে পারি দিল গাড়ি। স্টেশনের কাছাকাছি পথের পাশে পড়ল আরেকটা ভিউ পয়েন্ট। সেখান থেকে নীলাকাশের নিচ সবুজ পাহাড় ও নিচে একফালি উপত্যকার দারুণ দৃশ্য দেখে মোহিত হয়ে যেতে হয়। অনেক নিচে দেখা যাচ্ছে একটা নদী। খাদে দেখা যাচ্ছে ট্রেন লাইন। শোনা যাচ্ছে ট্রেনের হুইসল। এখান থেকেও নিচে একপাশে চোখে পড়ে ঐ দায়াং নদীর উপর রেল ব্রীজটি।

রহস্যে মোড়া জাতিঙ্গা ও বার্ড ওয়াচিং সেন্টারঃ

এবার জাতিঙ্গায়, হাফলং থেকে দূরত্ব ৮ কিমি। মনমুগ্ধকর জাতিঙ্গা (Jatinga) ভ্যালি, রহস্যে মোড়া। অনেক কাল আগেই পড়েছিলাম জাতিঙ্গায় পাখিদের আত্মহত্যার এক আজানা রহস্য কাহিনি। বর্ষাশেষের মাসগুলোতে, চাঁদ হীন, কুয়াশায় ঢাকা সন্ধ্যায় কখনও কখনও দেখা যায় শয়ে শয়ে পাখি উপর থেকে নিচে ঝাঁপ দিয়ে যেন আত্মহত্যা করছে। পক্ষী বিশারদেরা অনেক গবেষণা করে মতামত দিয়েছেন যে কুয়াশা ও প্রবল হাওয়ায় বিভ্রান্ত হয়ে পাখিরা উপর থেকে নিচে নামতে থাকে আলোর দিকে আকৃষ্ট হয়ে। একটা মত অনুযায়ী এই নামার সময় স্থানীয় উপজাতি মানুষদের বাঁশে আঘাত প্রাপ্ত হয় পাখিরা। পাখি দেখার জন্য রয়েছে জাতিঙ্গা বার্ড ওয়াচিং সেন্টার (Jatinga Bird Watching Centre)। এই ওয়াচ টাওয়ারের উপর থেকেই নাকি পাখিদের আত্মহত্যা দেখা যায়। তবে এ সময় তেমন কোন পাখিই চোখে পড়ল না ওয়াচ টাওয়ার থেকে। ইদানিং স্থানীয়দের সচেতনতা বেড়েছে, পাখিদের আত্মহত্যার মর্মান্তিক ঘটনা আজকাল আর খুব একটা ঘটেও না। তবে ওয়াচ টাওয়ারের উপর থেকে আশেপাশের পাহাড় ও তার মাঝে জঙ্গলে ঢাকা উপত্যকার অপূর্ব দৃশ্য দেখে মন তৃপ্ত হল। বার্ড ওয়াচিং সেন্টারে আছে একটি গ্যালারি, যেখানে অতীতে আত্মহত্যার দিন গুলিতে তোলা নানান পাখির ছবি সংগৃহিত আছে।

এথনিক ভিলেজ পার্কঃ

জাতিঙ্গার নব আকর্ষণ ‘এথনিক ভিলেজ পার্ক’ (Ethnic Village Park)। ওয়াচ টাওয়ার থেকে ৪কিমি। চারিদিকে পাহাড়ের মাঝে উপত্যকায় নির্মিত এই এথনিক ভিলেজে আছে ডিমা হাসাও জেলায় বসবাসকারি উপজাতিদের গ্রামের মডেল। স্থানীয় ডিমাসা (Dimasa) ভাষায় ‘ডিমা হাসাও’ শব্দের অর্থ ‘ডিমাসা পাহাড়’। আসামের এই পার্বত্য জেলার ৭১% মানুষই উপজাতি গোষ্ঠীর।  Dimasa KachariKarbiZeme NagaHmarKukiBiate, Khasi-Pnars বিভিন্ন উপজাতিদের স্বতন্ত্র ঐতিহ্য, ঘর বানানোর পদ্ধতি ও জীবন যাত্রা তুলে ধরা হয়েছে পর্যটকদের জন্য এই ভিলেজ পার্কে। রয়েছে ফুলের বাগান ও একটি চিল্ড্রেনস পার্কও। এখানে আদিবাসীদের জীবন যাত্রার মডেল দেখতে দেখতে খানিক সময় কাটাতে বেশ লাগে।

