Tripsee Treks  and Tours LLP
Blog and Travel with Us

শান্তিনিকেতনের আনাচে-কানাচে ---এক সপ্তাহান্তে…



Sumedha Chattopadhyay Sumedha Chattopadhyay

“আকাশ জুড়ে শুনিনু ওই/ বাজে তোমারই নাম

সকল তারার মাঝে।“

​             মন ও আত্মার শান্তির এক অপরূপ আনন্দ-আশ্রম কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শান্তিনিকেতন।এখানে সত্যিই যেন আকাশে-বাতাসে কবিগুরুর নামই ধ্বনিত হয়।

              হেমন্তের বেলাশেষে একটি লঙ উইক-এন্ডে আমরা এলাম বোলপুরের “প্রকৃতি বনবাংলোতে”। আমাদের ‘প্রকৃতি’তে আসা একাধারে সবুজের রসাস্বাদন ও প্রাণের আরামের মনোবাসনা নিয়ে।

             ভোরবেলার হাওড়া-গণদেবতা এক্সপ্রেস ধরে আমরা পৌছোলাম প্রান্তিক ও তারপর বনবাংলোতে- প্রান্তিকের উপকণ্ঠে “প্রকৃতি বনবাংলো”-তে যেন সবুজের সমারোহ--- বাংলোর পিছনে “ছায়া গায়ে মেখে এঁকে বেঁকে” সোনাঝুরির রাস্তা। দোতলার ছায়াঘেরা ছোট্ট ঘর “কাঞ্চন”-এ আমাদের ঠাঁই হল।প্রথমদিন আমাদের গন্তব্য বিশ্বভারতী।মধ্যাহ্নভোজের পর আমরা উপস্থিত হলাম বিশ্বভারতীর প্রবেশদ্বারের সামনে ‘রবীন্দ্রভবনে’। এখানে গুরুদেবের ব্যবহৃত বিভিন্ন দ্রব্যাদি ও উপহার সামগ্রীর অনন্য সম্ভার অত্যন্ত যত্নে সাজানো-প্রতিটি সামগ্রীর সামনে ইংরাজি ও বাংলা ভাষায় তার বর্ণনা। এখানেই নোবেল পুরস্কারের প্রতিলিপিটি শোভিত, রাখা আছে ‘গীতাঞ্জলি’র প্রথম প্রকাশিত সংস্করণ।পৃথিবীর বহু ভাষায় আজ ‘গীতাঞ্জলি’ অনুবাদ হয়েছে।প্রতিটির পাণ্ডুলিপি এই রবীন্দ্রভবনে সংরক্ষিত- আরও রাখা রবি ঠাকুরের নিজের হাতে আঁকা অসংখ্য ছবি এবং হাতে-লেখা কবিতা। কলকাতার রবীন্দ্রসদন মেট্রোষ্টেশনে আমরা তাঁর হাতের লেখার ছবি দেখেছি বটে- কিন্তু এ যেন অমূল্য রত্নসম্ভার নিজের চোখে দেখলাম- মন ভরে গেল।

            রবীন্দ্রভবনের বাইরে এসে জানলাম,দুপুর একটা পর্যন্ত মুক্ত আকাশের নীচে পাঠভবনের ক্লাস হয় ,তাই বিশ্বভারতী প্রাঙ্গণে পর্যটকদের প্রবেশানুমতি দুপুর একটার পর। একজন সাদা পায়জামা-পাঞ্জাবি পরা ভদ্রলোক স্বেচ্ছায় নামমাত্র পারিশ্রমিকে আমাদের পথপ্রদর্শক হতে রাজি  হলেন-অপূর্ব বাচনভঙ্গিতে প্রায় দুঘণ্টার ভ্রমণে আমাদের কাছে ব্যাক্ত করলেন ছাতিমতলা, শান্তিনিকেতন গৃহ, কবিগুরুর বিভিন্ন বাড়ি (উদয়ন,পুনশ্চ,শ্যামলী, কোনার্ক, উদীচী ইত্যাদি), কলাভবনের বিবরণী। বিশ্বভারতী প্রাঙ্গণের এক একটি স্থাপত্য- সাঁওতাল পরিবার, ঝড়ে আক্রান্ত দুই মহিলা, তির-ধনুক, রঙিন পাথরের একটি লোক-সবই মনকাড়া।এক আশ্চর্য উদ্ভিদ সদস্যের সাথে পরিচয় হল, যার প্রচলিত নাম ‘বিনুনি গাছ’ ( বিজ্ঞানসম্মত নাম Flemingia strobilifer)। এছাড়া বহু নাম-না-জানা সুদর্শন ফুল তো আছেই...।

