জম্মু থেকে শ্রীনগর
একজন অলরাউন্ডার জম্মু থেকে শ্রীনগর বাস ড্রাইভার এর ১৬ ঘন্টার চেষ্টায় মানালি থেকে জম্মু এসে পৌছালাম। অলরাউন্ডার এই কারণে বললাম যে উনি এই বাসের ড্রাইভার,হেল্পার সব! যাত্রী উঠানো, যাত্রীর মালামাল বক্সে দেওয়া, যাত্রী নামার সময় দরজা খুলে দেওয়া সবই তার কাজ। যাই হোক সকাল ছয়টার বাস দশটায় পৌঁছায়। এদিকে জম্মু-কাশ্মীরের অঞ্চলে প্রবেশ করার সাথে সাথেই সকাল থেকে মোবাইলের সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ায় আমাদের ড্রাইভার মোস্তাক ভাইয়ের সাথে যোগাযোগ করার কোন উপায় পাচ্ছিলাম না। একজন ভদ্রলোকের কাছ থেকে মোবাইল চেয়ে নিয়ে মোস্তাক ভাই এর লোকেশন জেনে তাকে খুঁজে বের করি।
এগারোটার দিকে শ্রীনগরের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করি, উদ্দেশ্য প্রায় 60-70 কিলোমিটার বেশি জার্নি করে মুঘল রোড দিয়ে যাব। সুজন ভাইয়ের কাছ থেকে শুনেছিলাম মুঘল রোড নাকি খুব সুন্দর। যদিও আমাদের জম্মু আসার কোন প্ল্যান ছিল না, যেহেতু চলে এসেছি তাই এই সৌন্দর্য মিস করতে চাইনি। যাত্রা শুরু হল জম্মু শহরের মধ্য দিয়ে। সকালে কারোরই নাস্তা হয়নি, মোস্তাক ভাইয়ের পরামর্শমতো নাস্তা করব জম্মু থেকে বের হয়ে কোন এক নির্জন পাহাড়ি এলাকায়। সাথে থাকা দুই প্যাকেট বিস্কিট আর পানি খেয়ে কোনমতে ছয়জন মানুষের পেট ঠান্ডা করার আপ্রাণ চেষ্টা।
আমি একজন পাহাড় প্রেমী মানুষ, সুযোগ পেলে তাই প্রিয়তমাকে দেখার সুযোগ হাতছাড়া করি না, তা সে বড় হোক বা ছোট পাহাড়। কিন্তু দেশে আরেকজন আমার সাথে কথা বলার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। সকাল বেলাতেই তার মন খারাপ যে সামনের সাতদিন কোন কথা হবে না। মোস্তাক ভাইয়ের কাছ থেকে হট্স্পট নিয়ে তার সেই হতাশা দূর করা গেল। ঘন্টা খানেক পরেই শহুরে ইটপাথরের গন্ডি পেরিয়ে ছোট ছোট গ্রামের মধ্য দিয়ে ছুটে চলা শুরু। সারারাত জার্নির ক্লান্তি থাকা সত্বেও প্রকৃতির কোন একটা অংশ যাতে মিস করে না ফেলি সেজন্য চোখ খোলা রাখার প্রাণপণ চেষ্টা করে যাচ্ছি। কাছাকাছি দূরত্বে ছোট ছোট পাহাড়ের সারি মোঘল রোডের আসল সৌন্দর্যের জানান দিচ্ছিল।
রাস্তা দুইপাশ সবুজ থেকে সবুজতর হচ্ছিল। আর পাহাড় গুলো কেমন জানি কাছাকাছি ছুঁয়ে দেখার দূরত্বে আমাদের সাথেই চলতে লাগলো। প্রায় দুই ঘন্টা পর পাহাড়ি এলাকায় রাস্তার পাশে ছোট একটি হোটেলে ফ্রেশ হয়ে রাজমা চাওয়াল আর কোক দিয়ে নাস্তা করে আবার যাত্রা শুরু করি।
আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথে সারি সারি পাইন, দেবদারু আর নাম না জানা অসংখ্য গাছপালা যেন সবুজের কার্পেট বিছিয়ে রেখেছে প্রকৃতিতে। মাঝেমাঝেই নিচু উপত্যকায় যখন ছুটে চলছিলাম নাম না জানা পাহাড়ি নদী বয়ে চলেছে অজানার উদ্দেশ্যে আলপনা এঁকে। অনেক দূর থেকে পাহাড়ের ফাঁক দিয়ে উঁকি দেয় বরফে ঢাকা কোন পর্বতের মাথা।
আবার খাবারের জন্য বিরতি দেওয়া হয় বিকেল চারটার দিকে। হোটেলের বেসিনে হাত ধোয়ার সময় এক 7-8 বছরের কিউট দেখতে মেয়ে, সোজা এসে আমাকে জিজ্ঞেস করে " আপকা সাদি হো গেয়া?"। আমি বললাম "আগার নেহি হুয়া তো আপ করেঙ্গে মুঝে সাদি?" এই কথা শুনে সে একদম লজ্জায় লাল হয়ে যায়। আমি তখনও বুঝতে পারিনি কেন এ কথা বলল। খাওয়ার জন্য ভাত আর কাশ্মীরের বিখ্যাত রিস্তা সাথে খাসির মাংসের ভুনা। আসলেই রিস্তা কাশ্মীরের অন্যতম স্বাদের একটা খাবার যার স্বাদ আজও আমার মুখে লেগে আছে। খাবার সময় খেয়াল করলাম আমার হাতে মেহেদি দেওয়া, আসার আগে বউ অনেক যত্ন করে হাতে মেহেদি লাগিয়ে দিয়েছিল ঈদ উপলক্ষে। আর সেই কারণেই ওই মেয়েটি আমাকে বিয়ের কথা জিজ্ঞাসা করেছে। খাবার শেষে আবারো ওই মেয়েকে জিজ্ঞেস করলাম "সাদি করেঙ্গে মুজছে "? এবারও আগের মতোই লাজুক হাসি ।