হাফলং ও জাতিঙ্গার আশেপাশে রয়েছে বেশ কয়েকটা জলপ্রপাত। গাড়ির রাস্তা থেকে খানিকটা ট্রেক করে যেতে হয়। সঙ্গে বয়স্ক লোক থাকায় এযাত্রায় জলপ্রপাত দর্শন হয় নি। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এমনকি বিদেশ থেকেও অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর ট্রেকাররা আসে পাহাড় চড়তে ও জলপ্রপাত দর্শনে।

দিনের শেষে আরেক ভিউ পয়েন্টঃ জাতিঙ্গা দর্শন সেরে শেষ বিকেলে হাফলংয়ে ফিরে এলাম। ডন বস্কো স্কুলকে পাশে রেখে মেইন রোডের ধারে আরেকটি ভিউ পয়েন্ট ছিল এদিনের শেষ গন্তব্য। স্থানীয়রা বলে গ্যালারি। পড়ন্ত আলোয় নিচে দেখা যায় শহরের আরেকাংশ। খাদের ধারের বেঞ্চিতে বসে চা পান করতে করতে নিচের শহরের বাড়ি-ঘর, চার্চ ও দূরের পাহাড়, পড়ন্ত আলোয় দেখতে বেশ লাগছিল। ভীষণ সুন্দর এই হাফলং।

সাইট সিয়িং ট্যুর শেষে সন্ধ্যায় ফিরে এলাম গেস্ট হাউসে। তারপর চা-পকোড়া সহযোগে সান্ধ্য জলযোগ। অক্টোবরে হাফলংয়ের পাহাড়ে সন্ধ্যার পর ঠান্ডার আমেজ। রাতে ডিনার সেরে হোটেলের নরম বিছানায় এক ঘুমে রাত কাবার।

পরদিন সকাল থেকেই আবার হাফলংয়ের শান্ত, নিরিবিলি পরিবেশে ঘুরে বেড়ানো। পায়ে পায়ে পৌঁছে গেলাম হাফলংয়ের প্রধান লেকটিতে আরেকবার। লেকের পার ধরে হেঁটে আবার হ্যাঙ্গিং ব্রীজে। দুলতে দুলতে ব্রীজ পেরিয়ে ওপারে গিয়ে লেকের পারে বেঞ্চিতে নিভৃতে বসে সময় কাটানো। কোথাও এতটুকু কোলাহল নেই এখানে। লেকের ধারের গাছগুলিতে শুধুই পাখির ডাক, কখনও বা ঝিঁ ঝিঁ র একটানা ডাকের ঘন্টাধ্বনি। পিছনে পাহাড়ের ধাপে রক গার্ডেন।

হাফলংয়ের সৌন্দর্য্য ও স্নিগ্ধতা উপভোগ করে, মিঃ হাগজেই ও তার স্টাফেদের আতিথেয়তায় নশরিং গেস্ট হাউসে দুটো দিন কাটিয়ে, এবার হাফলংকে বিদায় জানানোর পালা। এবার গন্তব্য আসাম ছেড়ে ত্রিপুরায়। অটোয় চড়ে আবার নেমে চলা নিউ হাফলং স্টেশনে। নামার সময় উপর থেকে স্টেশনের একটা বার্ডস আই ভিউ ক্যামেরা বন্দী করে যখন স্টেশনে পৌঁছচ্ছি, তখন প্লাটফর্মে ঢুকছে শিয়ালদা তথা গুয়াহাটি থেকে আসা কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেস। নির্দিষ্ট সময়ের আধ ঘন্টা আগেই। এই ট্রেনেই পরের গন্তব্য আগরতলা। রেলের ওভার ব্রীজের উপর থেকে অতি সুন্দর এই স্টেশনের বেশ কয়েকটা ছবি লেন্স বন্দী করে ফেললাম ট্রেনে ওঠার আগে। সবুজ পাহাড়ের প্রেক্ষাপটে প্লাটফর্মের উপর রঙিন ছাতার সারি। দুপুর বেলা ছাতার নিচে নানান খাবারের পসরা সাজিয়ে বসে উপজাতি মানুষজন।