 সবশেষে নতুন কলাভবন পঠনকক্ষের গায়ে রবিঠাকুরের কিছু ‘অরূপ বাণী’ আঁকা। আমাদের গাইড ভদ্রলোক আমাকে উচ্চারণ করে লেখাটি পড়তে বললেন। পড়লাম খুব মন দিয়ে- এক অদ্ভুত দৃঢ়তা ছিল সমগ্র লেখনীর মধ্যে-রোমাঞ্চিত হলাম। তারই লাইন…’’ আমাদের সকলের মধ্যেই একটা পাগল আছে, সে আমাদের সব দেখা ও ভাবার মধ্যে নিজের খেয়ালি রং মিশিয়ে দেয়, আমাদের ছবির মধ্যে নিজের তুলি বুলোয়, আমাদের গানের মধ্যে নিজের সুর লাগিয়ে বসে...আমার মন আকাশে কান পেতে ছিল, বাতাস থেকে সুর আসত, কথা শুনতে পেত, আজকাল সে আছে চোখ মেলে, রূপের রাজ্যে, রেখার ভিড়ের মধ্যে—গাছপালার দিকে তাকিয়ে দেখি আকারের মহাযাত্রা, আমার কলমেও আসতে চায় সেই আকারের লীলা...”। এক অতিকায় বিচিত্রদর্শন ইউক্যালিপ্টাস গাছের নীচে বসে এই বাণী আত্মস্থ করেই আমরা বিশ্বভারতী থেকে বেরোলাম। আমাদের পথপ্রদর্শক ভদ্রলোকটি মনে চিরস্থায়ী হয়ে রইলেন। ফেরার পথে দেখালেন শ্রী অমর্ত্য সেনের ছায়াঘন বাড়ি “প্রতীচী” এবং বল্লভপুর অভয়ারণ্যের অসংখ্য হরিণ।

বনবাংলোতে ফিরতে প্রায় দুপুর গড়িয়ে গেল। ডান হাতের কাজ সেরে বিকেলের নরম রোদে সোনাঝুরির মধ্যে দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে শুনতে পেলাম দূর থেকে ভেসে আসা মাদলের আওয়াজ। বাংলোর চৌকিদার জানালো যে খোয়াই-এ “সোনাঝুরির হাট” বসেছে- ওখানে আদিবাসীদের সমবেত নাচ-গানের সঙ্গত ঐ মাদল। পড়ন্ত বিকেলে সেই মাদলের ধ্বনি অনুসরণ করে হেঁটে চললাম-মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে। খোয়াই-এর হাট এ বিকিকিনির সুবর্ণ সুযোগ- নকশি-কাঁথার শাড়ি, খেসের সামগ্রী, আদিবাসী গহনা, ছেলেদের পাঞ্জাবী, ঘর সাজানোর আনন্য দ্রব্যাদি- সবই খোলা আকাশের নীচে সাজানো। প্রিয়জনেদের জন্য কিছু স্মারক শান্তিনিকেতনের স্মৃতি হিসেবে সংগ্রহ করলাম। অসংখ্য মানুষের হস্তশিল্পের এই পসরা –পাশে আদিবাসী গান-এক ঘোরলাগা অনুভূতি নিয়ে ফিরলাম ‘কাঞ্চন’-এ।রাতে চাঁদের আলোয় “প্রকৃতি বনবাংলো” ভেসে যাচ্ছিল। চাঁদের অপার দাক্ষ্যিণ্যে জোৎস্নাস্নাত হলাম আমরা।বারান্দায় বসে চাঁদের এই সংগোপন সঙ্গলাভে মনে হচ্ছিল ‘পূর্ণচাঁদের মায়ায় আজি ভাবনা আমার পথ ভোলে...’।প্রথম দিনের অবসান।