আবারো ছুটে চলেছি শ্রীনগরের উদ্দেশ্য। এবার শুধু পাহাড়ে উঠছে তো উঠছেই। হঠাৎ মুস্তাক ভাই বলল চাকাতে লিকেজ আছে ঠিক করতে হবে, আর সামনে ঠিক করার দোকান পাওয়া যাবে না। এমন নির্জন আর প্রকৃতির সুন্দরতম কোন জায়গায় গ্যারেজ থাকতে পারে বলে আমার বিশ্বাসই হচ্ছিল না। চাকা ঠিক করতে করতে আমরা কয়েকজন সামনে হাঁটতে থাকি। 100 গজ সামনে হাটতেই মাঝারি সাইজের একটা ঝর্ণা ঠিক রাস্তার পাশে। হিমশীতল ঠান্ডা পানিতে সাথে সাথে ওযু করে আসরের নামাজ পরে নিয়েছিলাম। চারিদিকের নির্জনতা ভেঙে দিচ্ছিল ঝর্নার আওয়াজ। এই মুহূর্তটা বলে বোঝানো যাবে না।শুনেছিলাম কোন একজন কবি কাশ্মীর সম্পর্কে বলেছেন ‘পৃথিবীতে স্বর্গ যদি কথাও থেকে থাকে তবে সেটা এখানেই’। আধা ঘন্টা পরে আবার চলতে শুরু করি।
শেষ বিকেলের সূর্যটা পশ্চিম দিকে হেলে পড়েছে। আর পাহাড়ের চূড়া বরফ গুলো আরো বেশি আলোকিত হয়ে উঠেছিল। পাহাড়ে পাহাড়ে আলোছায়ার যে লুকোচুরি এই জিনিসটা আমাকে সব থেকে বেশি পাহাড়ের প্রতি আকৃষ্ট করে। যত উপরে উঠছি পাহাড়ের সবুজ ততো কমে যাচ্ছিল। সামনে আর্মি চেকপোস্ট আছে বলে মাঝারি সাইজের একটা জ্যামে পড়ে যাই। আমি যখন অন্যান্য ইন্ডিয়ানদের মতো চেকপোস্ট পার হচ্ছিলাম গাড়ি থেকে নেমে তখন পাসপোর্ট দেখে একজন আর্মি বলল আপনাদের চেক আলাদা হবে।
আমাদের উপরে তাদের অফিসে নিয়ে যাওয়া হল। খুব কম সময় লাগবে মনে করে কয়েকজন শীতের জামা নিয়ে যায়নি। কিন্তু আমাদের ধারণা ভুল করে আমাদের প্রায় ৪৫ মিনিট সেখানে আমাদের জেরা করেতে থাকে। আমরা কোথায় যাবো, কোথায় থাকবো, কিভাবে আসছি, কবে যাব, কিভাবে যাব, পাসপোর্ট এর ছবি ভিসার ছবি ইত্যাদি ইত্যাদি।
চেকপোস্টের আনুষ্ঠানিকতা শেষে যখন আরো উপরে যাচ্ছি তখন অন্ধকার ঘনিয়ে এলো। এই রুটের সবথেকে উঁচু জায়গা "পির কা গলি" (১১,৪৩৩ ফুট) পৌঁছাতে পৌঁছাতে ঘন অন্ধকারে ছেয়ে গেছে চারপাশটা। সন্ধা তখন ০৮:২৫ বাজে, যদি চেকপোস্ট এতটা সময় না লাগতো তাহলে হয়তোবা সন্ধ্যার আগেই পৌঁছে যেতাম। চাঁদনী রাত হওয়াতে কাছের পাহাড়ের বরফ গুলো জ্বলজ্বল করছিল। দিনের বেলা হলে না আমি জানি কত সুন্দর লাগতো। দূর থেকে যে বরফ গুলো দেখা গিয়েছিল ভাবতে পারিনি সে জায়গা দিয়েই আমরা যাব।
অন্ধকার হয়ে যাওয়াতে আর টানা জার্নি করার কারণে শরীর খুবই ক্লান্ত হয়ে গেছিল তাই কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি টের পাইনি। গাড়ি যখন পুলওয়ামা দিয়ে যাচ্ছিল তখন জায়গাটার নাম শুনেই ঘাবড়ে গিয়েছিলাম। কারন কিছুদিন আগেই এখানে অনেক সেনা মারা যায় বোমা হামলায়। শেষে রাত ১১:১৫ তে আমরা হোটেলে চেক ইন করি। ফ্রেশ হয়ে খাওয়া দাওয়া শেষ করতে করতে প্রায় রাত ১২:৩০। টানা ২৯ ঘন্টার জার্নি করা একটা সফরের সমাপ্তি। কাল আবার শুরু হবে লাদাখের যাত্রা।
Name- Md Al-Amin Sarker
Profession- Business
City- Ashulia, Dhaka, Bangladesh
Hobbies- Travelling
Previous Tours- Shimla, Manali, Delhi, Agra, Leh, Kashmir, Jaipur, Ajmer, Jodhpur, Goa, Lonavala, Arakku Valley, Vishakhapatnam, Kolkata, Darjeeling