নিউ হাফলং থেকে বদরপুর - নয়নাভিরাম রেল যাত্রা আরেকবারঃ

দুপুর ১২টায় ছাড়ল ট্রেন। নিউ হাফলং স্টেশন ছাড়িয়েই লাগোয়া বিশাল টানেলে প্রবেশ করল কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেস। ৩.২ কিমি দীর্ঘ টানেলটি হাফলংয়ের নিচ দিয়ে চলে গেছে। এই রেলপথের দীর্ঘতম টানেল এটি। টানেলের উপরে হাফলং-জাতিঙ্গা রোড। প্রায় মিনিট দশেক পর যখন টানেল থেকে ট্রেন বেরোল, তখন এক ছবির মত উপত্যকায় পৌঁছে গেছি। জাতিঙ্গা ভ্যালি। একটি নদী এঁকেবেঁকে চলেছে – জাতিঙ্গা নদী (Jatinga River)। পার হলাম জাতিঙ্গা স্টেশন, এ ট্রেন অবশ্য কোনো স্টেশনেই দাঁড়ায় না। জাতিঙ্গা নদী আমাদের সঙ্গী হয়ে পাহাড়ের বাঁকে বাঁকে চলল অনেকক্ষণ। আর রেললাইন তার সাথে পাল্লা দিয়ে চলেছে। কখনও নদীকে নিচে রেখে পার বরাবর, কখনও বা নদীর উপর ব্রীজ পার হয়ে। দার্জিলিং-সিকিমের পাহাড়ে বেড়াতে গেলে যেমন গাড়ির রাস্তায় সঙ্গী হয় পাহাড়ের বাঁকে বাঁকে চলা তিস্তা নদী, তেমনই যেন রেল যাত্রার সঙ্গী হয়েছে পাহাড়ি নদী জাতিঙ্গা। অসাধারণ প্রাকৃতিক শোভা এই রেল যাত্রায়। একের পর এক টানেল পেরিয়ে পাহাড় ভেদ করে ছুটছে ট্রেন। এই পার্বত্য রেলপথের মোট ২৪টি টানেলের মধ্যে ১৬টি পড়ে হাফলং-বদরপুর এই অংশে। আগেরদিন সকালে লামডিং-হাফলং অংশে রেলযাত্রা যতটা মনমুগ্ধকর ছিল, হাফলং-বদরপুর অংশটা ততোধিক সুন্দর। প্রাকৃতিক শোভার বিচারে অতি পরিচিত ভাইজাগ-আরাকু রেলপথের থেকে কোন অংশে কম নয় এই রেল যাত্রা।

এবার ধীরে ধীরে উৎরাইয়ে পাহাড় থেকে নামতে থাকল ট্রেন। দূরত্ব কমে সঙ্গী নদীটি একেবারে রেল লাইনের পাশে চলে এল। ‘ডিমা হাসাও’ ছাড়িয়ে ট্রেন ঢুকে পড়ল ‘কাছার’ জেলায়। ২৪ নম্বর টানেলটি পার হবার পর পাহাড় থেকে সমতলে. নেমে এল ট্রেন। পাহাড়ের পাদদেশে এবার চা বাগান। বরাক (Barak) নদীর উপর ব্রীজ পেরিয়ে ট্রেন অবশেষে থামল বদরপুর স্টেশনে। স্টেশনের ফলকে ‘জংচন’ নয় ‘জংশন’ দেখে বুঝলাম, আমরা এখন বরাক ভ্যালির (Barak Valley) কাছারে, যে জেলা আসামে অবস্থিত হয়েও অফিসিয়াল ভাষা বাংলা। বদরপুর থেকে একটি লাইন গেছে শিলচরের দিকে ও আরেকটি আগরতলার দিকে। বদরপুর ছাড়িয়ে বরাক ভ্যালি পেরিয়ে ট্রেন এগোতে থাকল ত্রিপুরার দিকে।