দ্বিতীয় দিনে আমাদের গন্তব্য শান্তিনিকেতনের আনতিদূরে ৫১ সতীপীঠের দুই পুণ্যস্থান- কঙ্কালীতলা ও ফুল্লরাতলা। প্রাতরাশ সেরে আমরা রওনা হলাম লাভপুরের দিকে। গন্তব্য ফুল্লরাতলা, যেতে যেতে বারবারই মনে পড়ে যাচ্ছিল ‘ হাঁসুলী বাঁকের উপকথা’র স্রষ্টা শ্রী তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়ি এখানেই।ফুল্লরাতলার মন্দিরটির গড়ে উঠেছে খুবই মনোরম পরিবেশে-এখানে সতীর অধঃওষ্ঠ পতিত হয়।আশ্চর্য হয়ে দেখলাম এখানে দেবীর কোন বিগ্রহ নেই। সিঁদুরচর্চিত কচ্ছপাকৃতি শিলাখন্ডই দেবীর প্রতিভূ। মন্দির লাগোয়া দেবীদহ। লোকশ্রুতি, রামচন্দ্রের মহাপুজোর জন্য বীর হনুমান ১০৮টি নীলপদ্ম এখান থেকেই সংগ্রহ করেন। দহের ঘাটে দুটি শিবমন্দির। ফেরার পথে আমরা থামলাম কঙ্কালীতলাতে। অপেক্ষাকৃত জনবহুল এই পীঠস্থানে দেবীর কাঁখাল বা কোমরের অস্থি পতিত হয়। পাশে একটি শ্মশান- বেশ একটা গা ছমছমে পরিবেশ। এরপর গাড়ি ছুটল সৃজন শিল্পগ্রামের দিকে। এটি শ্রীনিকেতনে অবস্থিত। এখানে ভারতের বিভিন্ন প্রাদেশিক হস্তশিল্পের স্থায়ী প্রদর্শনী।খুবই যত্নে ও পরিচ্ছন্নতার সঙ্গে সংরক্ষিত প্রতিটি গ্যালারি-কিছু ভাললাগা নিদর্শন ক্যামেরাবন্দী করলাম।

এবার আমরা চললাম “হোটেল বনলক্ষ্মী”। এর খোঁজ পেয়েছিলাম

“বেলাশেষের” পরিচালক শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের এক সাক্ষাৎকারে।

এখানকার বাঙালি খাবার শান্তিনিকেতনের ‘not to be missed’ তালিকাভুক্ত।

             বনলক্ষ্মীতে পাবদা মাছ সহযোগে মধ্যাহ্নভোজ সেরে আমরা এলাম ‘সায়রবীথি’ পার্কে। এ যেন এক উন্মুক্ত, সবুজঘন পরিবেশে প্রাণের আশ্বাস—খরগোশ, বিভিন্ন ধরনের পাখি ও নৌকাবিহারের সৌজন্যে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামার পথে। আবছা চাঁদের অবয়ব যেন দেখা যাচ্ছে দূরের আকাশে—কোপাই নদী যাওয়ার ইচ্ছা ছিল। কিন্তু সন্ধ্যা নেমে যাচ্ছে দেখে খানিক দোটানায় ছিলাম। বাধ সাধলো আমাদের টোটোচালক। ভদ্রলোক বললেন – “ আজ মনে হয় পূর্ণিমা—নদীর ধারে যান—ভাল লাগবে।“ অত:পর প্রায় কুড়ি মিনিটের যাত্রাশেষে পৌঁছলাম কোপাই নদীর তীরে। টোটো থেকে নেমেই মনে হল যেন এক লহমায় কোন অপার্থিব জগতে এসে পড়লাম। আমরা দাঁড়িয়ে আছি একটি ছোট সাঁকোর উপর—আমাদের সামনে পূর্ণিমার চাঁদের আলোয় “ আমাদের ছোট নদী চলে বাঁকে বাঁকে” অপরূপে ধরা দিয়েছে। যতদূর চোখ যাচ্ছে চাঁদের আলোর প্রতিচ্ছবি জলে। এক জায়গায় আবার নদীর জলের কুলুকুলু শব্দ কানে এল- দেখলাম পাথরের উপর থেকে নীচে জল পড়ছে- চাঁদের আলোর প্রতিফলন সেখানেও সঙ্গে ধ্বনিমূর্ছনা।

এরমধ্যেই নদীর পাড় থেকে ভেসে এল এক বাউলের গান। সব মিলিয়ে পূর্ণিমায় কোপাই নদীর এক মায়াবী রূপের সাক্ষ্মী রইলাম- চালক ভাইয়ের কথা শুনে ভুল করিনি বুঝলাম। ফিরতে ইচ্ছা করছিল না। কিন্তু চরৈবেতি- টোটো চলল- বনবাংলোর রাস্তায়- পিছনে পড়ে রইল কোপাইয়ের মোহময়তা – এবার যে ফেরার পালা কর্মক্ষেত্রে। পরের দিন ‘শান্তিনিকেতন এক্সপ্রেসে’ চড়ে বসলাম বটে –কিন্তু মনের স্মৃতিদেশ তোলপাড় – ‘কাঞ্চনের’ সুগন্ধ, বনবাংলোর ছাদ থেকে দেখা জ্যোৎস্না স্নাত সোনাঝুরি, শনিবারের হাট ও কোপাই তীরের বাউল গান, হাঁসুলি বাঁক , ছাতিমতলার ছায়া নিবিড়তা—মনে পড়ছিল কবি শ্রীজাত বন্দ্যোপাধ্যায়ের সেই আলখাল্লা পরা লম্বা দাড়িওয়ালা “সান্তা ঠাকুরের” লেখা দুটি লাইন—

            ‘মধুর, তোমার শেষ যে না পাই প্রহর হল শেষ—

              ভুবন জুড়ে রইল লেগে আনন্দ আবেশ।

কিভাবে যাবেনঃ  

                    শান্তিনিকেতন যাওয়ার উপযুক্ত সময়- গরমকাল ছাড়া যেকোন সময়ে। বসন্তোৎসব ও পৌষমেলা বিখ্যাত। হাওড়া থেকে শান্তিনিকেতন যাবার সবথেকে ভাল ট্রেন হল হাওড়া-গণদেবতা এক্সপ্রেস। রোজ হাওড়া থেকে সকাল ৬-০০ টায় ছেড়ে ৮-৪০ নাগাদ বোলপুর পৌছায়। এছাড়া সকালের দিকে, পরের ট্রেনগুলি হল শিয়ালদা-রামপুরহাট এক্সপ্রেস(সকাল৭-২০) হাওড়া- সিউরি এক্সপ্রেস(সকাল ৮-৩৫) ইত্যাদি। শান্তিনিকেতন থেকে ফেরার জন্য সবথেকে ভাল হল বিশ্বভারতী ফাস্ট প্যাসেঞ্জার, যেটি সকাল ৬-৩০ টায় ছেড়ে ১০-১০ টায় হাওড়া পৌঁছে দেয়। এছাড়া বিকালের দিকে রামপুরহাট-শিয়ালদা এক্সপেস (১৫-০৯), রামপুরহাট-হাওড়া এক্সপ্রেস(১৭-৩৭) করেও ফেরা যায়।

থাকবার জায়গাঃ প্রকৃতি বনবাংলো, প্রান্তিক (৯৪৩৪২৪৯৬৮৮), বাউলমন রিসর্ট, প্রান্তিক (৯৪০৪৩০৭১৫০), শান্তিনিকেতন টুরিস্ট লজ (৯৭৩২১০০৯২০)।

Meet the Blogger

Sumedha Chattopadhyay


Name- Sumedha Chattopadhyay
Age- 34yrs
Profession- Scientific Research
City- Kolkata
Hobbies- Trained Classical Dancer, Reading storybooks, writing Travelogues and short stories, Embroidery.
Previous Tours- Vizag, Darjeeling, Takdah, Ramdhura, Shantiniketan, Sundarbans, Dooars, Simla- Manali, Delhi-Agra, Rambha-Barkul-Satpada(Orissa),  West Sikkim, Gangtok, Shankarpur, Puri



You may also like