প্রয়োজনীয় তথ্যঃ

যাতায়াতঃ হাফলং যেতে গেলে পৌঁছতে হবে নিউ হাফলং স্টেশনে। গুয়াহাটি, শিলচর ও আগরতলা তিন জায়গা থেকেই নিউ হাফলংয়ের ট্রেন আছে। গুয়াহাটি থেকে নিয়মিত ট্রেন দুটি – রাত ১১-৫৫য় ছাড়া শিলচর প্যাসেঞ্জার ও ভোর ৪টেয় ছাড়া কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেস, যাতে দিনের বেল পাহাড়ি রেলপথে যাত্রা করা যায়। শিয়ালদা থেকে সরাসরি কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেসেও পৌঁছানো যায় নিউ হাফলং।

নিউ হাফলং স্টেশন থকে হাফলংয়ের অটো ভাড়া 250 টাকা। হাফলংয়ের সাইট সিয়িং ট্যুরে ৬ সিটার গাড়ির ভাড়া পড়েছিল 2200 টাকা।

পরিশেষেঃ সমগ্র উত্তর-পূর্ব জুড়ে ছড়িয়ে আছে প্রচুর পর্যটন সম্ভবনা। মেঘালয় ও অরুনাচলের চেনা কিছু সার্কিট বাদে, উত্তর-পূর্বের অনেক জায়গাই এখনও পর্যটকদের কাছে তেমন জনপ্রিয় হয়ে ওঠে নি। উত্তর-পূর্বের অনেক কিছুই রয়ে গেছে পর্যটন মহলে অনাস্বাদিত।

Meet the Blogger

Subhrangsu Dasgupta


Name- Subhrangsu Dasgupta
Profession- Engineer – Working in an Engineering MNC
City- Kolkata
Hobbies- Travelling, Travel Blogging, Photography, Reading
Previous Tours-
North India tours:
Parts of J & K – Patnitop, Sanasar, Vaishnodevi
Himachal – Shimla-Kassauli-Chail, Kufri-Narkanda, Manali, Dalhousie-Khajiyar
Garhwal – Hardidwar-Rishikesh (multiple times), Mussourie-Chakrata-Dhanaulti, Uttarkashi, Lansdowne-Pauri-Khirsu
Kumayun – Nainital-Ranikhet-Sitalakhet-Mukteswar-Binsar-Kausani
Rajasthan – Jaipur, Jodhpur-Jaisalmer, Bikaner, Ajmer-Pushkar, Udaipur-Chittaur, Alwar-Sariska Tiger Reserve, Ranthomber National Park, Bharatpur Bird Sanctuary
Delhi (stayed for 6 years)
UP - Agra-Mathura-Vrindavan, Lucknow, Alhabad, Varanasi
Central India Tour:Madhya Pradesh – Amarkantak, Bandhavgarh National Park, Jabalpur, Pachmarhi, Khajuraho
Eastern Himalaya: Darjeeling Himalaya – Darjeeling, Kalimpong, Tinchuley-Lamahatta, Lepchajagat, Latpanchar, Icchegaon, Labha-Rishyap, Jhandi-Kolakham, Mirik-Schooldara, Kurseong-Singell, Kalej Valley
Sikkim – Gangtok, Lachung-Yumthang, Ravangla, Pelling, Yuksom, Uttarey, Rinchenpong
Weekend tours in Eastern India: Bengal - Digha/Mandarmani/ Tajpur/ Sankarpur/ Talsari, Bakkhali, Sagar Island, Shantiniektan, Jhargram, Jhilimili-Sutan-Kankrajhore, Bishnupur-Mukutmanipur, Ajodhya Hill-Muguma, Baranti, Garhpanchakot, Maithon, Murshidabad, Murti-Garumara-Chapramari-Sauntaleykhola-Jhalaong-Bindu, Buxa-Jayanti,       Odisha:Chandipur-Panchalingeswar, Bhitarkanika, Puri, Chilika-Barkul-Rambha, Taptapani-Gopalpur
Jharkhand: Ranchi, Netarhat, Hazaribagh, Tata Nagar, Ghatsila, Galudih, Deoghar, Madhupur
North East Tour: Guwahati-Shillong-Cherrapunji
Others:  Vizag-Araku, Andaman
ForeigTours: Bhutan,Thailand – Bangkok-Pattaya, Dubai-Sharjah, Bangaldesh, Wildlife Tours:Bandhavgarh, Sariska, Ranathomber,Bharatpur,Chilla, Bhitarkanika,Garumara, Chapramari, Buxa



You may also like